আর্ট কলেজ(Art College) থেকে পাশ করেই চাকরি হল বটে, কিন্তু তা আসলে ঠিক জুতসই বা মনোমত কোনওটাই হল না। সরকারি এবং বেসরকারি স্কুলের আর্ট-টিচারের চাকরি জুটলেও অ্যাপয়েন্টমেন্ট যা পেলাম, সে-সবই কলকাতার বাইরে; চলে গেলেই হত। আমার আর কী-ই বা পিছুটান! বাবা- মা তো পারলে একরকম ঠেলেই পাঠিয়ে দেন; কষ্ট বলতে যা একটু মন খারাপ হবে, সে ওই দাদুর; আর ফাঁকি পড়ে যাবে, আমার ছাত্র-ছাত্রীরা। কলেজে পড়বার সময় থেকেই রবিবার, মানে ওই একটাই দিন সকাল থেকে ক্লাস করি। সেটা এখন বেশ জমে উঠেছে। নিয়মিত আউট-ডোর(Outdoor) স্কেচ, প্রদর্শনী দেখাতে নিয়ে যাওয়া, বছরে একবার হল ভাড়া করে ওদের আঁকা-ছবির প্রদর্শনী(Exhibition), পিকনিক; এ-সবের ফলে একটু আধটু নামও ছড়িয়েছে আমার এবং ওই আঁকার ক্লাসেরও। আমাদের বাড়িটা দোতলা হলেও ঘর বেশি নেই। কিন্তু দাদু তাঁর সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে, ছাদের ওপর কাচের একটা চমৎকার স্টুডিয়ো(Studio) বানিয়ে দিয়েছেন। তা-ছাড়াও একতলায়, ভেতরের ঘর-দেওয়াল সব ভেঙেচুরে, একবারে পুরোটা নিয়ে একটা স্টুডিয়ো(Studio)- অ্যাপার্টমেন্টও বানিয়ে ফেলেছেন নীচে। ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর তাঁর নাকি আর ওই চেনা ঘরদোর কিছুই ভালো লাগত না। এ-সব খরচও দাদুর; পরিবর্তে আমাকে শুধু ঠাকুমার অল্প বয়সের একখানা ছবি তেল-রঙে এঁকে, ভালো দোকান থেকে ফ্রেমে বাঁধিয়ে এনে দিতে হয়েছে। (Cover Story)
আমার ক্লাসে দাদুও একজন ছাত্র; সকলের সঙ্গে মন দিয়ে ছবি আঁকেন এবং যত্ন করে ক্লাসটা বসাতে সাহায্যও করেন। ফলে, ক্লাসের আগে এবং পরে সাফসুতরোর দিকটা আমাকে একেবারেই দেখতে হয় না। ফি-কালেকশান বা অন্যান্য ছোটো কাজের জন্য আছে দাদুরই ড্রাইভার মোহনদা; রবিবারের জন্য তার এই বাড়তি ডিউটি হওয়ায় সকলেরই সুবিধে হয়েছে। রবিবার দাদুর সঙ্গেই নীচের ঘরে লাঞ্চ করে মোহনদা। তাই দাদুর নজরদারিতে, পুরো কালেকশনটাই আমার হাতে আসে। ভগীরথের ঝাড়ু-পোঁছার বা মোহনদার সানডে- ডিউটির ‘এক্সট্রা-আওয়ারসে’র টাকা— সে সবও দাদুর খরচ। বুঝতে পারি যে, আমার এই আঁকার ক্লাসটা নিয়ে দাদুর যেন আহ্লাদের সীমা নেই কোনও।

