নভেল করোনাভাইরাসের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর হার যত বাড়ছে, তত শোনা যাচ্ছে একটি অপরিচিত শব্দবন্ধের ব্যবহার। কো-মর্বিডিটি। এবং এই কো-মর্বিডিটি নিয়ে বিতর্কেরও শেষ নেই। শরীরে কোন কোন রোগ থাকলে রোগীকে কো-মর্বিডিটি ফ্যাক্টরের আওতায় ফেলা হবে, আর কী কী ক্ষেত্রে হবে না, তা নিয়ে প্রশ্নও উঠছে বিস্তর। এরমধ্যে ডায়াবিটিসের ভূমিকা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। শহরের অন্যতম নামকরা ডায়াবেটোলজিস্ট ও এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ডঃ তীর্থঙ্কর চৌধুরী তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি আলাপচারিতায় শর্মিলা বসুঠাকুর।
শর্মিলা – কো-মর্বিডিটি বলতে কী বোঝাচ্ছে?
ডঃ চৌধুরী – কো-মর্বিডিটি বলতে সাধারণতঃ নানা ধরনের ক্রনিক অসুখকে বোঝায়। যেমন, হার্টের সমস্যা, ফুসফুসের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, এবং অবশ্যই ডায়াবিটিস। এ ছাড়াও আরও কিছু অসুখবিসুখও তালিকায় আসতে পারে। তবে প্রধানত এই ক’টিই।
শর্মিলা – ডায়াবেটিস ও করোনা-র সম্পর্ক নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা। তার আগে জেনে নিই, কো-মর্বিডিটি থাকলে করোনা মারাত্মক আকার ধারণ করছে কেন?
ডঃ চৌধুরী – প্রথমেই বলি, করোনাভাইরাস রোগ হিসেবে আমাদের কাছে, মানে চিকিৎসকদের কাছেও কিন্তু নতুন। ধীরে ধীরে এর চরিত্র, গতিবিধি, আমাদের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। একে আমরা বলি ‘ইভলভিং নলেজ।’ নানা ভাবে শরীরের নানা অংশ আক্রান্ত হচ্ছে। কখনও নিউমোনিক লাইক সিচুয়েশন তৈরি হচ্ছে। আবার কখনও কার্ডিওভাস্কুলার সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়াও দেখা যাচ্ছে, এই ভাইরাস মিউটেট করছে। খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, বিদেশের তুলনায় ভারতে করোনার নেচার অফ ইনফেকটিভিটির ভয়াবহতা তুলনায় কম। মানে বলতে চাইছি, ভাইরাসটি সাঙ্ঘাতিক ভাবে ছোঁয়াচে ঠিকই, কিন্তু এখানে ফেটালিটি তত নয়। এখনও গবেষণা চলছে। ভ্যাক্সিন বেরলে নিশ্চয়ই এর সুরাহা হবে।
শর্মিলা – ডায়াবিটিকদের ক্ষেত্রেই করোনা মারাত্মক আকার নিচ্ছে কেন?
ডঃ চৌধুরী – ডায়াবিটিসই যেহেতু আমার গবেষণা ও কাজের ক্ষেত্র, তাই এটা নিয়ে একটু বিশদে বলতে চাই। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার লক্ষ করতে হবে। যাঁদের ডায়াবিটিস আছে, করোনা আক্রান্ত হলে তাঁদের মেটাবলিক ডিসফাংশন মারাত্মক পর্যায়ে যেতে পারে। আবার যাঁদের সেই অর্থে ডায়াবিটিস নেই, বা বর্ডারলাইন বলা চলে, তাঁরা এই রোগে আক্রান্ত হলে তাঁদের প্রোপেনসিটি টু ডায়াবিটিস বাড়তে পারে। অর্থাৎ, তাঁদের ডায়াবিটিস হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। প্রশ্ন হল, তাহলে কি করোনার জন্য ডায়াবিটিস বাড়ছে? এখানে করোনা ও ডায়াবিটিসের বাই-ডিরেকশনাল নেচারটা বোঝা দরকার। অর্থাৎ যাঁদের আগে থেকেই ডায়াবিটিস রয়েছে, তাঁরা করোনা আক্রান্ত হলে মেটাবলিক ডিসফাংশান খুব বেড়ে যায়। আবার করোনা হলে, ডায়াবিটিস হবার আশঙ্কা থেকে যায়।
শর্মিলা – তাহলে কি বলা যায়, করোনা ডায়াবিটিস ডেকে আনে?
