আমার জীবনী! সেটাও কি লেখার মতো? কী জানি! হ্যাঁ এটা ঠিক আমি যখন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারি নিজেকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি কথা বলি। সবাই খুব উপভোগ করে। অনেকদিন ধরেই শুনছি, লেখো, লেখো। কিন্তু নিজের জীবন নিয়ে লিখব? বেশ সঙ্কোচ ছিল মনে। শেষমেশ লিখতে শুরু করলাম। কোথায় শুরু? সেটাও বেশ চিন্তায় ফেলল। তারপর ভাবলাম জীবনের প্রথম সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে মনে রাখার মতো ঘটনা সেটাই বলি।
আজ আমার আশীর্বাদ। শঙ্কর চলে যাবে লন্ডন। বিয়ে এক বছর পরে। কিন্তু রবুদা আর কমলাদি সেইসময় বিদেশে থাকবেন। রবুদা অর্থাৎ পণ্ডিত রবিশঙ্কর, কমলাদি – কমলা চক্রবর্তী। ওঁরা দু’জন আজ আসবেন আমাদের কেয়াতলার বাড়িতে। বিরাট চারতলা বাড়ি। এক একটা তলা কমবেশি পাঁচ হাজার স্কোয়ার ফিট। ছাদবাগান। ছাদবাগানে আমার গানের ঘর। গানের ঘরের দুটো বড় বড় জানলার গ্রিল স্পেশাল অর্ডার দিয়ে তৈরি করানো। আমার আঁকা ডিজাইন। এক জানলায় একজন নর্তকী। অন্য জানলায় তানপুরা আর তবলা। বিশাল এক মেহগনি খাটের বিছানা। তার ওপর হারমোনিয়াম, তানপুরা। তানপুরার লাউ— সেটা খুব বড়। আসলে আমার তানপুরাটা মেয়েদের নয়। ওটা ছেলেরা বাজায়। খুব বড়। আমার ওটাই পছন্দ। আওয়াজ খুব ভালো আসে। সাদা ধপধপে দেওয়াল। সাদা ধপধপে বিছানার চাদর। ঘরের চারপাশে টবে সাজানো ফুলের বাগান, বেলি আর জুঁইয়ের গন্ধে ম ম করছে। আরও কতরকমের ফুলের যে বাহার তা লিখে বোঝাতে পারব না। এই ছাদবাগান প্রত্যেকবার হর্টিকালচার কম্পিটিশনে প্রথম পুরস্কার পায়। আমি নিজে সেই পুরস্কার— বিরাট রুপোর কাপ নিয়ে আসি। নারদ সিং— দাদুর আর্দালি, অনন্ত— দাদুর মালি, প্রভাসদা— দাদুর ড্রাইভার সবাই সবাই ভীষণ গর্বিত এই ছাদবাগান নিয়ে। আর আমরা দাদু আর নাতনি, এই বাগান আমাদের জীবনে স্বপ্নের মতো। এখন কিন্তু লিখতে গিয়ে আমার সবটাই স্বপ্ন মনে হচ্ছে। এই ছাদবাগানের গানঘরে বসে দিনের মধ্যে অন্তত দু-তিন ঘণ্টা শুধুই গান, শুধুই তান।

ফুলবাগানের কথা বলতে গিয়ে খরগোশ আর পাখিদের ভুলেই গেলাম! খাঁচার মধ্যে সর্বদা ব্যস্ত সাদা নরম লোমের জামা পরা, সবুজ চোখের খরগোসগুলোও যেন বুঝতে পেরেছে আজ কোনও বিশেষ দিন। টিয়াপাখি, ময়না, বদ্রি— ওরাও খাঁচায় আর দাঁড়ে বসে নেচে নেচে খুশি ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে। আমি বললাম, ঠিক ধরেছিস। আজ একটু পরে কারা আসবে জানিস?
আমি তো একটা মেরুন জমি, চওড়া সাদা পাড় দেওয়া কাঞ্জিভরম পরে বেশ জড়োসড়ো হয়ে আছি। মাথার কোমর ছাপানো চুল খোঁপা করে বেঁধে দিয়েছে আমার মেজো ননদ। ছাদবাগানের গোলাপি বোগেনভিলিয়া কানের পাশ দিয়ে খোঁপায় গোঁজা। সেটা আমার ছোট ননদের ইচ্ছেতেই টবের গাছ থেকে তোলা। এমনিতে কিন্তু আমরা কেউ গাছের ফুল ছিঁড়ি না। ওরা আপনমনে ফোটে, আবার নিজেই ইচ্ছেতেই ঝরে যায়। ও হ্যাঁ। এরা সবাই আমার হবু ননদ।
মা, বাবা, দাদু, হবু শ্বশুরবাড়ির মানুষজন। ভাই বোনেরা। মাসির বাড়ি, পিসির বাড়ি, সবাই মিলে কী জমজমাট আমার আশীর্বাদ বাড়ি! চারদিক ফুল দিয়ে সাজানো, রেকর্ড চেঞ্জারে একটার পর একটা জ্ঞান গোঁসাই, বড়ে গোলাম, রবিশঙ্কর, বিলায়েত, জ্ঞানপ্রকাশ বেজে চলেছে।
বিরাট রান্নাঘরে এলাহি রান্নার আয়োজন।