বেশ জমজমাট আনন্দেই দিন কাটছিল; আমি আর দাদু যেন দুই ব্যাচেলার; আর দোতলায় বাবা–মা? ওই, আছে কিন্তু নেই গোছের একটা কিছু। ইতিমধ্যে দাদুর শালাবাবু মানে আমার বাবার মামা-মামী এসে দাদুকে ধরলেন যে, তাঁদের এন.জি.ও তে যাতে আমি ওই কাজটা নিই; বুঝলাম যে আমার কোনও চয়েস নেই; কারণ দাদুরও তাই ইচ্ছা; আর এমন কোনও যুক্তি তো আমারও হাতে নেই, যার জোরে বেশ সপাটে ‘না’ বলতে পারি; কারণ আমি তো চাকরি পেয়েও না-নেওয়া এক বেকার; নিজের আঁকা ছবিও এখন অবধি একটাও বিক্রি হয়নি। একদিনের ক্লাস থেকে যে রোজগার তাও কেউ ধর্তব্যে আনে না; দাদু অবশ্য বলেন যে বেকার থাকলে এটাই সুবিধা যে, তাঁর পেনশনের নমিনি হিসেবে, আমিই নাকি হাফ-পেনশন পাব; তবে সেটা অবশ্য পাব দাদুর, অবর্তমানে। এ-সবে আর মাথা ঘামালাম না। মূলত দাদুর উচ্ছ্বাসের বহর দেখে, চলেই গেলাম মামা-দাদুর সঙ্গে দেখা করতে।
কাজটা অদ্ভুত। ঘুরে ঘুরে নথি সংগ্রহ করে জানানো যে, ফুটপাথে রাতে ঘুমোয় অথচ ফুটবাসী নয়; শর্ত একটাই যে ফটো তোলা যাবে না; প্রয়োজনে যদিও কথা বলা চলবে, মানে ইন্টারভিউ। কিন্তু রিপোর্টটা দিতে হবে হাতে আঁকা স্কেচ সমেত। পরে নাকি সেগুলো দিয়ে ছবির প্রদর্শনী-সমেত একটা অ্যালবাম প্রকাশ পাবে।
অদ্ভুত একটা চাকরি; ডিউটি আওয়ারস— সন্ধে আটটা থেকে রাত-দুটো। তবে সাড়ে সাতটার মধ্যে অফিসে গিয়ে হাজিরা দিয়ে ডিউটি-লোকেশন জেনে নিতে হবে। মাইনে বেশ ভাল; সপ্তাহে যে কোনও একদিন ফুল লিভ, যেটা রোটেটিং; তিনমাস ট্রেনিং পিরিয়ডে হাফ স্যালারি; তারপর চাকরিতে বহাল হলে, মাসান্তে পুরো মাইনে। তবে কাজটা অদ্ভুত। ঘুরে ঘুরে নথি সংগ্রহ করে জানানো যে, ফুটপাথে(Footpath) রাতে ঘুমোয় অথচ ফুটবাসী নয়(Homeless); শর্ত একটাই, ফটো তোলা যাবে না; প্রয়োজনে যদিও কথা বলা চলবে, মানে ইন্টারভিউ। কিন্তু রিপোর্টটা দিতে হবে হাতে আঁকা স্কেচ সমেত। পরে নাকি সেগুলো দিয়ে ছবির প্রদর্শনী-সমেত একটা অ্যালবাম প্রকাশ পাবে। বুঝলাম যে, এই স্কেচ আঁকার জন্যই চাকরিটা হল; তবে সবাই যে আমার মতো পাশ করা আর্টিস্ট বা কাঠ-বেকার তা নয়। দিনেরবেলা এরা আবার অন্য কাজও করে। কাজের সময় এবং ধরণ শুনেই তো মায়ের মুখ গম্ভীর; একা বাড়ির বাইরে থাকলেই, রাত দশটা থেকে মায়ের ফোন আসতে শুরু করে, ‘কোথায়’- ‘কোথায়’ বলে! আবার বলে-কয়ে দেরি করে ফিরলেও বাবা-মা দুজনেরই মুখ হাঁড়ি। মজা লাগলেও, মায়ের মনে ফুসফুসিয়ে ওঠা সংশয়ের বুদবুদটা কিন্তু আমার মনেও বেশ জাঁকিয়েই বসল; কারণ কাজটায় রিস্ক আছে — হাঙ্গামা, হল্লা, মারপিট; কারণ রাতের অন্ধকারে তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আমি ঢুকে পড়তে চলেছি, কিছু মানুষের ঘুমের নিভৃতে এবং সেই সঙ্গে যেচে-সেধে অন্য কিছু মানুষের বেখাপ্পা কাজকর্মেরও নীরব সাক্ষী হতে।

২
