(Rabindranath Tagore)
“ভয় তার আপনার
বাড়িটার ইঁটেতে,
ভয় তার অকারণে
অপরের ভিটেতে।
ভয় তার বাহিরেতে
ভয় তার অন্তরে।
দিনের আলোতে ভয়
সামনের দিঠেতে,
রাতের আঁধারে ভয়
আপনারি পিঠেতে”!
ভয়ের কারণ বা উৎস খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি তাঁকে। কীসে লাগে ভয়– বেশ সহজ করে রবীন্দ্রনাথ লিখে ফেলেছিলেন এক “খাপছাড়া” পদ্যে! লক্ষ্যণীয়, তার মধ্যে ভূত পেরেতের স্থান হয়নি। শুধু শেষ দু’লাইনে “রাতের আঁধারে ভয় আপনারি পিঠেতে” লিখে খানিক ভয়ের আবহ তৈরি করে দিয়েছিলেন; অভিশঙ্কার পালে লেগেছিল হাওয়া। (Rabindranath Tagore)
বিদায় অভিশাপ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূত আছে, কী নেই, সে তর্কের অবসান হওয়া কঠিন। তার অস্তিত্ব বা অবস্থান দুই-ই আমাদের জানার বাইরে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতে “ভূতে বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস দুটোই সমান কুসংস্কার। বিশ্বাস যেমন ইতিবাচক বিশ্বাস, তা প্রমাণ নয়, তেমনই অবিশ্বাসও নেতিবাচক বিশ্বাস, তাও জ্ঞান নয়”। সেদিক থেকে দেখলে রবীন্দ্রনাথের অলৌকিক অথবা অতীন্দ্রিয়তে বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের জায়গাটি খানিক কুয়াশায় মোড়া সন্নিধি। অন্তত ‘গল্পগুচ্ছ’-এ প্রকাশিত কিছু গল্প সেরকমই ইঙ্গিত দেয়। (Rabindranath Tagore)

১৯৪০ সালে প্রায় চার কুড়ি পেরোনো বয়েসে ফিরে দেখেছিলেন আপন শৈশবকে, যার বেশিটাই অতিবাহিত হয়েছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অন্দরে। চেষ্টা করেছিলেন সেই “অতীতের প্রেতলোকে প্রবেশ করতে”। সেকেলে সেই কলকাতায়, না ছিল গ্যাস, না ছিল বিজলি বাতি। সন্ধ্যাবেলায় ঘরের কোণা বা কুলুঙ্গির উপরে পিতলের পিলসুজে জ্বলত, দুই সলতের রেড়ির তেলের সেজ। রাত ন’টা বাজলেই, কোনওরকমে মাস্টারমশায়ের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে, ঢুলু ঢুলু চোখে বাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ। খড়-খড়ির আব্রু দেওয়া বারমহল থেকে অন্দরমহলের সরু পথে আলো ছড়াত মিটমিটে আলোর লণ্ঠন। আর সেই মুহূর্তেই “মন বলত কীসে যেন পিছে ধরেছে- পিঠ উঠত শিউরে”। (Rabindranath Tagore)
উনিশ শতকের আলো-আঁধারির শহরে ভূত প্রেত শাঁকচুন্নি ছিল মানুষের মনের আনাচে কানাচে– গল্পে গুজবে– কানা ঘুষোয়। বাড়ির পশ্চিম কোণে ঘন পাতাওয়ালা বাদামগাছ, তারই ডালে এক পা আর অন্য পা’টা তেতালার কার্নিশের উপরে তুলে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও মূর্তিকে নাকি দেখেছে অনেকেই– মেনে নেওয়ার লোকেরও অভাব হয়নি। “সে সময়টাতে হাওয়ায় হাওয়ায় আতঙ্ক এমনই জাল ফেলেছিল যে, টেবিলের নীচে পা রাখলে পা সুড়্সুড়্ করে উঠত”! (Rabindranath Tagore)
জোড়াসাঁকোর সাতমহলা বাড়িতে অন্ধকার চোরা কুঠুরি, স্যাঁতসেঁতে ঘর, গলিঘুঁজি, উঠোন এসব যে কত, তার ইয়ত্তা নেই। আর এরকম গা ছমছমে, নিস্তব্ধ, নিঝুম জায়গাতেই ভূতেরা সংসার পাতে, সে কে না জানে!
