banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

দূরদর্শনের কথা বলা পুতুল মাইকেল ও তার স্রষ্টা প্রবীরকুমারের কথা

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

১৯৭৫ এর ৯ অগাস্ট কলকাতা দূরদর্শন শুরু হওয়ার দিনে চিচিংফাঁক অনুষ্ঠানে ছিল কথাবলা পুতুল মাইকেল আর প্রবীরকুমারের ‘ মাইকেলের আসর’। ছোটবড়র এই মন জয় করা অনুষ্ঠানটি একটানা চলেছিল ১৯৯৫ পর্যন্ত। সেই হিসেবে আজ ৯ অগস্ট ২০২০ মাইকেলের ৪৫ বছর।

সাতের দশকের শেষ থেকে আটের দশকের শুরু– এই সময়টায় কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালিবাড়ির যে সমস্ত ছেলেমেয়ে তাদের ছোটবেলা কাটিয়েছে, তাদের কাছে সাদাকালো দূরদর্শনের ‘চিচিং ফাঁক’ অনুষ্ঠানটির আকর্ষণ যে কতটা ছিল, তা হয়তো আজ ঠিক পুরোপুরি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ‘চিচিং ফাঁক’ ছিল ছোটদের কাছে এক জ্যান্ত রূপকথার সিংদরজা।

আর এই অনুষ্ঠানেই প্রথম পর্দায় দেখা মেলে এক কথাবলা পুতুলের, যে আমাদের মতো খুদেদের সঙ্গে অবিকল মানুষের মতো গল্প করে যেত। ওই পুতুলের নাম ছিল মাইকেল। আর চিচিং ফাঁকের সেই বিশেষ অনুষ্ঠানটির নাম ছিল ‘মাইকেলের আসর’। সেই অনুষ্ঠানে মাইকেল, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা-পরা, চওড়া গোঁফওলা এক ছিপছিপে মানুষের কোলে বসে কথাবার্তা বলত। দেখে মনে হত সেই ভদ্রলোক বোধহয় মাইকেলের কাকা। অনুষ্ঠানের মধ্যেই পর্দায় তাঁর নাম ভেসে উঠত– প্রবীরকুমার।
আমার মতো ছোটরা কিন্তু প্রবীরকুমারকে নিয়ে তখন একদমই মাথা ঘামাত না। প্রবীরকুমার আছেন — তো আছেন। মাইকেল কোনও কিছু বুঝতে না-পারলে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রবীরকুমারের কাছ থেকে বিষয়টা জেনে নিত। ছোটরা মাইকেলকে গান শোনাত, নাচ দেখাত, কবিতা শোনাত। প্রবীরকুমারও সেসব হাসিমুখে দেখতেন। আর মাইকেল খুশি হয়ে বলে উঠত– ফ্যান্টাসটিক্!

মাইকেল ও অন্য দুই কথা বলা পুতুলের সঙ্গে প্রবীরকুমার

খুদে বন্ধুরা মাইকেলকে নানান উপহার দিত। কেউ বিস্কুট, কেউ চকোলেট, কেউ হাতে-আঁকা ছবি। প্রবীরকুমারই হাত বাড়িয়ে সেইসব উপহার নিতেন। একবার মাইকেল আমাদের ভবানীপুরের মিত্র ইস্কুলে এল প্রবীরকুমারের সঙ্গে। আমি ওর জন্যে নিজের হাতে একটা গ্রিটিংস কার্ড এঁকে নিয়ে গিয়েছিলাম, আর একটা ছোট্ট চকোলেট। ওর হয়ে প্রবীরকুমারই সেটা নিয়েছিলেন। মাইকেল ঘাড় নেড়ে বলে উঠেছিল– বা বা, বা বা, খুব সুন্দর! থ্যাংক ইউ!! স্কুলের হল-ঘরে একদম সামনে থেকে দেখেছিলাম মাইকেলকে। একবারও মনে হয়নি সে জ্যান্ত নয়, শুধু একটা পুতুল, তার হয়ে অন্য কেউ কথা বলে। অথচ বাস্তবে সেটাই ঘটত– কিন্তু আমরা কিচ্ছু বুঝতে পারতাম না।

