banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

কে ছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী?

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Purnendu Pattrea

পূর্ণেন্দু পত্রী কে ছিলেন?

আপনি ভাবছেন আর পাঁচজন বিশিষ্ট বাঙালির মতো ইন্টারনেটের দুই ক্লিকেই বেশ একটা দু’লাইনের চটজলদি উত্তর পেয়ে যাবেন। সেই বুঝে করলেনও ক্লিক। কিন্তু… আজ্ঞে হ্যাঁ। পূর্ণেন্দু পত্রীর পরিচয় বা বলা ভালো তাঁর বিপুল প্রতিভার পরিচয় ইন্টারনেটের অসীম পরিসরেও ধরা যায় না। তাঁকে এখনও খুঁজে পেতে হয় বইয়ের সাদা পাতার কালো অক্ষরে, প্রচ্ছদের তুলির টানে, পুরনো সাদা-কালো চলচ্চিত্রের আলো-আঁধারিতে। রঙিন বর্ণময় প্রাণবন্ত মানুষটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন বাঙালিজীবনের শাশ্বত মননচিন্তা ও শিল্পভাববনার শরিক হয়ে, একান্তে, নীরবতায়।

পূর্ণেন্দু পত্রী কি কবি? হ্যাঁ, অবশ্যই। তাঁর প্রথম পরিচয়েই তিনি কবি। আসলে তাঁর প্রতিটি পরিচয়ই এতখানি স্বতন্ত্র যে প্রত্যেকটি সম্পর্কে লিখতে গেলেই মনে হয়, তাঁর সেই পরিচয়ই মুখ্য। এ এক বিড়ম্বনা। তবে কবি-পরিচিতি সম্ভবত তাঁকে বাঙালি মানসের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ করে তুলেছিল একসময়ে। তাঁর ‘কথোপকথন’ সিরিজের নায়ক-নায়িকা শুভঙ্কর ও নন্দিনী যে একদা বাঙালি প্রেমিকের খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিল, সে কথা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। তাঁর বিখ্যাত কবিতার সংখ্যাও গুণে শেষ করা যাবে না। তার মধ্যে একটি প্রিয় কবিতা তুলে দিলাম। বইয়ের নাম ‘তুমি এলে সূর্যোদয় হয়।’

যে টেলিফোন আসার কথা সে টেলিফোন আসেনি।
প্রতীক্ষাতে প্রতীক্ষাতে
সূর্য ডোবে রক্তপাতে
সব নিভিয়ে একলা আকাশ নিজের শূণ্য বিছানাতে।
একান্তে যার হাসির কথা হাসেনি।
যে টেলিফোন আসার কথা আসেনি।

অপেক্ষমান বুকের ভিতর কাঁসন ঘন্টা শাঁখের উলু
একশ বনেরবাতাস এস একটা গাছে হুলুস্থুলু
আজ বুঝি তার ইচ্ছে আছে
ডাকবে আলিঙ্গনের কাছে
দীঘির পড়ে হারিয়ে যেতে সাঁতার জলের মত্ত নাচে।
এখনো কি ডাকার সাজে সাজেনি?
যে টেলিফোন বাজার কথা বাজেনি।
তৃষ্ণা যেন জলের ফোঁটা বাড়তে বাড়তে বৃষ্টি বাদল
তৃষ্ণা যেন ধূপের কাঠি গন্ধে আঁকে সুখের আদল
খাঁ খাঁ মনের সবটা খালি
মরা নদীর চড়ার বালি
অথচ ঘর দুয়ার জুড়ে তৃষ্ণা বাজায় করতালি।
প্রতীক্ষা তাই প্রহরবিহীন
আজীবন ও সর্বজনীন
সরোবর তো সবার বুকেই, পদ্ম কেবল পর্দানশীন।
স্বপ্নকে দেয় সর্বশরীর, সমক্ষে সে ভাসে না।
যে টেলিফোন আসার কথা সচরাচর আসে না।

