“শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।
শরৎ তোমার শিশির ধোওয়া কুন্তলে
বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।”
শরৎকাল আর দুর্গা পুজো (Durga Puja) তো সমার্থক শব্দ। তাই দুর্গাপুজো এলেই বাঙালির মনে ঢাক আর কাঁসর ছন্দ বাজে। আর পুজো মানে শুধু তো পুজো উপাচার নয়,রীতিমতো কবজি ডুবিয়ে পেট পুজোও। পঞ্চমী থেকে দশমী, ঘরে ও বাইরে পরপর নানারকম খাওয়াদাওয়া চলতেই থাকে— পোলাও, মাংস, মাছ, লুচি, আরও প্রচুর দেশি বিদেশি খাবার খেয়ে মোটামুটি ক্লান্ত হতে না হতেই বিসর্জনের পর থেকে বিজয়ার খাওয়ার পালা শুরু হয়ে যায়। লক্ষ্মীপুজো অবধি তো বটেই, কোনও কোনও ক্ষেত্রে এক্কেবারে দিওয়ালি বা কালিপুজো অবধি লোকজন বাড়িতে আসাযাওয়া করেন।

আগে তো প্রচুর লোকজন বিজয়ার বিসর্জনের পর থেকেই প্রণাম-আলিঙ্গন, কুশল বিনিময় করতেন। প্যান্ডেলেই প্রতিমা বিসর্জনের পর শুরু হত কোলাকুলি আর গরম মিহিদানা বা রসগোল্লা খাওয়ানো। তারপর পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সম্মিলিত বিজয়া উৎসব ফাংশান, ঘরে ঘরে পাড়ায় পাড়ায় যার মহড়া সেই কবে থেকে শুরু হয়ে যেত। এমনকি পুজোর মধ্যেও সকালবেলায় প্রায় প্রতিদিন চলত সেই মহড়া। আর ছিল নীল ইনল্যান্ড আর হলুদ পোস্টকার্ডের আনাগোনা। রোজই ডাকবাক্স হাতড়ে চিঠি পাওয়া যেত। গুরুজনদের প্রণাম আর ছোটদের স্নেহ ভালোবাসার কয়েকটি শব্দে থাকত সারাবছরের কুশল বিনিময়। পরবর্তীকালে ল্যান্ড ফোন ব্যস্ত থাকত সারাদিন বিজয়া থেকে লক্ষ্মীপুজো অবধি। চুঁচুড়ার মামাদাদু থেকে দিল্লির রাঙাদিদা, নওগাঁর দিদা থেকে ব্যাঙ্গালোরের কাকু সকলকে ফোনে প্রণাম জানানো। দিনকাল আস্তে আস্তে পাল্টে এখন মোবাইল কল এবং হোয়াটস আপে বদলে গেছে শুভেচ্ছা বিনিময়।
তবে যাই কিছু পাল্টাক বাঙালির রসনাতৃপ্তির খোঁজ কিন্তু অব্যাহত রয়েছে। আর রয়েছে বিজয়ার মিষ্টিমুখের সেই পুরনো রেওয়াজ

আমার দিদাকে দেখতাম পুজোর শুরুতেই নিমকি, নানারকম নাড়ু, নারকেল তক্তি এসব বানিয়ে রাখত আর বয়ামে, কৌটোতে মজুত করত। বিজয়ার দিন বানাতো ঘুগনি। দশমীর দিন সন্ধে থেকেই পাড়ার লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়ে যেত। আমরাও যেতাম।
মাকে দেখতাম এলোঝেলো, মিষ্টি গজা, মুগ ডালের বরফি, সেমুইয়ের পায়েস, পাউরুটিকে ক্ষীরে ভিজিয়ে ঘিয়ে ভাজা রসের নানান মিষ্টি, নোনতার মধ্যে দইবড়া, মাংসের কিমা দিয়ে ঘুগনি, ভেজিটেবল চপ— এমন আরও কত কী বানাত! (Durga Puja)
আজ বিজয়ার মিষ্টি নিয়ে লিখতে গিয়ে আমিও তাই পুরনো আধুনিক সব মিলিয়ে নিজের মতো করে ফিউশন বানিয়ে কিছুটা নিজের মস্তিস্কপ্রসূত মিষ্টির রেসিপি তুলে ধরছি আপনাদের সামনে। কেনা মিষ্টি তো সবাই প্লেটে সাজিয়ে অতিথিকে দিতে পারেন। কিন্তু যদি দূরে থাকা কোনও বন্ধু, আত্মীয়, পরিজন বা বিশেষ অতিথি আসেন বলুন তো ভালো লাগবে কি না নিজের হাতে ভালোবাসা দিয়ে বানানো মিষ্টি যত্ন করে তাদের খেতে দিতে!
তাই আজ সৃষ্টিসুখে মিষ্টিমুখ করাই সকলকে আমার অগ্রিম শুভেচ্ছা জানিয়ে।

