আগের পর্বের লিংক- জীবন তো একটাই, জমায়েত, খাই খাই ক্লাব, পুজোর বাজনা এবং খাজনা, প্রজাপতির নির্বন্ধ, বেড়ু বেড়ু, জন্মদিন, সরস্বতী পুজো,
দোল (Holi) কি আর শুধু রঙের উৎসব! এ হল মাতামাতির মোচ্ছব। রবি ঠাকুর অবশ্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন এই ‘মোচ্ছব’ থেকে টেনে এনে আমাদের মনে এক অন্য উৎসব জাগাতে। ‘মাতামাতি’কে বাতিল না করে তাকে জুড়ে দিতে চেয়েছিলেন এক মহতী-উৎসবের আনন্দে; নবীন প্রাণের বসন্তে। প্রচলিত আচার এবং ধর্মীয় পুজোপাঠের বাইরে এসে এমন এক দিগন্তের দিকে তাকাতে যেখানে শিখায় শিখায় ফুলের আগুন, সুরের আগুন— তাই ‘কাঁদন বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে রাঙিয়ে দিয়ে যাও’। এ এক বৈপ্লবিক আয়োজনই বটে। কিন্তু ক্রমাগত অপব্যবহারে তা হয়ে উঠল এমনই এক প্রাতিষ্ঠানিক নিগড়, যা চিরাচরিত ধর্মীয় আচারের থেকেও শ্বাসরোধকারী। রবি ঠাকুরকে শিখণ্ডী খাড়া করে গজিয়ে উঠল যথার্থ এক ‘আমোদের’ উৎসব; বসন্ত সেখানে একটা ছল মাত্র; যেখানে বিপুল অর্থ ব্যয়ে পলাশ-রঙ্গনে সেজে ওঠা সদন বা অঙ্গনের ছড়াছড়ি; পোস্টমডার্ন বাবু-কালচারের মজলিশ; রবি ঠাকুরের গান, কবিতা এবং নাটকের সঙ্গে টাকা ওড়াবার ‘প্রাইভেট’ ব্যবস্থা। পান-ভোজনের সে এক জম্পেশ বিলাস। ফলে কোনটা যে ঠিক আমাদের সময়, তা আর ঠাওর করতে পারছি না। কারণ এটাই তো দেখছি প্রায় গত চল্লিশ বছর ধরে।

শরীর-জন্মের বয়সটা যখন সাতষট্টি, মনের বয়স তখন আর কত পিছিয়ে থাকবে! ফলে ‘কাঁদন’ এবং ‘বাঁধন’ দুই চেপে ধরেছে বেশ জড়ামড়ি করে। এখন যেন সেই ‘বন্দুক লাও, সড়কি লাও — লাও তো বটে, কিন্তু আনে কে!’ কয়েকজনকে যে বাড়িতে ডাকব সে-ও ভারি মুশকিল! শ্যামলী এবং নমিতা দুজনেই দেশে গেছে, চৈত্রমাসের ‘মোচ্ছব’ মানাতে। এ সময় তাদের গ্রামে কৃষ্ণ-কীর্তন হয়। এক এক এলাকার মানুষ চাঁদা করে মোচ্ছব পালন করে। কেউ একরাত, কেউ তিনরাত, কেউ বা আবার সপ্তাহভর। তাদের মুখে যখন ‘মোচ্ছব’ শব্দটা শুনি তখন তাতে ব্যঙ্গের কলুষ লাগে না; তা যেন ঝলমল করে তাদের বিশ্বাস-পরম্পরার অন্য এক জৌলুসে। সেখানেও কি চলে না মদ-মহোৎসব? সব চলে। কিন্তু উচ্চ সংস্কৃতির নামে বিলাসি অপচয়ের বাহানা খোঁজে না তারা। দারিদ্র্যই বোধহয় এখনও ওদের রক্ষাকবচ। আমি তাই হাসি মুখেই ছুটি দিই ওদের। (Holi)

