নানারকম পরীক্ষার পরে জানা গেল সত্যব্রতবাবুর বাঁ চোখে স্ট্রোকই হয়েছে এবং তাঁর দৃষ্টি প্রায় আশি শতাংশ কমে গিয়েছে। সত্যব্রতবাবু হতাশ স্বরে বললেন, ‘ তাহলে আমি আর কখনো ভাল দেখতে পাব না?’ ডা সান্যাল জানেন, যে কোনো চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল পেতে হলে রোগীর মানসিক জোর থাকাটা ভীষণ জরুরি। তাই সত্যব্রতবাবুকে সাহস যুগিয়ে বললেন, ‘অত ভেঙে পড়বার মতো কিছু হয়নি। এখনই আমরা আপনার চোখের চিকিৎসা শুরু করব। এজন্য আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। ততক্ষণে আমরা ওষুধপত্র আর যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নেব। অপেক্ষা করতে সম্মত হয়ে সত্যব্রতবাবু জানতে চাইলেন চোখের স্ট্রোকের চিকিৎসা কীভাবে করা হয়।
[the_ad id=”270085″]
- চোখের স্ট্রোকের চিকিৎসা নির্ভর করে রেটিনার কতটা ক্ষতি হয়েছে আর রোগী কত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করছেন তার উপর। একই সঙ্গে তার আনুষঙ্গিক অন্যান্য শারীরিক জটিলতা যেমন ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হার্টের অসুখ ইত্যাদিকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
- চোখের উপরে ম্যাসাজ করে কিম্বা রক্তনালিতে জমাট বাঁধা রক্তকে পাতলা করবার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা হয়।
- প্রয়োজনমতো নির্দিষ্ট ওষুধ (Anti VGEF, Corticosteroid ইত্যাদি) চোখের ভিতরে ইনজেকশনে উপকার পাওয়া যায়।
- লেজারের সাহায্যে (Pan Retinal Photocoagulation) রেটিনায় গজিয়ে ওঠা নতুন রক্তনালিগুলিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
- উচ্চচাপের অক্সিজেনের (Hyperbaric Oxygen) ব্যবহারও কখনও কখনও প্রয়োজন হতে পারে।
যেহেতু সত্যব্রতবাবু যথেষ্ট তাড়াতাড়ি অর্থাৎ স্ট্রোক হবার সাথে সাথেই চলে এসেছেন, ফলে তাঁর চিকিৎসায় সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেশি। ডা. সান্যালের তত্ত্বাবধানে যথাযথ চিকিৎসার পরে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র বুঝিয়ে দিয়ে তাঁকে ছুটি দেওয়া হল। বলা হল ধূমপান পুরোপুরি ছেড়ে দিতে হবে আর এক সপ্তাহ পরে আসতে হবে ফলোআপের জন্য।
‘আচ্ছা ডাক্তারবাবু কতদিন পরে পুরোপুরি ভাল হয়ে যাব বলে মনে হয় ?’ ডা. সান্যালের সহানুভূতি আর চিকিৎসার পরে কিছুটা আশ্বস্ত ভয়ে ভয়ে প্রশ্নটা রাখলেন সত্যব্রতবাবু।
[the_ad id=”270086″]
চোখের স্ট্রোকের পরে কিছু মানুষের জীবনে চিরদিনের মতো অন্ধকার নেমে আসে, কিন্তু অনেকেই আংশিক বা পুরোপুরি দৃষ্টি ফিরে পান। এজন্য কিছুটা সময় এবং ধৈর্য লাগে। এছাড়াও স্ট্রোকের তীব্রতা, রেটিনার ক্ষতির পরিমাণ, রোগীর অন্যান্য শারীরিক সমস্যার যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির উপরেও চিকিৎসার সাফল্য নির্ভর করে। ডা. সান্যাল এবং ক্লিনিকের সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে সত্যব্রতবাবু বাড়ি যাবার জন্য তৈরি হচ্ছেন এমন সময় ডা. সান্যাল বললেন, তবে একথা মনে রাখা দরকার যে স্ট্রোকের পরেও চোখে নানা রকমের জটিলতা দেখা দিতে পারে যার ভয়াবহতা কোনো অংশেই কম নয়।
