আত্মপ্রসাদ
বারমুডা আর স্যান্ডোগেঞ্জি পরা নিজের চেহারাটা সেলফিতে দেখল গেজেট। একবার, দু’বার, তিনবার। ‘গেজেট‘ নামটা পাড়াপড়শির দেওয়া। যে কোনও খবর ঝড়ের আগে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাবলু দাসের নাম ‘গেজেট‘। তিপ্পান্ন বছরের বাবলুর এই স্বভাব আজকের নয়। তখন মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট গেজেটে বার করত শিক্ষাপর্ষদ। বাবলু মহানন্দে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে পাড়ার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিত অকৃতকার্যতার সংবাদ। কে টায়েটুয়ে পাশ করেছে কিংবা কার থার্ড ডিভিশন! বহুত মজা হত গেজেটগিরি করে। আত্মপ্রসাদ। কাঁকড়াগিরি। এখন আর সেদিন নেই। হোয়াটসঅ্যাপ আর ফেসবুক এসে বাবলুর গেজেটত্ব মেরে দিয়েছে। খবর ছোটে হাওয়ার আগে। কোথায় সেই রামরাজ্য!
গেজেট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নেয়াপাতি ভুঁড়িটা গন্ডগোল করছে। দীর্ঘদিন লকডাউনে ঘরে বসে বসে কাঁহাতক বাসন মাজা আর কাপড় কাচা যায়! বিদ্রোহ করেছিল বলে বউ বলেছে বাসন মাজা মকুব। বদলে টিকটক করে হোয়াটসঅ্যাপে ছাড়তে হবে।
– টিকটক? সেটা কী?
– হুঁ। তুমি নাচবে আর আমি বসে বসে মাল খাব।
গেজেটের চোখ পকোড়া।
– নাচব?
– বচ্চনের ঐ গানটার সঙ্গে আমার গোলাপি ঘাগরা পরে নাচবে। আর আমি তোমার দিকে টাকা ছুঁড়ে দেব। এতকাল ধরে তোমরা যা করেছ তার উল্টোটা।
– কোন গান? জিসকি বিবি মোটি উসকা ভি বড়া নাম হ্যায়?
একটা খুন্তি উড়ে এসেছিল গেজেটের মাথা লক্ষ্য করে।
বারমুডা ছেড়ে গোলাপি ঘাগরা পরলে যদি বাসনমাজার কাজটা কমে! পুড়ে যাওয়া কড়াই মেজে ঝকঝকে করার থেকে ভালো। কীভাবে যে বউটা রোজদিন এই খাটুনির কাজ করে। যাকগে, এখন বোতল জোগাড় করতে হবে। অন্ধকার হোক। ভোলামুদির দোকানের পিছনে চুপ করে দাঁড়াতে হবে। সবাই ওভাবেই মাল কিনছে। অন্ধকারে কলাপাতার মধ্যে খসখস আওয়াজে অস্বস্তি হতে লাগল গেজেটের। কুকুর? নাকি শিয়াল? ভাতজাংলার এখানটা কৃষ্ণনগর শহরের একদম কাছে হলে কী হবে, পাড়াগাঁ ভাব। তার মধ্যে বিনবিনে মশা। পাখির সাইজ। এক একটা কামড়াচ্ছে যেন কাঠঠোকরা। শালা! কেন যে বউয়ের আবদারে রাজি হলাম! মাল আনতে দোকানের গুদামে ঢুকে ভোলা করছেটা কী?

আজ বোধহয় পূর্ণিমা। চাঁদ উঠেছে আকাশে। সামনের বিশাল পরিত্যক্ত বাড়িটার ছাদে একটা ছায়া সরে গেল। গায়ে কাঁটা দিল গেজেটের। বাড়িটায় কেউ থাকে না আজ দশ বছর। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিঁঝি ধরেছে। তা হোক। তাদের জন্যই তো লোকের ঘরে টাকা ঢুকছে। অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। জয় হোক মাতালদের। ‘করোনা মাঈ কী জয়‘ বলে চেঁচাতে গিয়েও চুপ করে গেল গেজেট। পেগ না মেরেই কি খোয়াব দেখছে? থরথর করে কাঁপুনি শুরু হল।
– ভূ উ উ উ ত
দাঁতে দাঁত চেপে দড়াম করে উল্টে পড়ল গেজেট। ভোলা বোতল নিয়ে বেরিয়ে গেজেটকে খুঁজে না পেয়ে হাঁক পাড়ল,
– কই গেলি? কেউ নেই রে। নিচ্চিন্তে আয়।
কিন্তু মোমের আলোয় খরিদ্দারের মুখ দেখে ভোলার রক্ত চলকে উঠল। বুক গুড়গুড়। ডাক্তারবাবুর আত্মা? উনি তো মারা গিয়েছেন আজ দু’হপ্তা! প্রসাদ ডাক্তার। বড় ভালো চিকিচ্ছে করেন। কিন্তু, ওঁর নাকি করোনা হয়েছিল। ভোলা হাঁউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠতেই ভিড় জমে গেল দোকানের সামনে। চাঁদের ফ্যাটফেটে আলোয় ডাক্তার প্রসাদকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
– আপনি বেঁচে আছেন ডাক্তারবাবু?
