জমিয়ে শীত মানেই মিঠে নরম রোদ্দুর, আর পিঠে রোদ্দুর নিয়ে নলেন গুড় আর নতুন চালের পিঠে খাওয়া.. পিঠে, নানান রকম নানান স্বাদের, যা অঞ্চল-বিশেষে এক এক রকম বৈচিত্র্য নিয়ে বংশপরম্পরায় চলে আসছে, মা ঠাকুমাদের হাত ধরে। আগেকার দিনে, এই বিশেষ রান্নার উৎসবে হেঁশেল হয়ে উঠত শিল্প আর দক্ষতা হস্তান্তর করার এক অলিখিত বিদ্যালয় যেন— সরু চাকলি, গোকুল পিঠে, নক্সী পিঠে, ভাজাপুলি, দুধপুলি, চন্দ্রপুলি আরও কতরকম পিঠে পুলি..
সংক্রান্তির আগে, চাল ভিজিয়ে নিখুঁতভাবে গুঁড়ো করা হত, তারপর দক্ষতার সঙ্গে সঠিক আঁচে, সঠিক উপকরণে আর শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় রূপ পেত নানান পিঠে। পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি বা উত্তরায়ণ সংক্রান্তি, যখন সূর্য আবার উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করে, ধনু থেকে মকর রাশিতে সঞ্চারিত হয়, সেদিন ভোরে স্নান সেরে পরিষ্কার শাড়ি পরে বাড়ির মা কাকিমা জেঠিমারা শুরু করেন পিঠে পার্বণ…এই পৌষ সংক্রান্তিতে কোথাও কোথাও পুজো হয় ‘উঠোন লক্ষ্মী’ বা ‘পৌষ লক্ষ্মী’র… উঠোনময় আলপনা দিয়ে সাদরে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন ধানের আশীর্বাদকে… পৌষকে বেঁধে রাখতে, লক্ষ্মীর কৃপাদৃষ্টি ধরে রাখতে কোথাও কোথাও পালন করা হয় চাউনি বাউনি লোকাচার। শীষ সমেত ধানগাছ পুজো করে তা দিয়ে ধানের গোলা, খুঁটি, সিন্দুক বাঁধা হয়… মেয়েরা পৌষ বন্দনা করে গান করে, “পৌষ পৌষ সোনার পৌষ, এসো পৌষ যেয়ো না…” শীতের বাংলা নতুন ধানের আনন্দে মেতে ওঠে, পুজো আর পিঠে পার্বণে… সেই পিঠে উৎসবে এবারে রইল চাররকম পিঠে। দুটো পিঠে বদলে যাওয়া জীবনযাত্রা মাথায় রেখে, চটজলদি আর দৃষ্টিনন্দন। আর দুটো আমার মাসিশাশুড়ির কাছে শেখা ওপার বাংলার ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু পিঠা… ১. বলা পিঠা২. ছিটা পিঠা৩. রোল মালাই পুলি পিঠে৪. সুজি দিয়ে ভাপা পিঠে

বলা পিঠা
২ কাপ চালগুঁড়ি৩ কাপ জল১/২ চা চামচ চুন১/২ চা চামচ নুন খুব ভালো করে হাত দিয়ে মিশিয়ে নিয়ে মিডিয়াম আঁচে ক্রমাগত নেড়েচেড়ে নিতে হবে। যখন সেটা প্যানের গা থেকে উঠে উঠে আসবে তখন আঁচ বন্ধ করে নামিয়ে ঠান্ডা করে নিতে হবে। ঠান্ডা হলে ভালো করে ঠেসে মেখে, বড় এক বাটি ঠান্ডা জলের ওপর একটা ছানতা ধরে, অন্য হাত দিয়ে একটু একটু করে ওই সেদ্ধ করা চালের মণ্ড চেপে চেপে জলে ফেলতে হবে, খানিকটা কাঠি ভাজার মত আকারে হবে। ওদিকে— ১ কাপ গুড়৩ কাপ জল১” দারচিনি৪ এলাচ২ তেজপাতা১/৪ চা চামচ নুন একসঙ্গে মিশিয়ে ফুটিয়ে নিয়ে প্রায় ২ কাপ মতো করে নিতে হবে। তারপর এক একটা ছোট কাচের গ্লাসে গুড়ের মিশ্রণ দিয়ে তাতে ওই পিঠাগুলো জল ঝরিয়ে দু চামচ করে ঢেলে দিতে হবে। ওপরে একটু নারকেল কোরা দিয়ে সাজালেই রেডি, মুখে দিলেই মিলিয়ে যাওয়া বলা পিঠা! আমি অবশ্য গুড় গুলে না ফুটিয়ে, একদম প্রথম ওঠা পাতলা নলেন গুড় দিয়েই বানিয়েছি।

