banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

কোভিড: ছোটগল্প

মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়

জানুয়ারি ২৩, ২০২১

Covid scare
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

দিগন্ত বিস্তৃত খাঁড়ি। যতদূর চোখ যায় ঘন ছাই-নীল জল ধীরে ধীরে মিশে গেছে প্রায় চারকোল-রঙা আর জায়গায় জায়গায় ফ্যাকাশে হয়ে আসা মেঘগুলোতে। ঠান্ডা কনকনে ভিজে হাওয়ায়, তীরের উঁচুনিচু এবড়ো খেবড়ো পাথরগুলোর একটাতে বসে আছে মেয়েটা। কোঁকড়ানো অবাধ্য চুলগুলো ছড়িয়ে আছে গালে, পিঠের ওপর।

নিজের হাঁটুর ওপর মুখ রাখা। অনেককাল বাদে অবাধ্য, অসহায় সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ চোখের জল লেগে যাচ্ছে জ্যাকেটে,  প্যান্টে। পাশে আর একটা পাথরের ওপর রাখা তার ব্যাকপ্যাক। শুধু ওইটুকু বোঝা-ই নামিয়ে রাখতে পেরেছে সে।

গতকাল রাত্রে ওয়ালমার্ট থেকে নাইট শিফট করে বেরনোর পথে ফ্র্যাংকের সঙ্গে দেখা। ফ্র্যাংক তখন তার দাদার গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল।

“লেক্সি, শুনেছ কথাটা?”

লেক্সি বড্ড ক্লান্ত। এক হাতে সাবওয়ে থেকে কেনা স্যান্ডউইচের প্যাকেট,  তার আর মায়ের ডিনার। বাড়ি গিয়ে স্নান সেরে আবার হোমওয়ার্ক নিয়ে বসতে হবে, কেমিস্ট্রি হোমওয়ার্ক বাকি আছে। এক হাত দিয়ে মাস্কটা নাকের একটু ওপরে ঠেলে ফ্র্যাংকের দিকে তাকিয়ে রইল সে।


[the_ad id=”266918″]



“আমি লে-আউটের ব্যারি আর ফার্নান্দেজের কাছে শুনলাম। আমাদের স্টোরে সাত জন পজিটিভ।”

লেক্সির পা দুটো কেউ যেন মনে হল সাইডওয়াকের ওপর আটকে দিয়েছে। এক মুহূর্তে যেন হাওয়া কমে গেল। শ্বাসকষ্ট হতে লাগল। হঠাৎ মনে পড়ল, আজ নানা ডিপার্টমেন্টে বেশকিছু চেনা মুখ দেখতে পায়নি। কিন্তু এত ব্যস্ততার মধ্যে খেয়ালও করেনি। কোথাও দেখা হয়নি কারও সঙ্গে সেভাবে।

“কী হল,  তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?”
“না ফ্র্যাংক, গুডনাইট। আর কিছু জানতে পারলে আমাকে…”
“নিশ্চয়ই।”

গাড়িতে উঠে চলে গেল ফ্র্যাংক। আগে দু’একবার লেক্সিকে তার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে দিয়েছে সে, কিন্তু এখন সময় অন্য। কেউ কারও গাড়িতে উঠবে না। হাঁটতে হাঁটতে লেক্সির বুকের মধ্যে ফিরে আসতে শুরু করেছে অনুভূতি, ব্রেনের মধ্যে বাজতে শুরু করেছে সাইরেন।কী করবে সে এখন?

লেক্সি বড্ড ক্লান্ত। এক হাতে সাবওয়ে থেকে কেনা স্যান্ডউইচের প্যাকেট,  তার আর মায়ের ডিনার। বাড়ি গিয়ে স্নান সেরে আবার হোমওয়ার্ক নিয়ে বসতে হবে, কেমিস্ট্রি হোমওয়ার্ক বাকি আছে।

