নারতিয়াং-এ জয়ন্তিয়া রাজাদের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ দেখতে দেখতে মনে হতেই পারে কোথায় ছিল এই রাজবংশের রাজত্ব। কোথায় ছিল তাঁদের স্থায়ী রাজপ্রাসাদ? এইসব প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন-কৌতূহল নিরসনে ইতিহাসের পুঁথি নাড়াচাড়া করতেই হবে। শিলং-এর পূর্ব প্রান্ত থেকে শুরু করে বরাক নদীর উপত্যকার উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল জয়ন্তিয়া রাজাদের রাজত্ব। এখনকার বাংলাদেশের সিলেট জেলার একটা বড় অংশও ছিল জয়ন্তিয়া রাজাদের আয়ত্বে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় যে সিলেটের জৈন্তাপুর ছিল জয়ন্তিয়া রাজাদের স্থায়ী রাজধানী। জৈন্তাপুর এখন সিলেট জেলার একটি উপজেলা। আয়তন কমবেশি দুশো-আশি বর্গকিলোমিটার। প্রায় সোয়া লক্ষ মানুষের বসবাস। মেগালিথ অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রকান্ড প্রস্তরখণ্ডের ধ্বংসাবশেষের জন্য জৈন্তাপুর সুপরিচিত।
সিলেট বিভাগের সদর শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে জয়ন্তিয়া বা স্থানীয় ভাষ্যে খাসি পাহাড়ের পাদদেশে জৈন্তাপুরের অবস্থান। অঞ্চলটির উত্তর ও পূর্ব দিকে রয়েছে অসংখ্য পাহাড়-উপত্যকা এবং পশ্চিম ও দক্ষিণাংশে রয়েছে নিচু সমভূমি ও অসংখ্য জলাশয় যা চলতি কথায় হাওড় বলে পরিচিত। প্রাচীন যুগে বর্তমানের এই নিচু অঞ্চলটি সম্ভবত জলের তলায় ছিল অথবা কোনও একটি বিশাল জলাশয় জৈন্তাপুর ও সিলেটকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। ভূতাত্ত্বিক গঠনের বৈশিষ্ট্যর জন্য আশপাশের অন্যান্য জনপদের থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলেই হয়তো জয়ন্তিয়ায় দীর্ঘদিন সার্বভৌমত্ব বজায় ছিল। এবং রাজধানী জৈন্তাপুরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়নি। পৌরাণিক কাহিনী ও লোককথায় এভাবেই জয়ন্তিয়ার পরিচয় পাওয়া যায়। স্থানীয় জনশ্রুতি, লোকগাথা ও তাম্রশাসনে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে আনুমানিক সপ্তম বা অষ্টম শতাব্দী নাগাদ জয়ন্তিয়া কামরূপ রাজ্যের অধীনে আসে এবং পরবর্তীকালে চন্দ্র ও বর্মণ রাজবংশের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বর্মণদের পতনের পর জয়ন্তিয়া কিছু সময়ের জন্য দেব রাজবংশের শাসনাধীন ছিল। দেব রাজবংশের শেষ শাসক জয়ন্ত রায়ের মেয়ে জয়ন্তীর সঙ্গে খাসি জনজাতির এক শাখা নর (Pnar) গোষ্ঠীপতির ছেলে লান্দোয়ারের বিয়ে হয়। এই বিয়ের সুবাদেই নাকি আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে রানি জয়ন্তীর নামে জয়ন্তিয়া রাজ্য স্থাপিত হয়। বিয়ের পর নর রাজত্বের প্রথম রাজা অর্থাৎ জয়ন্তীর স্বামী হিন্দুধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে প্রভাত রায় নামে পরিচিত হলেন। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৮৩৫ পর্যন্ত একুশজন রাজা স্বাধীন ও সার্বভৌম জয়ন্তিয়া রাজ্য শাসন করেন। জয়ন্তী থেকে জয়ন্তিয়া নাকি এখানকার আদি জনজাতি সিনটেং (Synteng) যারা আবার জানটেইন (Zantein) নামেও পরিচিত তার অপভ্রংশ হয়ে জয়ন্তিয়া হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা-গবেষণা চলতে থাকুক। সেই অবসরে আপনি বরং এখনকার জৈন্তাপুরের খোঁজখবর নিয়ে নিন।
