(Fish and Chips) ২০২৩-এর ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের এক রাত। ওঁরা তিনজন। দুই পুলিশ অফিসার এবং একজন রিপোর্টার। ঠান্ডা ভালোই পড়েছে। এঁরা কেবল ভোজনরসিকই নন, খাবারের ব্যাপারে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে। শেক্সপিয়র সরণি বা থিয়েটার রোডে নামীদামি এক হোটেলের দোতলার একটি ঘর। তাঁরা হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কে ফোন করে অনুরোধ জানালেন, শেফ যিনি এখন ডিউটিতে, তিনি যদি একবার তাঁদের ঘরে আসেন। (Fish and Chips)

মিনিট তিনেকের মধ্যে ঘরে শেফ এসে পৌঁছনোর পর দুই পুলিশ অফিসারের মধ্যে সিনিয়র যিনি, তাঁর প্রশ্ন, ‘ফিশ অ্যান্ড চিপস্ হবে?’ ছ’ফুটের বেশি লম্বা, ঝকঝকে চেহারার বাঙালি শেফের গলায় আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে, ‘অবশ্যই হবে। এটা আমরা খাঁটি কলকাতা ভেটকি দিয়ে করি।’ সিনিয়র পুলিশ অফিসারের ঠোঁটে মুচকি হাসি খেলে গেল। তারপর তিনি বললেন, ‘খুব ভালো কথা। আচ্ছা, কী কী থাকে আপনাদের ফিশ অ্যান্ড চিপসে?’ (Fish and Chips)

ভুরু কুঁচকে গেল শেফের, ‘কেন? ভেটকির ডায়মন্ড ফ্রাই আর ফিঙ্গার চিপস্! টার্টার ডিপ থাকবে।’ সিনিয়র পুলিশ অফিসারের চোখেমুখে এ বার কৌতুক, ‘ডায়মন্ড ফ্রাই মানে ভেটকি ফিলের ক্রাম্ব ফ্রাই তো! মানে ম্যারিনেট করা ভেটকি-ফিলের গায়ে ব্রেড ক্রাম্ব বা লেড়ো বিস্কুটের গুঁড়ো মাখিয়ে ভাজা। ঠিক?’ কেতাদুরস্ত হোটেলের শেফ আবার একটু চনমনে হলেন, ‘রাইট স্যার।’ হাসি চওড়া হলো পুলিশ অফিসারের, ‘তা হলে আপনাদেরটা ফিশ অ্যান্ড চিপস্ নয়। ওটা ফিশ ফ্রাই উইথ চিপস্।’ শেফ এবার ভ্যাবাচাকা খেলেন। নিতান্ত অপ্রস্তুত তিনি, ‘মানে? স্যার, এটাই তো…।’ (Fish and Chips)
তাঁকে কথা শেষ করতে না-দিয়ে সাংবাদিক বললেন, ‘ফিশ অ্যান্ড চিপস্ যদি আপনি বলেন, তাহলে ফিশ ফ্রাইটা হতে হবে ব্যাটার ফ্রাই। আর সেটা হবে অনেকটা কড়মড়ে। তার সঙ্গে কড়াইশুঁটি সেদ্ধ কিংবা ম্যাশড গ্রিন পিজ় আর টার্টার ডিপ থাকাটাও মাস্ট।’ শেফ তবু অনমনীয়, ‘এক-এক জায়গার এক-এক রকম স্টাইল। আমাদেরটা ওরকম হয় না।’
গলা না-চড়িয়ে পারলেন না সাংবাদিক, ‘ফিশ অ্যান্ড চিপস্ খাস বিলিতি আইটেম। লন্ডনের। ফিশ অ্যান্ড চিপস্ দিতে হলে আপনাকে ব্যাটার ফ্রাই-ই দিতে হবে। যেটা জানেন না, শিখে নিন।’ সাংবাদিককে ঠান্ডা করতে আসরে নামলেন সিনিয়র পুলিশ অফিসার। শেফের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি কি ব্যাটার ফ্রাই করে দিতে পারবেন?’ শেফ বললেন, ‘না স্যার।’ সমাধান বাতলালেন পুলিশকর্তা, ‘আপনি ওই ফিশ ফ্রাই আর ফিঙ্গার চিপস্-ই দিন তিন প্লেট।’ (Fish and Chips)