চাবি খুলে ভেতরে ঢুকে একবার উঁকি দিয়ে দেখল শোবার ঘরে মা ঘুমোচ্ছে। ল্যাম্প জ্বালানো। সামনে টিভিতে রাত্রের খবর চলছে। জ্যাকেটটা খুলে দরজা এক চিলতে ফাঁক করে ব্যালকনিতে বার করে দিল লেক্সি। তারপর জামাকাপড় ছেড়ে একটা প্ল্যাস্টিক ব্যাগে ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে সরিয়ে রেখে,  গরম জলে ভাল করে স্নান করে ফেলল সে। মায়ের ঘরে গিয়ে সন্তর্পণে ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিল। থাক, ঘুমোক মা; এখন আর খেতে হবে না। মায়ের ঘরের দরজাটা বন্ধ করে যখন লেক্সি সোফায় বসল, তখন রাত প্রায় বারোটা। মোড়ক খুলে স্যান্ডুইচটা খেতে শুরু করল আর অনেকদিন বাদে খাবার ধাপগুলো মানে, চিবোনো, গেলা, এগুলো যেন অনুভব করতে পারল। ব্রেড, চিকেন, লেটুস, টোম্যাটো– সে চিবোচ্ছে ঠিকই, কিন্ত সবই যেন একটা দলা হয়ে আটকে যাচ্ছে গলায়। কোনওরকমে খাওয়া শেষ করে, অনেকখানি জল খেয়ে ল্যাপটপটা নিয়ে বসল সে কেমিস্ট্রির হোমওয়ার্ক বের করে। দৃষ্টি সম্পূর্ণ শূন্য তার। মাথা যন্ত্রণায় ঝনঝন করছে। পাক খাচ্ছে একটাই প্রশ্ন– কী করবে সে এখন?

মায়ের সিওপিডি  আছে। তার সঙ্গে ইস্কেমিক হার্ট। কী করবে সে? মাকে বাঁচাতে গেলে হয় তাকে সরতে হবে এই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে অথবা মাকে সরাতে হবে। হে ঈশ্বর, সে সময় আছে তো এখনও? বেশ খানিকক্ষণ কম্পিউটার স্ক্রিনের দুর্বোধ্য লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওইভাবেই ঘুমিয়ে পরল লেক্সি।

সকালে উঠে লেক্সি পরপর কয়েকটা ক্লাস করল। তাদের অ্যাপার্টমেন্টটা বড্ড ছোট, অনলাইন ক্লাস চললে মা এদিকে বড় একটা আসেন না। একটু বেলায় মা তার সামনে আগের দিনের রান্না করা খানিকটা রাইস আর বিনস একটা প্লেটে দিয়ে, তার দিকে চেয়ে একটু হেসে নিজের ঘরে চলে গেলেন। ক্লাস শেষ হলে সে উঠে একটা যন্ত্রের মতো বাথরুম, কিচেন,  লিভিং রুমের প্রতিটি জিনিস পরিষ্কার করা শুরু করল ব্লিচ সলিউশন বানিয়ে। মা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

গাড়িতে উঠে চলে গেল ফ্র্যাংক। আগে দু’একবার লেক্সিকে তার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে দিয়েছে সে, কিন্তু এখন সময় অন্য। কেউ কারও গাড়িতে উঠবে না।

“কী করছিস? এখন এসব শুরু করলি কেন? উইকেন্ডে করতাম?”
মায়ের বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “পুরোটা করছি না, আমি বেরিয়ে গেলে তুমি বেডরুমটা পরিষ্কার করে নিও।”

ক্লাস চলাকালীনই সে খবর পেয়ে গেছে  তাদের ওয়লমার্টে এগারো জন কর্মী কোভিড পজ়িটিভ।


[the_ad id=”266919″]



যদিও লেক্সি জানত ওয়ালমার্ট বন্ধ,  তবু ওখানেই পৌঁছল সে… নির্দিষ্ট সময়ে,  যেমন পৌঁছয়। শরীরের ঘড়িটা কেমন অভ্যস্ত হয়ে গেছে,  ঠিক এই সময়টাতে তার কাজে পৌঁছনোর কথা|  একটা বেঞ্চে এসে বসে সে। কাঁধ দুটো টনটন করছে। এবার ফোনটা করতেই হবে। ফোনটা বার করে, ধীরে ধীরে মুখের মাস্কটা সরিয়ে ফেলে, কিন্তু ফোন করার বদলে ফোনটার দিয়ে তাকিয়ে থাকে। অনেকক্ষণ।

