banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বুড়ি! থুড়ি থুড়ি: সরস্বতী পুজো

মন্দার মুখোপাধ্যায়

ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৪

Saraswati Pujo and life of senior citizen
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

এ এমন এক উৎসব যে বছরভর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকলেও সরস্বতী পুজো (Saraswati Pujo) যেন একেবারেই আলাদা; তাই বছরে যে একদিন নিজেকে একেবারে নির্ভার লাগে তা হল, সরস্বতী পুজোর সকাল। ইস্কুলবেলার পর মেতে থাকতাম বাড়ির ঠাকুর সাজানো, বাড়িতেই নিজের নাচের ইস্কুল বা বিধান শিশু উদ্যানের পুজো নিয়ে। এরপর হল, মেয়েকে সাজিয়ে আনন্দ। তারপর মেয়ের সাজানো পুজো। তা এসে ঠেকল, নাতির তখনকার ইস্কুলের পুজোয় যাওয়া অবধি। শেষে ষাট পার করে ইস্কুল বন্ধুদের নিয়ে আবার মাতামাতি এবং নিজের ইস্কুল যাওয়া। 

২০২১। বয়স না হয় ষাট থেকে বেড়ে বেড়ে পঁয়ষট্টির দিকেই ধেয়ে চলেছে, কিন্তু তাতে কী! ভোরবেলা নিম-হলুদ বাটা মেখে স্নান সেরে নতুন একখানি হলুদ শাড়ি পরে, মাথায় ফুল গুঁজে আমার ঘরের আসনের মা-সরস্বতীকে সাজালাম। কাজের মেয়েদের জুটিয়ে খিচুড়ি, ফুলকপির ডালনা, বেগুনভাজা আর কুলের অম্বল খেয়ে এবার অপেক্ষা ড্রাইভার আসার। এগারোটায় বেরবো।

ঘরের আসন
আমার ঘরের আসনের মা-সরস্বতী

২০২২। আমার সঙ্গে সারাদিন থাকা মেয়ে শিপ্রা অতি বুদ্ধিমতী, সব কাজে নিপুণ, কিন্তু অক্ষর-জ্ঞানহীন। আমার অনলাইন ক্লাস নেওয়া দেখতে দেখতে তার ইচ্ছে হল লেখাপড়া শেখার। সময় পেলে দেখিয়ে দিই, আবার ভুলেও যাই। ইতিমধ্যে আমাকে ত্যাগ করে, পাড়ারই এক চেনা মেয়ের কোচিং-এ, যেখানে বাচ্চাদের ‘প্রাইভেট’ পড়ায়, মাস-মাইনে পাঁচশো টাকার কড়ারে, চুপি চুপি সে ভর্তি হল। সরস্বতী পুজোর দিন ওকে ডেকে বললাম, চল তোর হাতেখড়ি দেব। নতুন শ্লেট আর খড়ি নিয়ে বসতেই, লক্ষ্মী মেয়ের মতো কাছে এসে বসল। কী লিখবে ভেবে পাচ্ছে না দেখে বললাম, ‘ফুল আঁক না একটা’। ফুল আঁকা শেষ হতেই আমাকে অবাক করে দিয়ে, শ্লেটের উল্টো পিঠে সে লিখল, অ আ ই ঈ / A B C D E F G H… আর তার নীচের লাইনে লিখল, ‘Shipra’ 5/2/22। ওর হাতে ১০১ টাকা দিয়ে বললাম, ‘এই নে তোর প্রণামী। তুই-ই আজ আমার গুরু’। 

এই প্রথম, মাথা হেঁট করে প্রণাম করল আমাকে। 

শিপ্রার হাতেখড়ি 2023
শিপ্রার হাতেখড়ি

ইস্কুলবেলা থেকে এই আজও সরস্বতী পুজো (Saraswati Pujo), ২০২৪ — সেই একইরকম…

গেটের সামনে মেয়েদের আলপনা আঁকার যে ফটোটা পুজোর দুদিন আগেই অদিতি পাঠিয়েছিল, সেটা দিয়েই মুগ্ধতার শুরু। সেই রেশ নিয়ে কাচের দরজা পেরিয়ে ঢুকতেই আর এক চমক। চৌখুপি নকশায় মেঝের ওপর আরও এক অপূর্ব আলপনা। চারপাশে চারটে টবে পাতাবাহার সাজিয়ে মাথার দিকে একটা খাটো ইজেলে রাখা, আমন্ত্রণলিপি-বোর্ড। যেখান থেকে যত নেমন্তন্ন এসেছে সে সবই পিন দিয়ে সুন্দর করে আটকানো। এবারের থিম মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কবির ওপর চার্ট ও পোস্টার বানিয়ে সারা ইস্কুল, পুজো-ঘর, করিডোর সর্বত্র সাজানো হয়েছে।

