২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত পৃথিবীর সব দেশের ওপর দিয়ে এক নির্মম ঝড় বয়ে গেল। এক অজানা শত্রু কোভিড এসে বুঝিয়ে দিয়ে গেল, মানুষ কত অক্ষম, অসহায়। আমাদের স্বাভাবিক জীবন গেল বদলে। আমরা গৃহবন্দি হলাম, সতর্ক হলাম, পরস্পরের সংস্পর্শ এড়ালাম, তবুও মৃত্যুর হাতছানি এড়াতে পারলাম না। এই শত্রু ছোটবড়, গরিব, গুণীজন, বিত্তশালী কারুকেই এড়িয়ে গেল না। সেল ফোন, ল্যাপটপ, টিভি, রেডিওতে সেই একই বার্তা, একই সতর্কতা, একই খবর- কত মানুষ আক্রান্ত, কত মানুষ মৃত, আর কী কী সতর্কতা নেওয়া উচিত।
কোনওদিন সকালের রোদ ঝলমলে দিন দেখে মনে হয়েছে, দুঃস্বপ্ন দেখছি না তো? এই প্রতিনিয়ত মৃত্যুর হাতছানি কি সত্যি? নির্মম হলেও সত্যি। চলেছিল এক মৃত্যুর মিছিল। যে ছেড়ে গেল সে পেল না তার সন্তান, স্বামী, স্ত্রী, মা-বাবাকে শেষ দেখা দেখতে। কোন এক অচেনা মানুষ, কোন এক অচেনা জায়গায় তার চোখের আলো নিভে গেল। কিন্তু যারা বেঁচে রইল তারাও কী মানসিকভাবে মৃত নয়?
ধীরে ধীরে কিছুটা বাঁচার রসদ, বিশ্বাসের আশ্বাস যখন ফিরে পাচ্ছি ২০২২ সালে, তখনই এল এক নিদারুন সংবাদ,বসন্তের আগেই কোকিলের ডাক স্তব্ধ হয়ে গেল। সারা ভারতবর্ষের ওপর যেন শোকের ছায়া বিছিয়ে দিল। কোভিড কেড়ে নিয়ে গেল ভারতের জীবন্ত সরস্বতী, লতা মঙ্গেশকরকে। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতেই আমার এই অঞ্জলি।
সালটা ঠিক মনে নেই, ১৯৫৯-৬০ হবে। আমি তখন খুবই ছোট তাই স্মৃতি বেশ ঝাপসা। তবু যতটা মনে ধরা আছে সেই ছবিই আজ তুলে ধরার চেষ্টা করব। তখন সবে আমি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ইন্দিরাদির ‘শিশুমহল’ অনুষ্ঠানে ঢুকেছি। বাবার উৎসাহে আবৃত্তি আর নাটক করতাম। তখনও পড়তে পারতাম না, তাই বাবা কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে কবিতা মুখস্থ করাতেন। বাবার হাত ধরেই অনেক বড় বড় মানুষদের কাছে যাবার সুযোগ পেয়েছি, স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছি। দাদাঠাকুর, কাজি নজরুল ইসলাম, আশাপূর্ণা দেবী, কাজী সব্যসাচী, সবিতাব্রত দত্ত, বিধায়ক ভট্টাচার্য, স্বপনবুড়ো, মৌমাছি-র মতো গুণী মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। তখন কিছুই বুঝিনি, এখন বুঝি যে কী অমূল্যরতন আমার বাবা আমাকে দিয়ে গেছেন।

আমার এক জ্যেঠু থাকতেন বোম্বেতে, আমাদের বোম্বের জ্যেঠু। প্রতিবছর বোম্বের জ্যেঠু একবার করে কলকাতা আসতেন আর আমাদের জন্যে বোম্বের নতুন ফ্যাশনের জিনিসও আসত। বাড়ি থেকেও বছরে একবার করে কেউ না কেউ বোম্বের জ্যেঠুর কাছে বেড়াতে যেত। জ্যেঠু বেঙ্গল কেমিকেলের সেলস ম্যানেজার ছিল। খুব সুন্দর জ্যেঠুর বাংলো। বিয়ে করেননি তাই ছেলেমেয়ের ভালোবাসাটা আমরাই সম্পূর্ণ করে পেতাম।
যে বছর আমি প্রথম বোম্বে গেলাম, আমরা গিয়ে কিন্তু জ্যেঠুর বাংলোতে উঠিনি। ওখানে আগে থেকেই কোনও অতিথি ছিলেন, তাই আমরা প্রথমে ক’দিন মেরিন ড্রাইভের ওপর হোটেল ডেলামার-এ উঠেছিলাম। আমরা চারজন গেছিলাম– বাবা, কাকা, ফুলপিসি আর আমি। আমার কাকা ফিল্ম প্রোডিউসার। তিনি গিয়েছিলেন কোনও দরকারে। আর আমরা গিয়েছিলাম বেড়াতে। আমার বাবা কোথাও গিয়ে বসে থাকার মানুষ নন, তাই রোজই কোথাও না কোথাও বেড়াতে যেতাম। তবে যে দুটোর কথা আমার সবচেয়ে মনে আছে সেগুলো হল মেরিনড্রাইভে ঘুরে বেড়ানো আর আইসক্রিম খাওয়া।
একদিন সকালে কাকা আমাদের একজায়গায় বেড়াতে নিয়ে গেলেন। এটাকে নাকি স্টুডিও বলে। এখানে নাকি সব সিনেমা তৈরি হয়। দেখে একদমই ভালো লাগেনি। কোথাও আধখানা ঘর, কোথাও শুধু সিঁড়ি আর বারান্দা, আবার কোথাও দড়ি বালতি ঝোলানো পাতকুয়া। সিনেমায় কত সুন্দর সুন্দর বাড়ি দেখায়, এখানে তো কিছুই নেই। কী একটা নাটক বারবার হচ্ছিল। কাকা বললেন, এটা সিনেমা, নাটক নয়। তাই অনেকবার করে, তারপর ঠিক করতে হয়। অবাক হয়েছিলাম, সিনেমা করছে দু’জন আর কতজন তাদের চারপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে, কেউ কোনও কথা বলছে না।
এর মধ্যেই একজন সুন্দর দেখতে ভদ্রমহিলা আমাদের নিয়ে গিয়ে একটা ঘরে বসিয়ে কী সব কথা বললেন। আমাকে খুব আদর করলেন, আবৃত্তি শুনলেন। আমি আইসক্রিম ভালোবাসি শুনে আনিয়ে দিলেন। আমার ওঁকে খুব ভাল লেগেছিল। পরে একটু বড় হয়ে, কাবুলিওলা দেখার পর শুনেছি, ওই ভদ্রমহিলার নাম লীলা দেশাই। উনি কাকার বন্ধু, উনিও কাকার মতো ফিল্ম প্রোডিউসার। ওঁর খুব ইচ্ছে ছিল আমাকে হিন্দি কাবুলিওলার মিনি করাতে। কিন্তু আমার বাবা-কাকা রাজি হননি!