জোড়াসাঁকোর সাতমহলা বাড়িতে অন্ধকার চোরা কুঠুরি, স্যাঁতসেঁতে ঘর, গলিঘুঁজি, উঠোন এসব যে কত, তার ইয়ত্তা নেই। আর এরকম গা ছমছমে, নিস্তব্ধ, নিঝুম জায়গাতেই ভূতেরা সংসার পাতে, সে কে না জানে! এই যেমন, একতলার অন্ধকার এক ঘরে সারি সারি বড় বড় জালায় ভরা থাকত সম্বৎসরের খাবার জল। সেই স্যাঁতসেঁতে এঁদো কুঠুরিতে গা ঢাকা দিয়ে যারা বাস করে “তাদের মস্ত হাঁ, চোখ দুটো বুকে, কান দুটো কুলর মতো, পা দুটো উল্টো দিকে”! সেই ভূতুড়ে ছায়ার সামনে দিয়ে যাওয়া মানে বুকের ভিতরে তোলপাড়, পায়ে তাড়া। অথবা সেই “রাজার বাড়ি” যা ছিল নাকি বাড়ির একতলা বা দোতলার কোনও একটা জায়গায়– যার খোঁজ বাতলেছিল তাঁরই সমবয়সী এক খেলার সঙ্গিনী। আসলে এসবই ছিল কল্পনা-জল্পনায় মাখা এক শিশু মনের ভাবনা যখন সন্ধ্যাবেলার কলকাতা শহর এখনকার মতো এত বেশি সজাগ ছিল না, এ-কথা স্বীকার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। (Rabindranath Tagore)
বদলের বিভিন্ন মাত্রা: রবীন্দ্রনাথ: শুভেন্দু দাশমুন্সী
অমিতা ঠাকুর, (রবীন্দ্র অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথের পৌত্র অজীন্দ্রনাথের স্ত্রী) যদিও আফসোস করে লিখেছিলেন, “স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেই কোনওদিন জিজ্ঞাসা করা হয়নি যে, তিনি ভূত দেখেছেন কী না, বা ভূতের পায়ের আওয়াজ কখনও শুনেছেন কী না”। তবে সে প্রশ্নের উত্তরে মনে হয় না খুব হাড়হিম করা কোনও অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যেত। কারণ ছেলেবেলায় পঠন পাঠনের মাধ্যমে তাঁর মধ্যে জন্ম নিয়েছিল এক ধরণের বিজ্ঞান মনস্কতা। সাধারণ স্কুলে ছাত্রাবস্থায় অন্য বিষয়ের সঙ্গে একসময় ক্যাম্বেল মেডিক্যাল স্কুলের এক ছাত্রের কাছে নিয়েছিলেন অস্থিবিদ্যার পাঠ। হাতে কলমে শেখবার জন্য, তার দিয়ে বাঁধা একটা নরকঙ্কাল এনে টাঙানো হয়েছিল স্কুলঘরে। অনেকে বলেন এই কঙ্কাল থেকেই তাঁর অতিপ্রাকৃত গল্পমালার “কঙ্কাল” গল্পটির সৃষ্টি। ইংরেজির মাস্টারমশাই অঘোরবাবুও ছিলেন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। ছাত্রদের জ্ঞানের আলো প্রজ্বলিত করবার উদ্দেশ্যে একবার তাদের নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন হাসপাতালের শবব্যবচ্ছেদের ঘরে। (Rabindranath Tagore)

“টেবিলের উপর একটি বৃদ্ধার মৃতদেহ শয়ান ছিল। সেটা দেখিয়া আমার মন তেমন চঞ্চল হয় নাই; কিন্তু মেজের উপরে একখণ্ড কাটা পা পড়িয়া ছিল, সে দৃশ্যে আমার সমস্ত মন একেবারে চমকিয়া উঠিয়াছিল। …সেই মেজের উপর-পড়িয়া–থাকা একটা কৃষ্ণবর্ণ অর্থহীন পায়ের কথা আমি অনেকদিন পর্যন্ত ভুলিতে পারি নাই!” (Rabindranath Tagore)