আর কী করেই বা বুঝব! মাইকেলের হয়ে কথা বলবার সময় প্রবীরকুমারের তো এক-ফোঁটাও ঠোঁট নড়ত না!! এর বেশ কিছুদিন পরে সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্প ‘ভুতো’ পড়ে জানতে পারলাম, পুতুলকে কথা বলানোর এই বিদ্যাটিকে ভেন্ট্রিলোকুইজম বলে। শুদ্ধ বাংলায় যা হল স্বরক্ষেপণ।

ছোটদের মাঝখানে প্রবীরকুমার

এরপর অনেকগুলো বছর কেটে গিয়েছে। আমরা ভবানীপুরের পাট চুকিয়ে কুঁদঘাটে চলে এসেছি। আর সেখানে এসে একদিন পূর্ব পুটিয়ারি বাজারে আমার সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল মাইকেলের স্রষ্টা প্রবীরকুমারের। ওঁর পুরো নাম প্রবীরকুমার দাস। প্রথমটায় চিনতে পারিনি। চেহারা আগের চেয়ে একটু ভারী। নাকের নিচে মোটা গোঁফজোড়া নেই। চওড়া ফ্রেমের চশমার বদলে চোখে রিমলেস। মাথার ঢেউ খেলানো চুলটাও যেন একটু পাতলা। কিন্তু যেটা একসুতোও পাল্টায়নি সেটা ওঁর হাসি আর ওই কণ্ঠস্বর। আমি বাজারের মধ্যেই ওঁকে প্রায় জড়িয়ে ধরতে গিয়ে, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে ঝপ করে ওঁর হাতটা চেপে ধরেছিলাম। জিগ্যেস করেছিলাম মাইকেলের কথা। প্রবীরদা আমায় ওঁদের কুঁদঘাটের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে বের করেছিলেন সে-ই পুরনো মাইকেলকে। ওঁর তিনতলার স্টুডিও-ঘরে অসংখ্য কথাবলা পুতুল। বলেছিলেন ওই নিয়ে এতগুলো বছর একটানা নানা এক্সপেরিমেন্ট করে চলেছেন। কথাবলা পুতুল বানানো চোখের সামনে দেখেছিলাম তাঁরই কাছে। তারপর অনেক গল্প, অনেক আড্ডা, আর মাইকেলের গল্প শোনা।

প্রবীরদার কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম– মাইকেলকে তৈরি করার ব্যাপারটা ওঁর মাথায় এল কী করে! কারণ তার আগে কথাবলা পুতুল যে কী– সেটা আমার মতো বোধহয় অনেকেই ঠিকঠাক জানতেন না। আর আমাদের কাছে ভেন্ট্রিলোকুইস্ট বলতে তখন তো একটিই নাম– প্রবীরকুমার। এর উত্তর দিতে গিয়ে প্রবীরদা অনেকটা ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে গিয়েছিলেন।

প্রবীরদার জন্ম ১৯৫৩ সালে। ছেলেবেলা থেকেই বয়েজ স্কাউটে অলরাউন্ডার ছিলেন। স্কাউট ড্রিলের পাশাপাশি লাঠিখেলা, ছোরাখেলা– সবকিছুই খুব ভালো পারতেন। নিজের হাতে বানানো টুকিটাকি ম্যাজিক দেখিয়ে স্কাউটের বন্ধুদের তাক লাগিয়ে দিতেন। আর এইসব দেখে ১৯৬৬ সালে প্রবীরদাকে পশ্চিমবাংলার তরফ থেকে রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছিল, স্কাউটের ‘ওয়ার্ল্ড জাম্বুরি’তে অংশ নেওয়ার জন্যে। রাশিয়ায় জাম্বুরির পাশাপাশি প্রবীরদাদের পুরো দলটাকে একটা রাশিয়ান সার্কাস দেখাবার জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল লেনিন স্কোয়ারে। সেই সার্কাসে প্রবীরদা একজন ম্যাজিশিয়ানকে দেখেন, যিনি একটা ছোট পুতুলকে দিয়ে কথা বলাচ্ছিলেন। দেখে তো প্রবীরদা অবাক। সার্কাস ভাঙলে উনি সেই ম্যাজিশিয়ানের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন– কী ভাবে তাঁর হাতের পুতুলটা কথা বলছে।

