বছর পাঁচেকের ছোট্ট ছেলেটি মায়ের সঙ্গে এসেছে বার্গার শপে। পাশের টেবিলে যিনি বসেছিলেন, তাঁর সঙ্গে আদনান সামির আগের চেহারার দারুণ মিল। যে বার্গারটি উনি অর্ডার করেছিলেন, তা সবেমাত্র টেবিলে এল। ভদ্রলোকের বার্গারটিও বিশালবপু। ‘ওয়াও’ বলে ব্যগ্র কামড় বসল বিশাল বার্গারে। শিশুটি তাঁর যুবতী মায়ের টিশার্ট টেনে ধরে বলল, ‘মাম্ মাম্, লুক। দ্যাট্স এ মেগাবাইট!’
শিয়ালদা-দত্তপুকুর লোকালে আমলকি-হরিতকির ম্যাজিক চূর্ণ বিক্রি করা এক আশ্চর্য হকারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। জেনেছিলাম, উনি এমসিএ পাশ। গ্র্যাজুয়েশনের পরে কাজের বাজারে যে তুমুল ‘জোয়ার’ এসেছিল, তা তাঁকে টেনে ট্রেনে হকারি করতে বাধ্য করে। বছরের পর বছর কম্পিউটার বিজ্ঞান গুলে খেয়ে হয়তো বিট-বাইট তাঁর রক্তে মিশে গিয়েছিল। কথাগুলো কানে ভাসে এখনও।
‘এই যে দাদারা, সকালবেলা কষ্ট করে শুধু কয়েক কেবি কেন? কেবি মানে জানেন তো দাদারা? কিলোবাইট, কিলোবাইট। তারপরে সারাদিন শুধু কষ্টের সিডি বাজে। বাজে বলা ভুল হল। সিডি ভরা গান, পেট আনচান, কিন্তু বাজে না। পেশ করা হল আমার ম্যাজিক চূর্ণ। মাত্র দশ টাকায় কোষ্ঠকাঠিন্যের থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়ার টিকিট। কাল থেকে আর কেবি নয়, কমোডের সঙ্গে কথা হবে মেগাবাইটে। পেট পরিষ্কার তো মন পরিষ্কার।’
‘বাইট’ শব্দের মানে, যা শুধু কামড় বলে জানতাম ছোটবেলায়, বার্গার শপে বসা বসা সেই ছোট ছেলেটির মতো, বড় হয়েছি যত, স্কিন টাইট জিন্সের মতো তাতে আঁকড়ে ধরেছে বাইনারি আদর। আর জেনেছি, বাইট হল এমন একটা শব্দ, যা শুধু ফুরিয়ে যায়। ছোট্টবেলার ‘চিনে নাও কম্পিউটার’ জাতীয় বইগুলোর হলুদ হয়ে যাওয়া পাতা উল্টে দেখি, ‘বিট কাহারে কয়’ পরিচ্ছদের দৌড় ছিল গিগাবাইট পর্যন্ত। ফ্লপি দেখে আশ্চর্য হওয়া চোখগুলোতে গিগাবাইটের হিসেব ছিল দূর আকাশের কোনও তারার মতো, কিংবা প্ল্যাটফর্মে দিন গুজরান করা কোনও মানুষের কোটি টাকার লটারি জেতার মতো। একের পিছনে কটা শূন্য থাকে? কত বাইট জুড়লে পরে গিগা হওয়া যায়? প্রশ্নগুলো সহজ ছিল। তবে উত্তর লেখার সময় চোখে ঝিলমিল লেগে যেত।
তথ্য পরিমাপের এককের নাম হল ‘বাইট’। বাইনারি উলের কাঁটায় আটটি বিট একসঙ্গে জোড়া লাগালে তৈরি হয় এক বাইট। ১০২৪ বাইটে হয় এক কিলোবাইট। ১০২৪ কিলোবাইটে জন্ম নেয় এক মেগাবাইট। এ ভাবে প্রতিটার আগে ১০২৪ বসিয়ে দিলে এক অনন্ত যাত্রার সন্ধান পাওয়া যায়। ১ সংখ্যাটির পরে যেন সীমাহীন শূন্য। কিলোবাইট-মেগাবাইট-গিগাবাইট-টেরাবাইট-পেটাবাইট-এক্সাবাইট-জ়েটাবাইট-ইয়ট্টাবাইট। এতেই শেষ নয়। এর পরে নাকি চলে এসেছে ব্রন্টোবাইট ও জ়িওপবাইটের মতো আরও বড় দাদা। এক জ়িওপবাইটকে যদি বিটের হিসেবে লিখতে বলা হয় কম্পিউটারের পর্দায়, তাহলে ১ এবং ০ লেখা কি-দুটোর উপরে এক জোড়া টিকটিকি ছেড়ে দিয়ে বলা যায়, দাপাদাপি কর। দু-চার দিন পরে এসে স্ক্রিনের দিকে একবার নজর দেওয়া যেতে পারে।