– ইয়ে, আমরা তো শুনেছিলাম আপনি এলাকা থেকে উধাও।
– সবাই দুঃখ পেয়েছে ডাক্তার। আপদ বিপদে রাতবিরেতে আপনার কাছে যেতাম!
চন্দ্রালোকে উপস্থিত জনতার কারও কারও যাও বা সন্দেহ হচ্ছিল, ছায়ামূর্তি দেশলাই এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার চাইতেই সম্বিত ফিরল। মানুষ হাত ধুয়ে ফেলতে পারে। চিরদিনের স্বভাব। কিন্তু ভূত নিশ্চয়ই হাত ধুয়ে ফেলবে না। এ ডাক্তারবাবু না হয়ে যায় না। ভোলা খুচরো ফেরত দিতে গিয়ে ছায়ামূর্তিকে জড়িয়ে ধরল।
– ডাক্তারবাবু আপনি আমার টিবি অসুখটা যেভাবে সারিয়েছিলেন! নয়তো মরেই যেতাম।
– ঠিক ধরেছ ভোলা। আমি এখন ডাক্তার আত্মাপ্রসাদ। তোমাদের জন্য সার্ভিস দিয়ে আজ নিজেই আত্মা হয়ে গেলাম। জানো কেন এমন হল?
ভোলার চোখ ছলছলে।
– মাসখানেক আগের কথা। চেম্বারে এক রোগী এল। মোটাসোটা, ডায়াবেটিস। জ্বর। আমি দেখতে চাইছিলাম না। কিন্তু ঐ যে একটা শপথ নিতে হয়েছিল পাশ করার সময়। হিপোক্রেটিসের শপথ। অসহায় রুগী ফেরানো যাবে না। দেখলাম। ওষুধপত্তর দিলাম।
– তারপর?
– পরদিন খবর পেলাম রোগী মারা গেছেন। ভয়ে বুক কেঁপে উঠল। তবে কি রোগীর করোনা হয়েছিল? তবে কি আমারও?
– জানি স্যার, উনি কৃষ্ণনগরের বিরাট বড় বিজনেসম্যান ছিলেন। শেষটা খুব খারাপ। মারা যাওয়ার পর ফ্যামিলির কাছে বডি যায়নি। এমনকী যেভাবে লুকিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে যেন ক্রিমিনাল।
– ঠিক। বাস্তবটা এতটাই নিষ্ঠুর যে আমাকেও সেই ভয় তাড়া করল। আমার যদি রোগীর থেকে করোনা হয়, তাহলে আমারও কি একই পরিণতি? পাড়ায় লোকে আড়চোখে দেখবে, ফিসফাস করবে। মরে গেলে বউ ছেলেমেয়ে দেখতে পর্যন্ত পাবে না। এত বছর ধরে মানুষকে সেবা করার এই পুরস্কার?
গেজেট কখন জ্ঞান ফিরে পেয়ে ভিড়ের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ বোঝেনি। ডাক্তার প্রসাদের পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল গেজেট।

– ডাক্তারবাবু ক্ষমাঘেন্না করে দ্যান। প্রথম খবরটা আমিই ছড়িয়েছিলাম। লোকটার করোনা টেস্ট নেগেটিভ এসেছিল। কিন্তু ততক্ষণে গুজবটা ছড়িয়ে গেছিল যে…
– হ্যাঁ স্যার, আপনাকে এভাবে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে! ছি ছি। লজ্জা আমাদের। কাল যদি আমাদের ঘরে ঘরে করোনা জ্বর হয় কোথায় পালাব সবাই? আপনারাই তো ভরসা।
– ভরসা নয় ভগবান।
ভিড়ের মধ্যে থেকে উড়ে এল কথাটা। ডাক্তার প্রসাদ হঠাৎ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন।
– এই ভগবান বলা বন্ধ করুন তো। দশচক্রে ভগবান ভূত! ভগবানকে এক নিমেষে শয়তান বানানো যায়। একবার ছুঁয়ে দেখুন আমায়। আপনাদের মতো মানুষ। রক্তমাংসের মানুষ। আসুন!