জে ভি দাবাত্নিয়ার দেওয়া রাশিয়ান পুতুলের সঙ্গে

সেই রাশিয়ান ম্যাজেশিয়ানের নাম ছিল জে. ভি. দাবাত্নিয়া। উনি প্রবীরদাকে বলেছিলেন, কথা-বলা পুতুল তো ইন্ডিয়ারই একটা আর্ট! আর প্রবীরদা একজন ইন্ডিয়ান হয়েই সেটা জানেন না? প্রবীরদা ঘাড় নেড়ে ‘না’ বলেছিলেন। তারপর স্কাউটের প্রথা অনুযায়ী নতুন বন্ধুর সঙ্গে প্রথম আলাপে তাকে যে উপহারটি দেওয়ার রীতি, তা মেনে সেই দাবাত্নিয়া সাহেবকে নিজে হাতে বানিয়ে নিয়ে যাওয়া একটা ‘কালার চেঞ্জিং ফেদার ম্যাজিক’ উপহার দিয়েছিলেন। সাহেব তো সেটা পেয়ে ভারি খুশি। তিনি প্রবীরদাকে পরেরদিন আবার সার্কাসে আসতে বলেছিলেন এবং রাশিয়ান ভাষায় লেখা একটি ভেন্ট্রিলোকুইজম শেখবার বই আর হাতখানেক লম্বা একটা কথাবলা পুতুল ওঁকে উপহার দিয়েছিলেন। প্রবীরদা সেই উপহারে ভারি খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু মুশকিল হয়েছিল এই যে, সেই রাশিয়ান বইটি কোনও ভাবেই পড়ার উপায় করতে পারছিলেন না। শেষে ওঁদের স্কাউটের স্টেট কমিশনার ডাক্তার অরুণ শীলকে সেই অসুবিধের কথাটি বলেছিলেন। অরুণবাবু প্রবীরদাকে বলেছিলেন, গোর্কিসদনে গিয়ে রাশিয়ান ভাষা শেখাবার জন্যে ভর্তি হয়ে যেতে।

১৯৭৫ থেকে ১৯৮৯, এই চোদ্দ বছর একটানা মাইকেলকে নিয়ে সন্ধে সাড়ে ছটা থেকে সাতটা লাইভ অনুষ্ঠান করতেন প্রবীরদা। গোড়ায় সেই শো তিনটি মঙ্গলবার অন্তর হলেও, কিছুদিন পরেই হাজার হাজার দর্শকের অনুরোধে প্রত্যেক সপ্তাহের মঙ্গলবারেই হতে লাগল ওই একই সময়ে।

প্রবীরদা সেখানে দশটাকা ফি দিয়ে ভর্তি তো হয়েছিলেন কিন্তু দু’চার দিন ক্লাস করেই বুঝতে পেরেছিলেন, এইভাবে একটা বিদেশি ভাষা শিখে, মানে বুঝে, সেই থেকে ভেন্ট্রিলোকুইজম শেখা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এদিকে সেখানকার এক রাশিয়ান দিদিমণি তো প্রবীরদার ম্যাজিকে মুগ্ধ! তিনি বাংলা, ইংরিজি, হিন্দি– সমস্ত ভাষাতেই বলতে-লিখতে পারতেন। একদিন প্রবীরদাকে দু’একটা ম্যাজিক শিখিয়ে দেওয়ার জন্যে অনুরোধ করলে, প্রবীরদা বলেছিলেন, দুটো-একটা নয়, দশ-দশটা ম্যাজিক উনি ওঁকে শিখিয়ে দিতে রাজি, যদি দিদিমণি তাঁর একটা ছোট্ট উপকার করে দেন। আর সেটা হল, সেই রাশিয়ান ভেন্ট্রিলোকুইজমের বইটার বাংলা তর্জমা। শুনে দিদিমণি বলেছিলেন, ব্যস! এইটুকু!!