জৈন্তাপুর কীভাবে যাবেন? ফিরতি পথে শিলং-গুয়াহাটি-কলকাতা হয়ে বাস-ট্রেন-বিমানে ঢাকা হয়ে যাওয়া যায়। তাও আবার শুধু ঢাকা গেলেই হবে না। সেখান থেকে আবার বাস-ট্রেন বা বিমানে যেতে হবে সিলেট। সেখান থেকে আবার গাড়ি বা বাসে চড়ে পৌঁছতে হবে জৈন্তাপুর। নারতিয়াং-এ যখন এসেই গেছেন আর সঙ্গে বৈধ কাগজপত্র মানে পাসপোর্ট-ভিসা থাকলে সরাসরি জেলা সদর জোয়াই-এ চলে আসুন। মেরেকেটে ঘন্টাখানেক। পথের হিসেবে পঁচিশ-ছাব্বিশ কিলোমিটার। জোয়াইতে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারেন। সেই সাত সকালে শিলং থেকে রওনা দিয়ে নারতিয়াং ঘুরে জোয়াই পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা তো অনেকটাই গড়িয়ে গেছে। পথপরিক্রমার ধকল সামলে নিলেও পেটের চাহিদা পূরণ না করে উপায় নেই। এরপর আরও ঘন্টা দুয়েক পথ চলতে হবে। দূরত্ব প্রায় ষাট কিলোমিটার হলেও পাহাড়ি পথে গাড়ির গতি সীমিত রাখাই ভালো। অতঃপর ডাউকি।
ডাউকিতে আগে না এলেও জায়গাটার নাম কিন্তু অপরিচিত নয়। এশিয়া মহাদেশের পরিচ্ছন্নতম গ্রাম হিসেবে মৌলিননঙ নামের গ্রামের খবর মাঝেমধ্যেই প্রচারিত হয়। সেই খবর প্রসঙ্গেই ডাউকির নাম একেবারে অজানা নয়। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ঝুলন্ত সেতুর কথা বলতে গেলেও ডাউকির নাম স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। ১৯৩২-এ উমগট নদীর উপর নির্মিত এই ঝুলন্ত সেতু তখনকার অসম এবং পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সুগম করে দিয়েছিল। তবে আপাতত মৌলিননঙ বা ঝুলন্ত সেতু পরিহার করে আস্তেধীরে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে এগিয়ে চলুন। এখানে রয়েছে সীমান্ত চৌকি অর্থাৎ বর্ডার চেক পোস্ট। রয়েছে অভিবাসন দপ্তর বা ইমিগ্রেশন অফিস। ব্যস্ততা নেই। ভিড় অনুপস্থিত। পাসপোর্ট-ভিসা পেশ করলেই ওপারে যাওয়ার ছাড়পত্র মিলে যায়। এপারের ডাউকি কিন্তু সীমান্ত পেরোলেই তামাবিল হয়ে যাবে। তামাবিলে বাংলাদেশের যে সীমান্ত চৌকি রয়েছে সেখান থেকে বাস স্ট্যান্ড মাত্র দেড় কিলোমিটার। হাঁটতে না চাইলে ট্যাক্সি আছে। আর বাস স্ট্যান্ড থেকে জৈন্তাপুর সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার। গাড়িতে দশ-বারো মিনিট।
এতক্ষণে বেলা গড়িয়ে সাঁঝের আঁধার নামতে চলেছে। জৈন্তাপুরে গিয়ে এখন কিছুই দেখা সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা শরীরও সায় দেবে না। সারাদিনে তো কম ধকল যায়নি। তার থেকে বরং জাফলং চলুন। তামাবিল থেকে দশ কিলোমিটার পথ। আঠারো-বিশ মিনিটে পৌঁছে যাবেন। শৈলশহর। নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিন। বাংলাদেশের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হওয়ার সুবাদে প্রচুর অতিথিনিবাস আছে। রাতের শেষে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়লেই দেখতে পাবেন খাসি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জাফলং ছবির মতো সুন্দর এক ছোট্ট জনপদ। পাস দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে সারি নদী। বহতা নদী হলে কি হবে পাথর বিছানো পথে এগিয়ে চলার জন্য প্রতি মুহূর্তে জলধারা হোঁচট খেয়ে গড়ে তুলছে জলের ফুলঝুড়ি। পাহাড়-নদী বুঝিয়ে দেয় প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য কোনো সীমান্তের পরোয়া করে না। তবে বেশিক্ষণ এই সৌন্দর্য উপভোগ করার মত সময় নেই। প্রাতরাশ সেরেই জৈন্তাপুর রওনা হতে হবে। তিরিশ-বত্রিশ কিলোমিটার পথ। সময় লাগবে মিনিট পনের। সে গল্প আর একদিন।
প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।