কত বছর হয়ে গেল নিজের দায়িত্ব সে নিজে নিয়েছে। সঙ্গে মায়ের দায়িত্বও। বাবা ঝগড়াঝাঁটি করে আলাদা হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর আগে,  সে তখন এলিমেন্টারি স্কুলে। সেই থেকে যুঝছে লেক্সি। বাবার টাকাপয়সা নিয়মিত না দেওয়া,  অভাব, মায়ের শরীর খারাপ;  কবে থেকে তার আর মনে পড়ে না যে সে-ই সিদ্ধান্ত নেয়  মা আর সে কী খাবে। ওয়লমার্টে কাজ শুরু করার পর থেকে ডিসকাউন্ট, ক্লিয়ারেন্স সেলে কেনা গ্রসারি,  ফেরার সময় সাবওয়ে থেকে কেনা স্যান্ডউইচ, যেহেতু বন্ধু জিনা এমপ্লয়ি ডিসকাউন্ট পায়। একসময় ভীষণ সিগারেট খাবার কারণে মায়ের সিওপিডি। বিশেষ ভারী কাজ করতে পারেন না,  অত্যন্ত সাবধানে থাকতে হয়। লেক্সির বন্ধুর সংখ্যা সীমিত,  মেলামেশা করার সময়ই নেই। উইকেন্ডের দু’দিনই সে কাজ করে। স্কুল আর কাজ– এটাই তার পৃথিবী।

আজ এই শ্বাসবন্ধ হয়ে আসা আশংকা আর আতঙ্কের সময়ও তার মস্তিষ্ক অঙ্ক  করে চলেছে নির্ভুল। তার বাবার এখনকার গার্লফ্রেন্ড আর বাবার ছোট একটা ছেলে সবে কিন্ডারগার্টেনে। খুব কম দেখাসাক্ষাৎ হয় ওদের সঙ্গে। কিন্তু লেক্সি জানে বাবার গার্লফ্রেন্ড সারা-র মা মারা যাবার পর ওদের বাড়ির বেসমেন্টটা খালি; ওখানে একজন থাকতে পারে। তার জোর করে বড় হয়ে যাওয়া সতেরো   বছরের মনটার প্রত্যেকটা আত্মাভিমানী তন্ত্রী বিদ্রোহ করছে– কিন্তু এই ফোনটা না করে তার উপায় নেই। মাকে বাঁচতে গেলে তাকে কোথাও সরে যেতেই হবে। আর বাবার কাছে সাহায্য চাওয়া ছাড়া এই মুহূর্তে তার আর কোনও উপায় নেই।

একটু বেলায় মা তার সামনে আগের দিনের রান্না করা খানিকটা রাইস আর বিনস একটা প্লেটে দিয়ে, তার দিকে চেয়ে একটু হেসে নিজের ঘরে চলে গেলেন। ক্লাস শেষ হলে সে উঠে বাথরুম, কিচেন,  লিভিং রুমের প্রতিটি জিনিস পরিষ্কার করা শুরু করল।

ফোনটা জ্যাকেটের পকেটে রেখে হাঁটতে শুরু করে লেক্সি। সমুদ্রের খাঁড়ির ধারে শহর তাদের। জল বেশ খানিকটা ঢুকে এসেছে কোনও কোনও জায়গায়। একটা ছোট্ট বনের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায়  ছোটবড় পাথরে ভরা জলের ধারের  এই জায়গাটায়। এ জায়গাটা বড় প্রিয়, অনেক স্মৃতিমাখা। খুব ছোটবেলায় বাবা, কাকার সঙ্গে মাছ ধরতে আসত লেক্সি। বড় হয়েও চলে আসে কারণে- অকারণে। এটা তার নিজস্ব ওয়েসিস।

নাহ,  শেষপর্যন্ত বাবাকে ফোনটা আর করেনি লেক্সি।

কেন করেনি?  এখন মনে হচ্ছে, উত্তরটা কী হবে সে জানত। আর সেটা বাবার মুখ থেকে শুনতে চায়নি। তাই টেক্সট করেছিল।

“হাই ড্যাড।” সঙ্গে সঙ্গেই উত্তরটা এল।
 “হাই লেক্স! কেমন আছ? মম? আমি একটু আগেই ওয়লমার্টের খবরটা পেলাম। তোমরা ঠিক আছ তো?”

শব্দগুলোর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল লেক্সি। শব্দগুলোর মধ্যে কতকাল বাদে সত্যিকারের কিছু যেন ছুঁতে পারছে সে…। কী সেটা? উদ্বেগ? ভিতরে আনন্দের ছোট্ট একটা গরম বাবল ভুশ করে ভেসে উঠল যেন…

“ইয়া ড্যাড, আমরা ঠিক আছি।” তারপর একটু সময় নিয়েছিল সে, নিজেকে গুছিয়ে নিতে।
“ড্যাড, তুমি তো মায়ের শরীরের অবস্থা জান।গতবছর থেকে আমাদের ইনশিওরেন্স নেই। আমি জানি না শরীর খারাপ হলে কোথায় যাব। কোথায় কোভিড টেস্ট করব। জাস্ট ভাবছিলাম, আমি কি কয়েকদিনের জন্য তোমাদের বেসমেন্টে এসে থাকতে পারি? তোমাদের বেসমেন্টটা তো একদম সেপারেট। মায়ের কথা ভেবেই। তাহলে মায়ের কাছ থেকে কয়েক সপ্তাহ দূরে থাকতে পারব।”