তারপর দিন সাতেকের মধ্যেই তিনি সেটা করে দিয়েছিলেন আর প্রবীরদাও তাঁকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শিখিয়ে দিয়েছিলেন দশখানা সুন্দর ম্যাজিক। তারপর টা-টা-বাই-বাই করে বেরিয়ে এসেছিলেন গোর্কি সদন থেকে।

সেই শুরু! তর্জমা করা বই এবং দাবাত্নিয়া সাহেবের দেওয়া পুতুল নিয়ে প্রবীরদার ভেন্ট্রিলোকুইজম চর্চা। সেই সময় বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান, জাদুকর সমীরণের সঙ্গে তাঁর খুবই হৃদ্যতা ছিল। সমীরণ ছিলেন একটু সিনিয়র বন্ধু, কাম দাদা। মার্কাস নামে প্রবীরদার আর এক বন্ধু ছিলেন, যাঁর তালতলায় একটা ছোট্ট জায়গা ছিল। সেখানে ওঁরা একটা ম্যাজিক এক্সপেরিমেন্ট স্টুডিও করেছিলেন। ম্যাজিক নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা হত সেখানে। জাদুকর সমীরণ আর জাদুকর গৌতম গুহও ওখানে যেতেন। সেই আড্ডাতেই সমীরণ প্রবীরদার ওই কথাবলা পুতুলটা দ্যাখেন আর রাশিয়ার পুরো গল্পটা শোনেন। প্রবীরদা সেই অনুবাদ করা বইটার তর্জমাও ওঁদের দেখিয়েছিলেন।।

এর আগে সমীরণ, কলকাতায় আসা অস্ট্রেলিয়ান ভেন্ট্রিলোকুইস্ট ক্লট ক্যানির শো দেখেছিলেন। ক্লট ক্যানির ছেলে প্যাট কি, ট্রিংকাস-এ বেশ কিছুদিন কথাবলা পুতুলের শো করেছিল, সমীরণ সেটাও দেখেছিলেন। কিন্তু তখন, প্রবীরদার এগুলো কিছুই দেখা ছিল না, উনি অনেক পরে ট্রিংকাস-এই প্যাট কি’র শো দেখেছিলেন। এর কিছুদিন পরে ১৯৬৯ সাল নাগাদ সমীরণ উত্তরবঙ্গে শো করতে চলে গেলেন। এই শো-টা হত টেন্ট-এ। সেটা ছিল নান্তুবাবু নামের একজনের– যিনি এখানে প্রথম জায়েন্ট হুইল চালু করেছিলেন। উত্তরবঙ্গে শো করতে চলে যাবার আগে সমীরণ হাতিবাগানের একজন পুতুলের মডেল বানানোর কারিগরকে দিয়ে একটা কথাবলা পুতুল বানিয়ে নিয়েছিলেন। সেই কারিগর কথা বলতে পারতেন না। সমীরণ সেই কথাবলা পুতুলটার নাম দিয়েছিলেন জনি। কিন্তু তাকে নিয়ে উনি তখন কলকাতায় কোনও শো-ই করেননি। তাই সেই পুতুলটা ঠিক কেমন বা তাকে দিয়ে কী ধরনের কাজ করানো যায়, সে সম্বন্ধে প্রবীরদার কোনও ধারণা ছিল না।

ছুটি ছুটি অনুষ্ঠানের শুটিং-এর খবর ১৯৯৪ সালের খবরের কাগজে

প্রবীরদা তাঁর রাশিয়ান পুতুলটা নিয়ে কলকাতা ময়দানের স্বদেশী মেলার মঞ্চে ’৭০ সালে প্রথম কথাবলা পুতুলের অনুষ্ঠান করেছিলেন। এরপর এক সংগঠক তাঁকে কাঁকুড়িগাছির নেতাজি মেলায় শো করার জন্যে টেনে নিয়ে যান। নেতাজি মেলার শো-টাই প্রবীরদার জীবনের প্রথম টিকিট বিক্রি করা শো। টিকিটের মূল্য ছিল ১৯ পয়সা। সমস্ত শো-তেই গিজগিজ করত দর্শক। কিন্তু দূরে দাঁড়ানো দর্শক, ছোট রাশিয়ান পুতুলটার ঠোঁট নড়া, মুখ নড়া ভালো করে দেখতে পেত না বলে, দরকার হয়ে পড়ল একটা বড়সড় কথাবলা পুতুল। তখন প্রবীরদা কুমোরটুলির মৃৎশিল্পী লক্ষ্মী পালের কাছে ক্লে-মডেলিং শিখছেন। তাঁকে বিষয়টা বলাতে তিনি প্রবীরদাকে বলেছিলেন, উনি ওই পুতুলটা বানাতে প্রবীরদাকে সাহায্য করবেন। লক্ষ্মীবাবুর স্টুডিওতে তাঁর গাইডলাইনেই পেপার পাল্প দিয়ে প্রবীরদা আস্তে আস্তে একটা কথাবলা পুতুল বানিয়েছিলেন। সেটা ১৯৭০ সালের পুজোর আগে আগে।