আরও পড়ুন: অম্লানকুসুম চক্রবর্তীর কলমে: পাসওয়ার্ডনামা
ফ্লপি ডিস্কে জায়গা না থাকলে কম্পিউটারের স্পিকার দিয়ে ঝং করে এক আর্তনাদ আসত। সেই ধ্বনিও যেন মিলিয়ে গিয়েছে দিকশূন্যপুরে। আজকের দুনিয়ার ডেটার হিসেব সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো করে দেয়। ‘দ্য কনভার্সেশন’ পত্রিকায় সদ্য প্রকাশিত এক নিবন্ধ কয়েকটা ভয়ংকর সুন্দর নম্বরের সন্ধান দিল। প্রতিদিন ফেসবুকে যে পরিমাণ ডেটা যোগ হয় তার পরিমাণ ৪ মিলিয়ন গিগাবাইট, মানে ১ পেটাবাইট। ইউটিউবের মতো ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে দৈনিক আপলোড করে দেওয়া ভিডিওর সম্মিলিত দৈর্ঘ্য হল ৭,২০,০০০ ঘণ্টা। এর মানে বেশি না, মাত্র ৩০ হাজার দিন। আর এই পরিমাণ দিন মানে ৮২টি বছর।
একটু অন্যভাবে ভাবি। ধরা যাক, ‘তোমার জীবনের সবচেয়ে দামি ইচ্ছে কী?’ প্রশ্নের উত্তরে কোনও দশ বছরের বালক আদর মাখানো গলায় উত্তর দিল, ‘শুধুমাত্র একদিনে যে পরিমাণ ভিডিও ভরে দেওয়া হয় ইউটিউবে, তা দেখাই আমার লাইফের এইম। বাপি আনলিমিটেড ডেটা প্যাক ভরিয়ে দিয়েছে।’ আরও ধরা যাক, ইচ্ছে মঞ্জুর হওয়ামাত্র বালকটি মোবাইল নিয়ে বসে পড়ল। বিন্দুমাত্র বিরতি না নিয়ে, একদিনের যাবতীয় কনটেন্ট শেষ করে সে যখন আড়মোড়া ভাঙবে, দেখা যাবে, বালক আর বালকটি নেই, পরিণত হয়েছে ৯২ বছরের এক বৃদ্ধ মানুষে। প্রতিদিন দুনিয়ায় যে পরিমাণ ইমেল চালাচালি করা হয় তার পরিমাণ নাকি ২৯৪ বিলিয়ন গিগাবাইট। এত ইমেল কারা লেখেন ও কারা পড়েন, জানি না। মগজে কারফিউ নিয়ে ভাবতে ভয় হয়।
কর্মজীবনের শুরুর দিকে ১৬ জিবির পেন ড্রাইভ কেনার পরে সব পেয়েছির দেশে যাওয়ার মতো অনুভূতি হয়েছিল। এক অদম্য মজা। কথাটা জানাজানি হওয়াতে বন্ধুমহলে পার্টিও দিতে হয়। মনে আছে, ১৬ জিবির গর্বে জামার কলার উঁচু হয়ে গিয়েছিল। ১ জিবির সমার্থক ছিল প্রায় শ’দুয়েক গান। মানে, আমার ওই সদ্য কেনা ডিজিটাল সিন্দুকে আমি অবলীলায় ঢুকিয়ে ফেলতে পারব তিন হাজারেরও বেশি সঙ্গীত। পাঁচশো মেগাবাইট মানে যদি একটি সিনেমা হয়, তা হলে আমার ওই সাধের পেন ড্রাইভে আমায় সর্বক্ষণ সঙ্গ দেবে তিরিশটা সিনেমা।

