কলকাতা শেষ পর্যন্ত কলকাতাতেই থাকল, তবে বোধহয় একটু কম থাকল। হ্যাঁ, কালীপুজো-দেওয়ালির রাতে বাজি ফাটানোর কথাই হচ্ছে। কথা ছিল, বিকট শব্দ করে বাজি ফাটালে পুলিশ ধরবে, শাস্তি দেবে। পুলিশ একেবারে ধরেনি, তা বলা যাবে না। পুলিশ কমিশনার জানিয়েছেন, এবার শব্দ দূষণের দায়ে অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি লোককে আটক করা হয়েছে। কিন্তু তার ফলটা কী দাঁড়াল? শহরের মানুষ স্বস্তি পেলেন কি? বিশেষ করে শিশুরা, বয়স্করা এবং অশক্ত বা অসুস্থ মানুষেরা, চড়া আওয়াজে যাঁদের কেবল বেশি কষ্টই হয় না, শরীরের ক্ষতিও হয় বেশি? এবং শহরের রাস্তায়, গাছপালায় ও বাড়িতে থাকা অবোলা প্রাণীরা? পশুপাখিদের পক্ষে শব্দের বাহুল্য অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক ও ক্ষতিকর, এই সময়টাতে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। এবার কি তারা কিছুটা রক্ষা পেল?
ছবিটা এখনও সম্পূর্ণ পাওয়া যায়নি। পেতে আরও সময় লাগবে। তবে একটা ব্যাপার মোটের ওপর স্পষ্ট। কলকাতা এবং শহরতলিতে নানা জায়গায় বাজির আওয়াজ বিভিন্ন মাত্রার হয়েছে। এমনকি পাশাপাশি, কাছাকাছি দুটো এলাকাতে অভিজ্ঞতা দু’রকমের, এমন দৃষ্টান্তও অনেক। যে কারণে পরের দিন হিসেব মেলাতে গিয়ে মতান্তর হয়েছে, তর্ক জমেছে, কেউ বলেছেন ‘আমাদের ওদিকে এবার আওয়াজ কম ছিল’, কেউ আবার উল্টো কথা বলেছেন, ‘না না, আমাদের তো কান পাতা দায় হয়েছে কাল।’ শুনে মনে হয়েছে, সবাই আসলে নিজের নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছেন, যেহেতু সকলের অভিজ্ঞতা এক নয়, তাই মতে মিলছে না। মানে, শেষ বিচারে, সেই অন্ধের হস্তিদর্শনের ব্যাপার।
কিন্তু এই যে নানা জায়গায় রকমের অভিজ্ঞতা, এটা নিয়ে ভাবলে একটা সূত্র পরিষ্কার বেরিয়ে আসে। সেটা হল সম্ভাবনার সূত্র। বুঝতে কোনও অসুবিধে নেই, যে অঞ্চলে পুলিশ প্রশাসন শব্দ আটকাতে তৎপর হয়েছে, সেখানে মানুষ একটু শান্তি পেয়েছেন, অন্য জায়গায় তাঁদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে শব্দদানবেরা। নানা অঞ্চলের মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও সে রকমটাই জানাচ্ছে। যেখানে অবস্থা কিছুটা শুধরেছে, সেখানকার মানুষ বলেছেন, পুলিশে ফোন করলে তারা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছে, অকুস্থলে হানা দেওয়া, ধরপাকড় করা, এ সবই ঘটেছে। তার মানে, প্রশাসন যদি চায় নিয়মশৃঙ্খলা জারি করতে এবং সেই চাওয়াটা যদি তাদের কাজে রূপান্তরিত হয়, তবে অবস্থা শোধরাতে পারে। তা না হলে যেমন চলছে সে রকমই চলতে থাকে, এবং বছরে বছরে শব্দের দাপট বাড়তেই থাকে।
কথাটা শুনতে সাধারণ মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে এই সাধারণ কথাটাই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাতে পারে। যেখানে প্রশাসন কাজ করছে না, সেখানে তাদের কাজ করার জন্য চাপ দেওয়া যেতে পারে। এবং একটা এলাকায় ভাল কাজের নমুনা চোখের সামনে হাজির করে অন্য এলাকার পুলিশ কর্তাদের বলা যেতে পারে, ‘ওরা পারলে আপনারা পারবেন না কেন?’ এ সব ক্ষেত্রে ‘পাবলিক শেমিং’ বা জনসমক্ষে লজ্জা দেওয়ার একটা উপকারিতা থাকে। সরকার যদি চায়, তা হলে যারা ভাল কাজ করেছে আর যারা ভাল কাজ করেনি, তাদের একটা তালিকা তৈরি করে প্রচার করতে পারে। এ কাজে দুষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ তাদের সাহায্য করতে পারে, কারণ তাদের কাছে বিভিন্ন এলাকায় দূষণের হিসেব থাকে। সত্যি বলতে কী, এখান থেকেই শুরু হতে পারে একটা নতুন নাগরিক আন্দোলন। যার মূল দাবি: শব্দ নয়, শান্তি চাই।