Purnendu-Pattrea
পূর্ণেন্দু পত্রীর আঁকা ছবিও এক একটি কবিতা

এই পঙক্তি যিনি লিখতে পারেন, তাঁকে কবি ছাড়া আর কোনওকিছুই বলাই শ্রেয় বোধ হয় না। তাঁর ‘হে সময়, অশ্বারোহী হও’, ‘স্রোতস্বিনী আছে, সেতু নেই’, ‘জেগে আছি বীজে বৃক্ষে ফুলে’ এবং অবশ্যই তাঁর ‘কথোপকথন’ সিরিজের চল্লিশটি কাব্যগ্রন্থ তাঁর বিস্ময়কর কবিপ্রতিভার দলিল। সাহিত্যের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের কালসমুদ্রে কবি পূর্ণেন্দু পত্রী নাবিকের মতো দিকনির্দেশ করে চলেছেন, চলবেন। কবি পূর্ণেন্দু আধুনিক, প্রেমিক এবং আদ্যন্ত শহুরে। তাঁর কাব্যভাষা সহজ, গতিশীল এবং গভীর। মম চৌধুরীর ভাষা ধার করে বলতে পারি, ‘প্রত্যয়ী কবির কাছে পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতাকে মনে হয় আলোয় গড়া জ্যোৎস্না। কেননা, এই কাব্যজ্যোৎস্নায় একটু প্রতিবাদ, একটু প্রেম আর একটু বিদ্রোহ আছে বলেই পূর্ণেন্দু পত্রী হয়ে আছেন নতুন আলোর আলোককবি। তাঁর কবিতায় উঠে আসে সাহসের তলোয়ারের পাশাপাশি ভালোবাসার লাল গোলাপও।’

অথচ এই পূর্ণেন্দু পত্রীই যখন ছড়া লিখেছেন ছোটদের জন্য, সে ভাষা কৌতুকময়, প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বল এবং চূড়ান্ত উইট-সমৃদ্ধ। তাঁর লেখা ‘রাম-রাবণের ছড়া’ পড়ে খুদেরা যত না হেসেছে, তাদের বাবা-মায়ের নিশ্চিত হেসেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। ‘আতাগাছে তোতা পাখি, ডালিমগাছে মৌ/ রাবণরাজা দেখতে পেলেন একা রামের বৌ’… সীতাহরণের এহেন প্রিলিউড পূর্ণেন্দু পত্রী ছাড়া কেউ রচনা করতে পারতেন কিনা, সন্দেহ থেকে যায়। বাচ্চাদের জন্য লেখা তাঁর আলটুং ফালটুং, ম্যাকের বাবা খ্যাঁক বা ইল্লিবিল্লি-র মতো বই বাংলা শিশু সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে।

তবে এ লেখার গোড়াতেই যেমন বলেছি, কবি পূর্ণেন্দু পত্রী বা ছড়াকার পূর্ণেন্দু পত্রীর পাশাপাশিই রয়েছে তাঁর গদ্যকার তথা প্রাবন্ধিক সত্তা। পূর্ণেন্দু পত্রী এক সার্থক গদ্যকার, প্রাবন্ধিক এবং পুরনো কলকাতার ইতিহাসের প্রথম দিককার ক্রনিকলার। পুরনো কলকাতা সম্পর্কে প্রায় ডজনখানেক বই লিখেছিলেন তিনি। কলকাতার রাজকাহিনী, এক যে ছিল কলকাতা, কলকাতার আদিপর্ব, কী করে কলকাতা হল, পুরনো কলকাতার কথাচিত্র এমন একের পর এক বইতে তিনি ধরে রেখেছেন পুরনো কলকাতার ধুলোবালি, মানুষজন, গাড়িঘোড়া।

Purnendu Patri drawing 1
কবি-পরিচিতি সম্ভবত তাঁকে বাঙালি মানসের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ করে তুলেছিল

বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা তাঁর প্রবন্ধ পরবর্তীকালে সংকলিত হয়ে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে ‘কালি কলম মন’ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। একটি সাময়িকপত্রে এই নামে ধারাবাহিক ফিচার লিখতেন পূর্ণেন্দুবাবু। দেশজ ভাষায় ভিনদেশি শিল্পী-সাহিত্যিকদের সৃষ্টি নিয়ে সে সব লেখায় তথ্য ও অনুভূতির মিশেল ঘটেছিল। চিত্র-ভাস্কর্য, চলচ্চিত্র, সাহিত্যের শিল্পরীতি নিয়ে তাঁর নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও অভিব্যক্তি ছিল পাঠকের কাছে বাড়তি পাওনা। সঙ্গে অবশ্যই তাঁর চমৎকার গদ্য। জীবনের উপান্তে পৌঁছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে গভীর গবেষণা করতে শুরু করেছিলেন পূর্ণেন্দুবাবু। ১৯৯৬ সালে, তাঁর প্রয়াণের বছরখানেক আগে প্রকাশিত হয় এই গবেষণালব্ধ বই ‘বঙ্কিম যুগ’। 

নতুন করে বঙ্কিমকে আবিষ্কার করতে করতে এক অন্য স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সম্পর্কে সংবাদপত্রে এক আলোচনায় গৌতম চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘… আমাদের পূর্বসূরিরা যাবতীয় তর্কশীলতা নিয়েও বিষয়ের প্রতি কী রকম শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, বৃহৎ বাঙালি কী ভাবে এক নিশ্বাসে রোদাঁ থেকে রিলকে হয়ে লোকশিল্পকে নিয়ে আসত আতপ্ত সংরাগে’ তার প্রমাণ তিনি পেয়েছেন পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রবন্ধ পড়েই। পূর্ণেন্দুবাবুর বঙ্কিম বিষক গবেষণা প্রসঙ্গে তিনি আরও লিখেছিলেন:

“১৮৭৫ সালে বঙ্গদর্শন-এ বঙ্কিম প্রবল ক্ষোভে লেখেন, “যে আকবর বাদশাহের আমরা শতমুখে প্রশংসা করিয়া থাকি, তিনিই বাঙ্গালার কাল।” টোডরমলের নীতিতে জমির রাজস্ব বেড়েছে, এবং বাড়তি টাকাটা বাংলার কাজে লাগছে না, সটান চলে যাচ্ছে দিল্লির রাজকোষে। হাল আমলের হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় এ বার উক্তিটা কেটেছেঁটে বঙ্কিমকে সুবিধেমাফিক বাঙালি বা হিন্দু, যে কোনও জাতীয়তাবাদের পুরোধা ভাবতে পারে। কিন্তু পূর্ণেন্দু পাশাপাশি জানান, এই প্রবন্ধের ঢের পরে রাজসিংহ, সীতারাম লেখা হয়েছিল। তা হলে? পূর্ণেন্দুর সিদ্ধান্ত, গোটাটাই প্রতিভার স্ববিরোধিতা। নিজের চিন্তাকে নানা ভাবে সম্প্রসারণ করতে চাইতেন বলেই বঙ্কিম সাম্য প্রবন্ধ লিখেও তা ছাপার পর প্রত্যাহার করেন। কৃষ্ণচরিত্র-এর প্রথম ভাগে যা লিখেছিলেন, গ্রন্থাকারে তা আমূল পরিবর্তিত। স্বভাবসিদ্ধ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বঙ্কিম সেই বইয়ের ভূমিকায় লেখেন, “জীবনে আমি অনেক বিষয়ে মত পরিবর্তন করিয়াছি… কে না করে?” বাঁধা গতের বাইরে, স্ববিরোধী পদচারণাতেই প্রতিভার সিদ্ধি।”

এ থেকেই বোঝা যায় তাঁর লেখনীর, বিশ্বাসের, মতামতের, অনুভবের স্বচ্ছন্দ পদচারণা বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে, স্তর থেকে স্তরান্তরে। কখনও সেখানে তাঁর বহুকালের বন্ধু সত্যজিৎ রায়ের সুদীর্ঘ উপস্থিতি, কখনও শেক্সপিয়রের বাড়িতে দাঁড়িয়ে তাঁর সাহিত্যকৃতি নিয়ে কথোপকথন, কখনও ‘আমার ছেলেবেলা’ বলে স্মৃতিকথনের স্রোতে ভেসে যাওয়া, কখনও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত এলেজি – তোকে আমরা কী দিইনি শক্তি?