কলকাতার দক্ষিণ-অঞ্চলে থাকি; তাই এলাকাগুলো এদিকেই পড়ল; মানে যাদবপুর থানা থেকে গড়িয়াহাট। এক-এক অঞ্চলে একেক রকম চরিত্র হলেও মানুষগুলো প্রায় একই-রকম—- ‘পরিযায়ী-শ্রমিক’। ইউ পি, বিহার বা নেপাল থেকে আসা; যারা নিজেদের চেনা-পরিচয়ের কারণে ছোটো ছোটো দলে থাকে; হিন্দু-মুসলমান-আদিবাসী সবই মেলানো মেশানো। রাস্তার কলে স্নান, ফুটপাতের স্টলে ছাতু মাখা বা আটার লিট্টি খেয়ে সুবিধে মতো জায়গা বেছে ঘুম; বাইরে থেকে ছবিটা এরকম সরল হলেও, এর মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। এলাকা ভাগ অনুযায়ী তোলা দিতে হয় বিভিন্ন ‘পার্টি’দের। সেই সঙ্গে আছে পুলিশের হয়রানি; সেটারও অবশ্য একটা নিয়ম আছে; এমনি সময়ে চায়ের দোকানে এদের সঙ্গে বসেই পুলিশও চা খায়; কিন্তু কয়েকটা-রাত লাঠির গুঁতোয় ঘুম থেকে তুলে, সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়; নাইট ডিউটিতে কাজ দেখানোর এটাই দস্তুর। অতর্কিতে ঘুম ছুটে যাওয়া লোকগুলো তখন একটু দূরে দূরে ছিটকে গিয়ে, বসে-বসেই ঢুলতে থাকে ভোর হওয়ার অপেক্ষায়।
গাছের গোড়াতেই গুঁজে রাখা, ভাঙা একখানা ঝাঁটা দিয়ে কী নিপুণ করে ঝাড়ু দেয়; রাস্তার কল থেকে ঘটি করে জল এনে ছিটিয়ে ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেয়, শান বা সিমেন্ট চটে বেরিয়ে আসা খোয়া-ধুলো। রাফিয়ার বড় বড় বস্তা বিছিয়ে এরা যখন সেই শক্ত জমিতে শোবার আয়োজন করে, ঘেউ ঘেউ থামিয়ে, তখনও তারা নির্বিকার বসে থাকে; এবার বড় একখান থান-ইটের ওপর জুতো জোড়া রেখে, তার ওপর গামছাটা কুণ্ডুলি পাকিয়ে বালিশ বানায়
সবচেয়ে মজা লাগে, রাস্তার কুকুরদের সঙ্গে ওদের ভাব দেখে। একটু চওড়া ফুটপাথের কোনও একটা ঝাঁকালো গাছের নীচটা বেছে নিয়ে, ওই গাছের গোড়াতেই গুঁজে রাখা, ভাঙা একখানা ঝাঁটা দিয়ে কী নিপুণ করে ঝাড়ু দেয়; রাস্তার কল থেকে ঘটি করে জল এনে ছিটিয়ে ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেয়, শান বা সিমেন্ট চটে বেরিয়ে আসা খোয়া-ধুলো। রাফিয়ার বড় বড় বস্তা বিছিয়ে এরা যখন সেই শক্ত জমিতে শোবার আয়োজন করে, ঘেউ ঘেউ থামিয়ে, তখনও তারা নির্বিকার বসে থাকে; এবার বড় একখান থান-ইটের ওপর জুতো জোড়া রেখে, তার ওপর গামছাটা কুণ্ডুলি পাকিয়ে বালিশ বানায়; প্রথম ঘুমের নাক-ডাকা আন্দাজ করেই গুটিগুটি উঠে আসা দু’তিনটে নেড়ি, লোকগুলোর গা ঘেঁষে জুত করে বসে ঘাড় গুঁজে ঘুমোয়। এদের চিৎকারেই সুরক্ষা পায় ঘুমন্ত লোকগুলো। সে সাপ- বিছে- মাকড়সাই হোক, অথবা রাতচরা পুলিশ বা গুন্ডা!