মাঝে আর একদিন ঘুমন্ত আমাকে তুলে আমার ফুলপিসি সাজিয়ে গুজিয়ে রেডি করে দিল। বুঝলাম আমরা কোথাও যাচ্ছি। চারজনে গাড়িতে করে একজায়গায় গেলাম। একটা বড় বাড়ির মধ্যে গিয়ে একটা ঘরে আমাদের নিয়ে গিয়ে বসানো হল। কারো বাড়ি নয়, অনেকটা অফিসের মতো। এখানে যারা ছিলেন, তাঁরা কাকার পরিচিত, কিন্তু আমাদের নয়। সবই অচেনা অজানা, তবে একটা কথা পরিষ্কার মনে আছে, আমরা যে ঘরে বসেছিলাম সেই ঘরের একটা দেওয়াল কাঁচের, আর তার ঠিক ওপাশের ঘরটা একেবারে রেডিও স্টেশনের শিশুমহলের ঘরটার মতো। সেটাই শুধুমাত্র আমার চেনা। তারপর একসময় দেখলাম সাদামতন শাড়ি পরা, রোগা, খুব সাধারণ দেখতে, সাজগোজের কথা মনে নেই, লম্বা বিনুনি করা একজন ঘরটাতে ঢুকলেন। কাকা ঘরে গিয়ে কথা বললো ওঁর সঙ্গে, এ ঘর থেকে কিছু শোনা গেল না। যেটা মনে আছে, উনি মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে মাটি ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। অবাক হয়েছিলাম। ওখানে তো কোনও ঠাকুর নেই! প্রণাম করলেন কাকে?
এটাকে নাকি স্টুডিও বলে। এখানে নাকি সব সিনেমা তৈরি হয়। দেখে একদমই ভালো লাগেনি। কোথাও আধখানা ঘর, কোথাও শুধু সিঁড়ি আর বারান্দা, আবার কোথাও দড়ি বালতি ঝোলানো পাতকুয়া। সিনেমায় কত সুন্দর সুন্দর বাড়ি দেখায়, এখানে তো কিছুই নেই। কী একটা নাটক বারবার হচ্ছিল। কাকা বললেন, এটা সিনেমা, নাটক নয়। তাই অনেকবার করে, তারপর ঠিক করতে হয়।
এরপর উনি একটা গান করলেন। তখন গানের ভালোমন্দ অত বুঝতাম না। একটাই গান করলেন। তারপর গান গেয়ে যেমন নিঃশব্দে এসেছিলেন তেমনই চলে গেলেন। হোটেলে ফেরার পথে গাড়িতে বাবা আমাকে বললেন, “খুকু তুই আজ কাকে দেখলি, কার গান শুনলি জানিস? খুব বড় গায়িকা, ভারতজোড়া নাম, লতা মঙ্গেশকর।” তখনও সেই বড় গায়িকা আমার জীবনে অজ্ঞাত, আমার প্রশ্ন – “উনি প্রণাম করলেন কাকে?” বাবার উত্তর– “ওই স্টুডিও, তার ফ্লোর, মাইক্রোফোন সব কিছুকেই! বড় হতে হলে এমন করেই নত হতে হয়। উনি ভারতের জীবন্ত সরস্বতী।”
সেইদিনের কথা মনে হলে একটা আফশোস মনে বিঁধে থাকে। এমন এক চলমান সরস্বতীকে এত কাছে পেয়েও কেন একবার তাঁর চরণ স্পর্শ করতে পারলাম না। সেই কোকিলকন্ঠী সরস্বতীর কণ্ঠ আজ যখন চিরকালের মতো রুদ্ধ, তখন দূর থেকে মনে মনেই তাঁকে প্রণাম জানাই।
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Twitter
আশির দশকে হাওড়ার বর্ধিষ্ণু যৌথ পরিবারের ঘোরাটোপ ছেড়ে বেরিয়ে বিজ্ঞান গবেষণা করতে মার্কিনদেশে চলে এসেছিলেন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের প্রাক্তনী স্বপ্না রায়। সঙ্গী স্বামী রাহুল রায়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের একনিষ্ঠ ভক্ত স্বপ্না তিন দশক আগে আমেরিকার বস্টন শহরে তৈরি করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার স্কুল স্বরলিপি। আজ তাঁর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা একশর বেশি। তার মধ্যে ভারতীয়, অভারতীয় উভয়েই আছেন।
One Response
পড়ে ভাল লাগলো