– মাফ করেন ডাক্তারবাবু। বুঝতে পারছি, কী কষ্টের মধ্যে আছেন আপনারা …
– এই পুরনো বাড়িটায় আজ চোদ্দোদিন ধরে আধপেটা খেয়ে আলাদা হয়ে আছি, জানেন? ঘুম নেই চোখে। সারাক্ষণ এক দুশ্চিন্তা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আজ কোয়ারেন্টাইন খতম। এবার বাড়ি ফিরব। বুড়ি মা আমার, কেঁদে কেঁদেই শেষ বোধহয়। আমাদের ঘরেও বউ বাচ্চা আছে। আমাদেরও ভয় হয়, ডিপ্রেশন হয়। কবে আর বুঝবেন?
ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় দেখা গেল কারও কারও চোখে জল চিকচিক। নিস্তব্ধ চরাচর। ডাক্তার এতক্ষণে আত্মপ্রসাদের আলগা হাসি দিলেন। হালকা।
নিউটনের ঈদ
– ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানেই খুশি। বছরে এই দুটো ঈদের জন্য হা পিত্যেশ করে বসে থাকি। হায় আল্লা, এমন ঈদ আসবে কে জানত?
– কেন আম্মি? জামাকাপড় কিনবে না?
– বড়সড় খরচা রে সোনা।
– তা হোক। চলো না আম্মি। এবছর ইফতারে শুধু মুড়ি, বেগুনি। ভাল্লাগে না!
– বুশরা, আমার মোটে কটা টাকা। তোর জন্য শুধু একটা ফ্রক হবে।
– লেসের কাজ করা, কেমন? সাদা নেটের ফ্রিল।
– অত দাম দিয়ে কিনতে পারব না মামণি। শিমূলের জন্মদিন ঈদের দিনে। ভুলে গেলি?
– তাহলে ভাইজানের জামা আগে কেনো আম্মি। আমাকে চুড়ি দিলেই হবে।
মায়ের চোখে জল দেখে নিউটন চুপ করে গেল। আজ পঁচিশ তারিখ। মে মাসের এই বিশেষ দিনটাতে আর কিছু না হোক মা একবাটি পায়েস রান্না করবেই। নিউটনের নাম ওর বাবা রেখেছিলেন শিমূল। বাড়ি ঘিরে টকটকে লাল শিমূল ফুলের গাছ। শিমূল সালাউদ্দিন নামটার ‘নিউটন‘ হওয়ার পিছনে একটা কারণ ছিল। আব্বা মারা যাওয়ার পর স্কুলছুট হতেই হয়েছিল শিমূলকে। আম্মির সঙ্গে রোজ দোকানে বসতে হত। পেঁয়াজি, বেগুনি, মোচার চপ, আলুর চপ আর চা। একহাতে সামাল দিতে পারত না মা। একপ্রস্থ বিক্রি হত সকালে। কচুরি ভাজত মা। আর শালপাতার প্লেটে একহাতা করে আলুর তরকারি দিয়ে চারটে কচুরি সাজিয়ে দিত সে খরিদ্দারদের। প্রতি প্লেট দশ টাকা। বড় উনুনে চা বানাত মা। কেটলি থেকে ঢেলে দিত মোটা কাচের গেলাসে। শিমূলের কাজ ছিল গেলাসগুলো থালায় বসিয়ে হাতে হাতে দেওয়া। বেঞ্চ তো মোটে একটা। টেনেটুনে তিনজন বসতে পারে।
বোন স্কুলে যেত। মিড ডে মিলের আশায়। শিমূলের আর স্কুল যাওয়া হল না। কম্পিউটার চালাতে এত ভালো লাগত, অথচ কথাটা বলাও হল না আম্মিকে। সে না দেখলে কে দেখবে তার মাকে! যখন উনুনের তাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চপ ভাজতে ভাজতে মায়ের মুখ লাল হয়ে যায়, ইচ্ছে হয়, পুকুরের পানি নিয়ে আঁজলা করে মায়ের মুখটা ভিজিয়ে দিতে। মা তার পৃথিবী। আব্বা তো চলেই গেলেন। দোকানদারি করলেও শিমূলকে নিয়ে বড় স্বপ্ন ছিল তাঁর। ছেলের যে কম্পিউটার সায়েন্স ভালো লাগে জানতেন আব্বা। তিল তিল করে জমাচ্ছিলেন। পাঁচ হাজার হয়েছিল। সব চলে গেল আব্বার দাফনে। নিউটন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বারো বছর বয়সে যে ছেলের বাবা মারা যায়, তার ভাগ্যে লড়াই আর লড়াই।