“ঝমাঝঝম মাদল হয়ে বাজবি বলে তোকে দিয়েছি চাইবাসার প্রত্যেকটা ফ্লুরোসেন্ট রাত। যথেচ্ছারের সুখে মাতাল হাতির মতো ঘুরবি বলে তুলে দিয়েছি জলদাপাড়ার জঙ্গল। দেদার ঘুমের জন্যে গোটা জলপাইগুড়ি জেলাটাকেই বানিয়ে দিয়েছি তোর মাথার বালিশ। মুখে যাতে মাছি না-বসে, ভুবনেশ্বরের দুপুরগুলো চামর দুলিয়ে গেছে সারাক্ষণ। শুধু তোর জন্যই হাওড়া স্টেশনে জিরোতে দিইনি দূরপাল্লার কোনও ট্রেনকে। স্টিমারে স্টিমারে ভোঁ বাজিয়ে জাহাজ, যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিনদের বলেছি, সরে যাও, শক্তি এখন সাঁতার কাটবে সমুদ্রে। ভূমিকম্পের আগে সতর্কতা জানাতে কলকাতার সমস্ত সাইরেন উপুড় করে দিয়েছি তোর মুঠোয়। ভারতবর্ষের যে-কোনও ডাকবাংলোর কনকনে কালো রাতগুলোকে বলা ছিল, ও কখন আসবে ঠিক নেই, কিন্তু আসবেই, কেয়ারটেকার যেন লণ্ঠনটা জ্বালিয়ে রাখে।

তোকে আমরা কী দিইনি, শক্তি?

মঞ্চে সবার আগে চেয়ার পেতে দিয়েছি তোকে। মাইকে সবার আগে তোর নাম। লিটল ম্যাগাজিনে সবার আগে তোর পদ্য। আড্ডায় সবার আগে তোর গান। যখন পা টলমল, জড়িয়েছি বুকে। যখন চোখ হারিয়েছে ঘরে ফেরার ঠিকানা, পৌঁছে দিয়ে এসেছি সদরঘরের দরজায়। যখন উদ্ধত, বলেছি — শান্ত হ। যখন শান্ত, বলেছি — শোনা তোর শঙ্খস্বর। যখন স্বেচ্ছাচারী, বলেছি — তুই কিন্তু গৃহী। যখন গৃহস্থ, এগিয়ে দিয়েছি ট্যুরিজমের ম্যাপ।

তোকে আমরা কী দিইনি, শক্তি?

তুই নিখোঁজ। আমরা পাহাড়ে-মেঘে-জলস্তম্ভে বাজিয়ে দিয়েছি কাড়া-নাকাড়া। তুই বিপন্ন। আমরা প্রতিপক্ষের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছি কামান-বন্দুকের মুখ। তুই পুরস্কৃত, আমরা ঝনঝনিয়ে উঠেছি রাগে। আমরা স্মৃতি-অ্যালবামে সাজিয়ে রেখেছি তোর একশো রকমের ছবি। আমাদের দৈনন্দিন হাসি-ঠাট্টা ভরাট হয়ে থাকত তোর দুশো রকমের দস্যিপনার গপ্পে। তুই কবিতা পড়বি। আকাশ ঝেঁটিয়ে জড়ো করেছি সমস্ত রঙের মেঘ। তুই নাচবি। সমস্ত আসবাব সরিয়ে বিছিয়ে দিয়েছি মোলায়েম মখমল।

তোকে আমরা কী দিইনি, শক্তি?

বাংলা আকাদেমির প্রাঙ্গণে সেদিন তোর কী বরবেশ! কপালে চন্দনের রাজটীকা। মনে হচ্ছিল, চশমা খুলে উঠে বসার আগে একটু গা-এলানো বিশ্রাম বুঝি। খানিক পরেই পড়বি শান্তিনিকেতনে লেখা নতুন কবিতা। তখনও ভাবছি চুল্লি ভয় পাবে আগুনকে। আগুন পড়ে নেবে শোকযাত্রীদের মুখরেখা। শেষ বিউগল কিছুতেই বাজাতে পারবে না কলকাতার কান্না। তখনও ভাবছি, দৈববাণীর মতো বলে উঠবি — যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব?”