আমাদের দেখে চিনতে পেরে দুজন কচি দিদিমণি এগিয়ে এসে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন; মেয়েদের হাতে মোবাইল দিয়ে ফটো তোলালেন। ফিরে আসার সময়, এখনকার বড়দি দেবিকা বসুও চিনতে পেরে, আদর করে তাঁর ঘরে ডেকে বসিয়ে ‘ঘোষ’-দোকানের প্যাকেট দিলেন। সকলের চোখেমুখেই খুব আনন্দ দেখলাম। আমাদের প্রিয় ঝর্ণা তালুকদারদি এসে যে ঘুরে গেছেন, সেটাও বললেন এঁরা। এক সময়ের বড়দি হিসেবে আমার মায়ের (অণিমা মুখোপাধ্যায়) অবদানের কথাও বললেন। “আমাদের ‘বড়দি’র ছবিটা কই?” —অদিতি বলতেই, ফটোটার সামনে থেকে ফুলদানি সরিয়ে দেখালেন।

ইস্কুল আলপনা 2024
চৌখুপি নকশায় মেঝের ওপর সরস্বতী পুজোর অপূর্ব আলপনা

তবে মাঠে গিয়ে বাথরুমের সেই চাতালটায় বসে একরাশ মনখারাপ। ইস্কুল চত্বর নিয়ে কেউই কি আর মাথা ঘামায় না! ‘Beyond Class Room’— এ ব্যাপারে মনে হয় সবাই নিশ্চল। কলাগাছের নোংরা ঝাড়। বেদি হারানো গুলঞ্চ গাছটা পাঁচিলের ওপাশে মুখ ঘুরিয়েছে। ট্যাংকের পাশে তালাবন্ধ দুখানা নতুন ঘর। খোলা জায়গাটা খোয়া আর সিমেন্টে ভরা। চারিদিক ধুলি ধূসরিত। গতবারের থেকেও দুরবস্থা চরম। ভাগ্যিস আমেরিকাবাসী লছমী এবারে নেই। ও থাকলে বোধহয় কোদাল দিতে নেমে পড়ত। তবু দলে দলে ছাত্রীরা আসছে তাদের খুশি জমাতে। অত বেলাতেও ভিড়ের বিরাম নেই। কিন্তু শৃঙ্খলাও নেই। নেই অনিলদা বা কালীদার মতো বাঘা সব নজরদাররাও। আঁট আর বন্ধনের যে পরম্পরা ছিল, সেটাই যেন খোওয়া গেছে কোথাও। বদলে গেছে পাঁচিলের বাইরের সেই সব পুরনো বাড়ির স্কাইলাইনও। মস্ত মস্ত সেইসব ধূসর ছাদ আর খড়খড়ি জানলার বদলে সরু সরু বহুতল। একটা কাঞ্জিভরমের দামে গোটা দশেক সিন্থেটিক শাড়ির মতো। তবু আমি হ্যালুসিনেট করছিলাম, ওই মাঠ জুড়ে বিরাট দলে আমাদের সেই সব নাচ— ‘লাচ্চুওয়ালি সুরতা’, ‘ডুগ ডুগ ডুগ ডুগ ডম্বরু’  ‘তোমার আনন্দ ওই এল দ্বারে…’
ভাবছিলাম যে ‘My School Day’ — হাতের কাছে এমন একটা যুতসই দিবস পেয়ে গেলে বা বানিয়ে নিলে মন্দ হয় না! 

