নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, আর নদীর ধারে, মাঠেঘাটে কাশফুলের মেলা মানেই মা আসছেন। আর মা আসা মানেই তো আমাদের হৈ হৈ মজা। ঘোরাঘুরি,খাওয়াদাওয়া, আরও কত কি! তা পূজোয় আনন্দ করতে গেলে শরীরটাকে তো ঠিক রাখতে হবে? তাই আসুন একটু জেনে নিই কীভাবে আমরা সুস্থ থেকে পুজোটা সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করতে পারি (how to stay fit during Durga Puja।
দুর্গাপূজা হয় শরৎকালে, অর্থাৎ সিজন চেঞ্জের সময়ে। দিনে রোদ আর রাতে হিম। ফলে দিনের বেলা গরম,আর রাতে ঠাণ্ডা। মাঝে মাঝে বৃষ্টি। একসঙ্গে এতরকমের আবহাওয়ার তারতম্য ডেকে আনে ইনফ্লুয়েঞ্জা, সর্দি, কাশি, জ্বর এর মতো অসুখ। সেই সঙ্গে আবার আছে টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া,ডেঙ্গুর ত্রিফলা। একটু সতর্ক হলেই কিন্তু অনেকাংশে বাঁচা যায় এইসব রোগজ্বালা থেকে।
প্রথমেই বলি, প্রতি বছর বর্ষার শেষে নিয়ম করে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাক্সিন নিন। এতে ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে সম্পূর্ণ বাঁচা যাবে না ঠিকই, কিন্তু ওই রোগজনিত জটিলতা অনেকটাই কম হবে। ভাইরাল ফিভার, সর্দি, কাশি অথবা করোনার সংক্রমণ এড়াতে জনবহুল জায়গায় যতটা সম্ভব মাস্ক ব্যবহার করুন। জানি এতে স্টাইল অনেকটাই মার খাবে-কিন্তু ওই যে বলে না, আপনি বাঁচলে বাপের নাম! যদিও সাধের পিতৃদত্ত প্রাণটা সংশয়ে ফেলবেন কিনা সে সিদ্ধান্ত আপনার।

নাক দিয়ে জল পড়লে,হাঁচি-কাশি হলে রুমাল বা টিস্যু পেপার ব্যবহার করুন। এতে একজন থেকে আরেকজনের সংক্রমণ এড়ানো যাবে। ঠাণ্ডা লাগা থেকে বাঁচতে রাতের বেলা স্কার্ফ বা টুপি ব্যাবহার করুন। ফ্রিজের জল, ঠাণ্ডা পানীয়, আইসক্রিম এড়িয়ে চলাই ভাল। নেহাতই খাওয়ার ইচ্ছে হলে একেবারে চিল্ড না খেয়ে একটু ঠাণ্ডাভাব কমে গেলে খান।
ভুললে হবে না যে নাক, মুখ ছাড়াও আমাদের হাতদুটো কিন্তু ভাইরাস ইনফেকসন সংক্রমণের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। নিজেদের অজান্তেই আমরা রোগীর ইনফেকসন হাতে বহন করি। আর ঘন ঘন মুখে হাত দেওয়ার প্রবণতা প্রায় সব মানুষেরই থাকে। ফলে হাতের ইনফেকসন খুব সহজেই নাক, মুখ দিয়ে আমাদের শরীরে সংক্রমণিত হয়। তাই হাত পরিষ্কার রাখতে বার বার স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন। বৃষ্টির জলে আচমকা যাতে ভিজে না যান, তাই সঙ্গে ছাতা বা বর্ষাতি রাখুন। টাইফয়েড জলবাহিত রোগ। এই রোগ এড়াতে যত্রতত্র জল খাবেন না। খাবার জল নিজের সঙ্গে রাখুন।

