মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ, টেনশন– কথাগুলো আজও এই একুশ শতকে দাঁড়িয়েও কেমন হালকাভাবে বলে যাই আমরা। মানসিক রোগ বা মানসিক স্বাস্থ্য কথাটা শুনলেই ‘পাগল’ বলে দেগে দেওয়ার প্রবণতায় এখনও ঠোঁট আর মন নিশপিশ করে আমাদের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানসিক রোগকে অতি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসংকটের আওতায় এনে ফেলার পরেও সেই বিষয়ে ভারতীয়দের অবহেলা এবং অসচেতনতা লক্ষ করার মতো। যেখানে ভারতের অন্ততপক্ষে কুড়ি কোটি মানুষ কোনও না কোনও সময়ে মানসিক অবসাদের শিকার হয়েছেন বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রেকর্ডে প্রকাশ, সে দেশে মানসিক স্বাস্থ্যের চর্চা এবং শিক্ষা এত আশ্চর্যরকম কম, এ কথা ভাবতেও কিঞ্চিৎ লজ্জাবোধ হয় বৈকি।
সদ্যপ্রয়াত ডাঃ এম সারদা মেনন আজীবন কাজ করে গিয়েছেন এই সচেতনতা প্রসারের লক্ষ্যে। মানসিক রোগীদের যাতে নিছক রোগী হিসেবে দেখা হয়, তাঁদের অসম্মান না করা হয়, তাঁদের একঘরে না করা হয়, সে কাজে আজীবন নিয়োজিত থেকেছেন এই মানুষটি। ১৯৯২ সালে পেয়েছেন পদ্মভূষণ। তিনি, ভারতের প্রথম মহিলা মনোচিকিৎসক, সম্প্রতি ৯৮ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন চেন্নাই শহরে, নিজের বাড়িতে।
১৯২৩ সালে ম্যাঙ্গালোরের মালয়ালি পরিবারে সারদা মেননের জন্ম। পুরো নাম মামবালিকালাথিল সারদা মেনন। বাবা বিচারক ছিলেন। চেন্নাইতে বদলি হলেন অচিরেই। ছোট্ট সারদা ভর্তি হলেন চেন্নাইয়ের গুড শেপার্ড স্কুলে। তারপর চেন্নাইতেই চলল শিক্ষার পালা। চল্লিশের দশকে মেডিকাল পড়তে ভর্তি হলেন মাদ্রাজ মেডিকাল কলেজে। আর সঙ্গে সঙ্গেই বাড়িতে জানিয়ে দিলেন, মনোচিকিৎসা নিয়েই উচ্চশিক্ষা করবেন। পুরুষ-অধ্যুষিত অচেনা মনোবিজ্ঞানের জগতে মেয়েদের পা রাখার কথা সে সময়ে ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু কাচের দেয়াল ভাঙবেন বলে বদ্ধপরিকর ছিলেন সারদা।

প্রথাগত ডাক্তারি শিক্ষার পাশাপাশিই চলল মনোচিকিৎসা নিয়ে ডিপ্লোমা। ১৯৫৯ সালে নিমহ্যান্স (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্সেস) থেকে মনোচিকিৎসার ডিগ্রি নিয়ে যোগ দিলেন কিলপক মানসিক হাসপাতালে, যার পরে নাম হয় ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ, চেন্নাই। সেই শুরু দুর্গম পথে সারদার যাত্রা। মানসিক স্বাস্থ্যের জায়গা তখন স্বাস্থ্যব্যবস্থার একেবারে তলানিতে। সেখান থেকে শুরু করে দীর্ঘ ষাট বছরের কেরিয়ারে শ্রীমতী মেনন অনেক অসাধ্যসাধন করেছেন, অনেক অন্ধকারে আলো এনেছেন, ভেঙেছেন অজস্র অচলায়তন।
৯৭ বছর বয়সে এক সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডাঃ মেনন নিজেই বলেছেন, ‘মনোবিজ্ঞান নিয়ে বিরাট গবেষণা, অনেক অনেক জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ, এসব আমি কখনও করিনি। আমার শিক্ষা এবং জ্ঞানের মূল উৎস সবসময়েই আমার রোগীরা। তাঁদের সঙ্গে মিশে, তাঁদের সমস্যা ও পরিবেশ বুঝতে পেরেছি ক্রমে। নিরীক্ষণ, ব্যাখ্যা, ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতিতে ছোট ছোট পরিবর্তন আনা, রোগীর প্রতি সহমর্মিতা এবং তার পরিবারের প্রতি সহানুভূতি, এটাই ছিল আমার পাথেয়। ভালোবাসা আর সহমর্মিতা দিয়েই বরাবর চিকিৎসা করেছি।’

