ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশনের সর্বশেষ খবর অনুযায়ী – ৯২০০-এর বেশি নতুন করোনা ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই চিনে ১৩২ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। চিনের বাইরে ৬৮টা কেসের কথা নিশ্চিতভাবে জানা গেছে। এই ভাইরাসের সংক্রমণের ঘটনা ‘পাবলিক হেল্থ ইমার্জেল্সি অফ ইন্টারন্যাশনাল কনসার্ন’ অর্থাৎ আন্তর্জাতিক স্তরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার প্রয়োজন আছে কিনা তা ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশনের কমিটি খতিয়ে দেখবে। আজ অর্থাৎ ৩১শে জানুয়ারি, ২০২০-র সর্বশেষ খবর অনুযায়ী কেরালাতে একজনের দেহে নিশ্চিতভাবে করোনা ভাইরাস তথা নভেল করোনা ভাইরাস পাওয়া গেছে। এদিন সকালের নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর খবর অনুযায়ী – এখনো পর্যন্ত চিনের য়ুহান প্রদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ১৭০ বা তার কিছু বেশি, ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৭,৭০০-র বেশি। এখনও অনেকটা রহস্যময় এই ভাইরাস রহস্য। উল্লেখ করার মতো যে ২০০২-২০০৩ সালে এসএআরএস-এর যে সংক্রমণ চিন সহ দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া তথা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়েছিল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা শুধু চিনেই এখনও অব্দি তার চেয়ে বেশি। ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশনের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, এসএআরএস-এর আক্রমণে ১৭টি দেশে ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫,৩২৭। কিন্তু করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৭,৭০০ ছাড়িয়ে গেছে ডিসেম্বর মাসে সংক্রমণ শুরু হবার এক মাসের মধ্যে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল গত ৩-৪ দিনের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যার ৩০%-এরও বেশি বৃদ্ধি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, কারণ দ্রুত পরীক্ষা করার মতো টেস্ট কিট-এর ঘাটতি পড়েছে। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের হার এখনও পর্যন্ত হিসেব অনুযায়ী শতকরা ৩ জন (৩%)।
চিকিৎসার জগৎ এ ভাইরাস নিয়ে কী বলে?

২৪ জানুয়ারি, ২০২০, নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এর সম্পাদকীয় হল – “অ্যানাদার ডেকেড অ্যানাদার করোনাভাইরাস”। এ ভাইরাসকে আপাতত ২০১৯-এনসিওভি নামে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ২০০২-৩-এর এসএআরএস (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটোরি সিন্ড্রোম– এসএআরএস-সিওভি) এবং ২০০৯-এর এমইআরএস-সিওভি (মিড্ল ইস্ট রেসপিরেটোরি সিন্ড্রোম করোনাভাইরাস)-এর এটা তৃতীয় অতিবৃহৎ সংক্রমণ। করোনা ভাইরাস একধরনের আরএনএ ভাইরাস। আরএনএ ভাইরাস হবার জন্য এই ভাইরাস সহজেই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নতুন করে সংক্রমণ ছড়াতে পারে কারণ এতে আছে “এরর প্রোন আরএনএ ডিপেনড্যান্ট আরএনএ পলিমেরাসেস” যার ফলে “মিফটেশন এবং রিকম্বিনেশন” খুব ঘন ঘন হতে পারে। আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হল শুষ্ক শ্বাসনালীর উপরিস্তরের কোষে (এপিথেলিয়াম) এরা সহজে বেঁধে যেতে পারে। এজন্য চিকিৎসকেরা বারেবারে অল্প অল্প জল (১০০ মিলি পর্যন্ত) পান করতে বলেন, যাতে গলা এবং শ্বাসনালী শুকিয়ে না যায়। এবং অবশ্যই সংক্রমণের পরিস্থিতি তৈরি হলে তবেই এ নির্দেশ পালন করার কথা, সাধারণ অবস্থায় নয়।