আমরা জানি, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু মশাবাহিত রোগ। তাই প্রত্যেকে যদি নিজের ঘর ও তার আশপাশে জল জমতে না দেয়, তাহলেই কিন্তু ওই রোগদুটির প্রকোপ অনেকটাই কমে যাবে। কারণ গাছের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, এসির জমা জলেই মশা জন্মায়। তাই জমা জলই যদি না থাকে, মশার বংশবৃদ্ধিও কমে যাবে। প্রতিদিন রাতে অবশ্যই মশারি টাঙিয়ে শোবেন। দিনের বেলা ওডোমস বা রোল অন ব্যবহার করতে ভুলবেন না। আর হ্যাঁ,জ্বর এলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রক্ত পরীক্ষা করিয়ে ডাক্তার দেখাবেন।
একটা কাজ করতে পারেন। ছেলেরা পুজোয় সঙ্গে নিয়ে সবসময় বেরোনোর জন্য চটজলদি একটা ফ্যাশনেবল ন্যাপস্যাক কিনে ফেলুন। মেয়েদের তো ভ্যানিটি ব্যাগ আছেই। সেখানে একটা করে ফোল্ডেবল ছাতা, টুপি, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, রোল অন, রোদ চশমা, ছোট একটা তোয়ালে, সানস্ক্রিন লোশন, টিস্যু পেপার রাখুন। যখন যেটা দরকার ব্যবহার করতে পারবেন। কয়েকটা ইমারজেন্সি ওষুধ রাখতে পারেন ও প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারেন। যেমন হঠাৎ জ্বর এলে প্যারাসিটামল, বমি হলে ডোমপেরিডোন, পেটেব্যথায় ডাইসাইক্লোমিন বা ড্রোটাভেরিন, বমি বা পাতলা পায়খানায় ওআরএস ইত্যাদি।
একটা কথা– যাঁদের আগে থেকেই সুগার, প্রেসার, হাঁফানি, মৃগি, হার্টের রোগ ইত্যাদির মতো কোনও ক্রনিক অসুখ আছে, তাঁরা ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মতো রোজকার ওষুধ অবশ্যই নিয়ম করে খাবেন। কারণ পুজো বলে শুধুই যে সিজনাল রোগ হবে তা কিন্তু নয়। অনিয়মে ক্রনিক রোগও বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। প্যান্ডেল হপিং করুন, ঘুরে বেড়ান- কিন্তু সময় করে বিশ্রামও নেবেন, তবেই শরীর চাঙ্গা থাকবে।

পুজো দেখতে বেরোবেন আর একটু ভালোমন্দ খাবেন না তা আবার হয় নাকি? নামি-দামি রেস্তোরাঁ তো আছেই, প্যান্ডেলের ধারেপাশের ফুচকা, ঝালমুড়ি, ভেলপুরি, ইডলি, ধোসা, সিঙাড়া, মোমো, চাউমিন, আইসক্রিমের স্টল আপনাকে হাতছানি দেবে। দেখে লোভ তো লাগবেই। খাবেন নাকি শরীরের কথা ভেবে এড়িয়ে যাবেন? মনে রাখবেন, অপরিশ্রুত জল, অপরিচ্ছন্ন রন্ধনপ্রণালী ও পরিবেশন আর খোলা, অস্বাস্থ্যকর খাবার সংরক্ষণ, যা প্রায়শই স্ট্রিট ফুড স্টলে (steet food) দেখা যায়, তা বমি, পায়খানা, ফুড পয়জনিং, ডায়েরিয়া, কলেরা, টাইফয়েড এর মতো রোগ ডেকে আনে। হামেশাই দেখা যায় অপরিষ্কার জায়গায় বা আবরণহীন নর্দমার ঠিক পাশেই খাবারের স্টল। সেখান থেকে জীবাণু ছড়াবার সম্ভাবনা প্রবল। খাদ্যজনিত জীবাণুদের দীর্ঘ তালিকায় রয়েছে– E.Coli, Bacillus Cereus, Vibrio Cholerae, Clostridium Perfringens ইত্যাদির মতো মারাত্মক সব রথী মহারথীরা।
এত্তসব রোগের ফিরিস্তি শুনে কি ভয় পেয়ে গেলেন? দোনামোনা করছেন বাইরে খাবেন কি খাবেন না? শরীর আগে না মন আগে? আরে বাবা বছরভর পুজো তো একবারই আসে। আপনি কি তবে আনন্দ করবেন না? মনভরে আনন্দ করুন। খান-দান, বিন্দাস ঘুরে বেড়ান। শুধু একটু সচেতন হোন এবং সেই মতো নিজের শরীর বুঝে কাজ করুন। তাতে শ্যামও থাকবে, কূলও রক্ষা পাবে। তবেই তো সর্বাঙ্গীণ আনন্দময় হয়ে উঠবে আপনার দুর্গাপুজো। আর হ্যাঁ, ইয়ে, যদি একটু আধটু শক্ত পানীয় অর্থাৎ হার্ড ড্রিংকস ঢুকু করে (সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়-এর ভাষায়) ফুর্তি করার ইচ্ছে হয় তো করুন। কিন্তু মাত্রাছাড়া যেন না হয়। বেশি খেয়ে বমি টমি করলে শরীরের ক্ষতি তো আছেই, সঙ্গে প্রেস্টিজটাও টাল খাবে।
ছবি সৌজন্য: Rawpixel, Wikimedia Commons
পেশায় পালমোনোলজিস্ট ডা: অর্পণ রায় চৌধুরীর মূল নেশা বেড়ানো ও ছবি তোলা। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লেখালিখি করতে ভালোবাসেন। ইতিমধ্যে তাঁর প্রকাশিত ভ্রমণ বইয়ের সংখ্যা ছয়। ট্রাভেল রাইটার্স ফোরামের সদস্য।