ঝাঁকালো গাছগুলোর ডালপালা ওদের চোখে আলো আড়াল করে। ওদের ওই ঘুমন্ত দেহটার ওপর লুটিয়ে থাকে, জ্যোৎস্না বা পাতাদের ছায়া। এরা কেউই বাঁ কিংবা ডান পাশে ফিরে ঘুমোয় না। লুঙ্গি-গামছা কোমর বা গায়ের থেকে সরে গেলেও ওরা কিন্তু টান-টান ঘুমিয়েই থাকে চিৎ হয়ে। অনেক সময় মুখগুলো অবশ্য হাঁ-হয়ে নাল গড়াতে থাকে কষ দিয়ে। কেউ কারও গায়ে পা-ও তোলে না আয়েশে; বা হাত লম্বা করে জড়িয়েও ধরে না পাশের জনকে।
আরও পড়ুন : এবারের নববর্ষ – ১৪৩১
রাস্তার আলোগুলো, রাত-ভোর জ্বলে থাকে; যে কোনও একটা জায়গা বেছে নিয়ে, আলোর নীচে দাঁড়িয়ে বা বসে, মিনি স্কেচ করে নিই। সকালে স্নান এবং ব্রেকফাস্ট করেই জল-রঙে দ্রুত কাজ সারি; বেশ লাগে দিনের আলোয় বসে, রাতে দেখা ঘুম আর ছায়ান্ধকারের ছবি আঁকতে। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে ফুটপাথ আঁকড়ে বিছিয়ে থাকা ঘুমন্ত মানুষদের গাদা গাদা ছবি, এঁকেই চলেছি সমানে।

৩
ইদানীং মা আমাকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে; বিরক্তও করে না। তবে, বাবা -মা দুজনেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানতে চায় যে রেপ, যৌনাচার এ-সমস্ত দেখেছি কি না! সেটা অবশ্য আমার বন্ধুদেরও প্রাথমিক প্রশ্ন! দাদুই শুধু ছবিগুলো দেখে; রং- রেখা বা কম্পোজিশন নিয়ে নানা মন্তব্য করে; একটা করে নাম দিয়ে নিজের ডায়েরিতে নোটও করে রাখে দাদু; রঙিন বা সাদা-কালো স্কেচগুলো জমা দেওয়ার আগে, দাদুর নির্দেশেই ম্যাট-ফিনিশড পেপারে প্রত্যেকটা ছবির প্রিন্টও নিয়ে রাখতে হয় আমাকে।
বয়স বেশি নয়; নিটোল স্বাস্থ্য; গায়ের চামড়া বাদামী; আপাতত ময়লা পড়ে পড়ে ছাতা ধরা। কেউ কাপড় পরিয়ে দিলেও, সে নাকি টান মেরে খুলে, ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কথা বলে না একটাও ; তাড়াও করে না কাউকে। কখনও আমের আঁটি, কখনও একটা কলা, কখনও বা অন্য কিছু খেতে খেতে ঘুরে বেড়ায়; চায়ের দোকানে এসে দাঁড়ালে, পাড়ার দোকানিরা তাড়াতাড়ি চা ধরিয়ে দিয়ে কুকুর তাড়ানোর মতো করে বিদায় করতে পারলে বাঁচে; চা -খেয়ে সেই কাগজের কাপটাকেও সে চিবোতে থাকে; একদিন তাকে দেখে মনে হল, সে যেন গর্ভবতী