জোড়াসাঁকোর বাড়িতে একসময় প্রেততত্ত্ব নিয়ে একটা মাতামাতি হয়েছিল। জানা যায় সে সময়ে প্ল্যানচেটে পরলোকের আত্মাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলেছিল বেশ কিছুকাল। এ প্রসঙ্গে “জীবনস্মৃতি”-র পাতায় রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন খাজাঞ্চি কৈলাস মুখুজ্জের কথা। ভারী রসিক মানুষ ছিলেন কৈলাস। মৃত্যুর পরেও নাকি কৌতুকপরতা এতটুকু কমেনি তাঁর। একদিন তিনি প্ল্যানচেটে ধরা দিলেন। জিজ্ঞেস করা হল, তুমি যেখানে আছ সেখানকার ব্যবস্থাটা কেমন বল দেখি? উত্তর এল “আমি মরিয়া যাহা জানিয়াছি আপনারা বাঁচিয়াই তাহা ফাঁকি দিয়া জানিতে চান? সেটি হইবে না।“ (Rabindranath Tagore)
পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথও সামিল হয়েছেন প্ল্যানচেটের আসরে। নানা সময় তাঁকে সঙ্গ দিতেন অবনীন্দ্রনাথ, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, অজিতকুমার চক্রবর্তী ও অন্য কেউ কেউ।
পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথও সামিল হয়েছেন প্ল্যানচেটের আসরে। নানা সময় তাঁকে সঙ্গ দিতেন অবনীন্দ্রনাথ, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, অজিতকুমার চক্রবর্তী ও অন্য কেউ কেউ। বন্ধু মোহিতচন্দ্র সেনের কন্যা উমা ছিলেন সেই সব অতীন্দ্রিয় অধিবেশনের ‘মিডিয়াম’। (Rabindranath Tagore)
সে সময়ে কলকাতার চিৎপুর রোড সংলগ্ন জোড়াসাঁকো পাড়া ছিল পরিবেশগতভাবে নির্জন। দিনের আলো নিভে গেলে সে পরত আলো আঁধারের বেশ। অলস আঁধারের ঘেরাটোপে ঠাকুরবাড়ির বিশাল চত্বর এবং অন্দরমহল ছিল খানিক রহস্যাবৃত। রবীন্দ্রনাথের অনুজ, ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথও তাঁর শৈশবে এভাবেই অনুভব করেছিলেন জোড়াসাঁকোর বাড়ির তামসী অস্তিত্ব। একতলায় সিঁড়ির নীচে একটা এঁদো ঘরের মধ্যে ছিল তাঁর “পরীস্থান”! (Rabindranath Tagore)
চিৎপুরের রাস্তা থেকে যে সরু গলি এসে ঢুকেছে বাড়ির ফটকে সে একেবারে জনশূন্য। দু’নম্বর বাড়ির গায়ে লাগানো মিউনিসিপালিটির তেলের বাতির আলো আঁধারে পুরনো শিব মন্দিরের দরজায় শিকার খুঁজে ফেরে এক স্কন্ধকাটা, “যার পেটটা থেকে থেকে অন্ধকারে হাঁ করে আর ঢোক গেলে”। সে থাকত আবার ঐ দুনম্বর বাড়ির দেওয়ালের আধ হাত এক ফোঁকরে, যেখানে দিনেও জমা হয়ে থাকে অন্ধকার। আর ছিল পদ্মদাসী, যার গায়ের রঙ একেবারে রাতের অন্ধকারের মত কালো’। যাকে দেখা যায় না– কেবল ছোঁয়া পাওয়া যায়। (Rabindranath Tagore)

আন্দিবুড়ি আসত রাত্রে সেই দক্ষিণেশ্বর থেকে বাড়ির গিন্নিমাদের শ্যামাসংগীত শোনাতে। “কপালজোড়া সিঁদুর, লাল টকটক করছে, গোল এক বড় মুখোশের মতো মুখ, যেন আহ্লাদী পুতুলকে কেউ কালি মাখিয়ে ছেড়ে দিয়েছে”। রাত্তিরবেলা চাঁদের আলোয় বারান্দার দোলনাতে চুল এলিয়ে বসে যখন সে অন্য দাসীদের সঙ্গে গল্প করত- মনে হত সব পেত্নীগুলো গুজগুজ ফুসফুস করছে। (Rabindranath Tagore)
