banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

সুকান্ত ভট্টাচার্যের পত্রগুচ্ছ

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Sukanta Bhattacharya

বাংলা সাহিত্যে বহুপরিচিত, বহুপঠিত এবং অপেক্ষাকৃত স্বল্প-আলোচিত একটি নাম। পৃথিবীতে ছিলেন মাত্র একুশটি বছর। তারই মধ্যে সৃষ্টি করে গিয়েছেন স্মরণীয় সাহিত্যকীর্তি। তাঁর ‘ছাড়পত্র’, ‘ঘুম নেই’ থেকে শুরু করে ছোটদের জন্য লেখা ‘মিঠে-কড়া’ আজও সমানভাবে জনপ্রিয়। সুকান্তর তীব্রভাবে রাজনৈতিক ভাষ্যযুক্ত কবিতাগুলি তাঁর মার্কসবাদী বামপন্থার সাক্ষ্য দেয়। সমসাময়িক কোন বিষয় নিয়ে না লিখেছেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা— সমস্ত অরাজকতা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সেই সদ্য কৈশোর পেরনো তরুণ কলমকে ব্যবহার করেছেন খাপখোলা তলোয়ারের মতো।

কিন্তু তাঁর পত্রগুচ্ছের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। সেখানে যেন ধরা পড়েছে সদ্য কৈশোর পেরনো ছেলেটির অস্থিরতা, রোম্যান্টিকতা এবং মানুষী প্রেমের তীব্র প্রকাশ। এ ভাষা তাঁর কাব্যভাষা নয়। এ তাঁর ব্যক্তিভাষা। ঘনিষ্ঠ সুহৃদ কবি অরুণাচল বসুর কাছে মন খুলে অকপটে মেলে ধরেছেন নিজের সংবেদনশীলতাকে। প্রেমই সেখানে প্রধান। কখনও শহরের প্রতি, কখনও প্রেমিকার প্রতি।

১৯২৬ সালের ১৫ অগস্ট কলকাতায় মহিম হালদার স্ট্রিটে, মামার বাড়িতে সুকান্তর জন্ম, যদিও তাঁর পৈতৃক ভিটে ছিল পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরে। বাবা নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্যের ছিল বই প্রকাশের ব্যবসা। ন’ দশ বছর বয়স থেকেই সুকান্ত ছড়া লিখতে শুরু করেন। খুব অল্পবয়সেই মাকে হারান। তারপর থেকে তাঁর ক্ষীণকায় জীবনটুকুর স্বরূপ ধরা রয়েছে তাঁর কবিতায়। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘সুকান্ত সমগ্র’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। সেখানে তিনি লিখেছেন,

‘আমি তখন স্কটিশ চার্চ কলেজে বি-এ পড়ছি। ‘পদাতিক’ বেরিয়ে তখন পুরনো হয়ে গেছে। রাজনীতিতে আপাদমস্তক ডুবে আছি। ক্লাস পালিয়ে বিডন স্ট্রীটের চায়ের দোকানে আমাদের আড্ডা। কলেজের বন্ধু মনোজ একদিন জোর ক’রে আমার হাতে একটা কবিতার খাতা গছিয়ে দিল। পড়ে আমি বিশ্বাসই করতে পারি নি কবিতাগুলো তার চোদ্দ বছর বয়সের খুড়তুতো ভাইয়ের লেখা। শুধু আমি কেন, আমার অন্যান্য বন্ধুরা, এমন কি বুদ্ধদেব বসুও কবিতার সেই খাতা প’ড়ে অবাক না হয়ে পারেন নি।… জীবনের অভিজ্ঞতাকে ক্ষমতায় বেঁধে সুকান্ত যখন কবিতার বিদ্যুৎশক্তিকে কলকারখানায় খেতে খামারে ঘরে ঘরে সবে পৌঁছে দিতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই মৃত্যু তাকে কেড়ে নিয়ে গেল। আরম্ভেই সমাপ্তির এই শোকে বাংলা সাহিত্য চিরদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলবে।’

সুকান্ত স্বাধীন ভারত দেখেননি। দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক তিন মাস আগে তিনি মারা যান। আর ঘটনাচক্রে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক দিনটি ছিল ১৫ অগস্ট, সুকান্তের জন্মদিন। আজ, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হল। আর সুকান্ত পা দিলেন ৯৫ বছরে। বাংলালাইভের শ্রদ্ধার্ঘ্য।  

বেলেঘাটা
৩৪, হরমোহন ঘোষ লেন
কলিকাতা।

শ্রীরুদ্রশরণম্—

পরম হাস্যাস্পদ, অরুণ, —আমার ওপর তোমার রাগ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক, আর আমিও তোমার রাগকে সমর্থন করি। কারণ, আমার প্রতিবাদ করবার কোনো উপায় নেই, বিশেষত তোমার স্বপক্ষে আছে যখন বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ। কিন্তু চিঠি না-লেখার মতো বিশ্বাসঘাতকতা আমার দ্বারা সম্ভব হতো না, যদি না আমি বাস করতাম এক বিরাট অনিশ্চয়তার মধ্যে— তবুও আমি তোমাকে রাগ করতে অনুরোধ করছি। কারণ কলকাতার বাইরে একজন রাগ করবার লোক থাকাও এখন আমার পক্ষে একটা সান্ত্বনা, যদিও কলকাতার ওপর এই মুহূর্ত পর্যন্ত কোনো কিছু ঘটে নি, তবুও কলকাতার নাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সব কটা লক্ষণই বিজ্ঞ চিকিৎসকের মতো আমি প্রত্যক্ষ করছি।…