Purnendu and Friends
পূর্ণেন্দু পত্রীর তোলা ছবিতে তাঁর কবিবন্ধুরা। একেবারে ডাইনে শক্তি চট্টোপাধ্যায়

তবে এই সবকিছুর পরেও আরও অন্তত দু’জন পূর্ণেন্দু পত্রী থাকেন, যাঁদের উপযুক্ত মূল্যায়ন হয়তো বাঙালি এখনও করে উঠতে পারেনি। তাঁরা হলেন, শিল্পী পূর্ণেন্দু এবং চলচ্চিত্রকার পূর্ণেন্দু। শেষেরজনকে এখনও বাঙালি ঠিক বুঝে উঠতে পেরেছে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ জাগে। ষাটের দশকে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোটগল্প ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ অবলম্বনে করা পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রথম ছবি ‘স্বপ্ন নিয়ে’ সে সময় বিদগ্ধমহলে যথেষ্ট সাড়া ফেললেও আমবাঙালির ছবিঘরে সেভাবে জায়গা পায়নি। এমনকী লেখকের নিজেরও সে ছবি নাকি পছন্দ হয়নি। অভিনয় করেছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায়, বিজন ভট্টাচার্য, রবি ঘোষ, চারুপ্রকাশ ঘোষ, শিউলি মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

পরের ছবি স্ত্রীর পত্র (১৯৭২)-এর জন্য জাতীয় পুরস্কার ছাড়াও পেয়েছিলেন তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ প্রযোজক ও শ্রেষ্ঠ পরিচালকের খেতাব। শতরঞ্জ কে খিলাড়ি-তে যে অ্যানিমেশনের ব্যবহার ভারতীয় সিনেমাপ্রেমীদের চোখ ট্যারা করে দিয়েছিল, তার অনেক আগে এ ছবিতে অ্যানিমেশন ব্যবহার করেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। এর পরের ছবি সমরেশ বসুর গল্প অবলম্বনে ‘ছেঁড়া তমসুক’-ও (১৯৭৪) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছিল একাধিকবার। তবে এক্ষেত্রেও লেখকের একেবারেই ভালো লাগেনি তাঁর গল্পের চিত্রায়ন। কিন্নর রায়ের লেখায় পাই:

“সমরেশদার ‘ছেঁড়া তমসুক’ নামের গল্পটি নিয়ে পূর্ণেন্দুদা যে ছবি করেন, সেখানে ট্রেনে গলা দিয়ে আত্মহত্যা করা বিজু কবি সম্মেলনে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পড়া শুনে আত্মহননে উৎসাহী হয়। কবি সম্মেলন, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আরও কোনো কোনো ‘দেশ’-আনন্দবাজার গ্রুপের কবি ছিলেন এই সিনেমার শটের কবি সম্মেলনে। সাদা-কালো ছবি ছিল ‘ছেঁড়া তমসুক’। সমরেশ বসু অবুশ্য ‘ছেঁড়া তমসুক’-এর চলচ্চিত্রায়ণ নিয়ে খুব একটা খুশি ছিলেন না। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে কিড স্ট্রিটের কাছে ‘শামিয়ানা’ নামক বারের আড্ডায় তিনি বলেওছেন সেই কথা।”

Purnendu with Suchitra Sen
সুচিত্রা সেনকে নিয়ে চতুরঙ্গ ছবি শুরু করেছিলেন। শেষ হয়নি

এছাড়াও ‘মালঞ্চ’ (১৯৭৯) এবং ‘ছোট বকুলপুরের যাত্রী’ (১৯৮১)-ও গুণগ্রাহীদের মধ্যে কদর পেয়েছিল। শেষেরটিতে পূর্ণেন্দুবাবু নিজে অভিনয়ও করেন ছোট একটি চরিত্রে। তথ্যচিত্রও করেছেন একাধিক, যার মধ্যে রয়েছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে করা ছবি, কালীঘাটের পটচিত্র নিয়ে করা ছবি ইত্যাদি। ‘খরা’ আর ‘গুহাচিত্র’ নামের দুটি তথ্যচিত্র অসমাপ্ত রয়ে যায়। সুচিত্রা সেন-কে নিয়ে ‘চতুরঙ্গ’ ছবিও শেষ হয়নি। তবে ছবির জন্য প্রযোজকদের দোরে দোরে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে মানুষের কাছে হাত পাতাকেই শ্রেয় বলে মনে করতেন পরিচালক। কিন্নর রায়ের স্মৃতিচারণাতেই আছে,