আমরা 2022
ইশকুলের সরস্বতী পুজোয় আমরা, দু বছর আগের ছবি

বাংলা মিডিয়ম ইশকুল মানেই ‘সরস্বতী পুজো’; তায় আবার বাগবাজারে। মানে, যেখানে হাত বাড়ালেই কুমোরটুলি এবং আরও নানা ইস্কুলের ছড়াছড়ি। নিজেদের ব্যাচের সহপাঠীদের সঙ্গে দল বেঁধে গিয়ে, সব কিছুই যেন বড্ডই ভালো লাগতে লাগল। পুরনোর ওপর গড়ে উঠতে লাগল, নতুন সময়ের বনিয়াদ; ফলে শ্রীজাতর শব্দ-ম্যাজিক সেই ‘জিয়া-নস্টাল’-এর দুঃখবিলাস ছেড়ে আমরা ওই ষাট-ষাটের দল শুরু করে দিলাম, খোলস ছেড়ে, একেবারে হৈ হৈ করে বেরিয়ে আসতে। বোঝা গেল যে একদিনে হবে না; কিন্তু শুরু তো একটা হল।    

হলুদ শাড়িতে সাজা আমরা হুড়োহুড়ি করে চলে এলাম, আমাদেরই বালিকা বয়সকে কোলে-পিঠে নিয়ে। কোথায় গেল সেই ‘নেই নেই’! শুধু মনে হতে লাগল— ‘আছি, আছি, সদলবলে আছি’। আশপাশের বারান্দা থেকে বা জানলার খড়খড়ির আড়াল থেকে বা রাস্তার অন্য ফুটে ঠায় দাঁড়িয়ে, যারা আমাদের দেখত, দু এক ক্লাস উঁচুতে পড়া, হিন্দু, হেয়ার, স্কটিশচার্চ, শ্যামবাজার হাই স্কুল, এ ভি স্কুল বা শৈলেন্দ্র সরকারের সেই মুখচেনা ছেলের দল— তারাও যেন সব ফিরে এসেছে আবার।

Saraswati Puja
বাংলা মিডিয়ম ইশকুল মানেই ‘সরস্বতী পুজো’

ছবি তুলে, হেসে গড়িয়ে পড়েও যখন ইচ্ছে হল আরও একটু থাকতে, তখনই বোঝা গেল যে, এ পাড়ায় অলিতে গলিতে ছড়িয়ে থাকা আমাদের বাড়িগুলো, এখন তো সব বাপের বাড়ি হয়ে গেছে! অনেকেই আবার পাট গুটিয়ে অন্যখানে; কিন্তু অটুট রয়েছে ইস্কুলের থেকে কয়েক পা এগিয়ে বেঞ্চি পাতা সেই চায়ের দোকান। আসল দোকানির ছবি ঝুলছে পলেস্তারা খসা দেওয়ালে। ইশকুল-জীবনে যা কখনও করিনি, এবার ফুচকা ছেড়ে চা; এবং চা-পর্ব শেষ করে আরও একটু এগিয়ে ‘মায়ের ঘাট’। ভর দুপুরবেলা, ঘাটের সিঁড়িতে বসে লেবু চা, ঘটি-গরম আর নিজেদের অল্প বয়সে ফিরে যাওয়া… হুশ করে পার হয়ে গেল চক্ররেলও; সেও এক নতুন অভিজ্ঞতা। সকলেরই মনে হল, এবার একদিন চক্ররেল চেপে কলকাতা চক্কর দিলে কেমন হয়! এখন তো আর অনুমতি নিতে হবে না; আরেহ, এটাই তো ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’ করে বেড়াবার বয়স। সব কাজ শেষ করে নিজেদের নিয়ে খেলার সময়।

গ্রুপে আপলোড করা ছবি ও ক্রমাগত কমেন্টস পড়তে পড়তে দেখা গেল যে, পরের বছরই নীরবে বেড়েছে বন্ধুদলের সংখ্যাটা। খুশির নিয়ম মেনে, গায়েও তো জড়ানো হল বাসন্তী শাড়িখানি; নতুন করে এমন একটা যাবারও জায়গা হল যেখানে সকলেরই আসতে ভালো লাগছে। না হোক থেবড়ে বসে খিচুড়ি খাওয়া, কিন্তু কে সি দাস, দ্বারিক বা ভোলানাথ কেবিন বা পটলার তেলেভাজা— এসব দোকান তো এখনও আছে !