…ম্লানায়মান কলকাতার ক্রমন্তস্বমান স্পন্দনধ্বনি শুধু বারম্বার আগমনী ঘোষণা করছে আর মাঝে-মাঝে আসন্ন শোকের ভয়ে ব্যথিত জননীর মতো সাইরেন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। নগরীর বুঝি অকল্যাণ হবে। আর ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে কলকাতা, তবে নাটকটি হবে বিয়োগান্তক। এই হল কলকাতার বর্তমান অবস্থা। জানি না তোমার হাতে এ চিঠি পৌঁছবে কি না; জানি না ডাকবিভাগ ততদিন সচল থাকবে কি না। কিন্তু আজ রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করছে পৃথিবী কলকাতার দিকে চেয়ে, কখন কলকাতার অদূরে জাপানী বিমান দেখে আর্তনাদ করে উঠবে সাইরেন- সম্মুখে মৃত্যুকে দেখে ধ্বংসকে দেখে। প্রতিটি মুহূর্ত এগিয়ে চলেছে বিপুল সম্ভাবনার দিকে। এক-একটি দিন যেন মহাকালের এক-একটি পদক্ষেপ, আমার দিনগুলি রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে বাসরঘরের নববধুর মতো এক নতুন পরিচয়ের সামীপ্যে। ১৯৪২ সাল কলকাতার নতুন সজ্জাগ্রহণের এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত। বাস্তবিক ভাবতে অবাক লাগে, আমার জন্ম-পরিচিত কলকাতা ধীরে ধীরে তলিয়ে যাবে অপরিচয়ের গর্ভে, ধ্বংসের সমুদ্রে, তুমিও কি তা বিশ্বাস কর, অরুণ?

কলকাতাকে আমি ভালবেসেছিলাম, একটা রহস্যময় নারীর মতো, ভালবেসেছিলাম প্রিয়ার মতো, মায়ের মতো। তার গর্ভে জন্মানোর পর আমার জীবন এতগুলি বছর কেটে গেছে তারই উষ্ণ-নিবিড় বুকের সান্নিধ্যে; তার স্পর্শে আমি জেগেছি, তার স্পর্শে অমি ঘুমিয়ে পড়েছি। বাইরের পৃথিবীকে আমি জানি না, চিনি না, আমার পৃথিবী আমার কলকাতার মধ্যেই সস্পূর্ণ। একদিন হয়তো এ পৃথিবীতে থাকব না, কিন্তু এই মুহূর্ত পর্যন্ত আমি যে কলকাতায় বসে কলকাতাকে উপভোগ করছি! সত্যি অরুণ, বড় ভাল লেগেছিল পৃথিবীর স্নেহ, আমার ছোট্ট পৃথিবীর করুণা। বাঁচতে ইচ্ছা করে, কিন্তু নিশ্চিত জানি কলকাতার মৃত্যুর সঙ্গেই আমিও নিশ্চিহ্ন হব। “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।” কিন্তু মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে, প্রতিদিন সে ষড়যন্ত্র করছে সভ্যতার সঙ্গে। তবু একটা বিরাট পরিবর্তনের মূল্য যে দিতেই হবে।

আবার পৃথিবীতে বসন্ত আসবে, গাছে ফুল ফুটবে। শুধু তখন থাকব না আমি, থাকবে না আমার ক্ষীণতম পরিচয়। তবু তো জীবন দিয়ে এক নতুনকে সার্থক করে গেলাম। … এই আমার আজকের সান্ত্বনা। তুমি চলে যাবার দিন আমার দেখা পাও নি কেন জান? শুধু আমার নির্লিপ্ত উদাসীনতার জন্যে। ভেবে দেখলাম কোনো লাভ নেই সেই দেখা করায়, তবু কেন মিছিমিছি মন খারাপ করব?…

 

আরও পড়ুন: জয়া মিত্রর কলমে: ঘাটের কাছে গল্প বলে নদীর জল

 