প্রাণাধিক প্রিয় ওই ড্রাইভ কোথায় রাখলে যে ভাল থাকবে তা নিয়ে চিন্তায় কয়েক রাত ঘুমোতে পারিনি বেশ মনে আছে। আলমারির লকারকেও সুরক্ষিত মনে হয়নি। শুতে যাওয়ার সময় পরম যত্নে তা রেখে দিতাম বালিশের নীচে। নিজের কাছে শপথ ছিল, রাত্তিরে চোর এলে যায় যদি যাক প্রাণ, আমার পেন ড্রাইভ যেন কেউ স্পর্শ না করতে পারে।
সামান্য ১৬ গিগাবাইট বাঁচাতে যে মেগা সুরক্ষা নিয়েছিলাম, দেওয়ালের অনেকগুলো ক্যালেন্ডার পাল্টে যাওয়ার পরে, আজ সেই কথা মনে পড়লে হাসি পায়। পৃথিবীর তাবড় তাবড় সংস্থাগুলোর ডেটা প্রোটেকশনের ব্যাপারে খবর নিলে বোঝা যায়, সুরক্ষা বোলে তো অ্যায়সা। সোজা কথায় বলা যেতে পারে, ডেটা সেন্টার আসলে এক রাক্ষুসে পেন ড্রাইভ। মানে, ডেটা স্টোর করার এক বিরাট আয়োজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পোর্টল্যান্ড থেকে ১২৯ কিলোমিটার দূরে কলম্বিয়া নদীর উপরে গুগলের যে ডেটা সেন্টারটি আছে, তার পরিধির মধ্যে আরামসে ঢুকে যেতে পারে দুটো ফুটবল মাঠ। এর মধ্যে লুকিয়ে থাকা ডেটার ঈশ্বরকে তুষ্ট করার জন্য যে কুলিং টাওয়ারগুলো বসানো রয়েছে তা নাকি চারতলা বাড়ির সমান। ডেটা সেন্টারের মেজাজ কীভাবে কম খরচে আরও বেশি করে ঠান্ডা রাখা যায়, তা নিয়ে দুনিয়াজুড়ে নানা গবেষণা চলছে।
মাইক্রোসফট-এর পক্ষ থেকে একটি ছোট ডেটা সেন্টারকে একেবারে সমুদ্রের তলায় রেখে আসা হয়েছিল ২০১৮ সালে। সীতার অগ্নিপরীক্ষা দেওয়ার মতো এই ডেটা সেন্টারকে অন্তঃসলিলা হয়ে জলের সঙ্গে যুঝতে হয়েছে টানা দু’বছর। সেখানে বন্দি ছিল ৮৬৪টি সার্ভারে ২৭.৫ পেটাবাইট ডেটা। ২০২০ সালে উত্তর সাগরের ১০০ মিটার গভীর থেকে ডেটা সেন্টারটিকে তুলে নেওয়ার পরে বিজ্ঞানীদের হাসি আর ধরেনি। দেখা গিয়েছে, ডেটা অনেক বেশি সুরক্ষিত থেকেছে জলের গভীরে। বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছিলেন, যদি বিশ্বাসযোগ্যতা পরিমাপের কোনও একক হয়, তা হলে স্থলের ডেটা সেন্টারের তুলনায় জলের ডেটা সেন্টার ৮গুণ বেশি বিশ্বাসযোগ্য।
এ ছাড়া, সাধারণ ডেটা সেন্টারকে ঠান্ডা রাখার জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়, জলের গভীরে পরিকল্পনা করে ডেটা জমা রাখলে এই খরচ আগামী দিনে হয়তো অনেকটাই কমানো সম্ভব। আগামী দিনগুলোয় হয়তো ডেটাভরা ফুটবল মাঠগুলো ক্রমশ ঢুকে যেতে থাকবে সমুদ্রের গভীরে। তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা আমার এক বন্ধু এই সেদিন বলছিল, বাইনারি অক্ষরে যদি আর কয়েক বছর পরে লেখা হয় ঠাকুরমার ঝুলির নয়া এডিশন, তা হলে দেখা যাবে, পৃথিবীর প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে সমুদ্রের গভীরে কোনও ডিজিটাল ঝিনুকে।