“কুপন ছাপিয়ে চাঁদা তুলে ছবি করতে চেয়েছেন পূর্ণেন্দু পত্রী। সেই চাঁদা তোলার সহযোগী হয়েছি আমরাও। সামান্য টাকা, কুপন কেটে তুলে দেওয়া।”

তবে, সমস্ত পরিচয় ছাপিয়ে পূর্ণেন্দু পত্রী ছিলেন আদ্যন্ত শিল্পী। শিল্পের গুণগ্রাহী, কদরদান। আর্ট কলেজে কমার্শিয়াল আর্টের কৃতি ছাত্র পূর্ণেন্দু ছাত্রাবস্থাতেই পত্রপত্রিকায় ছবি আঁকতে শুরু করেন, লেখার পাশাপাশি। তাঁর কাকা নিকুঞ্জবিহারী পত্রী সম্পাদিত সিনেমা পত্রিকা ‘চিত্রিতা’ এবং সাহিত্য পত্রিকা ‘দীপালি’-তে একরকম হাতেখড়ি হয় পূর্ণেন্দুর। ক্রমে প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে এক অননুকরণীয় উচ্চতায় চলে যান পূর্ণেন্দু পত্রী। শতাধিক বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ সৃজন করেছিলেন তিনি, এবং প্রত্যেকটিই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে স্মরণীয়। বিদেশি শিল্পীদের কাজ থেকে শুরু করে শহরের দেয়াল লিখন, রাস্তায় বসানো মূর্তি– সবকিছুই পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবন করতেন পূর্ণেন্দু, এক জাত শিল্পীর চোখ দিয়ে। রাতুল ঘোষ পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রচ্ছদ সম্পর্কে এক প্রবন্ধে লিখেছেন,

“তিনি কবিতা আঁকেন। এবং যখন আঁকেন তখন শুধু কবিতাকেই আঁকেন সকলের জন্য, তিনি কবিতা আঁকতে গিয়ে ভুলেও নিজের কথা বলেন না। কবিতার কথাই বলেন। এটাই প্রচ্ছদের ধর্ম। কবি পূর্ণেন্দু পত্রী আজীবন তুলি হাতে এই নির্লিপ্ত নিবেদনের ধর্ম পালন করেছেন। তাঁর সমস্ত শিক্ষা-ক্ষমতাকে বজ্রকঠোর হাতে আত্মপ্রভাবের সূক্ষ্ম সম্মোহন থেকে বাঁচিয়ে শাসন করেছেন এবং ব্যবহার করেছেন। তাঁর আঁকা প্রচ্ছদগুলি ঐ বিশেষ বইটির নান্দীমুখ বা মুখপত্র বা চিত্ররূপ হয়ে উঠেছে, পূর্ণেন্দুর ছবি হয়নি কখনোই। এজন্যই প্রচ্ছদশিল্পী পূর্ণেন্দু অমর।”

Purnendu Patri Cover
পূর্ণেন্দু পত্রী প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে চিরস্মরণীয়

বস্তুত, বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে যে তিন শিল্পীর নাম একত্রে করা উচিত, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। বাকি দুজন অবশ্যই তাঁর দুই সুহৃদ সত্যজিৎ রায় এবং খালেদ চৌধুরী। পূর্ণেন্দুবাবুর করা অজস্র, অসংখ্য প্রচ্ছদের মধ্যে কিছু কাজের উল্লেখ করা যাক, যেমন: শঙ্খ ঘোষের ‘নিহিত পাতালছায়া’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রভু নষ্ট হয়ে য়াই’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রেমের কবিতা, বুদ্ধদেব বসুর কবিতা সংগ্রহ, আবু সয়ীদ আইয়ুবের ‘পথের শেষ কোথায়’, গৌরকিশোর ঘোষের ‘রূপদর্শীর সংবাদভাষ্য’, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাস’ ইত্যাদি। নিজে কবি ছিলেন বলেই হয়তো কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদে এমন করে কবিতাকে ‘পার্সোনিফাই’ করে ফেলতে পারতেন তিনি। বিশিষ্ট শিল্প গবেষক ও বিশেষজ্ঞ প্রণবরঞ্জন রায় তাই সার্থকভাবেই পূর্ণেন্দু পত্রীকে বলেছেন, ‘বাংলা প্রকাশনার প্রচ্ছদসৃষ্টির (নির্মাণের নয়) কবি।’