কিন্তু সেদিন থেকে আর চিঠি লেখবার সুযোগ পাই নি। কারণ উপক্রমনিকা ভরিয়ে তুলল আমাকে তার তীব্র শারীরিকতায়-তার বিদ্যুৎময় ক্ষণিক দেহ-ব্যঞ্জনায়, আমি যেন যেতে-যেতে থমকে দাঁড়ালাম, স্তব্ধতায় স্পন্দিত হতে লাগলাম প্রতিদিন। দৃষ্টি দিয়ে পেতে চাইলাম তাকে নিবিড় নৈকট্যে। মনে হল আমি যেন সম্পূর্ণ হলাম তার গভীরতায়। তার দেহের প্রতিটি ইঙ্গিত কথা কয়ে উঠতে লাগল আমার প্রতীক্ষমান মনে। একি চঞ্চলতা আমার স্বাভাবিকতার? ওকে দেখবার তৃষ্ণায় আমি অস্থির হয়ে উঠতে লাগলাম বহুদর্শনেও। না-দেখার ভান করতাম ওকে দেখার সময়ে। অর্থাৎ এ ক’দিন আমার মনের শিশুত্বে দোলা লেগেছিল গভীরভাবে। অবিশ্যি একবার দুলিয়ে দিলে সে-দোলন থামে বেশ একটু দেরি করেই, — তাই আমার মনে এখনও চলছে সেই আন্দোলন। তবু কী যে হয়েছিল আমার, এখনও বুঝতে পারছি না; শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি, আমার মনের অন্ধকারে ফুটে উঠেছিল একটি রৌদ্রময় ফুল। তার সৌরভ আজও আমায় চঞ্চল করে তুলছে থেকে থেকে। ওর চলে যাবার দিন দেখেছিলাম ওর চোখ, সে চোখে যেন লেখা ছিল “হে বন্ধু বিদায়, তোমাকে আমার সান্নিধ্য দিতে পারলাম না, ক্ষমা কর।” সে ক’দিন কেটেছিল যেন এক মূর্ছনার মধ্যে দিয়ে, সমস্ত চেতনা হারিয়ে গেছল কোনও অপরিচিত সুরলোকে। তোমরা একে পূর্বরাগ আখ্যা দিতে পার, কিন্তু আমি বলব এ আমার দুর্বলতা। তবে এ থেকে আমার অনুভূতির কিছু উন্নতি সাধন হল। কিন্তু এ ঘটনার পর আমি কোনও প্রেমের কবিতা লিখি নি, কারণ প্রেমে পড়ে কবিতা লেখা আমার কাছে ন্যাক্কারজনক বলে মনে হয়।

আমার কথা তো অনেক বললাম, এবার তোমার খবর কি তাই বল। থিয়েটারের রিহার্সাল পুরোদমে চলছে তো?… তারপর… সঙ্গে নিয়ত দেখা হচ্ছে নিশ্চয়ই? তার মনোভাব তোমার প্রতি প্রসন্ন, অন্যথায় প্রসন্ন করবার প্রাণপণ চেষ্টা করবে। তোমার প্রেমের মৃদুশীতলধারায় তার নিত্যস্নানের ব্যবস্থা কর, আর তোমার সান্নিধ্যের উষ্ণতায় তাকে ভরিয়ে তুলো।

তুমি চলে যাবার পর আমি তারাশঙ্করের ‘ধাত্রীদেবতা’, বুদ্ধদেব-প্রেমেন্দ্র-অচিন্ত্যর ‘বনশ্রী’, প্রবোধের ‘কলরব’, মণীন্দ্রলাল বসুর ‘রক্তকমল’ ইত্যাদি বইগুলি পড়লাম। প্রত্যেকখানিই লেগেছে খুব ভাল। আর অনাবশ্যক চিঠির কলেবর বৃদ্ধির কি দরকার? আশা করি তোমরা সকলে, তোমার মা-বাবা-ভাই-বোন ইত্যাদি সকলেই দেহে ও মনে সুস্থ। তুমি কি লিখলে-টিখলে? তোমার মা গল্প-সল্প কিছু লিখছেন তো? তাহলে আজকের মতো লেখনী কিন্তু চিঠির কাগজের কাছে বিদায় নিচ্ছে।                                                                       

২৪ শে পৌষ, ৪৮
—সুকান্ত ভট্টাচার্য

দুই

বেলেঘাটা
কলকাতা
৩৪, হরমোহন ঘোষ লেন

-ফাল্গুনের একটি দিন।

অরুণ,

তোর অতি নিরীহ চিঠিখানা পেয়ে তোকে ক্ষমা করতেই হল, কিন্তু তোর অতিরিক্ত বিনয় আমাকে আনন্দ দিল এইজন্যে যে ক্ষমাটা তোর কাছ থেকে আমারই প্রাপ্য; কারণ তোর আগের ‘ডাক-বাহিত’ চিঠিটার জবাব আমারই আগে দেওয়া উচিত ছিল। যাই হোক, উল্টে আমাকেই দেখছি ক্ষমা করতে হল। তোর চিঠিটা কাল পেয়েছি। কিন্তু পড়লুম আজকে সকালে; কারণ পরে ব্যক্ত করছি। বাস্তবিক, তোর দুটো চিঠিই আমাকে প্রভূত আনন্দ দিল। কারণ চিঠির মতো চিঠি আমাকে কেউ লেখে না এবং এটুকু বলতে দ্বিধা করব না যে, তোর প্রথম চিঠিটাই আমার জীবনের প্রথম একখানি ভাল চিঠি, যার মধ্যে আছে সাহিত্য-প্রধানতা। তোর প্রথম চিঠির উত্তর দেওয়া হয় নি তোর মতোই অলসতায় এবং একটু নিশ্চিন্ত নির্ভরতাও ছিল তার মধ্যে। এবারে চিঠি লিখছি এইজন্যে যে, এতদিন ভয় পেয়ে পেয়ে এবার মরিয়া হয়ে উঠেছি মনে মনে।

