এইভাবেই জয়ন্তিয়া পাহাড়ের চরিত্র পাল্টে যাচ্ছে। র্যাটহোল মাইনিং-এর কাজ শুরু হওয়ার সূচনা লগ্নে হারিয়ে যায় সবুজ বনানী। যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকা, বড় হওয়া হাজারো রকমের গাছ কেটে ফেলে শুরু হয় র্যাটহোল মাইনিং-এর প্রস্তুতি পর্ব। রুক্ষ পাহাড়ি জমিতে গর্ত খুঁড়ে কয়লা খননের কাজ শুরু হওয়ার পাশাপাশি গড়ে ওঠে ট্রাক চলাচলের উপযোগী সড়ক। হারিয়ে যায় নীল আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য বৃক্ষের অরণ্য। সেই অরণ্য যেখানে হাওয়া বয় শনশন। এখনও সেখানে এলোমেলো হাওয়া খেলা করে যার মধ্যে মিশে থাকে কয়লার গুঁড়ো অথবা পাহাড়ি মাটির ধুলো।
পাহাড় ফাটিয়ে মাটি খুঁড়ে দিনের পর দিন ভূগর্ভের কালো পণ্য বের করে আনার পর এক সময় যখন নিংড়ে নেওয়ার জন্য কোনও কয়লার স্তর বা সীম আর পড়ে থাকে না তখন সেই খনিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলা হয়। ততদিনে ভূগর্ভের চরিত্রে এসেছে অনেক পরিবর্তন। কোথাও হয়তো জলের স্তর বিধ্বস্ত হয়েছে। আবার কোথাও হয়তো কোনো অন্তঃসলিলা নদীর গতিপথ পাল্টে গেছে। বৈধ কয়লা খনির ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটে থাকে। আইন অনুযায়ী নিঃস্ব কয়লা খনির গহ্বর বালি দিয়ে ভরাট করে দিতে হয়। অন্যথায় খনির ওপরের মাটি-জমি ভঙ্গুর হয়ে যায়। যে কোনও মুহূর্তে তাতে ধ্বস নেমে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সরকার নিয়ন্ত্রিত বৈধ কয়লা খনিতেও প্রায়শই বালি ভরাটের কাজ হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। আর র্যাটহোল মাইন তো পুরোপুরি অবৈধ। কাজেই র্যাটহোল মাইনিং-এর ফলে পরিবেশ বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি হয়ে চলেছে দুর্ঘটনাপ্রবণ পরিত্যক্ত ঊষর ভূমি।
পরিত্যক্ত শ্রমিকেরা কোথায় যায়?
পরিত্যক্ত শ্রমিকেরা কোথায় যায়? এ বড় কঠিন প্রশ্ন। ভিন রাজ্য থেকে কাজ করতে আসা শিশু বা কিশোর যার নির্দিষ্ট ঠিকানা আছে সে হয়তো নিজের মতো করে বাড়ির পথে রওনা দিয়ে দেশের অসংখ্য বেকার শ্রমিকের স্রোতে নিজেকে মিশিয়ে দিতে পারে। কিন্তু যার কোনও বৈধ ঠিকানাই নেই সে কোথায় যাবে? কেউ কেউ হয়তো আশপাশের কোনও চালু খনিতে, প্রয়োজনে কম পারিশ্রমিকেই যা হোক গোছের একটা কাজ জুটিয়ে নেয়। বাকিরা? কে জানে!
আজ না হয় কাল আইনের সুবাদেই হোক বা কয়লা নিঃশেষিত হওয়ার জন্য র্যাটহোল মাইনিং বন্ধ হয়ে যাবে। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা শিশু-কিশোর এত বড় দেশের কোথাও না কোথাও চলে যাবে। জমির মালিক তো ততদিনে পুরোপুরি দেশ-গাঁও ছেড়ে অন্য কোনও শহরের বাসিন্দা হয়ে অন্যরকম জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। কিন্তু স্থানীয় জনজাতির যে মানুষ অন্যের জমিতে বাগিচায় কাজ করতেন তাঁদের কী হবে? কয়লা খনির দৌলতে তাঁদের অনেকেই বহু বছর ধরে দোকানদারি করেছেন। কেউ আবার খনির আনুষঙ্গিক কাজে যুক্ত হয়েছেন।
যেমন ল্যাডরিমবাই এককালে ছিল একটা শান্ত গ্রাম। বাগান ঘেরা সাজানো গোছানো বাড়িগুলোতে সপরিবারে বসবাস করতেন একদল স্থানীয় জনজাতির মানুষ। বাগানের ফল-ফুল, অর্কিড, সুপারি কাঁধের ঝাঁকায় ভরে সপ্তাহান্তে একদিন দল বেঁধে গল্পগুজব হাসিঠাট্টা করতে করতে মেয়েরা রওনা দিতেন হাটের উদ্দেশে। কোনও ঝাঁকায় থাকত নানারকমের ভেষজ ওষধির গুল্ম-লতা। জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে আনা বিচিত্র সব ফল,- সহপি, সহসাং, সহলিংদুন, সাইয়ং, সোফলাং থাকত অনেকের ঝাঁকায়। এইসব ফলে ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদির উপাদান বেশি পরিমাণে থাকার ফলে বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের জন্য আদর্শ।