চেন্নাইয়ের সরকারি মানসিক হাসপাতালে কাজ করতে এসে প্রথম চোটেই রোগীদের হাল দেখে ধাক্কা লেগেছিল তরুণী চিকিৎসকের। এ কী অবস্থা! ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক, কেউ বা উলঙ্গ, সারা শরীরে ময়লা, ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাঁরা, কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করছেন, কেউ কেউ তো মারতে আসছেন, গালাগালি দিচ্ছেন, ছটফট করছেন। তাঁদের পরিবারের লোক কোনওক্রমে তাঁদের ফেলে দিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। এমতাবস্থায় চিকিৎসকরদের সঙ্গে কথা বলে সারদা বুঝলেন, কেউই এ অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় জানেন না। হয় জোর করে আটকে রাখা, নইলে ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়ানো—এ ছাড়া যন্ত্রণামুক্তির কোনও উপায় কারওর জানা নেই। এই দৃশ্য গভীর বেদনার জন্ম দিল সারদার মনে। সর্বক্ষণ ভাবতে লাগলেন, কীভাবে অসহায় মানুষগুলোকে একটু সুস্থভাবে, ভালোভাবে রাখা যায়।
সারদার নিজের কথায়, ‘একদিন একটা ষোলো বছরের মেয়েকে দেখলাম হাসপাতালে। রেলিংয়ের সঙ্গে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। ঘুমের ইনজেকশন দিলেও ঘণ্টাতিনেকের বেশি তার স্থায়িত্ব নয়। মেয়েটি তারস্বরে চিৎকার করে কাঁদছে, বিছানায় ছটফট করছে, অথচ ডাক্তারেরা অসহায়। করার কিছুই নেই। মেয়েটিকে ওই অবস্থায় হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। তখনই স্থির করি, আর নয়। পথ যতই অগম্য হোক, সে পথেই চলতে হবে, শিখতে হবে, জানতেই হবে, বুঝতেই হবে চিকিৎসার পথ। রিহ্যাবিলিটেশন, রিকভারি, আর রেস্টোরেশন—এই তিনই হবে আমাদের পরিবর্তনের মূলমন্ত্র।’

কিন্তু তার জন্য চাই প্রশিক্ষণ। কোথায় প্রশিক্ষণকেন্দ্র? সারা ভারতে এমন জায়গা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। অল্পদিনের জন্য কিছুটা আলো দেখলেন নিমহ্যান্সে। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসেন সেই সরকারি মানসিক হাসপাতালে। এবার আত্মপ্রত্যয়ী মেনন কাজ শুরু করলেন নিজস্ব ছন্দে। শুধু চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ নয়, প্রশিক্ষণ নিতে পাঠালেন হাসপাতালের সব স্তরের কর্মী, সেবিকা, সায়কোলজিস্ট, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বেসরকারি কর্মী, কাউন্সেলার এবং অকুপেশনাল থেরাপিস্টদেরও। সকলের কাজ একসূত্রে বাঁধা না হলে কখনও সুস্থ করা যাবে না একজন মানসিক রোগীকে, এ কথা ধীরে ধীরে বোঝাতে শুরু করলেন সারদা।
পরিকাঠামো উন্নয়নে নজর দিলেন প্রথমেই। রোগীদের ভালো খাওয়া, ঘুম, সময়মতো ওষুধের ব্যবস্থা করা, সাফাইয়ের দিকে নজর দেওয়া, মানসিক রোগের ওপিডি (আউটডোর পেশেন্ট ডিপার্টমেন্ট) চালু করা, বেসরকারি স্বাস্থ্যকর্মী নিযুক্ত করা, অপেক্ষাকৃত সুস্থদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা—এমন অজস্র কাজ শুরু করে দিলেন সকলের প্রিয় ‘সুপার ম্যাডাম’। এমন বহু বহু রোগী আছেন, যাঁরা সুস্থ হয়ে যাবার পরেও বাড়ির লোক তাঁদের ফেরত নিতে আসেন না। তাঁদের মূলস্রোতে ফেরার জন্য শুরু করলেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল থেরাপি, যেখানে তাঁরা নানারকম হাতের কাজ শিখবেন, অনেকের সঙ্গে মিশতে পারবেন।
ডাঃ মেননের ছাত্রী এবং বিশিষ্ট মনোবিদ ডাঃ আর তারা তাঁর স্মৃতিচারণে স্বীকার করেছেন, সরকারি মানসিক হাসপাতালের হাল দেখে তিনি মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়বার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু ‘ম্যাডাম’-এর দায়বদ্ধতা, শৃঙ্খলা, সহমর্মিতা দেখে তিনি পিছু হটতে পারেননি। ম্যাডাম নিজে তাঁকে বলেছিলেন, ‘কোর্সের মাঝখানে অন্য শখের বিষয় নিয়ে পড়তে চলে গেলে হবে না। মনোবিজ্ঞানে আরও আরও মেয়েদের আসা দরকার।’ মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনা চালুর ব্যাপারেও বিরাট অবদান ছিল সারদা মেননের। তিনি চিকিৎসকের পাশাপাশি ছিলেন একজন অসাধারণ শিক্ষকও।