পুতুল বানানো শেষ হলে যখন সেটার একটা নাম দেওয়ার প্রয়োজন হল, তখন প্রবীরদা পড়ে গেলেন ভারি চিন্তায়। ওটার কী নাম দেওয়া যায় আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে নিজের বাড়ির টেবিলে মাইকেল মধুসূদন দত্তের একটা বইয়ের ওপর নজর পড়েছিল। আর তা-ই দেখেই প্রবীরদা পুতুলটির নাম রেখেছিলেন মাইকেল দাবাত্নিয়া। আসলে দাবাত্নিয়া পদবীটির মধ্যে দিয়ে উনি রাশিয়ায় প্রথম দেখা ভেন্ট্রিলোকুইস্ট ভদ্রলোককেই শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছিলেন।

লাইভ অনুষ্ঠানের দিন মাইকেল, প্রবীরদার মোটরসাইকেলের সামনে বসে দূরদর্শন ভবনে যেত। আর ওকে দেখবার জন্যে রাস্তার দু’ধারে লোক দাঁড়িয়ে থাকত। একবার অনুষ্ঠানের শেষে প্রবীরদা মাইকেলকে একটা লম্বা ব্যাগে পুরে ফেলেছিলেন। হঠাৎ দেখা গেল বেশ কিছু ছোট ছেলেমেয়ে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। কী হল! কী ব্যাপার! না, মাইকেলকে ব্যাগে ভরে দেওয়া হয়েছে, ও তো দম বন্ধ হয়েই মারা যাবে!

১৯৭০-এ টাটা সেন্টারের উল্টোদিকে ময়দান হওয়া বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনে মাইকেলকে নিয়ে একরকম হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে কিন্তু মাইকেলের নাম ছিল না। তাতে বলা ছিল ‘রাশিয়ার কথা বলা পুতুলের অনুষ্ঠান’। সেখানে অন্য সবার সঙ্গে মাইকেলের অনুষ্ঠান দেখেছিলেন একজন বিশিষ্ট ভদ্রমহিলা। তিনি ছিলেন ভবিষ্যতে নির্মীয়মাণ কলকাতা দূরদর্শনের অধিকর্তা– মীরা মজুমদার। পরে ১৯৭৪ সাল নাগাদ, নতুন শুরু হতে যাওয়া দূরদর্শনে একটি বাচ্চাদের অনুষ্ঠান থাকা জরুরি– এই আলোচনায় তিনি তাঁর তিন বছর আগে দেখা মাইকেলের অনুষ্ঠানের স্মৃতির কথা বলেছিলেন। মীরাদেবী প্রবীরদাকে ঘুণাক্ষরেও চিনতেন না। তাই খোঁজখবর শুরু করেন এবং ওঁকে খুঁজেও পান। ফলে ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট যেদিন কলকাতা দূরদর্শন শুরু হল, সেদিন ‘চিচিং ফাঁক’ অনুষ্ঠানটি মাইকেলের আসর দিয়েই শুরু হয়েছিল। অনুষ্ঠানটি ছিল লাইভ এবং এতে অংশ নেওয়া অতিথিরা সবাই ছিল কুচোকাঁচা।

১৯৭৫ থেকে ১৯৮৯, এই চোদ্দ বছর একটানা মাইকেলকে নিয়ে সন্ধে সাড়ে ছটা থেকে সাতটা লাইভ অনুষ্ঠান করতেন প্রবীরদা। গোড়ায় সেই শো তিনটি মঙ্গলবার অন্তর হলেও, কিছুদিন পরেই হাজার হাজার দর্শকের অনুরোধে প্রত্যেক সপ্তাহের মঙ্গলবারেই হতে লাগল ওই একই সময়ে। শেষের বছর ছয়েক, মানে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৫, সরকারের সঙ্গীতনাটক বিভাগ সামলানোর চাপে প্রবীরদাকে কিছু ‘মাইকেলের আসর’ আগে রেকর্ডিং করতে হয়েছিল। কিন্তু ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি একদমই।