দুপুরবেলাটা সে আর বাড়ি যায় না। আবির চাচাদের বাগান, ক্ষেত পাহারা দেয়। আবির আলি ফিরোজ হলেন মুর্শিদাবাদের বিরাট আমবাগানের মালিক। যেমন মিষ্টি আম, তেমনি সুস্বাদু। কোহিতুর, গোলাপখাস, বেগমবাহার, বিরা, নবাবপসন্দ, রানি, চম্পা, চন্দনকোষা, ল্যাংড়া, হিমসাগর, মির্জাপসন্দ.. প্রায় একশো ত্রিশ প্রজাতির আম। পাহারাদার আছে প্রায় কুড়িজন। শিমূলের বাবা মারা যাওয়ার পর আবিরচাচা বাগানের পুবদিকটা পাহারার কাজে লাগিয়েছিলেন শিমুলকে। দুপুরবেলা একথালা ঝরঝরে সাদা ভাত, ঘন মুসুর ডাল আর তিন-চার রকমের তরকারি পাঠাতেন চাচি। অমন সুস্বাদু ব্যঞ্জন তাদের বাড়িতে হয় না। বাপমরা ছেলের জন্য চাচির হয়তো করুণা হত। সেরকমই একদিন বসেছিল এক আমগাছের তলায়। মাথার উপর এসে পড়ল একটা কোহিতুর আম।
প্রচণ্ড নরম এই আম। রাজা বাদশার খাওয়ার যোগ্য। কিন্তু ফলন খুব কম। পাড়াও মুশকিল। এমন তুলতুলে, যে অতি সামান্য চাপেও ফেটে যেতে পারে। শিমূল গল্প শুনেছে এই আম নাকি মসলিনে জড়িয়ে রাখতে হত নবাবদের জন্য আর পাড়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই খেয়ে ফেলতে হত। অবাক কান্ড! আমটা পড়বি তো পড় শিমূলের মাথায় এবং একফোঁটাও বিকৃত হল না। শিমূল সেই আম হাতের তেলোতে সাবধানে বসিয়ে ছুটল আবিরচাচার কাছে। মাথায় আপেল পড়েনি বটে, কিন্তু অত্যাশ্চর্য এই ঘটনার জন্য সেদিন থেকে তার নাম হয়ে গেল নিউটন।
আবির চাচা তার উপর এতটাই খুশি হল যে বাড়ির লাইব্রেরির বই পড়তে দিয়ে দিল শিমূলকে। শিমূলই প্রস্তাবটা দিয়েছিল। একে স্কুলছুট। তায় লকডাউন। বাইরের জগত বলতে আমবাগান আর খরিদ্দারেরা। মনের খোরাক পাবে কোথায়? বোন তো বাড়িতে বসে থাকে আজকাল। টুকটাক ঘরকন্নার কাজ করে। দাদা আর মা রোজ রাতে দোকান বন্ধ করে ফিরে এলে একসঙ্গে গল্প হয়। রোজা রেখেছে মা আর বোন। নিউটন ওদেরকে রোজকার পড়া গল্প ভালো করে বলে। শিমূল পড়েছে, নিউটনেরও লেখাপড়া শুরু করতে একটু দেরি হয়েছিল। দিদিমার কাছে উলসথ্রপে মানুষ হচ্ছিলেন নিউটন, কারণ তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর মা আবার বিয়ে করেছিলেন। নিউটনকেও ক্ষেতখামারের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন ওঁর মা। তবে কিছুদিন পর নিজের মেধার জোরে স্কুলে গেছিলেন নিউটন। আর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতেও ভর্তি হয়েছিলেন।