আশির দশকে চাকরি থেকে অবসর নেন সারদাদেবী। কিন্তু মন তখনও অশান্ত। আরও যে অনেক কাজ বাকি রয়ে গেল? ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন নিজের নন-প্রফিট বেসরকারি সংস্থা ‘স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ বা SCARF। সমস্যা ছিল বহুবিধ। অর্থাভাব, লোকবলের অভাব ইত্যাদি তো ছিলই। মূল সমস্যা ছিল, যে বিষয়ে কাজ, তা নিয়ে সর্বস্তরে অসচেতনতা, অমানবিকতা। তাঁর নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবেরা আক্ষরিক অর্থেই মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন সাহায্যের কথা শুনে। কিন্তু নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন সারদা মেনন। বলেছেন, ‘সমাজ পাল্টাতে গেলে এসব ছোটখাটো বাধাবিপত্তি গায়ে মাখলে চলে না।’
এর সঙ্গে ছিল সামাজিক কলঙ্কের বিষয়টিও। মনোরোগ মানেই লুকোচাপা, সমাজে একঘরে হবার ভয়, কলঙ্ক, রটনা। এসব থেকে রোগীকে, তার পরিবারকে মুক্ত করার অসাধ্য কাজটি শুরু করেছিলেন সারদাদেবী। মানসিক রোগ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষদের সমাজের মূলস্রোতে নানা কাজে যুক্ত করে তাঁদের ও তাঁদের পরিবারকে সামাজিক ও মানসিক অবলম্বন দিতে চেয়েছেন। এ কাজ আমৃত্যু করে গিয়েছেন তিনি। একাধিক বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়ে কখনও আত্মহত্যা প্রতিরোধ, কখনও স্কিৎজোফ্রনিয়া রোগীদের পুনর্বাসন, নানা দিকে কাজ করে গিয়েছেন নিরলসভাবে। সঙ্গে চলেছে শিক্ষকতা।

অবসর নেওয়ার আগেই নিজের বাড়ির একটি ঘরে তৈরি করেছিলেন মনোরোগীদের জন্য ‘শেল্টার’। ওয়াইএমসিএ-কে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সেখানে একটি প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিট পরিচালনা করার যা পরে অনেক বিস্তৃত হয়ে দক্ষিণের একাধিক শহরে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর সংস্থা SCARF আজও কাজ করে চলেছে মনোরোগীদের পুনর্বাসন, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, কাজের ব্যবস্থা, পারিবারিক সচেতনতা প্রসার, জনশিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে। তাঁর ছাত্রছাত্রী, রোগী, তাঁদের পরিবার সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন, চিকিৎসক যে শুধু ওষুধ লিখে দিয়ে ক্ষান্ত থাকেন, এই গতে বাঁধা ধারণার মূলে আঘাত করেছিলেন তিনি। প্রতিটি রোগীর কথা শুনতেন, তাঁদের জীবনে কী কী সমস্যা তা বুঝতে চেষ্টা করতেন, রোগীর পরিবার কী কী সমস্যার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে তা নিজে সমাধানের চেষ্টা করতেন। ওষুধ, সহানুভূতি, ধৈর্য, সান্ত্বনা – এ সবের শরীরী প্রতিমা ছিলেন ডাঃ সারদা মেনন।

৫ ডিসেম্বর মৃত্যুর কয়েকমাস আগে পর্যন্তও নিয়মিত উপদেষ্টা হিসেবে হাজিরা দিয়েছেন নিজের সংস্থায়। সংবাদমাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বলেছেন, ভারতের মতো দেশে, যেখানে প্রতিটি রাজ্যের ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্য, জীবনযাত্রা, স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো আলাদা, সেখানে তার সঙ্গে তাল মিলিয়েই আলাদা আলাদা রকম মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করতে হবে। যে ধরনের প্রান্তস্থ পরিষেবা (Peripheral service) বর্তমানে মানসিক রোগীদের জন্য রয়েছে, তা পরিষেবার কংকাল বললেও অত্যুক্তি হয় না। ফলে যথাযথ পরিষেবা দেওয়া কখনওই সম্ভব হয় না। প্রয়োজন আরও অনেক অনেক স্বাস্থ্যকর্মীর, সরকারি সাহায্য, শিক্ষা এবং সচেতনতা প্রচারের।
*তথ্যসূত্র: ThebetterIndia, Matrubhumi, Hindustan Times, The Hindu, Indian Express, iconsofscarf.com
*ছবিসূত্র: iconsofscarf, readersdigest, feminismindia, reset.scrollstack
লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!
One Response
ভালো লাগলো। এই ধরনের প্রতিবেদন আরও বেশি করে প্রকাশিত হোক।