[the_ad id=”270084″]



ওপারে বেশ কিছুক্ষণের স্তব্ধতা।

“লেক্স, আমার মনে হয় তুমি তোমার ওয়লমার্টের বন্ধুদের জিজ্ঞাসা কর। ওরা কোভিড টেস্ট করল কোথা থেকে।ওয়লমার্টের তো একটা রেসপনসিবিলিটি আছে! যত তাড়াতাড়ি হয়,  টেস্টটা তো করানো দরকার।লেক্সি আমাদের বেসমেন্টে তো ট্রয়ের সব খেলনা আর গাড়িতে ভর্তি। ওটাই তো ওর জায়গা। আর ও নীচে থাকলে তবেই সারা ওর স্কুলের অনলাইন ক্লাস করাতে পারে। ট্রয় যে বড্ড ছোট।”
“নো প্রব্লেম ড্যাড। ইটস ফাইন।”
“হোপফুলি ইউ উইল আন্ডারস্ট্যান্ড।… ট্রয় বড্ড ছোট লেক্সি।”
“নো প্রব্লেম।”

টেক্সটগুলো আবার পড়ল লেক্সি। মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেলে দিল। ট্রয় সত্যিই খুব ছোট। ওর বাবা-মা তো ভয় পাবেই, সেটাই স্বাভাবিক। কোভিড নামটাতেই তো আতঙ্ক!

তার বাবার এখনকার গার্লফ্রেন্ড আর বাবার ছোট একটা ছেলে সবে কিন্ডারগার্টেনে। খুব কম দেখাসাক্ষাৎ হয় ওদের সঙ্গে। কিন্তু লেক্সি জানে বাবার গার্লফ্রেন্ড সারা-র মা মারা যাবার পর ওদের বাড়ির বেসমেন্টটা খালি

ছোটবেলা থেকে  যা যা তার সঙ্গে হয়ে এসেছে,  কেন সেটা হচ্ছে,  কাকে দোষারোপ করবে, সেটা ভাবার অবকাশ আর বিলাসিতা ছিল না লেক্সির। একটার পর একটা সমস্যা এসেছে, বক্সিং রিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত বক্সারের মতো একটানা অনর্গল আঘাত পেতে পেতে শিখে গেছে কীভাবে নিজেকে ডিফেন্ড করা যায়। বেঁকিয়ে চুরিয়ে, নিচু হয়ে। কিন্তু সে জানে, ওই রিংটা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কোনও উপায় তার নেই। সমস্যা এলে কীভাবে সমাধান করা যায়, সেটাই তাকে করে যেতে হবে আজীবন।

আজ অনেককাল পর তার মনে হচ্ছে, সে মাটিতে শুয়ে পড়েছে, উঠতে পারছে না, আর ওঠার যেন কোনও ইচ্ছেও নেই। এতক্ষণে তার চোখের জলের ধারা বেয়ে সমস্ত দুশ্চিন্তা,  আতঙ্ক ছাপিয়ে যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে অভিমান। কিশোরী মেয়ের দুর্মর অভিমান। একবারও কি তার জন্য কেউ ভাবতে পারে না? কেন মাকে বাঁচানোর চিন্তা, নিজেকে বাঁচানোর চিন্তা শুধু তাকেই করে যেতে হবে? কেন সে এত একা? এত একা…। লেক্সির চোখ দুটো আসে আস্তে বন্ধ হয়ে আসে।

“লেক্সি লেক্সি লেক্সি…”

অনেকদূর থেকে ভেসে আসছে ডাকটা। আধো-তন্দ্রায় ঝাপসা চরাচর। লেক্সির একটু সময় লাগল চেতনায় ফিরতে। আবার ডাক। না, গলাটা চেনা নয় তো। পাথরভরা জায়গাটা একটু দূরে যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে একটা ছোট বিচ… এপ্রিলের এরকম ঠান্ডা দিনে এমনিতেই বিশেষ কেউ আসে না, আর এখন তো এদিক ওদিক পরে থাকা সি-উইড ছাড়া তেমন কিছুই নেই। সেখানেই দেখতে পেল দলটাকে। দু’জন মহিলা, একজনের হাত স্ট্রলারের হাতলে। সঙ্গে দুই কিশোর-কিশোরী। সেখান থেকেই কেউ একজন ডাকছে তার নাম ধরে। হাওয়ায় কেমন ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে শব্দগুলো।