১) ছানার ক্ষীরমালাই
এটি এক ঢিলে দুই মিষ্টি, রসমালাই আর ছানার পায়েসের মধুর কম্বিনেশান…
উপকরণ:
জল ঝরানো ভালো ছানা বড় এক বাটি
জ্বাল দেওয়া দুধ ১ লিটার
গুঁড়ো দুধ দু’ চামচ
কনডেন্সড মিল্ক হাফ কাপ
ঘি এক-দু চামচ
কাজু পিস্তা আমন্ড আধভাঙা করা অল্প কিছুটা, কিছুটা সাজানোর জন্য
চিনি পরিমাণ মতো
এলাচ গুঁড়ো ১/২ চামচ
রসগোল্লা বাড়িতে থাকলে ভালো, না হলে ছোট ছোট রসগোল্লা বানিয়ে নেবেন আগে
গোলাপজল সামান্য
প্রণালী: প্রথমে ছানাটাকে কড়াইতে ঘিয়ের মধ্যে খুব হালকা নেড়েচেড়ে কিছুক্ষণ পর দুধ ঢেলে দিতে হবে..বেশ কিছুক্ষণ। এরপর এলাচ গুঁড়ো দিয়ে দিন। তারপর একটু দুধ নিয়ে তাতে গুঁড়ো দুধ মিশিয়ে একটু জ্বাল দিয়ে হাফ কাপ কনডেন্সড মিল্ক মেশান। পুরো মিশ্রণ ঘন হয়ে গেলে সবরকম বাদাম দিয়ে নেড়ে ফুটিয়ে নামানোর আগে অল্প গোলাপ জল দিয়ে দেবেন। চাইলে এর মধ্যে রসগোল্লাও কেটে কেটে দিতে পারেন বা ঘরে বানানো মিনি রসগোল্লা। ছানার পায়েস এবং রসমালাইয়ের যৌথ স্বাদ পেয়ে যাবেন এই রেসিপিতে। ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশন করবেন। এক কথায় অতুলনীয় এই ঘরে বানানো মিষ্টি।

২) মুগ ডালের কদমফুল
যাদের ছানার মিষ্টি পছন্দ নয় বা বারণ, তারা এটা করে দেখবেন, অসাধারণ লাগে।
উপকরণ: মুগ ডাল খুব হালকা ভেজে গুঁড়ো করে নেওয়া বড় এক বাটি
আমন্ড গুঁড়ো ১/৩ ছোট বাটি
সামান্য খোয়া ক্ষীর গুঁড়ো ৬ টেবল চামচ
এলাচ গুঁড়ো
গাওয়া ঘি ৪ টেবল চামচ
চিনি
প্রণালী: প্রথমে মুগ ডাল খালি কড়াইতে হালকা নেড়ে গুঁড়ো করে নিন। এবার ডাল গুঁড়োকে কড়াইতে ঘি দিয়ে ভালোভাবে নাড়তে হবে। একটু ভাজা হলে ওর মধ্যে বাদাম গুঁড়ো দিয়ে নাড়তে হবে। দুটোই বেশ নাটি ফ্লেভারের, তাই এদের কম্বিনেশন চমৎকার। তারপর ডাস্টেড খোয়া ক্ষীর আর চিনি দিয়ে নাড়ুন। চিনি গলতে শুরু করলে ওর মধ্যে এলাচ গুঁড়ো আর ঘি দিয়ে বেশ করে নাড়ুন যতক্ষণ না পাকানোর মতো আঁট বাঁধছে। তারপর একটু ঠান্ডা হলে নিজের ইচ্ছেমতো শেপ দিয়ে সাজান। আমি আমার পছন্দ মতো সাজিয়েছি।

