পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, আরবসাগরের উপকূল মানেই সর্বাগ্রে মনে পড়ে সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি আর মশলাদার রান্নার গন্ধে জিভে জল চলে আসা। যে যুগে ভূগোলের ম্যাপ পয়েন্টিংয়ে কোঙ্কণ উপকূল চিনেছিলাম, সে যুগের অনেক পরে আরবসাগরের বুকে ক্রুজে বসে দুলছিলাম আলো আঁধারিতে। সাম্বা-র সুরে তাল দিতে দিতে হাতে এসেছিল কাজু আর কোকোনাট ফেনির গ্লাস। সঙ্গে ভুনা প্রন বালচাও। কাঁটায় বিদ্ধ করে তুলতুলে রসালো, সুস্বাদু প্রন মুখে পুরে মনে হয়েছিল, আহা কী খেলাম! বুঝেছিলাম গোয়ান ক্যুইজিনের মাহাত্ম্য।
ভিন্দালুর মতো বালচাও আর একরকম রন্ধনশৈলি। এর বিশেষত্ব হল মশলাদার, টক ঝাল আচারী স্বাদ। এবং তার মূলে হল টোম্যাটো চিলি পেস্ট। উত্তর গোয়ায় কেউ আবার তেঁতুলের পেস্টও দেয় এই বালচাওতে। মাছ, চিংড়ি, পর্ক, পনির, চিকেন সব দিয়েই বানানো যেতে পারে। গোয়া মানেই পর্তুগিজ উপনিবেশ। গোয়া মানেই ক্যাথলিক প্রভাব খাদ্যে, পানীয়ে, সঙ্গীতে, বসনেভূষণে সংস্কৃতি জুড়ে। তার সঙ্গে তেঁতুল, নারকেল আর কারিপাতার ব্যাবহার ভারতীয় রসনার তৃপ্তিতে অদ্বিতীয় করে তুলেছে গোয়াকে। এই যুগলবন্দিতে এক ফিউশন ঘটেছে অনবদ্য।

বালচাওয়ের উৎপত্তিস্থল পর্তুগিজ উপনিবেশ মাকাওতে, যেখানে এর নাম ছিল বালিচাও। মূলতঃ গরমের দেশে চিংড়ি সংরক্ষণের জন্যই এর উদ্ভাবন। প্রচুর মশলা, ভিনিগার সহযোগে রান্না করা চিংড়ির আচার হিসেবে আত্মপ্রকাশ হলেও ক্রমে তা ভাতরুটির অন্যতম সঙ্গতরূপে গ্রহণযোগ্যতা পায়। শুকনো চিংড়ির পেস্ট ব্যবহার করে আগে এই রান্না করা হত। কোঙ্কণীতে এটি গালম্বো নামে পরিচিত। গোয়ার বেশিরভাগ ক্যাথলিক বাড়িতে নারকোলের ভিনিগার দিয়ে রাঁধা হত আগে। হিন্দুরা রাঁধত আখের ভিনিগার বা মল্ট ভিনিগার দিয়ে। তবে লেবুর রসেও এর স্বাদ কিছু কমে না। তাই যতবার পশ্চিমঘাট পর্বতমালার উপকূলবর্তী শহরে গিয়েছি ততবার স্বাদ নিতে ভুলিনি উপাদেয় বালচাও-এর।