ছিটা রুটি/ পিঠা
১ কাপ চাল গুঁড়ো১/২ কাপ ময়দা১/২ চা চামচ নুন১ টেবিল চামচ আদার রস১ টেবিল চামচ পেঁয়াজের রস১ চা চামচ রসুনের রস১ ডিমের সাদা অংশজল ১ ১/২ কাপ সবগুলো একসঙ্গে মিশিয়ে একটা স্টিলের বড় ফুটোর ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। এই গোলাটা একটু পাতলা হবে, যাতে চামচ ডোবালে চামচের গায়ে একটা আস্তরণ হয়ে এক তারের মতো সরু হয়ে পড়ে… তারপর, পাঁচ আঙুল ডুবিয়ে নিয়ে গরম প্যানের ওপর হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওই গোলাটা ফেলে নরম আঁচে ছিটা পিঠা তৈরি হয়। তবে একটা ৫০০ মিলিলিটার বোতলের ঢাকনাতে খুব সরু ফুটো করে, তাতে ওই মিশ্রণ ভরে, সেটা দিয়ে প্যানের ওপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মিশ্রণ ঢেলে, নরম আঁচে এই পিঠে তৈরি হয়। এই অল্প নরম আর অল্প মুচমুচে রুটি বা পিঠা, গুড় দিয়ে হোক বা তরকারি দিয়ে, দারুণ খেতে লাগে।

রোল মালাই পুলি পিঠে
পুলির জন্যে—২ কাপ চাল গুঁড়ো২ কাপ জলনুন ১/২ চা চামচ সব মিশিয়ে, একটা প্যান গরম করে মিডিয়াম আঁচে ৩-৪ মিনিট নেড়েচেড়ে নিতে হবে। তারপর ঢাকা দিতে রাখতে হবে আরও ৪ মিনিট। তারপর ঠান্ডা হলে খুব ভালো করে মেখে নিতে হবে। পুরের জন্যে— নারকেল কোরা ৩ কাপখেজুর গুড় ১ কাপ খেজুর গুড় গরম প্যানে দিয়ে, সঙ্গে এক টেবিল চামচ জল দিয়ে গলিয়ে নিতে হবে। তারপর তাতে নারকেল কোরা দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে নরম আঁচে, যাতে একটুও জল না থাকে। তারপর ঠান্ডা করে নিতে হবে মালাই এর জন্যে—দুধ ৩ কাপচিনি ২ টেবিল চামচচাল গুঁড়ো ১ টেবিল চামচদারচিনি ১”এলাচ ৪ টেতেজপাতা ১ টা সব মিশিয়ে, ভালো করে ক্রমাগত নেড়ে ফুটিয়ে গাঢ় করে নিতে হবে। তেজপাতা আর গরম মশলা সরিয়ে দিতে হবে তার থেকে।এরপর, চালের মাখাটা থেকে লেচি কেটে ১/৪” মোটা করে রুটি বেলে নিতে হবে। তার ওপরে পিৎজাতে সস দেওয়ার মতো নারকেল পুর বিছিয়ে দিয়ে এক ধার থেকে গোল করে রোল করে নিতে হবে। সবগুলো রেডি করে, একটা স্টিমারে ২০-২৫ মিনিট স্টিম করে নিতে হবে ঢাকনা দিয়ে। তারপর, ছুরি দিয়ে কেটে, থালায় সাজিয়ে মালাই দিয়ে পরিবেশন গরম গরম। সেদ্ধ পিঠের এ এক অন্য রূপ, অপূর্ব লাগে খেতে কিন্তু…

সুজির ভাপা পিঠা
১ কাপ সুজি, নরম আঁচে ভেজে ঠান্ডা করে রাখা৩ টেবিল চামচ চিনি১/২ চা চামচ বেকিং সোডা১/৪ চা চামচ নুন১ কাপ জল ভালো করে সব মিশিয়ে নিয়ে আধ ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। তারপর ওই মাফিন মোল্ড বা কুকি মোল্ড বা ছোট বাটিতে তেল বা ঘি বুলিয়ে ১ টেবিল চামচ সুজি গোলা দিয়ে তার ওপরে একটু খেজুর গুড় আর একটু নারকেল কোরা দিয়ে আবার একটু সুজি গোলা দিয়ে ওপরে নারকেল কোরা দিয়ে সবগুলো রেডি করে নিতে হবে। তারপর একটা স্টিমারে দশ মিনিট ঢাকা দিয়ে ভাপিয়ে নিতে হবে। আমি প্রেসার কুকারে জল গরম করে তার ভিতরে স্টিমার স্ট্যান্ড বসিয়ে তাতে মাফিন মোল্ড রেখে ভাপিয়েছি।আর পরিবেশনের সময়, পাতলা সুগন্ধযুক্ত নলেন গুড় দিলেই জমে যাবে চটজলদি ভাপা পিঠা। এই পিঠে ব্যস্ত জীবনে যখন চাল গুঁড়ো করার বা কেনার সময় নেই, ঠিক তখন ঝটপট বানিয়ে নেওয়ার জন্যে একদম আদর্শ। শীত এদেশে ক্ষণস্থায়ী, পৌষ যেও না বললেও সে চলে যায়, আবার অপেক্ষা করিয়ে… রেখে যায় এই কর্মব্যস্ত জীবনে হারিয়ে যাওয়া যৌথ পরিবারের স্মৃতি পাতা থেকে রসনা তৃপ্তির উপহার, তাই উপভোগ করি না হয়… ছবি সৌজন্য: লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।