জিয়া- নষ্টাল 2023
জিয়া-নস্টাল

আর গেল বারের সরস্বতী পুজো? ২০২৩। সে তো একেবারে গল্পের রেশ-এ ঝিলমিল। ন্যুইয়র্ক থেকে দেশে আসছে লছমী, বহু বছর পার করে। বছর কয়েক আগে যখন সে এসেছিল, তখনই তাকে আবার দেখি আমাদের জমায়েতে। এবার সে আসছে তার জীবনের এক বিশাল বদল নিয়ে; কারণ তার সেই ইশকুল-বেলার প্রেমিক এবং পরে তার আদরের বর— লিল্টুদা আর নেই; তিনজন ফুটফুটে নাতি-নাতনি সমেত, ছেলে বউমা দিয়েও সে শূন্যতা ভরাট হচ্ছে কই? দীর্ঘ সময় বিদেশের ইশকুলে পড়িয়ে সদ্য অবসর নিয়েছে সে; আর্থিকভাবে স্বনির্ভর; সুন্দর একটা আস্তানা আছে তার; তবুও থেকে থেকেই চোখে জল। বন্ধুদের পেয়ে লছমী তো ভীষণ খুশি। সরস্বতী পুজোর দিন ইশকুলে যাবার ব্যাপারে তার উৎসাহই সবচেয়ে বেশি। ঝলমলে হলুদ শাড়িতে একে একে সবাই জুটে গেলাম; সঙ্গে যোগ দিল দুবছরের জুনিয়র, আমার বোন রঞ্জাও। সেও এখন বাষট্টি; তার ছেলে-বউ বিদেশে এবং স্বামীও চলে গেছে সম্প্রতি। যাই হোক, লকডাউন, আমফান-ঝড় সব সামলে ইশকুল আবার কলরব মুখরিত; ইতিমধ্যে আগের বড়দি হেনা সিদ্ধান্তও বদলে গেছেন; আমরা সদলবলে প্রতিমা দর্শন করেই চলে এলাম গুলঞ্চতলায়।

বাসন্তী আড্ডা -2023
মধ্যমণি লছমী, আর এ পাশে রঞ্জা

এই স্বপ্নের আবেশটুকু ধরা আছে সেদিনের  এই লেখায়, যা ফিরে ফিরে দেখি —   

‘ঠিক সাড়ে এগারোটায় একে একে সবাই জড়ো হল ইস্কুল গেটে, মানে যারা যারা আসবে বলেছে। যেন এরপর প্রেয়ারের ঘণ্টা পড়ে গেলেই আবার লেট মার্ক। আমেরিকাবাসী লছমীর প্রবল উৎসাহ। উৎসাহ শ্রাবন্তীরও। এবার এই প্রথম, এই দলে সে ইস্কুলে এল, আর এল দু-ক্লাস নীচে পড়া আমার বোন রঞ্জাও। সেটাও এই প্রথম যে, বড়দির দুই মেয়ে ‘মন্দার-রঞ্জা’ এক সঙ্গে। মা নিশ্চয়ই ভীষণ খুশি। আর এসেছে এখনও ওই পাড়ায় থাকা ইরা, অদিতি, রীতা এবং কালিন্দী থেকে গীতা। যারা আসতে পারেনি, গ্রুপে তাদের ঘন ঘন উচাটন— ছবি! ছবি! ছবি! প্রতি বছর দল বেঁধে যাই বলে, ইস্কুলের এখনকার বড়দি এবং অন্যান্য দিদিরাও অনেকেই আমাদের চেনেন। বয়সে এঁরা এখন আমাদের থেকে অনেকটাই ছোট। আন্তরিকতার সঙ্গে তাই কিছুটা সমীহও জুড়ে থাকে। তবে, গেট থেকে করিডোর এবং হল জুড়ে আগের মতোই সেই আলপনা। নোটিশ বোর্ডে একইরকমভাবে লাগানো, অন্যান্য ইস্কুল থেকে আসা নিমন্ত্রণপত্র — ‘বাণী বন্দনা’। আর সেই কলকল ছলছল উচ্ছ্বাস এবং ভিড়।