আমাদের দেশে বালচাও এসেছিল ক্যাথলিক পর্তুগিজদের আমলে। গোয়ায় যে হোটেলে ছিলাম সেখানে শেফ হাতে করে বানিয়ে দেখিয়েছিলেন চাটনির অনুরূপ এই মশলাদার ডিশ। দক্ষিণী খাবারের অন্ধ ভক্ত আমরা। ইডলি, দোসা, বড়া সম্বর ছাড়াও দক্ষিণী ননভেজ, বিশেষত, চিকেন আর প্রনের পদগুলো বেশ লাগে তাদের টক-ঝালের চড়া রসায়নের জন্য। আর কারিপাতার সঙ্গতটাও অভূতপূর্ব। স্টিমড রাইস অথবা গরম রুটির সঙ্গে জমে যায়। কলকাতায় ‘ট্যামারিন্ড’ রেস্তোরাঁয় খেয়েছিলাম এই প্রন বালচাও। বেশ আচারি রেসিপি। খুব ঝাল ঝাল মানে আজকালকার প্রজন্মের ভাষায় ফায়ারি হট আর কারিপাতার সুগন্ধে ভুরভুর। অথচ রান্নাটি খুব সহজ। দু’রকম স্টাইলে বালচাও রাঁধা হয়। ভুনা মানে ভাজাভাজা অর্থাৎ জল পড়বে না মোটে আর কারি স্টাইলে মানে স্পাইসি গ্রেভির মধ্যে।
সাদা তেলে অনেকটা ঝিরিঝিরি করে কাটা পেঁয়াজ আর সমপরিমাণ টোম্যাটো ভাজতে ভাজতেই নুন, সামান্য চিনি আর কারিপাতা দিতে হবে অনেকটা। এবার মিক্সিতে জলে ভেজানো লাল শুকনোলংকা, সামান্য আদা, রসুন, সামান্য গরমমশলা দিয়ে লেবুর রস বা ভিনিগার দিয়ে বেটে নিতে হবে অমসৃণ করে। মানে গ্রাইন্ডার একবার ঘুরিয়েই ক্ষান্ত দিতে হবে। পেঁয়াজ-টোম্যাটো-কারিপাতা বেশ ভাজা ভাজা হয়ে গেলে পরিষ্কার করা চিংড়ি দিয়ে হলুদ, নুন, লংকাগুঁড়ো দিয়ে আবার ভাজা। তেল লাগলে সামান্য দেওয়া যেতেই পারে। এবার আদা রসুন-লংকার পেস্ট দিয়ে আবার নাড়াচাড়া। নামানোর আগে কাঁচালঙ্কা চিরে দিলেই হল। উটি-কোডাইকানালে খেয়েছিলাম এর ওপর ছড়ানো নারকোল কোরা। পনির কিম্বা খোসাহীন চিংড়ি বা হাড় ছাড়ানো মুরগির কিউব সব তখন আচারী মশলায় ন্যায়দম খেয়ে দিব্য মাখোমাখো। বালচাও-এর রসালো আমিষের টুকরো মুখে পুরলেই মাথায়-মুখে পর্তুগিজ সুর।
বালচাও-এর মতো আর একটি জনপ্রিয় কোস্ট্যাল রান্না হল চিকেন সিক্সটিফাইভ। প্রথমবার নাম শুনে মনে হয়েছিল নারায়ণের ছাপ্পান্ন ভোগ হলে মা কালীর চ্যালা চামুণ্ডাদের জন্য মুরগির পঁয়ষট্টি ভোগ কেন হবে না? মা কালীর ভক্তদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত মুরগির এই বিশেষ পদটির নাম দিয়েছি আমি ৬৫ ভোগ। আমাদের সবার প্রিয় ককটেল স্ন্যাক্স এটি। ভারতীয় পাকশালায় মুরগির এহেন ৬৫ রকমের রেসিপির মধ্যে এটি অন্যতম, অন্যধারার এবং নামকরণে তার যথেষ্ট স্বকীয়তা আছে।

উইকি তথ্যরাজি জানাচ্ছে, আমাদের সবার অতিপ্রিয় স্পাইসি ডিপ ফ্রায়েড স্ন্যাকস বা স্টার্টার “চিকেন ৬৫” হল চেন্নাইয়ের বুহারি রেস্তোঁরা চেইনের মালিক এ এম বুহারির আবিষ্কৃত একটি উপাদেয় উপকূলীয় পদ। ভারতীয় সেনাদলের জন্য নাকি এই চটজলদি চিকেনের পদটি তিনি বানানো শুরু করেন ১৯৬৫ সালে। তাই এর নাম চিকেন সিক্সটিফাইভ। একদিকে লাল লঙ্কা অন্যদিকে কারিপাতার সঙ্গতে এই সুস্বাদু টক-ঝাল আচারি আমিষ পদটি সারা ভারতের মন জয় করে নিয়েছে এক লহমায়। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, উটি থেকে উত্তরপ্রদেশ, গৌহাটি থেকে গুজরাট, সর্বত্র দৌড়াচ্ছে এই ষাটোর্দ্ধ প্রবীণ পদটি।
কাঁচা পেঁয়াজের ঝাঁঝ আর লেবুর রসের ট্যাং-এর সম্মিলিত সুগন্ধে আর ধনেপাতা, স্প্রিং অনিয়নের অভিনব গার্নিশিংয়ের কেরামতিতে চুঁইয়ে পড়ে খাদ্যরসিকের রসনার লালারস। এই ৬৫ নিয়ে যদিও অনেক দ্বিমত আছে। কেউ বলেন প্রতি কেজি মুরগিতে ৬৫টা লংকা দেওয়া হয়। কেউ বলেন মুরগির সঙ্গে ৬৫ রকমের উপকরণ লাগে, আবার কেউ বলেন প্রথমে ৬৫ টুকরো মুরগি দিয়ে বানানো হয়েছিল। আবার কারো মতে ৬৫ দিনের মুরগির ছানার রসালো টুকরো দিয়ে বানানো হয়েছিল। তবে এর কোনোটাই ধোপে টেঁকেনি বুহারীর আবিষ্কারের কাছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর গল্প ছাড়াও বুহারীর রেস্তোরাঁয় একদল নবাগত বুভুক্ষুকে এই পদটি বানিয়ে তাক লাগিয়েছিলেন বুহারী স্বয়ং। সেদিন তিনি কী নাম দেবেন ভেবে না পেয়ে হঠাৎ করেই মাথা থেকে বের করেছিলেন চিকেন ৬৫। কারণ আগেই বলেছি এই পদের জন্মসাল ১৯৬৫।
এই পঁয়ষট্টি নম্বরি সিনিয়ার চিকেনের স্বাদগন্ধের মূলে এক নম্বরে হল ছাঁকা তেলে ভাজার কেরামতি আর দুনম্বরে আছে মশলা। তবে নাটের গুরু হল আটপৌরে চালের গুঁড়ি, যার জন্য চিকেনের গায়ে মুচমুচে কোটিং হবে। ছোট করে কাটা বোনলেস চিকেন অনেকটা টক দই, লেবুর রস, নুন, হলুদ আর লংকাগুড়ো, আদা-রসুন বাটা দিয়ে ম্যারিনেট করতে হবে। তার মধ্যে সামান্য সাদা তেল। চিকেন যাতে নরম হয় আরও। স্নেহ পদার্থের আধিক্যে কে না বশ হয় এই দুনিয়ায়! এবার একটা পেস্ট বানাতে হবে ধনে, গোলমরিচ, আদা, রসুন, শুকনো লঙ্কা মিক্সিতে বেটে নিয়ে। ম্যারিনেটেড মাংসের মধ্যে এই পেস্টটি দিতে হবে। ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে চিকেনের সঙ্গে। কমপক্ষে দু ঘণ্টা রাখলে খুব ভালো। মশলা ঢুকে যাবে মাংসের মধ্যে। চালের গুঁড়ো দিতে হবে মিশ্রণে। আবারও মেশাতে হবে ভালো করে।