ফড়িংয়ের ডানা ঝাপটানোর মতো দ্রুততায় পাল্টায় প্রযুক্তি। টেকনোলজি কথাটার আগে যে ‘লেটেস্ট’ বলে শব্দ জুড়ে দেওয়া থাকে অনেকসময়, রসিক মানুষেরা বলেন, তিন অক্ষরের এই শব্দটি নাকি তৈরি হয়েছে কর্পূর দিয়ে। কাল যে মেগাকে নিয়ে আমরা বুক ফোলাতাম, গিগা এসে তার শেষ লিখে দিয়েছে সেই কবেই। গিগাবাইটকে মেরেছে টেরাবাইট। প্রযুক্তির দুনিয়ায় আজকের রাজা আগামী দিনের সামনে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে। স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, নিজের মধ্যে কত বাইট লুকিয়ে রাখা যায়, তার খবর কি আমরা কখনও জানতে চেয়েছি? তাজ্জব বনে যাওয়ার মতো একটা তথ্য দেওয়া যেতে পারে এই সুযোগে। একজন সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্স যে পরিমাণ তথ্য জমা করে রাখার ক্ষমতা রাখে, তার পরিমাণ নাকি ৭৪ টেরাবাইট।
কত মেগার পরে মেগা জমলে টেরার পাথর হয়! যে সমুদ্র ধরে রাখার ক্ষমতা রয়েছে আমাদের মনে, তার কতটুকু আমরা এ জীবনে ব্যবহার করি? সাধে কি বলে, এমন মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা! সোনা কাকে বলে জানি না। তবে দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে বলতে পারি, চারটে ফোন নম্বরও কেন মনে রাখতে পারি না আজকাল? পলাশীর যুদ্ধটা কবে হয়েছিল যেন? আরে! কবিগুরু মারা যাওয়ার ইংরিজি তারিখটা? প্রশ্নগুলো মনে উদয় হওয়ার ন্যানোসেকেন্ডের মধ্যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে খুলে যায় মোবাইলের দরজা। এই তো গুগল, এই তো।
আয়তনে কত বড় তা আর জানার চেষ্টা করিনি। মেগাবাইটের আরও এক বড়দার নাম নাকি হেলাবাইট। নামটি যেভাবে এসেছিল, তার মূলে নাকি আছে ‘এ হেল অফ এ লট অফ বাইটস’। হেল মানে তো নরক, জাহান্নাম। মৃতের আলয়।
মেগার পরে কি মেঘ জমছে ক্রমশ?
*ছবি সৌজন্য: ExtremeTech, sordum.org, datafloq.com
অম্লানকুসুমের জন্ম‚ কর্ম‚ ধর্ম সবই এই শহরে। একেবারেই উচ্চাকাঙ্খী নয়‚ অল্প লইয়া সুখী। সাংবাদিকতা দিয়ে কেরিয়ার শুরু করলেও পরে জীবিকার খাতবদল। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্ট্র্যাটেজি অ্যানালিস্ট পদে কর্মরত। বহু পোর্টাল ও পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে গল্প সংকলন 'আদম ইভ আর্কিমিডিস' ও কয়েকটি অন্য রকম লেখা নিয়ে 'শব্দের সার্কাস'।
3 Responses
দুর্দান্ত লেখা, অনেক কিছু জানলাম
আটার থেকে ডেটা সস্তা হলে বালক তো বটেই সব লোক আনলিমিটেড প্যাকেজ চাইবেন। সবমিলিয়ে প্রাঞ্জল।
আটার থেকে ডেটা সস্তা হলে বালক তো বটেই সব লোক আনলিমিটেড প্যাকেজ চাইবেন।