শিমূল জানে, ওর হয়তো আর স্কুল যাওয়া হবে না। আমবাগান পাহারা দেওয়ার টাকা সংসারের খরচে লাগে। চুপ করে বই পড়ে সে। একদিন সাহস করে বলেই ফেলল,
– আপনার ইয়া বড় স্মার্টফোনটা ব্যবহার করতে দেবেন চাচা? ওটা দিয়ে তো ফোন করেন না।
আবির আলি নিউটনকে স্নেহের চোখে দেখেন। প্রশ্রয় দিয়ে বললেন,
– হ্যাঁ ফোন করি ছোট মোবাইল থেকে। বড়টা তো পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। আমরা ঠিকঠাক ব্যবহার করতে জানি না। তুই চালা। জিনিসটা ভালও থাকবে।
সেই থেকে শুরু নিউটনের স্মার্টফোন ঘাঁটাঘাঁটি। আবির আলি মাঝেমধ্যে দেখেন বিকেলেও ছেলেটা ঠায় বসে চোখ রেখেছে স্ক্রিনে। কী সব টেপাটেপি করছে।

বছরটা বড্ড মন্দ যাচ্ছে এবার। বিশে বিষ। শুরু থেকে রোগব্যাধি। আল্লাতালা রুষ্ট, প্রকৃতির প্রতি মানুষের ব্যাভিচারে। কত লোক যে জ্বরে ভুগছে। ফল ফুলুরিও ভাল হয়নি। মধুপোকায় আমবাগানের প্রচুর গাছে আম ধরেনি। গুটি অবস্থাতেই পড়ে গেছে। যাও বা ছিল, ঝড়ে ঝরে একেবারে লন্ডভন্ড বাগান। আবির আলির মাথায় হাত। ঈদের আগে এ কী ক্ষতি! এখন কীভাবে সে বিক্রি করবে এই আম। নেবে কীভাবে? লরি চলাচল বন্ধ। লকডাউন ওঠেনি সর্বত্র। এতগুলো লোকের মাইনে তো দিতে হবে! ঈদ বলে কথা। পঞ্চায়েতের মোড়ল এসে বলল,
– এবারে কোনও আশা নেই। আম সব বিলিয়ে দেওয়া হোক।
– তাহলে এক টাকাও তো আমার ঘরে ঢুকবে না! বিরাট লোকসান। চালাব কীভাবে?
নিউটন চুপ করে দেখছিল সব। সকাল হয়েছে সবে। আজ মায়ের সঙ্গে দোকানে যাওয়া হবে না। সোজা চেয়ে নিল আবির আলির স্মার্টফোন। ঘুটঘাট করল বেশ কিছুক্ষণ। ঘণ্টাতিনেক পর থেকে আবির আলির মোবাইলে পরপর ফোন আসতে লাগল। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই সার সার গাড়ি এসে দাঁড়াল তাদের গ্রামে। টেম্পো, ছোট হাতি, মায় প্রাইভেট গাড়ি, বাইক, এমনকী অটো। সবাই আম কিনতে এসেছে।
আরও পড়ুন: বাংলালাইভের বিশেষ ক্রোড়পত্র: সুরের সুরধুনী
রাতভর হাত লাগাল বাগানের কর্মচারীরা। ঈদের সকালে আবির আলির ঝুলি ভরে উঠল কড়কড়ে নোটে।
– হ্যাঁ রে নিউটন, কী যাদু করলি বাপ?
শিমূল আনন্দে ডগমগ। মিষ্টি হাসল।
– দেড় বছর ধরে আপনার স্মার্টফোনে একটা অ্যাপ বানিয়ে রেখেছিলাম চাচা।
– অ্যাপ মানে? আপেল?
নিউটন হেসে ফেলল।
– গুগল ঘেঁটে শিখে নিয়ে এই অ্যাপটা আমি নিজে ডিজাইন করে বানিয়ে রেখেছিলাম বিক্রিবাটার জন্য। বেশ ক‘বার মায়ের তৈরি শিমাইয়ের পায়েস বিক্রি করব ভেবেছি। কিন্তু আমার টিম কোথায় চাচা? টাকা কই? লোক লাগবে তো!