[the_ad id=”270085″]



হঠাৎ করে কাছেই একটা পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল মেয়েটা। একরত্তি মেয়ে। পার্পল জ্যাকেট, কানঢাকা পশমের টুপির পাশ দিয়ে বেরিয়ে আছে কোঁকড়ানো অবাধ্য চুল। হাতে একটা বোতল, যা ওর ছোট্ট শরীরের তুলনায় বেশ বড়। ভাল করে খেয়াল করে লেক্সি দেখল সেটা একটা বিরাট স্যানিটাইজ়ারের বোতল। এতক্ষণে মেয়েটা দেখতে পেয়েছে তাকে। মাস্কের ওপর বড় বড় দুটো চোখ। লেক্সিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মেয়েটা জলের ধারে একটা পাথরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর পাথরের ওপর বেশ খানিকটা স্যানিটাইজ়ার ঢেলে মুছতে শুরু করল।

“কী করছ?” লেক্সি শুধোল।
“ক্লিন করছি। তারপর বসব।”

লেক্সির বেশ মজা লাগল। মেয়েটার মধ্যে সে তার ছোট্টবেলার ছায়া দেখতে পাচ্ছে। তাদের কমিউনিটির মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে  শিখে যায়। হয়তো অনেক ভাইবোনের একজন বলে অথবা হয়তো মা-বাবার ব্যস্ততার কারণে! সেই বিরাট স্যানিটাইজ়ারের বোতলটা পাশে রেখে বসল মেয়েটা।

ড্যাড, তুমি তো মায়ের শরীরের অবস্থা জান।গতবছর থেকে আমাদের ইনশিওরেন্স নেই। আমি জানি না শরীর খারাপ হলে কোথায় যাব। কোথায় কোভিড টেস্ট করব।

“তোমার নাম লেক্সি?”
“হ্যাঁ।”
“আমারও।”

মেয়েটা একবার তার দিকে তাকিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে নিল। বেশ নীচ দিয়ে আওয়াজ করতে করতে উড়ে গেল দুটো সিগাল, ওর চোখ সেইদিকে। চারদিক প্রায় শব্দহীন; দূর থেকে ভেসে আসছে ওরই বাড়ির লোকেদের টুকরো টুকরো কথার  আওয়াজ। আর কাছে পাথরের গায়ে জলের মৃদু ছলাৎ ছলাৎ।

মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল লেক্সি অপলক। মাত্র দু’মাসে কীভাবে বদলে গেছে ওদের ছোট্ট পৃথিবী। কীভাবে পাল্টে গেছে বাচ্চাগুলো।যদি পরিস্থিতি না বদলায়, এইভাবেই স্কুলে ফিরবে ওরা। বন্ধুদের কাছে যাবে না,  খেলবে না, একে অন্যের গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়বে না,  খাবার ভাগ করে খাবে না, একসঙ্গে ক্রাফট করবে না, পাশাপাশি বসবেও না। যা ওরা বিন্দুমাত্র বোঝে না, সেরকম এক না-দেখা আতঙ্ক ওলটপালট করে দিয়েছে সবকিছু। যদি ঠিক না হয় এই মহামারী, এইভাবে বড় হবে ওরা? এরকম সতর্কতায়, দূরত্বে, কারওর হাসি না দেখে, কাউকে না ছুঁয়ে শুধু প্রত্যেক মুহূর্তে নিজেকে জীবাণুমুক্ত রাখার সচেতনতায়? এইভাবে?

একঝলকে যেন তার স্কুল থেকে গ্রেড ফাইভে যাওয়া ক্যাম্পিং ট্রিপের একটা ছবি ভেসে এল চোখে। মাঝরাত। চারদিকে জঙ্গল-পাহাড় থেকে রাত্রে ঝিঁঝির আওয়াজ, বেশ কিছুক্ষণ আগে মিস ডিরিমার দেখে গেছেন, ছোট্ট লগ কেবিনে তারা চারজন ঘুমন্ত। এখন তারা তিন বন্ধু, ঘুমন্ত চতুর্থ বন্ধুর সঙ্গে নিয়ে আসা স্ন্যাক্স থেকে কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে, চিপস, ক্যান্ডি, কুকিজ়। গোগ্রাসে। তার সঙ্গে শব্দহীন দুষ্টু  হাসি। কারও গলায় আটকালে মুখ থেকে প্রায় ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে জলের বোতল। সবাই গাদাগাদি করে বাঙ্ক-বেডের একটা বিছানায়।

কী সাধারণ, কী স্বাভাবিক সময়! সেটা ফিরবে না আর? দেখতে পাবে না এরা?