ডঃ চৌধুরী – সঠিক ভাবে বলা মুশকিল। তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়, গ্লুকোজ মেটাবলিজম-কে কোভিড নিশ্চিত ভাবেই বিপর্যস্ত করে।
শর্মিলা – তাহলে কোভিডের ফলে যাঁরা ডায়াবিটিস-আক্রান্ত হলেন, করোনামুক্ত হওয়ার পরেও কি ডায়াবিটিকই থেকে যাবেন?
ডঃ চৌধুরী – এটা খুবই মূল্যবান প্রশ্ন হলেও এর উত্তর এখনই সঠিক ভাবে বলা যাচ্ছে না।
শর্মিলা – ডায়াবিটিসের রোগীদের এই সময়ে বিশেষ কী সতর্কতা নেওয়া দরকার?
ডঃ চৌধুরী – প্রথম কথা, নিজের ব্লাড সুগার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিয়মিত ওষুধ খাওয়া, ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া, খাওয়াদাওয়ার নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা, সেলফ মনিটরিং – এগুলো খুব জরুরি। ভিটামিন সি খাওয়া যেতে পারে। এছাড়া মাস্ক-স্যানিটাইজার নিয়মমাফিক ব্যবহার করতে হবে। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং এবং হাত ধোওয়ার অভ্যাস কঠোর ভাবে মেনে চলতে হবে। মাস্ক শুধু ব্যবহার করলেই চলবে না, ব্যবহারবিধি মনে রাখতে হবে। আমাদের বিপুল জনসংখ্যার কথা মাথায় রেখে এইসব মৌলিক সাবধানতা মেনে চলতেই হবে। এর কোনও বিকল্প নেই। একটা কথা বলি, হাই সুগার ইন্ডিপেন্ডেন্ট রিস্ক ফ্যাকটর। কাজেই আনকন্ট্রোলড ডায়াবিটিসের রোগী করোনা-আক্রান্ত হলে বিপদ যে বহুগুণ বেড়ে যাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে, যে যে সতর্কতার কথা বললাম, তা মেনে চললে বিশেষ একটা ভয় নেই।
শর্মিলা – বর্তমান পরিস্থিতিতে ডিপ্রেশন ঘিরে আছে প্রায় সকলকেই। ডায়াবিটিসের সঙ্গে ডিপ্রেশনের কি কোনও সম্পর্ক রয়েছে?
ডঃ চৌধুরী – খুব ভালো প্রশ্ন। যে কোনও ক্রনিক অসুখের রোগীর ক্ষেত্রেই একটা ‘ভালো না-লাগা’ জড়িয়ে থাকে। ডায়াবিটিসের রোগীদের আমরা সব সময় বোঝাতে চাই যে নিয়মিত ওষুধ খেলে এবং লাইফস্টাইল ঠিক রাখলে, আর পাঁচটা মানুষের মতোই তিনি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে, সামগ্রিক বাতাবরণই যেখানে অত্যন্ত ডিপ্রেসিং, সেখানে ডায়াবিটিকরা তো বটেই, সকলের জন্যই বলব, পরিবারের সঙ্গে যতটা পারা যায় মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করুন। পারস্পরিক ইন্টার-অ্যাকশন যত বেশি থাকবে, তত মানসিক বাতাবরণও সজীব থাকবে।
সাংবাদিক, প্রশিক্ষিত নৃত্যশিল্পী ও নৃত্যসমালোচক। দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন সানন্দা পত্রিকা। যদিও কর্মজীবনের শুরু হয়েছিল দর্শনের অধ্যাপনা দিয়ে। পরে প্রাণের তাগিদে সাংবাদিকতাকেই পাকাপাকি ভাবে বেছে নেন। অবসর নেওয়ার পরও তুমুল ব্যস্ত। রান্নাবান্না, বেড়ানো, সাজগোজ নিয়ে অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতেই থাকে। ভালোবাসেন বই পড়তে, ভালো সিনেমা দেখতে আর খাওয়াতে। নিবিড় ভাবে বিশ্বাস করেন ভালো থাকায়, জীবনের রোম্যান্টিকতায়।