কাল বিকেলে তোর বাবা ঠিকানা খুঁজে খুঁজে অবশেষে তোর চিঠিখানা আমার হাতে দিলেন এবং আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তোম মা-র কাছে। কিন্তু তুই বোধ হয় এ খবর পাস নি যে, তোদের আগের সেই লতাচ্ছাদিত, তৃণশ্যামল, সুন্দর বাড়িটি ত্যাগ করা হয়েছে। যেখানে তোরা ছিলি গত চার বছর নিরবচ্ছিন্ন নীরবতায়, যেখানে কেটেছে তোদের কত বর্ষণ-মুখর সন্ধ্যা, কত বিরস দুপুর, কত উজ্জ্বল প্রভাত, কত চৈতালি হাওয়ায়-হাওয়ায় রোমাঞ্চিত রাত্রি, তোর কত উষ্ণ কল্পনায়, নিবিড় পদক্ষেপে বিজড়িত সেই বাড়িটি ছেড়ে দেওয়া হল আপাত নিষ্প্রয়োজনতায়। তোর মা এতে পেয়েছেন গভীরতম বেদনা, তাঁর ঠিক আপন জায়গাটিই যেন তিনি হারালেন। এক আকস্মিক বিপর্যয়ে যেন এক নিকটতম আত্মীয় সুদূর হয়ে উঠল প্রকৃতির প্রয়োজনে। শত শত জন-কোলাহল-মথিত ইস্কুল বাড়িটি আজ নিস্তব্ধ নিঝুম। সদ্য বিধবা নারীর মতো তার অবস্থা। তোদের অজস্র-স্মৃতি-চিহ্নিত তার প্রতিটি প্রত্যঙ্গ যেন তোদেরই স্পর্শের জন্য উন্মুখ; সেখানে এখনও বাতাসে বাতাসে পাওয়া যায় তোদের স্মৃতির সৌরভ। কিন্তু সে আর কতদিন? তবু বাড়িটি যেন আজ তোদেরই ধ্যান করছে।

কিন্তু সেদিন থেকে আর চিঠি লেখবার সুযোগ পাই নি। কারণ উপক্রমনিকা ভরিয়ে তুলল আমাকে তার তীব্র শারীরিকতায়-তার বিদ্যুৎময় ক্ষণিক দেহ-ব্যঞ্জনায়, আমি যেন যেতে-যেতে থমকে দাঁড়ালাম, স্তব্ধতায় স্পন্দিত হতে লাগলাম প্রতিদিন। দৃষ্টি দিয়ে পেতে চাইলাম তাকে নিবিড় নৈকট্যে। মনে হল আমি যেন সম্পূর্ণ হলাম তার গভীরতায়। তার দেহের প্রতিটি ইঙ্গিত কথা কয়ে উঠতে লাগল আমার প্রতীক্ষমান মনে। একি চঞ্চলতা আমার স্বাভাবিকতার? ওকে দেখবার তৃষ্ণায় আমি অস্থির হয়ে উঠতে লাগলাম বহুদর্শনেও। 

তোদের নতুন বাড়িটায় গেলুম। এ বাড়িটাও ভাল, তবে ও-বাড়ির তুলনায় নয়। সেখানে রাত প্রায় পৌনে এগারোটা পর্যন্ত তোর বাবা এবং মা-র সঙ্গে প্রচুর গল্প হল। তাঁদের গত জীবনের কিছু-কিছু শুনলাম; শুনলাম সুন্দরবনের কাহিনী। কালকের সন্ধ্যা কাটল একটি পবিত্র, সুন্দর কথালাপের মধ্যে দিয়ে, তারপর তোর বাবা-মা, তোর ছোট ভাই আর আমি গিয়েছিলাম তোদের সেই পরিত্যক্ত বাড়িতে এবং এইজন্যেই ঐ সন্বন্ধে আমার এত কথা লেখা। দেখলাম স্তব্ধ বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে, সদ্যবিয়োগ-ব্যথাতুরা বিরহিণীর মতো বাড়িটার এক অপূর্ব মুহ্যমানতা। তারপর ফিরে এসে হল আরও কথা। কালকের কথাবার্তায় আমার তোর বাবা এবং মা-র ওপর আরও নিবিড়তম শ্রদ্ধার উদ্রেক হল (কথাটা চাটুবাদ নয়)। তোদের (তোর এবং তোর মা-র) দুজনের লেখা গানটা পড়লুম; বেশ ভাল। কালকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলুম ‘পাঁচটি ফাল্গুনসন্ধ্যা ও একটি কোকিল’ গল্পটি। আজ দুপুরে সেটি পড়লুম। বাস্তবিক, এ রকম এবং এ ধরনের গল্প আমি খুব কম পড়েছি (ভালর দিক থেকে), কারণ ভাব এবং ভাষায় মুগ্ধ হয়ে গেছি আমি। পাঁচটি ফাল্গুনসন্ধ্যার সঙ্গে একটি কোকিলের সস্পর্ক একটি নতুন ধরনের জিনিস। গল্পটা বিশ্ব সাহিত্যে স্থান পাবার যোগ্য।

যাই হোক, এখন তোর খবর কি? তুই চলে আয় এখানে, কাল তোদের বাড়িতে তোর অভাব বড় বেশী বোধ হচ্ছিল, তাই চলে আয় আমাদের সান্নিধ্যে। অজিতের সঙ্গে পথে মাঝে মাঝে দেখা হয়, তোর কথা সে জিজ্ঞাসা করে। ভূপেন আজ এসেছিল— একটা চিঠি দিল তোকে দেবার জন্যে— আর একটু আগে তাকে এগিয়ে দিয়ে এলাম বাড়ির পথে। উপক্রমণিকার মোহ প্রায় মুছে আসছে। শ্যামবাজার প্রায়ই যাই। তুই আমাকে তোদের ওখানে যেতে লিখেছিস, আচ্ছা চেষ্টা করব।

চিঠিটা লিখেই তোর মা-র কাছে যাব। বাস্তবিক, তোর মা তোর জীবনে স্বর্গীয় সস্পদ। তোর জীবনে যা কিছু তা যে তোর এই মা-কে অবলম্বন করেই এই গোপন কথাটা আজ জেনে ফেলেছি। তুই কিসের ঝগড়া পাঠালি, বুঝতে পারলুম না। তুই চলে আয়, আমি ব্যাকুল স্বরে ডাকছি, তুই চলে আয়। প্রীতি-ট্রিতি নেওয়ার ব্যাপার যখন আমাদের মধ্যে নেই, তখন বিদায়।

—সুকান্ত ভট্টাচার্য।

তিন

বেলেঘাটা,
২২শে চৈত্র, ১৩৪৮।

সবুরে মেওয়াফল-দাতাসু.