“লেক্সি লেক্সি…”

 ডাক এল আবার ছোট্ট লেক্সির জন্য। উঠে দাঁড়াল সে। ছোট্ট হাত দিয়ে একবার মাস্কটা ঠিক করে, এক হাতে স্যানিটাইজ়ারের বোতলটা ধরে এবার এবড়োখেবড়ো পাথরের ওপর দিয়ে টলমল পায়ে ফিরে চলল ছোট্ট কন্যা। হোঁচট খেয়ে পড়ল না একবারও! 

উঠে পড়ল লেক্সিও। কোলের ওপর পড়ে থাকা মাস্কটা তুলে নিল। গালে এখনও নোনতা জলের দাগ। মুছে ফেলে আস্তে আস্তে। পিঠে তুলে নেয় ভারী ব্যাকপ্যাকটা। হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ল, মায়ের এক বন্ধুর কাছ থেকে শুনেছে যে তাদের পাশের  টাউনে দুটো হোটেল খুলে দেওয়া হয়েছে; তাদের মতো ছোট জায়গায় থাকা মানুষদের কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য। সে চেষ্টা করবে, ওখানে জায়গা পাবার।

এতক্ষণে মেয়েটা দেখতে পেয়েছে তাকে। মাস্কের ওপর বড় বড় দুটো চোখ। লেক্সিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মেয়েটা জলের ধারে একটা পাথরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

মায়ের বন্ধু আলিসা মানুষটা খুব উপকারী, নিশ্চয়ই চেষ্টা করবে ওদের জন্য। স্থানীয় চার্চের সঙ্গে কথা বলে ক’দিন খাবার ডেলিভারি করানো যাবে না মায়ের জন্য? স্কুল থেকেও তো বারবার বলে, যে কোনও প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে, স্কুলের কাছে অনেক রিসোর্স আছে। তবে সবার আগে কোভিড টেস্টিং। লেক্সির মাথায় ফিরে আসছে অঙ্ক, পরপর। কিছু একটা উপায় বার করতেই হবে। মাস্কটা গারবেজ বিনে ফেলে দিয়ে স্যানিটাইজ়ার দিয়ে হাত পরিষ্কার করল সে। ছড়িয়ে পড়া চুলগুলো বাঁধতে বাঁধতে অজান্তেই মুখে হাসি খেলে গেল লেক্সির। এই হাসি বোধহয় ষোলো-সতেরোরাই হাসতে পারে।


[the_ad id=”270086″]



লেক্সির চোখের সামনে ভেসে উঠল, মুখে মাস্ক পরে হাতে স্যানিটাইজ়ারের বোতল নিয়ে  পাথরের ওপর দিয়ে টলমল করে চলা একটা ছোট্ট মেয়ে। শেষ সূর্যের আলোয় তার কোঁকড়ানো চুলের চারপাশে একটা বলয় তৈরি হয়েছে যেন! না, একবারও পড়ে যায়নি সে। না-দেখা ভয়ের সঙ্গে লড়াইয়ের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেছে। একাই।

সামনে অর্ধেক চাঁদের মতো চেনা রাস্তা বেঁকে গেছে জলের ধার দিয়ে। রাস্তায় জ্বলে উঠেছে ল্যাম্পপোস্টের আলো। জ্যাকেটের হুডটা মাথায় তুলে নিয়ে, হাতদুটো পকেটে পুরে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল লেক্সি।

জন্ম, বড় হয়ে ওঠা কলকাতায়। গত একুশ বছর ম্যাসাচুসেটস,আমেরিকা প্রবাসী। বাংলা সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক। এখন পর্যন্ত লেখা বেরিয়েছে ওয়েব ম্যাগাজিন পরবাসে এবং আনন্দবাজারে।

3 Responses

    1. অপূর্ব লেখা। Covid – এর সময়ের অনিশ্চয়তা, চিন্তা ও পরিস্থিতি যুঝে বিজয়ী হওয়ার অদম্য জীবনী শক্তি সব অনুভূতি আছে। The have-nots have been hit harder. Only a teenager can show the resilience that Lexi shows!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

[adning id="384325"]
[adning id="384325"]

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com