এবার ভাবতে বসি নিজেকে নিয়ে— এখন উপায়! আমারই বা চলবে কী করে! সকাল থেকে রাত— কাজ তো কিছু কম নয়! সহজ উপায় হল কোথাও একটা বেড়াতে চলে যাওয়া। এ সময় তো অমরকণ্টক, বিহার বা উড়িষ্যার যে কোনও অঞ্চলই ভারি সুন্দর। আর হুট বলতে ছুট, সেও তো চলে যাওয়া যায় কাছেপিঠে এর-ওর বাড়ি। কিন্তু নিজের আস্তানায় থেকে, মঠ-কদমার সঙ্গে খই মুড়কি গুছিয়ে, পাথরের থালায় সুগন্ধি ফুলের আবির সাজিয়ে, পাটভাঙা একখানা সাদা শাড়ি পরে সেজেগুজে বসে থাকা! তার মতো আরাম আর কীসে পাই!
এ সময়টা ফোন হাতে নিলেই ব্যাজার লাগে। হয় রাশি রাশি ফরোয়ার্ডেড মেসেজে নাগরিক শুভেচ্ছা, নাহলে মেগা ডিসকাউন্টে এটা ওটা কেনার হাতছানি! দূর ভাল্লাগে না। আর একা থাকলেই মনে পড়ে যায় কিশোরীবেলার সেই দল জুটিয়ে পিচকিরিতে রং ভরে ছ্যা-র্যা-র্যা- রা…; মনে পড়ে ছোট-বড় সকলে মিলে গঙ্গায় গিয়ে হৈ হৈ করে স্নান। সন্ধেবেলা মাদুর পেতে ছাদে বসে কবিতা গানের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা; যে যেমন পারে— দিদু থেকে নাতি নাতনী; কেউ বাদ নেই। আর এটা ভেবে নিজেকে আজ বেশ সৌভাগ্যের অধিকারী বলেই মনে হয়; কারণ মেয়ের কিশোরীবেলা পার করে, কিশোর নাতিবাবুর দোল খেলার পর্বগুলো দেখতে দেখতে বেশ রৈ-রঙ্গে ‘বুড়োচ্ছি’। এই রে! ‘বুড়োচ্ছি’ শব্দটা লিখেই চোখে জল এল। এ তো আমার ভগ্নীপতি শৌনকের থেকে পাওয়া! যার উদাত্ত গলার গান, লোক জুটিয়ে আড্ডা, নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি গায়ে দোলের সাজ এবং তার মতো সুরা বিলাসীরও না-মদ যাপন; এসব তো হুস করেই শেষ হয়ে গেল তার সেই অকালে চলে যাওয়ায়। বড় বড় গিঁট মারা তাপ্পি দেওয়া মনটাকে একরকম জোর করেই আবার ফিরিয়ে আনলাম হাতের মুঠোয়; কারণ না ফিরবে শৌনক, না আর ফিরে পাব বিক্রম বা মিষ্টুনীদিকে!

হু হু করে মনে পড়ল, আজই তো বসন্ত উৎসব! আমার প্রাণের সেই অন্তরা সাইকিয়াট্রিক সেন্টারে! আমার দেখা গত বাইশ বছরে এই প্রথম খোলা চত্বরে নাচ-গান হবে। বসন্ত উৎসবে এখানকার কর্মীরা যোগ দেন; কিন্তু এবার এক পর্বে থাকবে মন-পীড়ায় আক্রান্ত সেই রোগীরাও; রবি ঠাকুরের গানে যারা নিয়মিত শুশ্রূষা পায় Aesthetic Therapy Unit-য়ে সপ্তাহে একদিন দু ঘণ্টার ক্লাস করে। কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিয়েছেন আর পাঁচজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষদের মতোই এই উৎসবে তাদের সামিল হতে। কী যে আনন্দ হচ্ছে! আর এই আনন্দ তো আজকের সময়কে ঘিরে! এর পিছনে তো স্মৃতি কাতরতা নেই!