অরুণ, তোর কাছ থেকে চিঠির প্রত্যাশা করা আমার উচিত হয় নি, সে জন্যে ক্ষমা চাইছি। বিশেষত তোর যখন রয়েছে অজস্র অবসর- সেই সময়টা নিছক বাজে খরচ করতে বলা কি আমার উচিত? সুতরাং তোর কাছ থেকে চিঠি প্রাপ্তির দুরাশা আমায় বিচলিত করে নি।

কোনো একটি চিঠিতে আমার ব্যক্তিগত অনেক কিছু বলার থাকলেও আজ আমি শুধু আমার পারিপার্শ্বিকের বর্ণনা দেব। প্রথমে দিচ্ছি কলকাতার বর্ণনা- কলকাতা এখন আত্মহত্যার জন্যে প্রস্তুত, নাগরিকরা পলায়ন-তৎপর। নাগরিকরা যে পলায়ন-তৎপর তার প্রধান দৃস্টান্ত তোমার মা, যদিও তিনি নাগরিক নন, নিতান্ত গ্রামের। তবু এ থেকে অনুমান করা যায় যে, কত দ্রুত সবাই করছে প্রস্থান আর শহরটি হচ্ছে নির্জন। তবে এই নির্জনতা হবে উপভোগ্য— কারণ এর জনাকীর্ণতায় আমরা অভ্যস্ত, সুতরাং এর নব্য পরিচয়ে আমরা একটা অচেনা কিছু দেখার সৌভাগ্যে সার্থক হব। আর কলকাতার ভীষণতার প্রয়োজন এই জন্যে যে, এত আগন্তুকের স্থান হয়েছিল কলকাতায়, তার ফলে কলকাতা কাদের তা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একজন বিদেশী এলে সে বুঝতেই পারবে না, যতক্ষণ না তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে দেশটা কাদের। কারণ, যা ভীড়-তাতে মনে হয় দেশটা সকলের না— হোক, শহরটা সার্বজনীন।

 

আরও পড়ুন: দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়ের কলমে: শিল্পী সোমনাথ হোর: শতবর্ষের প্রণাম

 

আজকাল রাত একটায় যদি কলকাতা ভ্রমণ কর তাহলে তোমার ভয়ঙ্কর সাহস আছে বলতে হবে। শুধু চোর-গুণ্ডার নয়, কলকাতার পথে এখন রীতিমত ভূতের ভয়ও করা যেতে পারে। সন্ধ্যার পর কলকাতায় দেখা যায় গ্রাম্য বিষণ্ণতা। এই আলোকময়ী নগরীকে আজকাল স্মরণ করা কঠিন; যেমন একজন বৃদ্ধা বিধবাকে দেখলে মনে করা কঠিন তার দাম্পত্য-জীবন। আর বিবাহের পূর্বে বিবাহোন্মুখ বধূর মতো কলকাতার দেখা দিয়েছে প্রতীক্ষা-অন্য দেশেরা বিবাহিতা সখীর মতো দেখবে ঘটিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

আজ আমার ভাইয়েরা চলে গেল মুর্শিদাবাদ— আমারও যাবার কথা ছিল, কিন্তু আমি গেলাম না মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াবার এক দুঃসাহসিক আগ্রহাতিশয্যে, এক ভীতি-সংকুল, রোমাঞ্চকর, পরম মুহূর্তের সন্ধানে। তবু আমার ক্লান্তি আসছে, এই অহেতুক বিলম্বে।

এ ক’দিন তোর মা-র সান্নিধ্য লাভ করলুম গভীরভাবে এবং আর যা লাভ করলুম তা এই চিঠিতে প্রকাশ করা অসম্ভব। অনেক আলোচনায় অনেক কিছুই জানলাম যা জানার দরকার ছিল আমার। আর তোর বাবার সরল স্নেহে আমি মুগ্ধ। আমার খবর আর কী দেব? তবে উপক্রমণিকাকে আমি একেবারে মুছে ফেলেছি মন থেকে, তার জায়গায় যে আসন নিয়েছে তার পরিচয় দেব পরের চিঠিতে। ভূপেন বিরহ-বিধুর মন নিয়ে ভালই আছে এবং কলকাতাতেই আছে। তাতে অন্তত একখানা চিঠি দিস-এতদিন পরে। ঘেলু এখানে নেই, কয়েক দিনের জন্যে ঘাটাল, ঝাড়গ্রাম প্রভৃতি জায়গায় গেছে ভ্রমণোদ্দেশে সুকুমার রায়ের বাড়ি। তোর খবর সমস্ত আমার জানা, সুতরাং কোনো প্রশ্ন করব না। আমার এই চিঠির উত্তর যতদিন পরে খুশি দিস- তবে না দিলেও ক্ষতি নেই।