ভীত দৃষ্টি নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন সত্যব্রতবাবু।
হ্যাঁ, স্ট্রোকের পরবর্তী জটিলতার মধ্যে কয়েকটি অত্যন্ত মারাত্মক এবং চিকিৎসায় সুফল পাওয়া যায় না।
- ম্যাকুলার ইডিমা (Macular Edema): রেটিনার কেন্দ্রের সবচেয়ে জটিল ও সংবেদনশীল অঞ্চলটির নাম ম্যাকুলা, যেটি সুস্থ ও স্বাভাবিক দৃষ্টির জন্য অপরিহার্য। স্ট্রোকের পরে ম্যাকুলায় রক্ত এবং ফ্লুইড জমে স্ফীত হয়ে ওঠে। এর ফলে দৃষ্টিক্ষমতা হ্রাস পায়।
- নিওভাস্কুলারাইজেশন (Neo Vascularisation): স্ট্রোকের সময়ে রেটিনায় রক্ত সরবরাহ কমে যাওয়ার ফলে অক্সিজেনের যে ঘাটতি হয় সেটা পূরনের জন্য রেটিনায় নতুন নতুন সূক্ষ রক্তজালিকার সৃষ্টি হয়। এই রক্তজালিকাগুলি অত্যন্ত ভঙ্গুর আর সহজেই ফেটে গিয়ে রেটিনা এবং ভিট্রিয়াসের ভিতরে রক্ত জমা হতে থাকে। এর ফলে চোখের ফ্লোটারস, রেটিনাল ডিটাচমেন্ট, অন্ধত্ব ইত্যাদি জটিলতার সৃষ্টি হয়।
- সেকেন্ডারি গ্লকোমা (Secondary Glaucoma): নিওভাস্কুলারাইজেশন অর্থাৎ নতুন রক্তজালিকাগুলি চোখের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে চোখের আভ্যন্তরীণ চাপ ভয়ানকভাবে বেড়ে যায় এবং অত্যন্ত বেদনাদায়ক গ্লকোমার সূত্রপাত হয়, যার একমাত্র গতি অন্ধত্ব।
- অন্ধত্ব (Blindness)
‘সেক্ষেত্রে আমার করণীয় কী ডাক্তারবাবু? মানে কী কী মেনে চলতে হবে চোখ ভাল রাখবার জন্য?’
[the_ad id=”270088″]
‘বুঝতেই পারছেন স্ট্রোক-পরবর্তী কমপ্লিকেশনগুলি খুবই সিরিয়াস। এজন্য আপনাকে নিয়মিত চোখের চেকআপ নানা পরীক্ষানীরিক্ষা করতে হবে, অন্তত একবছর বা তার বেশিদিন ধরে। এক্ষেত্রে কোনো অবহেলা চলবে না। চোখে কোনো নতুন সমস্যা দেখা দিলে সাথে সাথেই আমাদের জানাতে হবে। এছাড়া ডায়াবেটিস, প্রেশার, কোলেস্টেরল, হার্টের অসুখগুলির সময়মত ঠিকঠাক চিকিৎসা না করালে আরও বিপদ ঘটতে পারে। সুষম ও উপযুক্ত খাবার, শরীরচর্চা, পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুম, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন আপনার দৃষ্টিক্ষমতাকে সুস্থ রাখবে। আর মনে রাখবেন ধূমপান মানেই বিষপান।
উপসংহার
চোখের স্ট্রোকের ক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা শুরু করতে পারলে দৃষ্টি পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা থাকে । কিন্তু যদি স্ট্রোক-কবলিত হতে না চান তবে নীচের পরামর্শগুলি মেনে চলতে হবে।
ডায়াবেটিস, হাই ব্লাডপ্রেশার আর ব্লাড কোলেস্টেরলকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন। হার্টের যে কোনো সমস্যা চোখের ক্ষেত্রে মারাত্মক হতে পারে। চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকুন। গ্লকোমাকে অবহেলা করবেন না। নিয়মিত পর্যবেক্ষণে থাকুন।
বিশিষ্ট চক্ষু চিকিত্সক ডা. পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার সল্টলেক আই কেয়ার ফাউণ্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা। চিকিত্সার সঙ্গেই চলে লেখালেখির কাজ। লিখেছেন 'চশমার হ্যান্ডবুক', 'গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার', 'চোখের কথা' ইত্যাদি বই। এছাড়াও 'গীতবিতান আর্কাইভ' এবং 'রবীন্দ্রকবিতা আর্কাইভ' নামে দুটি মূল্যবান সংকলন তৈরি করেছেন।