ইস্কুল-আল্পনা ২০২৩
আগের মতোই সেই আলপনা

এখন অবশ্য ছেলে-বন্ধুদের নিয়ে ঢুকতে আর বাধা নেই। দাদা বা ভাই পরিচয়ের ছলও নেই। গেটেও নেই দীপকদা, নিধিদা, কালীদা, গঙ্গাদা, অনিলদা বা মুন্সিরাম। মেয়েদের শাড়ির বাহারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নীল, লাল, সবুজ ও হলুদ ধুতিতে সদ্য দাড়ি ওঠা কিশোর এবং যুবকদলও ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ঠাকুরমশাইয়ের দেরি দেখে মেয়েরাই পুজো শুরু করে দিয়েছে শাঁখ বাজিয়ে, উলু দিয়ে। পরে পুরুত এসে বাকিটা সারলেন।  

ততক্ষণে আমরা বাইরের মাঠে, ছায়া দেখে এক বাধানো রকে। হলই বা তা বাথরুমের চাতাল! ছড়িয়ে থাকা দু’চারটে চেয়ার তার সঙ্গে জড়ো করে, বসে গেলাম জম্পেশ আড্ডায়। নব্বই-তে জন্মানো এক কচি ছাত্রী মধুরিমা রায়— দিদিমণিদের কাছে আমাদের আসার খবর পেয়ে চলে এল! ১৯৭৫ ব্যাচ— এই এক অদ্ভুত দলের বাইট নিতে। বলতে বলতে মনে হল, এটা কি সেই ইস্কুলটাই, যার চিলতে মাঠের ঘাস, গুলঞ্চ বেদি, রিজার্ভার, ক্লাসরুম, করিডোর সব ঝলমল করত আলো আর পরিচ্ছন্নতায়!

যদিও আমফান ঝড়ে ভেঙে যাওয়া গেট ও পাঁচিল মেরামত হয়েছে। কিন্তু ধ্বংস হয়ে উবে গেছে সেই দুটো চেনা গাছ— কৃষ্ণচূড়া আর গুলঞ্চ; সঙ্গে গুলঞ্চ বেদিটাও। এমন সব ‘গেল গেল’র মধ্যেই ঝর্ণাদির নম্বর ভেসে উঠল, আমার ফোনে। ইস্কুলে এসে, বড়দির ঘরে বসেই, উনিও আমাদের আসার খবর পেয়ে ফোন করেছেন, “তোমরা কোথায়?”
ইনি সেই দিদি, যিনি পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নাচে ভাসিয়ে দিতেন আমাদের শরীর। এমন অমলিন হাসি আর স্নেহের আধার আর কি পেয়েছি! এখনকার বড়দির ঘর থেকে দিদিকে তুলে আনল রঞ্জা। মাঠ ছেড়ে আমরা নড়বো না বুঝে, ইরার হাতে বড়দি পাঠালেন খান দশেক সন্দশ। ঝর্ণাদি তো আমাদের দেখে আনন্দে কেঁদেই ফেললেন। আমাদের যখন সবে পনেরো, দিদির তখন মাত্র তিরিশ। স্মৃতির মণিকোঠায় আমরা এত আদরে রাখা ছিলাম! মধ্যমণি ঝর্ণাদিকে পেয়ে চেয়ার সরিয়ে মাঠের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল আশি বছরের ঝর্ণাদির সঙ্গে, বাষট্টির রঞ্জা সহ, পঁয়ষট্টি ধরে ফেলা আমাদের দল বেঁধে সেই সব নাচ গান— তোমার আনন্দ, উতল ধারা, রিমঝিম ঘনঘন রে, ডুগডুগ ডুগডুগ ডম্বরু ….. আজি দখিন দুয়ার খোলা।

নাচের পরে 2023
নাচের পরে

এখনকার বাচ্চারা কেউ কেউ দাঁড়িয়ে পড়ল, কেউ কেউ আবার তাকালোই না। দু’একজন ছবিও তুলল। দিদিকে জড়িয়ে ধরে, পরম স্নেহে আদর করল শ্রাবন্তী…  