আরও পরে, অমিতা ঠাকুর জোড়াসাঁকো বাড়িতে তাঁর ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। তখন সে বাড়ির বয়স ২০০ বছর পেরিয়েছে। তাঁর বর্ণনায় কোনও অনুভব বা অনুভুতি নয়, চাক্ষুষ দেখেছেন মৃত আত্মীয় পরিজনকে বাড়ির অন্দর মহলে ঘুরে বেড়াতে। ৬ নম্বরের তেতালার বন্ধ ঘরে মাঝে মাঝেই শুনতে পেতেন পেরেক ঠোকার আওয়াজ। রাতের অন্ধকারে নাকি জ্বলত আলো যা প্রত্যক্ষ করেছিলেন অবনীন্দ্র পত্নী সুহাসিনী দেবী খোদ। চাকরবাকরদের মুখে মুখে ফিরত ফিসফাস, কে খড়ম পরে খট খট করে বেড়ায়, কেউ আবার দরজা বন্ধ করবার সময় বাধা দেয়, এই সব নানা কথা। (Rabindranath Tagore)
জোড়াসাঁকোর বাইরে, শহর কলকাতা পেরিয়ে, জ্যোতিদাদার সঙ্গে শিলাইদহে গিয়ে, রবীন্দ্রনাথ ভগ্নপ্রায় পুরানো নীলকুঠিতে অনুভব করেছিলেন এক অজানা গা ছমছমে ভাব।
জোড়াসাঁকোর বাইরে, শহর কলকাতা পেরিয়ে, জ্যোতিদাদার সঙ্গে শিলাইদহে গিয়ে, রবীন্দ্রনাথ ভগ্নপ্রায় পুরানো নীলকুঠিতে অনুভব করেছিলেন এক অজানা গা ছমছমে ভাব। সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা পদ্মা। অতীত গিলে খেয়েছে নীলকর সাহেবের প্রভাব প্রতিপত্তি। যেখানে একসময়ে “ভোজের সঙ্গে চলত জুড়ি-নৃত্যের ঘূর্ণিপাক, রক্তে ফুটতে থাকত শ্যাম্পেনের নেশা” অথবা শোনা যেত “হতভাগা রায়তদের দোহাই-পাড়া কান্না”, সেখানে আজ লম্বা ঝাউগাছগুলোর দোলাদুলির মাঝে অযত্নে পড়ে আছে দুই সাহেবের গোর- দুপুর রাত্রে কুঠিবাড়ির পোড়ো বাগানে ঘুরে বেড়ায় নাকি সাহেবের ভূত। (Rabindranath Tagore)
সতেরো বছর বয়েসে বিলেত যাওয়ার আগে রবীন্দ্রনাথকে যেতে হয়েছিল মেজদাদা অর্থাৎ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে আহমেদাবাদে। উদ্দেশ্য খানিক বিলিতি চালচলনে সড়গড় হয়ে ওঠা। মেজদাদার বাসা ছিল শাহিবাগে– বাদশাহি আমলের এক রাজবাড়িতে। খানিক দূর দিয়ে বয়ে গেছে সবরমতী নদী।” দিনের বেলায় মেজদাদা চলে যেতেন কাজে; বড় বড় ফাঁকা ঘর হাঁ হাঁ করছে, সমস্ত দিন ভূতে–পাওয়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি”! এই জনমানবহীন অট্টালিকায় যেন সময় এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। “ছেলেবেলা” স্মৃতিচারণে তিনি লিখেছেন, “ক্ষুধিত পাষাণ” গল্পের প্রথম আভাস নাকি পাওয়া গিয়েছিল শাহিবাগের বাদশাহি মঞ্জিলে। (Rabindranath Tagore)
রবীন্দ্রনাথের জীবনের এই বিভিন্ন সময়ের ভীতিপ্রদ অভিজ্ঞতার ছায়া পড়েছে উনিশ শতকের শেষ দশকে লেখা কিছু গল্পের পটভূমিতে। সৃষ্টি করেছেন অতীন্দ্রিয়তা বা অলৌকিকতার এক অদ্ভুত আমেজ যার মধ্যে ঘুরে ফিরে বেরিয়েছে তাঁর চরিত্ররা।
রবীন্দ্রনাথের জীবনের এই বিভিন্ন সময়ের ভীতিপ্রদ অভিজ্ঞতার ছায়া পড়েছে উনিশ শতকের শেষ দশকে লেখা কিছু গল্পের পটভূমিতে। সৃষ্টি করেছেন অতীন্দ্রিয়তা বা অলৌকিকতার এক অদ্ভুত আমেজ যার মধ্যে ঘুরে ফিরে বেরিয়েছে তাঁর চরিত্ররা। কিন্তু কোনও মতেই গল্পগুলির মধ্যে তিনি গাঁজাখুরি অবাস্তব ভূতুড়ে ঘটনার অনুপ্রবেশ হতে দেননি। বরং বিক্ষিপ্ত মনের হ্যালুসিনেশন এবং দ্বিতীয় সত্তার অভিব্যক্তি, এই দু’টিকে সুকৌশলে ব্যবহার করেছেন গল্পগুলির ঘটনা প্রবাহে। (Rabindranath Tagore)