দোষটা কেবল শেক্সপিয়র সরণির ওই হোটেলের নয়, কলকাতার ৯৫-৯৮ শতাংশ রেস্তোরাঁর মালিক-মালকিন এবং শেফ-দের ধারণাই নেই ফিশ অ্যান্ড চিপস্ সম্পর্কে। মেনুতে তাঁরা লিখে দেন ফিশ অ্যান্ড চিপস্। অথচ অর্ডার দিলে অতিথি যেটা পান, সেটা ওই ক্রাম্ব ফ্রাই। মেনুতে ফিশ ফ্রাই অ্যান্ড চিপস্ লিখলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু ফিশ অ্যান্ড চিপস্-এ ফিশ ব্যাটার ফ্রাই-ই যে দিতে হবে, সেটাই তাঁরা জানলে তো! সে জন্যই ভুল নামে ভুল খাবার। বিলেতে ফিশ অ্যান্ড চিপস্ হয় কড কিংবা হ্যাডক মাছ দিয়ে। কলকাতা বা বাংলায় কড, হ্যাডক পাওয়া যায় না বলে ভেটকি। ইংল্যান্ডে টাটকা ভেটকি পাওয়া গেলে ওখানেও হয়তো ভেটকিই পড়ত ফিশ অ্যান্ড চিপসে। (Fish and Chips)
ফিশ অ্যান্ড চিপসে ভেটকির টুকরো কিন্তু ক্রাম্ব ফ্রাই কিংবা পাতুরির মতো কাটলে হবে না। তা হলে ব্যাপারটা বেগুনির মতো হয়ে যাবে। লম্বা, অল্প চওড়া এবং বেশ কিছুটা পুরু করে ফিলে কাটাতে হবে। মাছের ফিলের একটা ডেপথ থাকতে হবে। তবেই আসবে ফিশ অ্যান্ড চিপসের আসল শেপ। আর ব্যাটার তৈরি করতে হবে ময়দা, কর্নফ্লাওয়ার, অল্প পরিমাণ ডিম, নুন আর জল ভালো করে ফেটিয়ে। ময়দার সঙ্গে কর্নফ্লাওয়ার মেশালেই আসবে ওই কড়মড়ে ভাব।
কেউ কেউ আবার তর্ক করেন। ‘বিলেতে যা হচ্ছে, হোক! আমরা ফিশ অ্যান্ড চিপস্ লিখে ফিশের ক্রাম্ব ফ্রাই দিলে অসুবিধে কোথায়? ব্যাকরণগত ভুল তো কিছু নেই’— এমনই তাঁদের যুক্তি। আসলে অপযুক্তি। ব্যাকরণগত ভুল না-থাকলেও খাদ্য সংস্কৃতিগত ভুল রয়েছে অবশ্যই। আপনার পাতে মাটন বিরিয়ানি দিয়ে যদি সেটাকে মাটন তেহারি কিংবা মাটন ইয়াখনি পোলাও বলে চালানো হয়, তাহলে কেমন লাগবে? এই যুক্তিই দেওয়া যাবে তো যে, তিনটে আইটেমেই চাল ও মাটন রয়েছে, অতএব নামে কিছু যায়-আসে না! ফিশ অ্যান্ড চিপসে ফিশ ব্যাটার ফ্রাই না দিয়ে ফিশ ক্রাম্ব ফ্রাই দিলে সেটা উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো হয়। (Fish and Chips)