মুহূর্তে যেন জয়শ্রী গেয়ে উঠল, ‘বৃন্দাবনের কালো কোকিল রে’। আর অমরাবতীর গলায়— ‘ভবানী দয়ানী’। কী আশ্চর্য! দল বেঁধে রাজভবনে নেচে এলাম আমরা। রিপাবলিক ডে-তে প্যারেড করে এলাম, রেড রোডে। সার দিয়ে দাঁড়ালো রঞ্জাদের প্রেসিডেন্ট’স গাইডের দল, ক্লাসরুম জুড়ে বিজ্ঞান প্রদর্শনী, গুলঞ্চতলায় বসে গেল ‘আনন্দ মেলা’র স্টল। আর প্রকাশ হল আমাদের বার্ষিক পত্রিকা – ‘সকাল’!
কল্পনা, দেবযানী, গৌরী, শকুন্তলারাও ফিরে এল চিরঘুমের দেশ থেকে। সমস্ত দিদিদেরও ফিরে পেলাম আমরা। লাইব্রেরি আর গানের ঘরের সামনেও যেন অফ পিরিয়ডের ভিড়। 

ঝর্ণদির উপস্থিতিতে ধন্য হয়ে গেল আমাদের কিশোরীবেলা। ফিরে পাওয়ার আনন্দে, টালমাটাল পায়ে, নেশাতুর আমরা এখনও কি কেউ বাড়ি ফিরেছি! 

এই বোধহয় অনন্ত বিরহ। এই কি তবে অমরত্ব!
এই সংযোগ কি একজীবনে ফুরোয়! নাকি রয়ে যায় পায়ে পায়ে, ধুলোর মতোই মহার্ঘ আশীর্বাদ হয়ে; শুধু যে শুভ তাই নয়, মোহরের মতো দামিও তো বটে’!

ফেরার সময় 2023
ফেরার সময়

কোন অভিমানে জানি না অদিতি তার জন্মদিনটা আমাদের জানায়নি; ফলে প্রত্যেকের জন্মদিনে আমাদের গ্রুপে কার্ড এঁকে জয়শ্রী যে শুভেচ্ছা পাঠায়, তা থেকে বাদ পড়ে যায় অদিতি। তাই সকলে মিলে সহমত হয়ে ঠিক হল যে অবিবাহিত অদিতির জন্মদিন পালন করা হবে ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র দিন। কারণ সে ছিল আমাদের সেই ‘হলি রে রসিয়া’— নাচের দলে ‘কৃষ্ণ’।  আর এ বছরই ১৪ ফেব্রুয়ারি, একই দিনে সরস্বতী পুজো এবং প্রেম দিবস। বুড়িত্ব উড়িয়ে অদিতির সঙ্গে আমরাও তো নতুন করে জন্ম নিলাম বন্ধুত্বের ইস্কুল-উঠোনে; একেবারে সরস্বতী পুজোর দিন, এক অঞ্জলি ফুলে কার্ড এঁকে শুভেচ্ছা সাজিয়ে।

Birthday Card

আর আশ্চর্য যে, আমাদের অনেকের মনের কথাই সেদিন যেন ঝর্ণাদি বলে উঠেছিলেন – ‘এত আনন্দ হল, কিন্তু বাড়ি ফিরে এসব গপ্পো কার সঙ্গে করব!’ রুমাল দিয়ে ঝর্ণাদির চোখ মোছা দেখে মনে পড়ল, কয়েকমাস আগে তাঁর স্বামী মানবেশদাও তো চলে গেছেন। এক মেয়ে থাকে বিদেশে। অসুস্থ বড় মেয়েকে নিয়ে তাঁর নিত্যদিন কাটে। নিঃসঙ্গতার এই ছবিটায় তাই প্রজন্মের ফারাক নেই কোনও; একই ক্যানভাসে, একই রেখা ও রঙে আঁকা। কিন্তু এ দিনের কিছু আনন্দ-মুহূর্তের সংযোগে তা হয়ে গেল তরতাজা সবুজ। সাদাকালো সময়ের ওপর অনায়াসে সেঁটে গেল, সময়ের রঙিন বদল। 

অপেক্ষার এই নতুন রংটাই আমরা খুঁজে আনলাম আমাদের পড়ন্ত বেলায়। আমরা পারলাম। 

 

*ছবি সৌজন্য: লেখক, Flickr

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান। ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com