“কঙ্কাল”, “মণিহারা” এবং “নিশীথে”– কম বেশি এই তিন গল্পেই অশরীরী আত্মারা আসা যাওয়া করেছে তাদের অতীত জীবনের পথ ধরে। মৃত্যু পরবর্তীকালীন অবস্থা সম্পর্কে সাধারণের ধারণাকে রবীন্দ্রনাথ উপাদান করেছেন যাতে অতিপ্রাকৃতিক গল্পরস জমে ওঠে। পাঠকের মনের গভীরে, আশৈশব লালিত বিশ্বাসের সঙ্গে মিলেমিশে তা হয়ে যায় সুখপাঠ্য। কিছু ক্ষেত্রে আবার কৌতুক এবং পরিহাসের ছুরি দিয়ে নিজেই ছিন্ন করে দেন অতিপ্রাকৃতের মায়াজাল– লৌকিক জগতের সঙ্গে সাঁকো বাঁধা হয়। কঙ্কালের মালকীন তার অবিনশ্বর কঙ্কালটির খোঁজে রাতবিরেতে হানা দেন, গলায় বাজে এক আফসোসের সুর “পঁয়ত্রিশটা বৎসর আমি কেবল শ্মশানের বাতাসে হুহু শব্দ করিয়া বেড়াইয়াছি!” (Rabindranath Tagore)

আগাগোড়া এক ভৌতিক আবহে বলা “মণিহারা” গল্পের শেষে এক চমক আসে তাঁর লেখনীর টানে। গল্পের ফণিভূষণ সম্পর্কে জনশ্রুতির বর্ণনা দিচ্ছিলেন গল্প কথক এক স্কুল মাস্টার। গল্পটির পরিসমাপ্তি সেটির বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্নে। শ্রোতা যখন স্বীকার করেন তাঁরও নাম ফণিভূষণ সাহা অর্থাৎ গল্পের চরিত্রের সঙ্গে হুবহু মিল, তখন বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখবার জন্য কথকের বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন– “আমি তাহা হইলে ঠিকই অনুমান করিয়াছিলাম। আপনার স্ত্রীর নাম কী ছিল”। এই প্রশ্নের যে উত্তর শ্রোতা দিলেন তার সাপেক্ষে গল্পের বাস্তবতা নির্ধারণে যে কোনও প্রশ্নই অবান্তর! “নিশীথে” গল্পটির পটভূমি, গভীর রাত্রির রহস্যময়তার ঘন কালো অন্ধকার। ডঃ সুকুমার সেন বলেছেন “এই গল্পটি ভূত ছাড়াই ভূতের গল্প!” (Rabindranath Tagore)
“কঙ্কাল” গল্পে ভূতের অস্তিত্ব ও আবির্ভাব থাকলেও, “নিশীথে” তে সেরকম কোনও ভূতের উপস্থিতি নেই, অথচ গা ছমছম ভৌতিক অনুভূতি বিদ্যমান– প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় যাকে বলেছেন একধরণের “weirdness”, যার সন্ধান মিলবে “জীবিত মৃত” গল্পেও। (Rabindranath Tagore)
“মাস্টারমশায়” গল্পের প্রেক্ষাপট নিশুতি রাতের শহর কলকাতা। সেখানে ছুটে চলা এক ঘোড়াগাড়ির ভিতরে ঘটে অলৌকিক ঘটনা।
“মাস্টারমশায়” গল্পের প্রেক্ষাপট নিশুতি রাতের শহর কলকাতা। সেখানে ছুটে চলা এক ঘোড়াগাড়ির ভিতরে ঘটে অলৌকিক ঘটনা। “মজুমদার মনে করিল, চট করিয়া এক লম্ফে সামনের আসনে গিয়া বসিবে। যেমনি মনে করা অমনি অনুভব করিল, সামনের আসন হইতে কেবলমাত্র একটা চাহনি তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া আছে। চক্ষু নাই, কিছুই নাই, অথচ একটা চাহনি। সেই অনির্দেশ্য চাহনির দিকে দুই চোখ এমন শক্ত করিয়া মেলিয়া রহিল যে, নিমেষ ফেলিতে সময় পাইল না!”