সেই সময় মাইকেলকে নিয়ে মানুষের মনে কতটা ভালোবাসা, কতটা আগ্রহ ছিল, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করা যেত না। লাইভ অনুষ্ঠানের দিন মাইকেল, প্রবীরদার মোটরসাইকেলের সামনে বসে দূরদর্শন ভবনে যেত। আর ওকে দেখবার জন্যে রাস্তার দু’ধারে লোক দাঁড়িয়ে থাকত। একবার অনুষ্ঠানের শেষে প্রবীরদা মাইকেলকে একটা লম্বা ব্যাগে পুরে ফেলেছিলেন। হঠাৎ দেখা গেল বেশ কিছু ছোট ছেলেমেয়ে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। কী হল! কী ব্যাপার! না, মাইকেলকে ব্যাগে ভরে দেওয়া হয়েছে, ও তো দম বন্ধ হয়েই মারা যাবে! অগত্যা প্রবীরদাকে আবার তাড়াতাড়ি ওকে ব্যাগ থেকে বের করে ফেলতে হল। মাইকেলকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় অনুষ্ঠান শ্যুট করা হয়েছে। ‘৭৮-এর বন্যার সময় প্রবীরদার কোলে চড়ে মাইকেলও বেরিয়েছে ত্রাণ সংগ্রহে। বাড়ির বড়রা তো বটেই, ছোটরাও হাতের কাছে জামাকাপড়, চকোলেট, বিস্কুট যা পেয়েছে– তা-ই তুলে দিয়েছে আনন্দ করে। দূরদর্শনে সেই রেকর্ডিং দেখে স্বস্তি পেয়েছেন সবাই।

সত্যজিৎ রায়, সন্দীপ রায় ও মেকআপ আর্টিস্ট অনন্ত দাসের সঙ্গে প্রবীরবাবু এবং ভুতো

এবার ছোটদের কথা সরিয়ে রেখে মাইকেলের কিছু বড়সড় ভক্তের কথায় আসি। উত্তমকুমার, অমিতাভ বচ্চন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, পাহাড়ি সান্যাল, কমল মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, ছড়াকার অমিতাভ চৌধুরী, কাননদেবী– কে নয়? আর একবার তো ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এক মস্ত লম্বা ভদ্রলোক, প্রবীরদাকে ডেকে পাঠালেন নিজের বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে। ‘ভুতো’ নামে তাঁর একটা আশ্চর্য গল্প আছে– উনি নাকি সেটার শ্যুটিং করবেন বলে ঠিক করেছেন। আর সেই জন্যে ওঁর একটা কথাবলা পুতুল দরকার– যেটা প্রবীরদাকেই বানিয়ে দিতে হবে। প্রবীরদা সে-বাড়িতে ঢুকতেই উনি জিগ্যেস করেছিলেন– মাইকেলকে আনোনি? প্রবীরদা বলেছিলেন– এনেছি। তারপর মাইকেলের কথা-বার্তা শুনে তিনি তো হেসেই অস্থির। হঠাৎ বলে উঠেছিলেন– আরে প্রবীরদের দু’কাপ চা দাও! প্রবীরদা শুনে ভেবেছিলেন, তিনি তো একা, দু’কাপ চা কেন? জিগ্যেস করতেই তিনি হাসিমুখে বলেছিলেন– আমার একদম মনেই ছিল না যে মাইকেল পুতুল, ও চা খায় না! ওমনি মাইকেল বলেছিল– কে বলেছে আমি চা খাই না? আমিও চা খাব! আর তা-ই শুনে আবার ছোটদের মতো হা হা করে হাসতে শুরু করেছিলেন বিশ্ববরেণ্য সত্যজিৎ রায়।

8 Responses

  1. Very nice read. Just a request, can this lovely writeup be extended a bit by touching upon the conversations between Michael and Prabirbabu? The wit, repartee as I remember it, was remarkable. During that age of course it didn’t matter to me, only the fun did, but now when I think, it was remarkable.

  2. প্রবীর বাবু ও মাইকেল কে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি একজন বাঙ্গালী আর এমন কথা বলা পুতুল বাংলাদেশে শুধু দুটো রয়েছে আমি চাই আমকে এর সম্পকে বিস্তারিত জানার জন্য একটি বই বা সুযোগ দেয়া হোক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com