মা, বাবা, দাদু, হবু শ্বশুরবাড়ির মানুষজন। ভাই বোনেরা। মাসির বাড়ি, পিসির বাড়ি, সবাই মিলে কী জমজমাট আমার আশীর্বাদ বাড়ি! চারদিক ফুল দিয়ে সাজানো, রেকর্ড চেঞ্জারে একটার পর একটা জ্ঞান গোঁসাই, বড়ে গোলাম, রবিশঙ্কর, বিলায়েত, জ্ঞানপ্রকাশ বেজে চলেছে।
বিরাট রান্নাঘরে এলাহি রান্নার আয়োজন।
আমাদের বাড়ির রীতি অনুযায়ী বিয়ের দিনই আশীর্বাদ হয় মেয়ের। কোনও এককালে কোনও আশীর্বাদ হয়তো হয়েছিল বিয়ের আগে। সে কোনও হবু কনে বা হবু বরও হতে পারে। শেষমেশ সেই বিয়েটা হয়ে ওঠেনি। সেই থেকে বিয়ের আসরেই আশীর্বাদ পর্ব সারা হয়।
তবে আজকের অনুষ্ঠান খুবই স্পেশাল। কারণ রবুদা, কমলাদি চেয়েছেন ইন্দ্রাণীকে আশীর্বাদ করতে। পুরোহিত দাদুর সঙ্গে পরামর্শ করেই এই আয়োজন। আজকের নামকরা জ্যোতিষী প্রিয়াঙ্কা আমার ছেলেবেলার বন্ধু। সেও সবদিক বিচার করে মত দিয়েছে আশীর্বাদ অনুষ্ঠানের।

সবকিছু একদম যেমন হওয়া উচিত, হচ্ছে। আমরা সবাই অপেক্ষা করছি কখন শঙ্কর রবুদা আর কমলাদিকে নিয়ে আসবে। একতলার ড্রাইভওয়েতে লাল দড়ির কার্পেট বিছানো হয়েছে। দাদুর গাড়িতে করে রবুদা, কমলাদি আসবেন। পায়ে যেন ধুলো না লাগে। রবুদা, কমলাদি চারতলা পর্যন্ত টানা বিছানো কার্পেট দিয়ে হেঁটে ওপরে আসবেন। চারজন বোন হাতে শাঁখ নিয়ে রেডি। মা খুব ভালো উলু দেয়। মাও কী সুন্দর সেজেছে! ঝলমল করছে রূপের ছটা। বড্ড সুন্দরী আমার মা। ডাকসাইটে। হঠাৎ শাঁখের আওয়াজ। হুলুধ্বনি। আর, ‘এসে গেছে, এসে গেছে’ রব। সবাই দৌড়চ্ছে সিঁড়ির দিকে। দাদু হন্তদন্ত হয়ে ঢাকা বারান্দা দিয়ে নীচে তাকিয়ে বলল,—ওই তো পণ্ডিতজী। ওই তো শঙ্করলাল, কমলা চক্রবর্তী।
বাবার গলা পেলাম। গৌরী, ঘরে যাও। ওরা এসে গেছেন। তাকিয়ে দেখলাম আমার গৌরবর্ণ সুপুরুষ বাবা চুপ করে ডিভানে বসে। এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি। বাবা তোমার কি মনখারাপ?
(চলবে)
ছবি সৌজন্য: লেখক
আগামী পর্ব প্রকাশ পাবে ১৭ আগস্ট, ২০২৩
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব
7 Responses
1st Part is good. I enjoy.
Onobodyo…apnar motoi upobhogyo apnar lekhoni.
খুবই ভালো লাগলো।
অত্যন্ত সুন্দর করে সমস্ত বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। যেন সব কিছুই চোখের সামনে ঘটছে। ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন।
Apurbo ebong ashadharan
তর সইছে না। ভিসিওলাইজ করে ফেললাম আশীর্বাদের দৃশ্যপট। পরবর্তী পর্ব কবে পড়বো। বুঝতে পারছি দারুণ মনোগ্রাহী হয়ে উঠবে আমার প্রিয় সংবাদ পাঠিকার জীবনতরী
দিদি খুব ভালো লাগলো
আপনার যে লেখার হাত ও এত সুন্দর – সেটা তো জানতাম না। আরো একবার বুঝলাম – ওপরওয়ালা যাকে দেন, সব দিক থেকে, সব রকম ভাবে ভরিয়ে দেন।
আপনার লেখা থেকে সেই কবেকার ঘটনা একেবারে ছবির মত দেখতে পেলাম। খুব সুন্দর। পরের পর্ব গুলো পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকছি।
শুধু একটা কথা, খুব অসুবিধে না থাকলে এতে ঘটনার তারিখ গুলো লিখলে মনে হয় এই লেখা একটা সেই সময়ের ভালো দলিল হয়ে থাকবে।