এছাড়াও যেগুলো সহজে পালন করা যায় এবং গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো অল্প কথায় বললে – (১) সাবান আর পরিস্কার জল দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। সাবান না থাকলে অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে ব্যবহার করতে হবে। (২) হাত পরিস্কার না করে চোখ-মুখ-নাকে হাত দেওয়া অনুচিত। (৩) হাঁচি কাশি পেলে রুমাল বা টিসু পেপার ব্যবহার করুন এবং একবার ব্যবহারের পরে রুমাল হলে ভালো করে সাবান জলে ধুয়ে নিতে হবে, টিসু পেপার হলে ফেলে দিন। (৪) নাক মুখ ঢাকা মাস্ক ব্যবহার করুন। অসুস্থ রোগীদের কাছে যাওয়া পরিহার করুন। (৫) প্রতিদিনের অবশ্য ব্যবহার্য জিনিসগুলি বারবার পরিস্কার করতে হবে, জীবাণুমুক্ত করতে হবে। (৬) নিজের মধ্যে অসুস্থতার লক্ষ্মণ দেখা গেলে নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখুন।
চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনও জানেনা ঠিক কিভাবে মানুষের দেহের ভেতরে কোষের সাথে এই ভাইরাস জোড় বাঁধে এবং সংক্রমণ শুরু করে। জানেনা সংক্রমণ নিয়েও কিভাবে একজন মানুষ একেবারেই কোন উপসর্গহীন অবস্থায় থাকতে পারে, আবার একজন মরে যায়। যদিও মনে রাখা দরকার যারা মারা গেছে তাদের এক বড় সংখ্যক বার্ধক্য, টিবি, ডায়াবেটিস বা অন্য কোন ধরনের অসুখে যা শরীরের ইমিউনিটিকে দুর্বল করে দেয় ভুগছিল। কিন্তু য়ুহানের রিপোর্ট থেকে বোঝা যাচ্ছে বড়ো সংখ্যক রোগীর মৃত্যু ঘটেছে মাল্টি অরগ্যান ফেইলিওরের ফলে। ২৯ জানুয়ারি, ২০২০-এ ল্যান্সেট পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে – ২০১৯-এনসিওভি ইনফেকশনের প্রভাব বেশি করে পড়বে বয়স্ক পুরুষদের ওপর যারা অন্য অসুখে ভুগছেন। এই প্রভাবে তীব্র শ্বাসকষ্ট এবং তার থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। একই দিনে ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত আরেকটি গবেষণার বলা হয়েছে যে জিন স্টাডি করে দেখা যাচ্ছে ভাইরাসের উৎস, আগের দুবারের মতোই, খুব সম্ভবত বাদুড়।
করোনা ভাইরাসের সময় সারণী
- ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে করোনা ভাইরাসের খবর আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় পৌঁছয়। চিন সরকার দ্রুত এ খবর WHO-র কাছে পাঠায় উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবার জন্য।
- ৩০ জানুয়ারি, ২০১৯, ওয়াশিংটন পোস্ট-এর সংবাদ অনুযায়ী মোট ১৮টিরও বেশি দেশে এ রোগ আক্রমণ করেছে। সংখ্যা অনুযায়ী – চিনঃ ৭,৭০০; থাইল্যান্ডঃ ১৪; হংকংঃ ১০; তাইওয়ান, জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াঃ প্রত্যকেওক্ষেত্রে ৭-৮ জন করে; আমেরিকাঃ ৫; অস্ট্রেলিয়াঃ ৫; সৌদি আরবঃ ৪; ফ্রান্সঃ ৪, জার্মানিঃ ৪, ইত্যাদি।
- ওয়াশিংটন পোস্টের ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯-র খবর জানাচ্ছে – চিনে রাসায়নিক অস্ত্র তৈরিতে করোনা ভাইরাস ব্যবহারের থিওরি নস্যাত করে দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
- ২৭ জানুয়ারি, ২০২০, অস্ট্রেলিয়া কৃত্রিমভাবে নভেল করোনা ভাইরাস তৈরি করতে সফল হয়েছে। ফলে ভবিষ্যৎ গবেষণার সুবিধে হবে।
- কিন্তু এক ভাইরাসের গুঁতোয় বিশ্বসুদ্ধ গেল গেল রব পড়ে গেছে – কি মেডিসিনে, কি পর্যটনে, কি বিশ্ব অর্থনীতিতে। একেই বলে গ্লোবালাইজেশন – “আওয়াজ খানা দিচ্ছে হানা দিল্লী থেকে বর্মা”।
পেশায় ডাক্তার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণায় নিযুক্ত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। বর্তমান ঠিকানা রায়গঞ্জ।