এ কী কম আনন্দের হে! বাইশ বছর আগে একদিন যাদের সঙ্গে এ কাজ শুরু করেছিলাম, আজ তাদেরই ছেলে-মেয়েদের বয়সীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এ বিভাগটাই চালাচ্ছি! লকডাউনের সময় ফেসবুকে আলাপ হওয়া দীপাঞ্জন পাল এসে গেল গান শেখাতে; যোগাযোগ করিয়ে দিল কন্যাসমা স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়; শ্রাবস্তী ঘোষ শুরু করে দিল ডান্স থেরাপি। আমার সেই নিষ্ঠ ছাত্রী কৌশিকী আট বছর ধরে এই বিভাগে নাচ শিখিয়ে, হঠাৎই কলেজের চাকরি পেয়ে চলে গেল নর্থ বেঙ্গল। সেই শূন্যতা হু হু করে ভরিয়ে দিল দীপাঞ্জন আর শ্রাবস্তী। ঝিমিয়ে পড়া ক্লাসটাতে এখন যোগদানকারীর সংখ্যা তিরিশ। কম-বেশি জনা ছাব্বিশ তো উপস্থিত থাকেই। নবীন শিক্ষকদের পেয়ে আনন্দে মেতে উঠল সকলে। আমার মেয়ে মধুজাও সেখানে একদিন পৌঁছে গেল তার Art Therapy-র সম্ভার নিয়ে। আর এল অন্তরার পক্ষ থেকে ইন-হাউস কোয়ার্ডিনেটর সুকন্যা। তার তদারকিতে বাড়তি চেয়ার পড়ল। এমনকী টি-ব্রেকে শুরু হল জল-চা-বিস্কুট দেবার ব্যবস্থাও। এমনটা ঘটিয়ে ফেলতে কোনও অসুবিধেই হল না। কারণ এখনকার ম্যানেজমেন্টও চালাচ্ছে নবীন এবং আশরফ নামে দুই তরুণ তুর্কি; ফলে সেক্রেটারি ডঃ ম্যাথু জনও সস্নেহে প্রশ্রয় দিচ্ছেন এই বদলকে।

আরও এক চমক যে অপেক্ষা করেছিল সেটা তো ভাবতেই পারিনি! দোলের ছুটিতে ওইদিন ভোরেই কলকাতায় ফিরছে কৌশিকীও। ওর মেসেজ পেয়েই অনুষ্ঠানের কথা জানাতে সে-ও রাজি, আগের মতোই ধড়াচুড়ো পরে ওদের সঙ্গে নাচার জন্য। এ তো অভাবনীয়ই বটে! আর সেই সঙ্গে এও এক মজা যে, অনেক আগে থেকে না বলেও হুট করেই ডেট পাওয়া গেল কি-বোর্ড বাজিয়ে সুরজিত দাসেরও। নাচ গানের সঙ্গতে তাকে পেলে ‘অন্তরা’র সবাই ভীষণ ভরসা পায়। এবার ওরা প্রাণ খুলে গাইবে ‘মঞ্জরি ও মঞ্জরি! আমের মঞ্জরি!’ দীপাঞ্জন রাজি করিয়ে ফেলল, তুহিন নামে এক নতুন তবলিয়াকেও। ফলে এবারের বসন্ত উৎসব একেবারে জমজমাট। আবার আমি মেল চালাচালি করে ঠিক করব Budget, Programme Schedule, To-Do List, Client-List। মাথা ঘামাব নাচের আর গানের দলের পোশাক নিয়ে। বিস্তর ফোনাফুনি হবে আমাদের মধ্যে কাকে কোথা থেকে তোলা হবে— এই নিয়েও। আবার মঞ্চ, মাইক ব্যালেন্স, গানের ধরা-ছাড়া এবং নাচের সময় কোন লাইনটা কতবার। মাথা থেকে বেরিয়ে যাবে সংসারের ঝুলকালি মাখা বয়সের ভারটাও। আর অনুষ্ঠান শেষে আমরা যখন বাড়ি ফিরব সবুজ গাছে ছাওয়া বারুইপুর বাইপাস ধরে, তখন সবাই মিলে মুগ্ধ হয়ে দেখব আকাশ জুড়ে চাঁদ; যা আমাদের আরও একবার মনে করিয়ে দেবে যে আর মাত্র দুদিন! তার পরই চৈত্রের সেই ভরা পূর্ণিমা। সকলের মনে মনে নিশ্চিত বেজে উঠবে একটাই কথা—-’ এসো হে, এসো হে, এসো হে… আমার বসন্ত এসো’!

২
দোল, দুর্গাপুজো বা জন্মদিন যাই হোক না কেন, কাজের মেয়েরা ছুটি নিলেই সব আনন্দ মাটি। সর্ব-শরীরে ব্যথা নিয়ে খুশি খুশি ভাব জাগিয়ে, কত আর ঘুরঘুর করা যায়! দৌড় তো সেই এ ঘর থেকে ও ঘর! ওষুধ, শাড়ি, কানের ফুল, মাথার কাঁটা— সবই তো ওরা গুছিয়ে এগিয়ে দেয়। ছাড়ার পর আবার জায়গা মতো গুছিয়ে তোলে। একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে শতেক ফোন করেই যাচ্ছি। নিমাইবাবু, অঞ্জনাদি যে’কটা আয়া-সেন্টারের ফোন নম্বর সেভ করা আছে, অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্যেও একটা বদলি লোক যদি পাওয়া যায়! হঠাৎই কোথা থেকে খবর পেয়ে ফোন করেছে আমার পুরনো কাজের মেয়ে, বড় পছন্দের সেই মঙ্গলা। লকডাউনের সময় কোথায় যে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল কে জানে! চার পাঁচদিনের বদলি কাজ তো কী! আমাকে সাহায্য করতে সে নাকি সবসময় রাজি। ব্যস! আর আমায় পায় কে!