ইতি-
সুকান্ত ভট্টাচার্য

চার

বেলেঘাটা-
চৈত্র সংক্রান্তি ৪৮
কলকাতা।

প্রভূতআনন্দদায়কেষু-

অরুণ, তোর আশাতীত, আকস্মিক চিঠিতে আমি প্রথমটায় বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম আর আরও পুলকিত হয়েছিলাম আর একটুকরো কাগজে কয়েক টুকরো কথা পেয়ে। তারপর কৃতসংকল্প হলাম পত্রপাঠ চিঠির জবাব দিতে। আজ খুব বেশী বাজে কথা লিখব না, -আর আমার চিঠি সাধারণতঃ একটু উচ্ছ্বাসবর্জিতই, সুতরাং আজকে প্রধান কথাটি বলতে, সাধারণ জবাবগুলো একটু সংক্ষেপে সারব। এতে আপত্তি করলে চলবে না।

তুই যে খুব সুখে আছিস তা বুঝতে পারছি, আর তোর অপূর্ব দিনগুলির গন্ধ পেলাম তোর চিঠির মধ্যে দিয়ে। তুই আমাকে তোদের কাছে যেতে লিখেছিস, কিন্তু আমার ভয় হয় পাছে কলকাতার ভয়ঙ্কর দিনগুলো হারিয়ে ফেলি। তবে আশা রইল, বৈশাখ মাসেই হয়তো লাভ করব তোর সামীপ্য। তবে তা দ্বিতীয় সপ্তাহে কিনা বলতে পারি না। আর তোদের ওখানে যাবার একটা ‘নীট-খরচ’ যদি জানিয়ে দিতে পারিস, তবে আমার কিছু সুবিধা হয়। তোর একাকীত্ব ভাল লাগে না এবং ভাল লাগে না আমারো এই প্রাণস্পর্শহীন আত্মমগ্নতা। তবে একাকীত্ব অনুকূল নিজের সত্তাকে উপলব্ধি করার পক্ষে। একাকী মানুষ যা চিন্তা করে সেইটাই তার নিজের চিন্তা নিঃসঙ্গ মানুষ নিজের প্রকৃতিকে পায়। সেই জন্যেই, একাকীত্বের একটা উপকারিতা আছে বলে আমার মনে হয়। তা দীর্ঘ হলেও ক্ষতি নেই।

কোনো একটি চিঠিতে আমার ব্যক্তিগত অনেক কিছু বলার থাকলেও আজ আমি শুধু আমার পারিপার্শ্বিকের বর্ণনা দেব। প্রথমে দিচ্ছি কলকাতার বর্ণনা- কলকাতা এখন আত্মহত্যার জন্যে প্রস্তুত, নাগরিকরা পলায়ন-তৎপর। নাগরিকরা যে পলায়ন-তৎপর তার প্রধান দৃস্টান্ত তোমার মা, যদিও তিনি নাগরিক নন, নিতান্ত গ্রামের। তবু এ থেকে অনুমান করা যায় যে, কত দ্রুত সবাই করছে প্রস্থান আর শহরটি হচ্ছে নির্জন। তবে এই নির্জনতা হবে উপভোগ্য— কারণ এর জনাকীর্ণতায় আমরা অভ্যস্ত

তোর কথামত অজিতকে শুধূ জানিয়েছি তোকে লেখার কথা। আর কাজগুলো সবই ধীরে সুস্থে সস্পন্ন করব-সন্দেহ নেই। … তোর চিঠি পড়তে পড়তে একটা জায়গায় থমকে গিয়েছিলাম আমার চিঠির প্রশংসা দেখে, কারণ তোর কাছে আমার চিঠির মূল্য হয়তো কিছুটা থাকতে পারে, কিন্তু অন্যের কাছে প্রশংসনীয় জেনে নিজের সম্বন্ধে আমার বিস্ময় বেড়ে গেল, বিশেষত আমার মতো জলীয়, লঘুপাক চিঠিগুলো যদি প্রশংসা পেতে থাকে, তবে চিঠির ভালত্ব বিচার করা কঠিন হয়ে পড়বে মনে হচ্ছে। আমার সমগ্র জীবনের লেখা তোদের ওখানে নিয়ে যাওয়া অসাধ্য-সাধন সাপেক্ষ। কারণ লেখা অমি সঞ্চয় করি না কখনও, যেহেতু লেখবার জন্য আমিই যখন যথেষ্ট, তখন আমার সঙ্গে একটা অহেতুক বোঝা থাকা রীতিমত অন্যায়। তবে প্রকৃতির প্রয়োজন বাঁচিয়ে যেগুলো এখানে— ওখানে বিক্ষিপ্ত, সেগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে পারি।