৩) রাবড়ি বাদাম মুস
এটা একটা অসাধারণ সুস্বাদু ডেজার্ট
উপকরণ:
দুধ ১ লিটার
কনডেন্সড মিল্ক হাফ কাপ
গুঁড়ো দুধ ৫ টেবল চামচ
কাজু ৬ টা
পিস্তা ১০ টা
আমন্ড ৫ টা
ফ্রেশ ক্রিম এক মাঝারি বাটি
চিনি স্বাদ অনুযায়ী
কেশর অল্প
গোলাপ জল
প্রণালী: প্রথমেই দুধ ভালো করে জ্বাল দিয়ে ঘন করে নিতে হবে। এরপর ওর মধ্যে গুঁড়ো দুধ, অল্প কেশর আর বাদাম কুচি দিয়ে ফোটাতে হবে। ভালোভাবে ফুটে গেলে কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে নাড়িয়ে মিশ্রণ ঘন করে নিতে হবে। শেষে চিনি দিয়ে আরও বেশ করে জ্বাল দিয়ে বেশ ঘন করে নামিয়ে পাশে একটা বাটিতে রেখে দিন এটাকে।
এর পরের ধাপে ফ্রেশ ক্রিম নিয়ে ব্লেন্ড করুন ভালো করে, যাতে ক্রিমটায় একদম স্মুথ ফ্লাফি একটা হালকা ভাব আসে। তারপর ওর মধ্যে চিনি আর গোলাপ জল দিয়ে ফের ব্লেন্ড করে আগের বাটিতে রাখা বাদাম দুধের ক্ষীরটাও দিয়ে ব্লেন্ড করুন। এবার একটা পাইপিং ব্যাগে নিয়ে মনের মতো কাচের গ্লাসে সাজিয়ে পরিবেশন করুন ঠান্ডা করে। এটা দুর্দান্ত খেতে। দেখতেও চমৎকার লাগে সাজানোর পর।

৪) আমসত্ত্ব মালাই ক্ষীরের পাটিসাপটা
যারা খুব বেশি মিষ্টি পছন্দ করেন না বা হাতের কাছে যদি খুব কম ছানা, ড্রাই ফ্রুটস বা কনডেন্সড মিল্কও না থাকে, এদিকে স্পেশাল গেস্ট আসছে বাড়িতে, ভালেবাসে আপনার হাতে বানানো মিষ্টি খেতে— তাহলে কী করবেন? অবশ্যই এই মিষ্টিটা বানিয়ে ফেলুন।
উপকরণ:
ময়দা
চালের গুঁড়ো
সুজি
আমসত্ত্ব
ছানা
দুধ
গুঁড়ো দুধ
চিনি
নুন
ঘি
সাদা তেল
প্রণালী: প্রথমে ময়দা, চালের গুঁড়ো আর সুজি ৪:১:২ অনুপাতে সামান্য নুন মিশিয়ে জল, অল্প দুধ আর খুব সামান্য চিনি দিয়ে মাঝারি ঘনত্বের ব্যাটার গুলে রাখুন। এবার ওটা ঢাকা দিয়ে রাখুন কিছুক্ষণ। বেশি চিনি দেবেন না, তাতে প্যান থেকে ওঠাতে অসুবিধা হবে।
এবার ভেতরের পুরের পালা—
প্রথমে দুধ খুব ভালো করে ঘন করে নিন যাতে মোটা সর বা মালাই ওঠে। তার মধ্যে গুঁড়ো দুধ আর ছানা দিয়ে ফুটিয়ে ঘন করে চিনি দিয়ে দিন। ঠান্ডা হয়ে এলে এবারে আমসত্ত্বগুলোকে একদম মিহি আর ছোট ছোট করে কেটে ওর সাথে ভালো করে মিশিয়ে নিন।
এবার পাটিসাপটার মতো ওই তৈরি করে রাখা আগের ব্যাটারের মধ্যে এই পুর দিয়ে পাকিয়ে তুলে নিন। সাজানো আপনার ইচ্ছে মতো করবেন।
বেশ অন্যরকম আর ফ্রুট ফ্লেভারফুল মিষ্টি এটা, আর সাথে ছানার গুণ তো আছেই।

৫) ছোলার ডালের রসবরফি
উপকরণ:
ছোলার ডাল সিদ্ধ করে বেটে নেওয়া এক বড় বাটি
কনডেন্সড মিল্ক – ৫ চামচ বা গুঁড়ো দুধ ৫ চামচ
ঘি
এলাচ গুঁড়ো
তেল
চিনি
এক চিমটে নুন
প্রণালী: প্রথমেই ছোলার ডালটাকে সিদ্ধ করে বেটে নিতে হবে। তারপর কড়াইতে বা প্যানে সাদা তেলে ঘি দিয়ে বেশ করে নাড়তে হবে… একটু পরে কনডেন্সড মিল্ক বা গুঁড়ো দুধ দিয়ে নাড়তে হবে। সব শেষে চিনি, এলাচ গুঁড়ো দিয়ে বেশ আঁটো করে পাক দিতে হবে।
কড়াইয়ে মিশ্রণটা ঘি ছাড়লে ওটাকে থালায় সমান করে পেতে বরফি আকারে কাটতে হবে। মিষ্টিটা এই অবধিও রাখা যায়। আবার আরেক স্টেপ বাড়িয়ে নেওয়াও যায়, যেমন আমি করেছি।
বরফিগুলোকে তেল মেশানো ঘিয়ে বাদামি করে ভেজে নিয়ে তুলুন।
চিনির একটু ঘন সিরা এলাচ দিয়ে বানিয়ে রাখুন আগেই। সিরা ঠান্ডা হলে সেটা ঐ ভাজা বরফির ওপরে ঢেলে দিন।
চমৎকার খেতে লাগে এই ভাজা বরফির মিষ্টি।