রেপ প্রসঙ্গে মনে পড়ল, যাদবপুর অঞ্চলে দেখা এক উন্মাদ-মেয়ের কথা; রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় সম্পূর্ণ উলঙ্গ; বয়স বেশি নয়; নিটোল স্বাস্থ্য; গায়ের চামড়া বাদামী; আপাতত ময়লা পড়ে পড়ে ছাতা ধরা। কেউ কাপড় পরিয়ে দিলেও, সে নাকি টান মেরে খুলে, ছুঁড়ে ফেলে দেয়। কথা বলে না একটাও ; তাড়াও করে না কাউকে। কখনও আমের আঁটি, কখনও একটা কলা, কখনও বা অন্য কিছু খেতে খেতে ঘুরে বেড়ায়; চায়ের দোকানে এসে দাঁড়ালে, পাড়ার দোকানিরা তাড়াতাড়ি চা ধরিয়ে দিয়ে কুকুর তাড়ানোর মতো করে বিদায় করতে পারলে বাঁচে; চা -খেয়ে সেই কাগজের কাপটাকেও সে চিবোতে থাকে; একদিন তাকে দেখে মনে হল, সে যেন গর্ভবতী; কয়েক মাস যেতে না যেতেই বুঝলাম, আমার ধারণাটা অমূলক নয়। উন্মাদ, উলঙ্গ অথচ পূর্ণ-মাসের এক গর্ভিণী; রাতের আলোয় চরে বেড়াচ্ছে শহর- বসতের রাজপথ। পরে শুনেছি, রাস্তাতেই প্রসব হতে গিয়ে বাচ্চা-সমেত সে নাকি মারাও গেছে! আজও ভুলতে পারিনি সেই উলঙ্গ-উন্মাদিনীকে। জানি যে, পেন্সিল ধরলেই ড্রইংয়ে ফুটে উঠবে আসন্ন-প্রসবা উলঙ্গ মেয়েটিই। কিন্তু মনে হয়েছে, আমি অন্তত ওর লজ্জাটুকু ঢেকে রাখি!

৪
প্রোজেক্ট শেষ হলে, রমরম করে একটা প্রদর্শনী হল; দেশ-বিদেশে পাঠানোর জন্য প্রকাশ করা হল ‘কফি টেবল বুক’; সেই সঙ্গে চাকরিটাও পাকা হল আমার। দাদুর খুশি দেখে চোখে জল এসে গিয়েছিল সেদিন। এরপর আমার কাজের দায়িত্ব বদলে হল, জমা পড়া ছবিগুলোর ডকুমেন্টেশন করা। ফলে আমাকেও আর রাতে ঘুরে ঘুরে কেস খুঁজতে হয় না। তার থেকেও বড় যে লাভটা আমার হল, তা একরকম নিয়মিত ছবি আঁকার নেশা। মনোহর পুকুরের অফিস থেকে বেরিয়ে এ-রাস্তা ও-রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরি। লেক ফ্লাইওভার ক্রস করে আর একটু হাঁটলেই আমার বাড়ি, ইন্দ্রাণী পার্কের গায়ে। ফ্লাইওভারে দাঁড়িয়ে কত যে স্কেচ করি; স্কেচ করি লেকের ভেতর ঢুকেও। সেদিন লেক পেট্রল পাম্প ক্রস করতেই ফুটপাথের ওপর একটা ভরাট ছবি দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এখানে দাঁড়িয়ে লাইফ-স্টাডি করলে মারধোর খেয়ে যেতে পারি; একটা সিগারেট ধরিয়ে চেয়ে আছি উদাসীন ভঙ্গিতে। ফুটপাথের রেলিঙে হেলান দিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে বাচ্চা-কাচ্চা সমেত নানা বয়সের ছেলে-মেয়ে-বুড়ো-বুড়ি। ক্রিকেট ক্লাবের মাঠে এখনও চড়া রোদ; রোদ্দুর পড়েনি রোয়িং-ক্লাবের চত্বরেও। তারই মধ্যে একটা ঝাঁকালো রাধাচূড়ার নীচে, মাদুর পেতে আরাম করে শুয়ে আছে এক লাবণ্যবতী। ঢিলে সালোয়ারের পট্টিগুলো একটু উঠে গিয়ে চোখে পড়ছে তার দস্তার-নূপুরজোড়া; বালিশের বদলে একটা হাত মুড়ে মাথার নীচে; অন্য হাতটা কাঁধ থেকে লুটিয়ে রাখা, কোমর ছাড়িয়ে হাঁটুর একটু