তুই আমাকে গ্রহ-বিচ্ছিন্ন উল্কার সঙ্গে তুলনা করেছিস- কিন্তু গ্রহটা কু গ্রহ, যেহেতু তার আগ্রহ আমায় নিক্ষেপ করা কোনো এক প্রশংসা-মুখর ক্ষেত্রে। যাই হোক, তোর এই চিঠিটা যেন নতুন জন্মের আভাস দিয়ে গেল। এখন শোন, যে “আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছে দান” তার পরিচয় :-এই পরিচয়পত্রের প্রারন্তেই তোর কাছে ক্ষমা চাইছি, তোর কাছে একদিন ছলনার প্রয়োজন হয়েছিল বলে। কিন্তু আর নয়, এই জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আর কপটতার আশ্রয় নিলুম না এই জন্যেই যে, কথাটা গোপন হলেও ব্যথাটা আর গোপন থাকতে চায় না, তোর কাছে- উলঙ্গ, উন্মুক্ত হয়ে পড়তে চায়। এ-ব্যাপারটা আমার প্রাণের সঙ্গে এমন অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ যে, তোর কাছেও তা গোপন রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আবেগের বেগে সংযমের কঠিনতা গলে তা পানীয়রূপে প্রস্তুত হল তোর কৌতূহলে। তুই এ-প্রেমে ফেনায়িত কাহিনী-সুরা কি পান করবি না?- এই সুরার মূল্য যে শুধু সহানুভূতি ও পরিপূর্ণ বিশ্বাস।

…কে তুই চিনিস, -যদি ‘না চিনি না’ বলিস তবে তাকে চিনিয়ে দিচ্ছি, সে উপক্রমণিকার অন্তরঙ্গ বন্ধু। সর্বোপরি সে আমার আবাল্যের সঙ্গিনী, সঙ্গিনী ঠিক নয়, বান্ধবী। যখন আমরা পরস্পরের সমুখে উলঙ্গ হতে দ্বিধা বোধ করতাম না, সেই সুদূর শৈশব হতে সে আমার সাথী। সব কিছু মনে পড়ে না, তবু এইটুকু মনে পড়ে যে, আমরা একত্র হলে আনন্দ পেতুম এবং সে আনন্দ ছিল নানারকমের কথা বলায়। একটা কথা বলে রাখা ভাল যে, আমাদের উভয়ের দেখা হত, কোনো কারণে, প্রায়ই। সে আমায় শ্রদ্ধা করত এবং আমার সান্নিধ্যে খুশি হত। একবার আমাদের উভয়কেই… যেতে হয়, সেখানেই আমরা আরো অন্তরঙ্গ হয়ে পড়ি এবং আমি সেখান থেকেই লাভ করি ওর সান্নিধ্যের আকর্ষণ। তখন আমার বয়স ১১, তার ৯। তারপর আমাদের দেখা হতে লাগল দীর্ঘদিন পরে পরে।..

সেখানে আমি ঘনঘন যেতে লাগলুম। …ওর আকর্ষণে অবশ্যি নয়। বাস্তবিক আমাদের সস্পর্ক তখনও অন্য ধরনের ছিল, সস্পূর্ণ অকলঙ্ক, ভাই-বোনের মতোই। তখন ওকে নিয়ে যেতাম পার্কে বেড়াতে, উপক্রমণিকার বাড়ি ওকে পৌঁছে দিতাম দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে। একত্রে আহার করতাম, পাশাপাশি শুয়ে বই পড়ে শোনাতাম ওকে, রাত্রেও পাশাপাশি শুয়ে ঘুমোতাম। ঘুমের মধ্যে ওর হাতখানি আমার গায়ে এসে পড়ত, কিন্তু শিউরে উঠতাম না, ওর নিঃশ্বাস অনুভব করতাম বুকের কাছে। তখনো ভালবাসা কি জানতাম না আর ওকে যে ভালবাসা যায় অন্যভাবে, এ তো কল্পনাতীত। কোনো আবেগ ছিল না, ছিল না অনুভূতির লেশমাত্র।

Letters of Sukanta Bhattacharya
চিঠি লিখছেন কবিবন্ধু অরুণাচল বসুকে

শেষে একদিন, যখন সবে এসে দাঁড়িয়েছি যৌবনের সিংহদ্বারে, এমনি একদিন, দিনটার তারিখ জানি না, পাশাপাশি শুয়েছিলাম, ঘুমিয়ে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতেই দেখি ভোর হচ্ছে আর সেই ভোরের আলোয় দেখলাম পার্শ্ববর্তিনীর মুখ। সেই নব প্রভাতের পাণ্ডুর আলোয় মুখখানি অনির্বচনীয়, অপূর্ব সুন্দর মনে হল। কেঁপে উঠল বুক, যৌবনের পদধ্বনিতে। হঠাৎ দেখি ও চাইল আমার দিকে চোখ মেলে, তারপর পাশ ফিরে শুল। আর আমি যেন চোরের মতো অপরাধী হয়ে পড়লাম ওর কাছে। লজ্জায় সেই থেকে আর কথা বলতে পারলাম না-আজ পর্যন্ত।… জিজ্ঞাসা করল, সুকান্ত কথা বলছে না কেন আমার সঙ্গে?… বহুবার চেষ্টা করল আমাদের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে-কিন্তু আমারই বিতৃষ্ণা ধরে গিয়েছিল ওর ওপর, কেন জানি না (আমার বয়স তখন ছিল ১৩/১৪)। এই বিতৃষ্ণা ছিল বহুদিন পর্যন্ত। আমিও কথা বলি নি।