গ্রামশুদ্ধ লোক হাঁ করে তাকিয়ে নিউটনের দিকে।
– তোমার নামে একটা মেল আইডি খুলে ফেলেছিলাম চাচা। তারপর এই অ্যাপ দিয়ে গ্রামের আশেপাশে বহরমপুর টাউনে একটা ট্রাই করলাম।
– তারপর?
– লেগে গেল। ঈদের সময় ফল কে না চায়! পাকা আম, কাঁচা আম, সবকিছুর ডিম্যান্ড। খরিদ্দাররা ফোন নম্বর চাইল। আমি তোমারটা দিয়ে দিলাম।
– তোর মাথায় কী আছে নিউটন? ধার দিবি?
শিমূল হেসে বলল,
– এটা কিছুই না। স্কুল যেতে পারলে স্যারের থেকে আরও কত প্রোগ্রামিং শিখতে পারতাম। তবে লকডাউন নিউটনের সময়ও হয়েছিল।
বুশরা উত্তেজিত হয়ে বলল,
– হ্যাঁ, তুই তো বলেছিলি। তখন প্লেগ মহামারী।
শিমূল হেসে বলল,
– বিউবোনিক প্লেগের জন্য কেমব্রিজ ছুটি হয়ে গেছিল। লকডাউনে নিউটন ফিরে এসেছিলেন দিদিমার গ্রামের বাড়ি, উলসথ্রপে।
আবির আলি ফিরোজ হলেন মুর্শিদাবাদের বিরাট আমবাগানের মালিক। যেমন মিষ্টি আম, তেমনি সুস্বাদু। কোহিতুর, গোলাপখাস, বেগমবাহার, বিরা, নবাবপসন্দ, রানি, চম্পা, চন্দনকোষা, ল্যাংড়া, হিমসাগর, মির্জাপসন্দ.. প্রায় একশো ত্রিশ প্রজাতির আম। পাহারাদার আছে প্রায় কুড়িজন। শিমূলের বাবা মারা যাওয়ার পর আবিরচাচা বাগানের পুবদিকটা পাহারার কাজে লাগিয়েছিলেন শিমুলকে। দুপুরবেলা একথালা ঝরঝরে সাদা ভাত, ঘন মুসুর ডাল আর তিন-চার রকমের তরকারি পাঠাতেন চাচি।
শিমূল দেখল মায়ের চোখ বড় বড়। ঐ সময় উনি বিখ্যাত দুটো আবিষ্কার করেছিলেন। বাইনোমিয়াল থিওরেম আর ক্যালকুলাস।
আবির আলি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন।
– বলিস কী? তুই এত কিছু জানিস? লকডাউন উঠলেই তোকে আমি শহরের স্কুলে পাঠাব।
শিমূল ফাজিল হেসে বলল,
– আসলে লকডাউনের সময় স্যার নিউটনের মাথায় আপেল পড়েছিল বলেই বোধহয়, ঠিক যেমন আমার। আম পড়েছিল।
শিমূল দেখল মায়ের চোখ থেকে জল পড়ছে। কিন্তু মুখে হাসি।
– জন্মদিন মুবারক বেটা।
– দাদা, পঁচিশে মে তোর জন্মদিন, কবি নজরুলের জন্মদিন আর পঁচিশে ডিসেম্বর আইজাক নিউটনের জন্মদিন, যিশুখ্রিস্টেরও।
– কেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা ভুলে গেলি? পঁচিশে বৈশাখ? আসলে পঁচিশ তারিখটাই মহামানবদের। রাসবিহারী বসুর জন্মদিনও আজ।
মিচকি হাসল শিমূল।
– দেখাচ্ছি তোর মজা রে ভাইজান।
বুশরা ছুটে গেল শিমূলের দিকে। ‘ঈদ মোবারক নিউটন‘ বলতে বলতে একে একে সবাই আদর করতে এগিয়ে এল শিমূলকে।
*ছবি সৌজন্য: Artmejeur, Fineartamerica, Wonder.ph, Indiaart
পেশায় ডাক্তার দোলনচাঁপা নতুন প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে পরিচিত নাম। মূলত গল্প এবং উপন্যাস লেখেন বিভিন্ন ছোটবড় পত্রপত্রিকায়। 'চন্দ্রতালের পরীরা' এবং 'ঝুকুমুকু' তাঁর লেখা জনপ্রিয় কিশোরসাহিত্যের বই।
2 Responses
খুব ভাল লাগল ।
দুটো গল্পই খুব সুন্দর।মন ছুঁয়ে গেল।