৬) চকোলেট ক্ষীর প্রদীপ-সন্দেশ
উপকরণ:
বাড়িতে বানানো ছানা
খোয়া ক্ষীর
চিনি
ঘি
কোকো পাউডার
মধু
আমন্ড
এলাচ গুঁড়ো
প্রণালী: প্রথমে বাড়িতে টাটকা ছানা বানিয়ে নিয়ে জল ঝরিয়ে ফ্রিজে রেখে দিন। তারপর খোয়া ক্ষীর আর গুঁড়ো চিনি দিয়ে মাখুন। এবারে কোকো পাউডার দিয়ে মেখে কড়াইতে ঘি দিয়ে অল্প নাড়াচাড়া করে একটু জমাট বাঁধলে প্রদীপের আকারে গড়ে নিন হাতে ঘি লাগিয়ে। তারপর সামান্য কিছু খোয়া, ছানা, সামান্য চিনি গুঁড়ো আর এলাচ গুঁড়ো দিয়ে কড়াইতে নেড়ে জমাট বেঁধে গেলে সলতের আকার দিন।
এরপর প্রদীপের মধ্যে তেলের বদলে মধু দিয়ে দিন। আর আমন্ড দিয়ে শিখা বানিয়ে নিন।
হয়ে গেল চকোলেট প্রদীপ মিষ্টি। যেমন সুন্দর দেখতে হয়, তেমন অতুলনীয় খেতে।

৭) রাঙালুর মোহন ল্যাংচা
উপকরণ:
মিষ্টি আলু
খোয়া ক্ষীর
নারকেল কোরা
কিসমিস
কনডেনসড মিল্ক
এলাচ গুঁড়ো
কেশর কয়েকটা
সুজি
চিনি
ময়দা
গুঁড়ো দুধ
তেল
সামান্য নুন
প্রণালী: প্রথমে মিষ্টি আলু খোসা সমেত সিদ্ধ করে নেবেন, যাতে অতিরিক্ত সিদ্ধ হয়ে গলে না যায়। এবার খোসা ছাড়িয়ে শুকনো করে তাতে সুজি, খোয়া ক্ষীর, খুব সামান্য ময়দা আর এক চিমটে নুন দিয়ে ঠেসে মাখুন। এলাচ গুঁড়ো দিয়ে মেখে ডো-টা আলাদা রাখুন।
এবার দ্বিতীয় স্টেপে নারকোল কোরা, একটু কনডেনসড মিল্ক, কিসমিস কুচি অল্প ঘি-তে নেড়ে প্রয়োজন মতো চিনি দিয়ে মাখো মাখো একটা পুর বানা, নারকোল নাড়ুর মতো টেক্সচার করে।
এবার ঐ রাঙালুর ডো থেকে একটু করে নিয়ে হাতের তালুতে ঘি লাগিয়ে গর্ত মতো করে তাতে নারকেলের পুরটা দিন। এবার গোল পাকিয়ে রাখতে পারেন পান্তুয়া স্টাইলে বা আমার দেওয়া ছবির মতো ল্যাংচার শেপ দিতে পারেন।
সবশেষে তেল, ঘি একসঙ্গে গরম করে ভেজে ওগুলোকে এলাচ দেওয়া চিনির রসে ফেলবেন। খুব নরম তুলতুলে আর বলাই বাহুল্য অতি চমৎকার খেতে হয় এই মিষ্টি।

তবে আর কী! বানিয়ে ফেলুন সব দারুণ দারুণ সাতটা মিষ্টির পদ আর প্লেটে সুন্দর করে সাজিয়ে অতিথিকে মুগ্ধ করে দিন|
আর হ্যাঁ,আমাকে কিন্তু বানিয়ে জানাবেন কেমন লাগল!
ছবি সৌজন্য: লেখক, Flickr, Shutterstock
আঁকা, ফুড আর্ট ও রান্নাবান্না সৌমীর প্যাশন। গাছপালা, প্রকৃতি ভালোবাসেন। যেকোনও সৃজনশীল কাজে আনন্দ পান। বিজ্ঞাপণ ও বিপণন নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। লেখালেখি করতে পছন্দ করেন।