এবার ফুটন্ত রিফাইন্ডে তেলে অল্প করে চিকেনের টুকরো দিয়ে ভজতে হবে আঁচ কমবেশি করে, যাতে ভেতর অবধি সেদ্ধ হয়। যতক্ষণ না চিকেনের সব দিক সোনালি করে ভাজা হয়ে আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত ভাজতে হবে। এবার এর মধ্যে কারিপাতা দিয়ে ভালো করে টস করতে হবে। এবার নামিয়ে পেঁয়াজের রিং দিয়ে সেজেগুচজে পরিবেশিত হবে উপকূলীয় মুরগির অসামান্য মারকাটারি পদটি।
এই অঞ্চলের আর একটি সুস্বাদু রান্না হল ম্যাঙ্গালোরের ঘি রোস্ট। তার আগে জেনে নিই ঝালবিহীন কর্ণাটকের স্পেশ্যাল বৈদেগি লঙ্কার রহস্য। ঝালবিহীন এই লাল লঙ্কাই নাকি ঐ গ্রামের অর্থনীতি চালায়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কন্যা, সুরাঁধিয়ে সুচিকিৎসক ডঃ ললিতা চট্টোপাধ্যায় জানালেন এসব। ব্যাঙ্গালোরের এক রেস্তোরাঁয় তাঁর এই রান্না শেখা। অন্যরকম চিকেন রেসিপি। এককেজি বড় করে কাটা চিকেনের জন্য পনেরো থেকে কুড়িটা লঙ্কা ভিজিয়ে রেখে চার কোয়া রসুন, নুন, একটু তেল, একটু ভিনিগার দিয়ে মিক্সিতে বাটা হবে।

একটা ডেকচিতে গোটা বড় এবং ছোট এলাচ, লবঙ্গ, গোলমরিচ, একটুকরো দারচিনি, আধখানা পেঁয়াজ, দু’কাপ জল দিয়ে ফুটতে দিতে হবে। চিকেন এর মধ্যে দু’মিনিট করে রেখে তুলে নিতে হবে, রঙ পাল্টানো অবধি। ঐ স্টকটাই ব্লেন্ড করে রাখতে হবে। একটা কড়াইতে মন খুলে ঘি দিয়ে চিকেন, লঙ্কাবাটা দিয়ে গ্যাস কমিয়ে সাঁতলিয়ে পনেরো মিনিট পর স্টকটা ঢেলে ঢাকাচাপা। মুরগি নরম হলে, ঝোল কমিয়ে গা-মাখা করে নিয়ে ঝাল কাঁচালঙ্কা চিরে দিলেই নাকি রেডি হয় এমন অনবদ্য আর একটি কোঙ্কণী আমিষ। ললিতাদেবী নিয়ম করে ব্যাঙ্গালোরের মুদিখানা থেকে বৈদেগি লংকা কিনে এনে রান্না করেন চিকেন ঘি রোস্ট। এবার আসি এই ঘি রোস্টের জন্মসূত্রে। এটি “টুলুভা ম্যাঙ্গালোরীয়ান ক্যুইজিন”। এর মূলে শেট্টির নাম করতেই হয় যিনি ৫০ বছর আগে ম্যাঙ্গালুরু থেকে ৯০ কিমি দূরে উদুপীর কাছে কুন্ডাপুরে কিংবদন্তী রেস্তোরাঁ ‘শেট্টি লাঞ্চ হোম’ খুলে তুমুল জনপ্রিয় হন। সেখানে লাল বৈদেগি মিরচি সারারাত ভিজিয়ে তারপর পেস্ট করা হয় ঘিয়ে। তবেই একটা টকটকে লাল, রেশমি বা সিল্কি টাচ আসে মুরগির ওপর।
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।
One Response
Ideal way of writing food related columns. প’ড়ে জিভে জল এসে গেল ।