দিনের শেষে বিক্রিবাটা সেরে সূর্যাস্তের আগেই আবার একইরকমভাবে দল বেঁধে ফিরে আসতেন নিজের নিজের কুটিরে। ফিরতি পথে ঝাঁকায় থাকত সারা সপ্তাহের জন্য খাদ্যসামগ্রী আর সংসারের নানা টুকিটাকি জিনিস। প্রকৃতিকে জড়িয়ে বেঁচে থাকা স্থানীয় জনজাতির পরম্পরাগত সমাজ জীবন এখন বিপন্ন। মেঘালয়ের প্রতিটি পাহাড়, নদী, ঝরনা, গুহার সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারো উপকথা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মুখে মুখে চলতে থাকা এইসব উপকথা ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে। প্রথাগত পোশাক আস্তে ধীরে বিদায় নিচ্ছে। সবমিলিয়ে র্যাটহোল মাইন-এর দাপটে জয়ন্তিয়া পাহাড়ের গাছপালা, ফল-মূল, ভেষজ ওষুধ সমৃদ্ধ পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র ক্রমশঃ বিলীন হয়ে চলেছে।

শান্ত গ্রাম হয়ে ওঠে গঞ্জ
এখনকার ল্যাডরিমবাই তো রীতিমতো ঝলমলে গঞ্জ-বাজার। সারাদিন এমনকি গভীর রাতেও এখানকার দোকানপাটে লেগে থাকে বেচাকেনার ধূম। কে বলবে যে মাত্র কয়েক দশক আগে এখানে ছিল শান্ত অথচ সমৃদ্ধ একটি গ্রাম। এখানকার হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল জনজীবনে হয়তো শিলং বা গুয়াহাটির নাগরিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না। কিন্তু কোনও অভিযোগ ছিল না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যে প্রথাগত সমাজ গড়ে উঠেছিল তাই নিয়েই নিজেদের মতো করে শান্তির জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন এখানকার মানুষ। তাঁরা কি ফিরে পাবেন তাঁদের ফেলে আসা জীবন?
ল্যাডরিমবাই-এর মতো মেঘালয়ের বিশেষত জয়ন্তিয়া পাহাড়ের ছোট ছোট গ্রামগুলির চিরায়ত সমাজে এসেছে চোখভোলানো বাণিজ্যিক পরিবর্তন। জয়ন্তিয়া পাহাড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র বদলে যাওয়ায় সেই শান্ত জীবন আর ফিরে আসবে না।
গ্রামকেন্দ্রিক কৃষিভিত্তিক সমাজ এইভাবেই শিল্পায়নের ফলে সমাজ বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় নাগরিক সভ্যতায় রূপান্তরিত হয়। বিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্ন পর্যন্ত পাহাড় জঙ্গল অধ্যুষিত সাকচি, ইস্পাত শিল্পের দৌলতে হয়ে গেছে জামশেদপুর । অরণ্য আর অকৃষিযোগ্য জমি, যেখানে জনবসতি ছিল না বললেই চলে, সেই দুর্গাপুর ইস্পাত ও অন্যান্য অনুসারি শিল্পের জন্য গত সত্তর বছরে শিল্পনগরীতে পরিণত হয়েছে। এটাই ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু জয়ন্তিয়া পাহাড়ের কয়লা খনন কোনও স্থায়ী শিল্প নয়। তাছাড়া আইনগত দিক থেকে ২০১৪ থেকেই নিষিদ্ধ। টেনেটুনে আরও কয়েক বছর হয়তো নিয়ম ভেঙেই চলবে। কিন্তু তারপর?
ফিরবে না পুরনো প্রকৃতি
জয়ন্তিয়া পাহাড়ের পুরনো প্রকৃতি আর কোনওদিন ফিরে আসবে না। ফিরে আসবে না স্থানীয় জনজাতির চিরায়ত সমাজ জীবন। র্যাটহোল মাইন-এর দৌলতে গত কয়েক দশকে গড়ে ওঠা অস্থায়ী নাগরিক সভ্যতার চাকচিক্য হারিয়ে যাবে। প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে জোয়াই, ক্লেহরিয়াট নিশ্চয়ই টিকে থাকবে। তার বাইরের জয়ন্তিয়া পাহাড় ততদিনে নিঃস্ব-দূষিত-পরিত্যক্ত এক উপল মথিত ঊষর পাহাড়ে রূপান্তরিত হবে। মাত্র পাঁচ দশকেই মেঘালয়ের ইতিহাসে বিলীন হয়ে যাবে র্যাটহোল মাইন। অথবা ইঁদুরের গর্তে মানুষের জীবন এবং মরণ।
তথ্যঋণ:
- Assam State Gazetteer, Government of Assam, 1999.
- A History of Assam, Albert Edward Gait, Thacker Spink & Co., 3rd revised edition, 1926.
- The Economy of Meghalaya, Hamlet Bareh, Ngap Kynta, Spectrum, 2001.
- Khasi and Jaintia Megaliths and Culture, Dhritiman Sharma, Spectrum, 2014
- Field Survey Reports of Impulse NGO Network, Shillong
- মেঘালয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগের বার্ষিক প্রতিবেদন।
- এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকা।
সমাপ্ত
প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।