এবার আমি জমিয়ে বসে তাল ঠুকব ইস্কুল বন্ধুদের ভিডিও কলে ডেকেডুকে, দিনের দিন কী করে একটা বসন্ত উৎসব করে ফেলা যায়! সকলে রাজি হলে বা ওদের কিচ্ছুটি না জানিয়ে ফেসবুক লাইভও। ছেলেমেয়েরা দূরে থাকার দৌলতে এসবে এখন আমরা বেশ দড়। এমনকী এটাও শিখে গেছি যে, ওই সময় কেউ ফোন করলেই মেসেজ পাঠিয়ে দেওয়া ‘In a meeting’ বা ‘Call you later’; শুনে সবাই হাসবে, তবু সেই গানগুলোই না হয় আবার নতুন করেই গাইব, যেগুলো আমরা দল বেঁধে গাইতাম ইস্কুল জীবনে! আর আমাদের সকলের হয়ে অদিতি নাচবে। কারণ নাচ এখনও ওর শরীর ছেড়ে যায়নি। ভিডিও কল মানেই সাজ এবং প্রস্তুতি। শাড়ির রং বেছে, মাথায় লাগাবার ফুল যোগাড় করে একেবারে লাগ ভেলকি লাগ। পালাতে পথ পাবে না মনের মধ্যে জমে থাকা বিষাদ আর নিরানন্দ। কে বলে বুড়ি! থুড়ি থুড়ি।

বুড়ির শখ জাগানো আরও এক গপ্পো, বলবার অপেক্ষায় জুল জুল করছে ঝাঁপিতে; যা এখানে না লিখলেই নয়! অন্তরার দোলের অনুষ্ঠানে গলায় ঝোলাব বলে কদিন ধরেই নতুন শাড়ি বেঁধে আসা কাপড়ের ফালিগুলো নিয়ে বসছি জুতসই একটা ঝোলা হার বানাবার বাসনায়। অর্ধেকটা হয়ে সেই যে পড়ে আছে সে আর ধরা হচ্ছে কই! দফায় দফায় কাজ সেরে, মিস্ত্রি খাটিয়ে, এটা ওটা কিনতে বেরিয়ে, ডাক্তার দেখিয়ে সেই খানকয় কাচ-পুঁতি একটু বাহার দিয়ে গাঁথা—- সে তো আর হয়েই উঠছে না। ভেবেছিলাম যে শ্যামলী থাকতে থাকতে সব হয়ে যাবে; তো শুরু হল ট্যাক্সের হিসেব নিকেশ। ধ্যাৎ তেরিকা! মার্চ মাসেই কিনা দোল পড়তে হল! ক্যালেন্ডারে আর দিন নেই কোনও!
কিন্তু সাত সতেরো যত ঝ্যামেলা- চটাং পটাং করে সব মিটে যাওয়ায়, এবার আমি সেই ন্যাকড়ার হারে পুঁতি সাজিয়ে গেঁথে ফেলবই ফেলব। লাল-সাদা ফালিতে, মানিয়ে মানিয়ে লাল-সাদা পুঁতি; আর তার সঙ্গে অজস্র গিঁটের বাহার। এই মালাখানি গাঁথব আর গুন গুন করলেই মনে পড়বে
‘এই আভাসগুলি পড়বে মালায় গাঁথা, কালকে দিনের তরে… তোমার অলস দ্বিপ্রহরে’

বিগত সময়ের কথা ভেবে কাঙালপনা না করে, না হয় আগামী সময়টাকেই যত্ন করে গেঁথে ফেলি, আমার নিজেরই এই মালা গাঁথার আঙুলগুলি দিয়ে! তবেই না বয়সকে গুনে গুনে সাত গোল খাইয়ে বলতে পারব…কাজ সেরে বসি আর শত্তুর মেরে হাসি!
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Pexels
আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।