তবে অবস্থা কিছুটা হলেও পাল্টাচ্ছে হালফিলে। তার কারণ সম্ভবত দু’টো। এক, নেট দুনিয়ায় অবাধে বিচরণ করা জেন জ়ি-র একটা বড় অংশের কাছে ভুলভাল শব্দবন্ধ ব্যবহার করে পার পাওয়া যাবে না। দুই, ভালো ফিশ ফ্রাই এখন অনেকে বাড়িতেই তৈরি করতে পারেন। তাহলে ফিশ ফ্রাই দিলে আর নতুনত্ব কী থাকল? ফিশ ব্যাটার ফ্রাই তৈরিতে কিন্তু কয়েক গুণ বেশি কেরামতি দরকার। যা বাড়ির কিচেনে ঝট করে বানানো যাবে না। (Fish and Chips)

২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করা পার্ক স্ট্রিট তল্লাটের রিপন স্ট্রিটের ‘ইটারনিয়া’ মাত্র মাস কয়েক আগে চালু করেছে ‘মিনি ফিশ অ্যান্ড চিপস্’। যাতে ফিশ ব্যাটার ফ্রাই, কোনও ভুলচুক হয়নি। একই রকম রুচিশীল পদক্ষেপ সল্টলেক সেক্টর ফাইভে উচ্চকোটির পাব ‘ব্রুহাইভ’-এর। ২০১৯ সালে সূচনা হওয়া ওই পাবের মেনুতে ফিশ অ্যান্ড চিপস, এর ঠিক নীচে লেখা- ভেটকি ফিলে, ব্যাটার ফ্রাই, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ়। লন্ডন, বার্মিংহামে আনুষঙ্গিক হিসেবে টার্টার ডিপ আর লেবুর টুকরো দেওয়া হয়। বিলেতের কোনও কোনও পাবে গার্নিশিংয়ে পার্সলে পাতা ভেজে ছড়িয়ে দেওয়া হয় দু’টুকরো মাছের উপর। ব্রুহাইভের ফিশ অ্যান্ড চিপসে ওসব তো থাকেই, সেই সঙ্গে দু’টো নিজস্ব টাচ। এক, দু’খণ্ড ফিশ ব্যাটার ফ্রাই রাখা হয় প্লেটে বিছিয়ে রাখা কলাপাতার উপর। দুই, একটা চেরি টোম্যাটো, যা দেখতে ভালো, খেতেও। (Fish and Chips)
আরও পড়ুন: লুকোচুরির ‘মাছ রান্না’
তবে কলকাতায় সত্যিকারের ফিশ অ্যান্ড চিপসের পথিকৃৎ সম্ভবত শরৎ বোস রোড চত্বরে লেক টেরেসের ‘কডফাদার’। যার সূচনা একযুগ বা তারও বেশি আগে। ওই রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ ঘোষণাই করেছিলেন যে, ব্রিটিশ স্টাইল ব্যাটার্ড ফিশ অ্যান্ড চিপস্ থেকে এবং বিলেতের খ্যাতনামা পাবগুলো থেকে তাঁরা অনুপ্রাণিত। কডফাদারেই পাওয়া যায়, অন্তত বছর দশ-বারো আগে পাওয়া যেত বিয়ার ব্যাটার ফিশ। যাতে ব্যাটারে মিশবে বিয়ার-ও।