আর ঠিক এখান থেকেই শুরু হল ফ্ল্যাশব্যাকে এক দীর্ঘ কাহিনি। অজানা রহস্যের মোড়কে গল্প এগিয়ে নিয়ে যান রবীন্দ্রনাথ। (Rabindranath Tagore)
রহস্য আর অলৌকিকতার আবেশে মোড়া সেই কাহিনির পরতে পরতে রয়েছে রহস্যাবৃত মহল ঘিরে, তৈরি হওয়া এক ভয়ের আশ্লেষ। কিন্তু ইচ্ছে করেই হয়তো বা রবীন্দ্রনাথ অকস্মাৎ ছেদ টেনেছেন গাড়ি এসে পড়ার অছিলায়।
“ক্ষুধিত পাষাণ” এর গল্পের কথক সরাসরি লেখক নন। রেলযাত্রায় আলাপ হওয়া এক আগন্তুক। ট্রেনের জন্য অপেক্ষার অবসরে প্রাচীন, পরিত্যক্ত এক রাজপ্রাসাদের কাহিনি শুনিয়েছেন তিনি। রহস্য আর অলৌকিকতার আবেশে মোড়া সেই কাহিনির পরতে পরতে রয়েছে রহস্যাবৃত মহল ঘিরে, তৈরি হওয়া এক ভয়ের আশ্লেষ। কিন্তু ইচ্ছে করেই হয়তো বা রবীন্দ্রনাথ অকস্মাৎ ছেদ টেনেছেন গাড়ি এসে পড়ার অছিলায়। কাহিনির না-বলা অংশে থেকে গেছে গুলবাগের ইরানী ক্রীতদাসীর পুরানো ইতিহাস, যা সঞ্চারিত করে এক ভয়ের রেশ। গল্প ফুরালেও ফুরায় না মনের জিজ্ঞাসা। আর সেখানেই কাহিনিকার হিসেবে তিনি সফল। (Rabindranath Tagore)
নিজের জীবনে পরোক্ষভাবে অশরীরীকে অনুভব করেছেন রবীন্দ্রনাথ আলো আঁধারির মাঝে। সে কারণেই হয়তো বা ভয় মাখানো ভাষায় ভূতকে বর্ণনা করতে হয়নি তাঁকে; তাঁর চরিত্ররা ভূতের চেহারা দেখে অজ্ঞান হয়ে যায়নি। কিন্তু পাঠক হিসেবে প্রেত সত্তার উপস্থিতি টের পাওয়া গিয়েছে গল্পের নানা পর্যায়ে। এখানেই তাঁর লেখনীর মুন্সিয়ানা! (Rabindranath Tagore)
চিত্র ঋণ- গেটআর্কাইভ ও ফ্লিকার
সপ্তর্ষি রায় বর্ধনের জন্ম, কর্ম এবং বর্তমান ঠাঁই তার প্রাণের শহর কলকাতায়। প্রথাগত ছাত্রজীবন কেটেছে কলকাতার পাঠভবন স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। লেখাজোকা, ছবি তোলা, নাট্যাভিনয় আর হেরিটেজের সুলুক সন্ধানের নেশায় মশগুল। সঙ্গে বই পড়া, গান বাজনা শোনা আর আকাশ পাতাল ভাবনার অদম্য বাসনা। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন- "রূপকথার মতো- স্মৃতিকথায় প্রণতি রায়", "খেয়ালের খেরোখাতা" এবং "চব্য চোষ্য লেহ্য পেয়"।