Pattrea and Baij
কলকাতার পথে পথে মূর্তি দেখে বেড়াচ্ছেন রামকিংকর বেজ (বাঁয়ে) ও পূর্ণেন্দু পত্রী

শেষমেশ প্রচ্ছদসৃজন নিয়ে একটা মজার গল্প দিয়ে শেষ করা যাক। এ গল্প শুনিয়েছিলেন আর এক প্রয়াত চলচ্চিত্রকার-কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, খবরের কাগজের পাতায়। গল্পের বিষয়: তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘গভীর এরিয়েল’-এর প্রচ্ছদ সৃজন নিয়ে। সে বই প্রকাশিত হয়েছিল কবিপত্র প্রকাশনা থেকে। সেখানকার কর্ণধার পবিত্র মুখোপাধ্যায় বুদ্ধদেববাবুকে বললেন, প্রচ্ছদ করবার জন্য পূর্ণেন্দু পত্রীই আদর্শ। অতঃপর:

“পূর্ণেন্দু পত্রী তখন থাকতেন লেকটাউনে। আমি চিনতাম আগেভাগেই, ওঁর সেই ‘দাঁড়ের ময়না’ পড়ে মুগ্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই। ফোন করে আগেই বলে রেখেছিলাম। পূর্ণেন্দুদা তখন মহা ব্যস্ত তাঁর প্রথম ছবি ‘স্বপ্ন নিয়ে’-র শুটিং-এর কাজে, আর লেকটাউনের আকাশ ভেঙে সেদিন প্রবল বৃষ্টি। ভেজা চিঁড়ের মতো নেতানো আমার অবস্থা।

বেল টিপতেই পূর্ণেন্দুদা দরজা খুলে বলে উঠলেন ‘এখন হবে না, এখন হবে না…’ তার পর কী মনে হওয়ায় আবার বললেন, ‘আগে জল ঝরে যাক তার পর ভেতরে ঢুকো।’ শুটিং কেমন চলছে জানতে চাওয়ায় বললেন, ভাল, কিন্তু ক্যামেরাম্যান আমার কথা শোনে না। যাই বলি, খালি বলে ‘হয় না, হয় না’… তার পরে একটু থেমে বললেন, ‘বইয়ের নাম কী?’
— গভীর এরিয়েলে।
হেসে বললেন, জীবনানন্দ দাশ থেকে মেরে দিয়েছ! কী যেন লাইনটা?
— প্রাণাকাশে বচনাতীত রাত্রি আসে, তবুও তোমার গভীর এরিয়েলে…
তার পর দু’কাপ চা, দুটো সিগারেট আর দশটা মিনিট। সেই প্রচ্ছদ তৈরি হয়ে গেল, যা এখনও পর্যন্ত আমার প্রকাশিত কবিতার বইগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ।”

*তথ্যসূত্র:

তেলেনাপোতা, ছেঁড়া তমসুক – কিন্নর রায়
আমার প্রথম বই – বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত; আবাপ- রবিবাসরীয়
পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রচ্ছদ: নিজস্ব নিবিড়তা – রাতুল ঘোষ
বাংলা বই-য়ের প্রচ্ছদ – প্রণবরঞ্জন রায়
কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর পথচলা— মম চৌধুরী

*ছবি সৌজন্য: Wikipedia, কবি সন্দীপন চক্রবর্তীর ফেসবুক পেজ, Abp, Souncloud, Alchetron, Facebook

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com