লন্ডনের বহু পাব তো বটেই, এমনকি খোলা রাস্তায় ফিশ অ্যান্ড চিপস্-এর দোকানেও মেলে ওই বিয়ার ব্যাটার ফিশ। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনী, এখন মেক্সিকো প্রবাসী জৈব-প্রযুক্তি বিজ্ঞানী, ভোজনরসিক অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘সর্বত্র নয়, তবে লন্ডনের বিশেষ কিছু জায়গায় ফিশ অ্যান্ড চিপসে ফিশের উপরের ব্যাটারটা অসাধারণ।’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘ওই সব ঠেকে ফিশ ব্যাটার ফ্রাইটা তেল জবজবে নয়, খুব কড়মড়ে হয়। সব চেয়ে বড় কথা, ব্যাটারে পড়ে ‘পেল এল’ ব্র্যান্ডের অ্যামবার বিয়ার। ওই বিয়ার কিন্তু পাতলা নয়, বেশ ঘন আর তাতে কড়া গন্ধ। যার ফলে ব্যাটারটায় একটা অদ্ভুত ভালো ফ্লেভার আর টেস্ট আসে।’
তর্কসাপেক্ষে ‘বিজলী গ্রিল’-ই কলকাতায় মাছের ফিলে ব্যাটারে চুবিয়ে ফ্রাইয়ের প্রবর্তক। কেটারিং ও রেস্তোরাঁ জগতের ওই কিংবদন্তি প্রতিষ্ঠান সেটা শুরু করেছিল ফিশ ওরলির মাধ্যমে। ওই ফিশ ওরলি ছিল কিছুটা বিলেতের ফিশ অ্যান্ড চিপস্ আর কিছুটা প্যারিসের দক্ষিণ-পূর্বে, ওরলি নামে শহরতলির মাছভাজা, ফিশ ওরলির ককটেল। হ্যামবার্গার যেমন হামবুর্গ শহর থেকে, ফিশ ওরলিও তেমন জায়গার নামে – ওরলির নামে।

নিউ টাউনে বিজলী গ্রিলের রেস্তোরাঁ ‘রুটস্ অফ ক্যালকাটা’-র কর্ণধার শাশ্বতী বারিক জানাচ্ছেন, তাঁর রেস্তোরাঁর মেনুতে বিলিতি ফিশ অ্যান্ড চিপস্ ঢুকে পড়ল বলে। এখন চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্ব। এক-একটা প্লেটে দু’টো ব্যাটার ফ্রাই, ম্যাশড গ্রিন পিজ়, হ্যান্ড কাট ফ্রাইজ়, টার্টার ডিপ এবং বড় জাতের যে পাতিলেবু, তার একটা টুকরো।
ওই রেস্তোরাঁর শেফ লিও গোমস্ বলছেন, ‘ফিশ অ্যান্ড চিপসে ভেটকির টুকরো কিন্তু ক্রাম্ব ফ্রাই কিংবা পাতুরির মতো কাটলে হবে না। তা হলে ব্যাপারটা বেগুনির মতো হয়ে যাবে। লম্বা, অল্প চওড়া এবং বেশ কিছুটা পুরু করে ফিলে কাটাতে হবে। মাছের ফিলের একটা ডেপথ থাকতে হবে। তবেই আসবে ফিশ অ্যান্ড চিপসের আসল শেপ। আর ব্যাটার তৈরি করতে হবে ময়দা, কর্নফ্লাওয়ার, অল্প পরিমাণ ডিম, নুন আর জল ভালো করে ফেটিয়ে। ময়দার সঙ্গে কর্নফ্লাওয়ার মেশালেই আসবে ওই কড়মড়ে ভাব। এই ফিশ ব্যাটার ফ্রাইয়ের তেল জবজবে না-হওয়া অনেকটাই নির্ভর করছে ব্যাটারটা ভালোভাবে তৈরির উপর।’
উচ্চাঙ্গের ফিশ অ্যান্ড চিপসের রহস্যের অনেকটাই লুকিয়ে তার ব্যাটারে।
ছবি সৌজন্য: লেখক, ব্রুহাইভ, অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, Pexels, Wikimedia Commons
খাওয়ার জন্য বাঁচেন। চোখ বেঁধে খেতে দিলেও রুই ও কাতলা মাছের পার্থক্য নিরূপণ করতে পারেন অনায়াসে। আর চোখ খোলা থাকলে? মুখে না-তুলে রান্না করা খাবারের রং দেখেই বুঝতে পারেন, নুন বেশি বয়েছে নাকি কম।