ওপরে। কিন্তু তার মাদুর-জুড়ে বিছিয়ে আছে হলুদ হলুদ ফুল; গায়ের ওপর টুপটাপ করে দু’একটা ঝরে পড়লেই সেটা সে উড়িয়ে দিচ্ছে, তার লুটিয়ে থাকা ডান-হাতটা দিয়ে; ওই হাত নাড়ানো দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, সে জেগে আছে। তার মুখটা যে কেমন, বোঝা যাচ্ছে না; কারণ তা রেলিঙের দিকে ফেরানো; তবে মাথার চুলগুলি নিপুণ ভাবে আঁচড়ে, চুড়ো করে গুটিয়ে একটা সস্তার ক্লাচার আটকানো; শুয়ে থাকার ভঙ্গিটা এতই বিন্যস্ত যে অবাক হতেই হয়! আর এ-ও কী আশ্চর্য যে, কেউ তাকে বিরক্ত করছে না; এমনকী হেঁটে যাওয়া পথচারীদের পায়ের ধাক্কাও লাগছে না তার গায়ে। ফুটপাথে শোয়া কোনও রমণীর এমন কুসুমিত – বিশ্রাম তো, কোনও আঁকা ছবিতেও দেখিনি! স্কেচ করতে যতটা সময় লাগত, তার থেকে অনেক বেশি সময় নিয়ে আমি শুধু দেখে গেলাম একটা ফ্রেম; সাড়ে-পাঁচখানা সিগারেট টেনে, সূর্য ডোবার মরা আলোয় বাড়ির পথ ধরলাম, নেশাগ্রস্তের মতো।
তারই মধ্যে একটা ঝাঁকালো রাধাচূড়ার নীচে, মাদুর পেতে আরাম করে শুয়ে আছে এক লাবণ্যবতী। ঢিলে সালোয়ারের পট্টিগুলো একটু উঠে গিয়ে চোখে পড়ছে তার দস্তার-নুপুরজোড়া; বালিশের বদলে একটা হাত মুড়ে মাথার নীচে; অন্য হাতটা কাঁধ থেকে লুটিয়ে রাখা, কোমর ছাড়িয়ে হাঁটুর একটু ওপরে। কিন্তু তার মাদুর-জুড়ে বিছিয়ে আছে হলুদ হলুদ ফুল; গায়ের ওপর টুপটাপ করে দু’একটা ঝরে পড়লেই সেটা সে উড়িয়ে দিচ্ছে, তার লুটিয়ে থাকা ডান-হাতটা দিয়ে
এই অফিসের জনাচারেক সহকর্মী-বন্ধু মিলে ‘Hunt’ নামে একটা গ্রুপ তৈরি করেছি; নতুন খোলা ‘Windy’ ক্যাফেতে আমাদের প্রথম প্রদর্শনী; সকলেই অন্তত তিনটে করে আঁকা দিয়েছে। দাদু সমানেই তাড়া দিলে কী আর হবে! কোনও ছবিই তো মনোমত হচ্ছে না। এ-দিন বাড়ি ফিরেই ক্যানভাস রেডি করে, ড্রয়িং শেষে রং চাপাতেই, তুলি থেকে ঝরে পড়তে লাগল রাধাচূড়া; মধ্যরাতে দাদুকে ঘুম থেকে তুলে, বসিয়ে দিলাম ছবিটার সামনে। ফ্রেম করে আমার আঁকা যে একটাই ছবি ঝুলল তার নাম – ‘The Frame’। ওই দিনই বিক্রি হয়ে গেল ছবিটা। টাকাটা পেয়ে দাদুর হাতে দিয়ে বললাম, যাদবপুর অঞ্চলের সেই উলঙ্গ-উন্মাদ-গর্ভিনীর কথা মনে করে, এর সবটা দিয়ে তুমি একটু ব্যবস্থা করে দাও-না, কিছু অনাথ মানুষদের খাইয়ে দেওয়ার।

৫
আমার মনের মধ্যে, এখন আর বিবস্ত্র নয় সেই উন্মাদিনী। আরাম করে শুয়ে আছে যে মাদুরে, তাতে ঝরে ঝরে পড়ছে হলুদ রঙের ফুল- রাধাচূড়া।
আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।