তারপর গত দু বছর আস্তে আস্তে যা গড়ে উঠেছে, সে ওর প্রতি আমার প্রেম। নতুন করে ভালবাসতে শুরু করলাম ওকে। বহুদিন থেকেই উপক্রমণিকাকে নিয়ে… রা আমাকে ঠাট্টা করত। আমার কাছে হঠাৎ একদিন প্রস্তাব করল, উপক্রমণিকাকে তোর সঙ্গে জুড়ে দিতে হবে। আমি আপত্তি করলেও খুব বেশী আপত্তি করলাম না। এই জন্যে যে, ভেবে দেখলাম, আমার এই নব যৌবনে ভাল একজনকে যখন বাসতেই হয়ে তখন…র চেয়ে বৈধ উপক্রমণিকাকে হৃদয়দান, সুতরাং সম্মত হওয়াই উচিত। কেন জানি না,… নিজে আমাদের সঙ্গে মিলন সংঘটনের দায়িত্ব নিল। উপক্রমণিকাও একবার আমার সঙ্গে আলাপ করতে রাজী হয়েও রাজী হল না। আমিও দু’তিনবার ওর প্রেমে পড়ে শেষে মোহমুক্ত হলাম তুই চলে যাবার পর। অর্থাৎ সম্প্রতি কয়েক মাস। এখন… কেই সস্পূর্ণ ভালবাসছি।.. কে ভালবাসা যায় তা জানলাম,… প্রতি আমার এক নির্দোষ চিঠি এক বৌদির কাছে সন্দেহিত হওয়ায়। চিঠিটায় উচ্ছ্বাস ছিল সন্দেহ নেই, তাতে ছিল ওর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা-জ্ঞাপন। কিন্তু তাতে সন্দেহ করা যায় দেখে বুঝলুম আমি ওকে ভালবাসতে পারি। যদিও আমার বোন ছিল না বলে ওর ভাইফোঁটা নিয়েছি দু’বার, আমাদের কথা বন্ধ হওয়ার পরও। আমি ওকে এখন ভালবাসি পরিপূর্ণ ও গভীরভাবে। ওর কথা আরও লিখব পরের চিঠিতে। আজ এই পর্যন্ত। এখন অন্যান্য খবর দিচ্ছি, শৈলেন ও মিন্টু দুজনেই কলকাতা ছেড়েছে বহুদিন। আর বারীনদার B.A. Examination ১লা মার্চ। সুতরাং তিনি ব্যস্ত আছেন পড়াশুনায়।

ইতি-
সুকান্ত ভট্টাচার্য

পুনশ্চ:- উপক্রমণিকার পরিবর্তে যে দেবীর শুভপ্রতিষ্ঠার কথা লিখেছিস, তিনি দেবী হতে পারেন, কিন্তু সৌভাগ্যবতী আখ্যা দিয়েছিস তাঁকে কি জন্যে? আমি যে তাঁর উপষুক্ত নই। সু.ভ.

এই চিঠির উত্তর সত্বর দিবি, আমিও তৎক্ষণাৎ তার উত্তর দেব। আজ তোদের ওখানে নববর্ষ-সুতরাং তার প্রীতি গ্রহণ কর।

পাঁচ

বেলেঘাটা
১৭/৪/৪২

আশানুরূপেষু,

অরুণ, আজ আবার চিঠি লিখতে ইচ্ছে হল তোকে। আজকের চিঠিতে আমার কথাই অবিশ্যি প্রধান অংশ গ্রহণ করবে। এ জন্যে ক্ষুব্ধ হবি না তো? কারণ আজকে আমি তোকে জানাব আমার সমস্যার কথা, আমার বিপ্লবী অন্তর্জগতের কথা। এই চিঠির আরম্ভ এবং শেষ …র কথাতেই পরিপূর্ণ থাকবে। একবার যখন আদি-অন্ত জানতে কৌতূহল প্রকাশ করেছিস, তখন তোর এ চিঠি ধৈর্য ধরে পড়তেই হবে এবং আমার জন্যে মতামত আর উপদেশ পাঠাতে হবে।

আজকে এইমাত্র ..র কথা ভাবছিলুম, ভাবতে-ভাবতে ভাবলুম তোকেই ডাকা যাক পরামর্শ এবং সমস্যা-সমাধানের জন্যে। কিন্তু তার আগে জিজ্ঞাসা করব, আমার এই প্রেমের ওপর আস্থা ও সহানুভূতি তোর মনের কোণে বাসা বেঁধেছে কি? যদি না-বেঁধে থাকে, তবে এই চিঠি পড়া এখানেই বন্ধ করতে পারিস। যদিও তুই একবার আমাকে কৌতূহল জানিয়ে আমার মনের চোরা-কুঠুরীর দ্বার ইতিমধ্যেই ভেঙে দিয়েছিস, তবুও তোকে জিজ্ঞাসা করছি, আমার এই সমস্যার ওপর তোর কিছুমাত্র দরদ জেগেছে কি না। যদি জেগে থাকে তবে শোন:

আমার প্রধান সমস্যা, আমি আজও জানি না ও আমায় ভালবাসে কি না। কতদিন আমি ভেবেছি, ওর কাছে গিয়ে মুখোমুখি জিজ্ঞাসা করব, এই কথার উত্তর চাইব; কিন্তু সাহস হয় নি। একদিন এগিয়েও ছিলাম, কিন্তু ওর শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আমার কথা বলবার শক্তি হারিয়ে গেছল, অসাড়তা লাভ করেছিল চেতনা। ভাল ও আমায় বাসে কি জানি না, তবে সমীহ করে, এটা ভালরকম জানি।

আবার সন্দেহ হয়, হয়তো ও আমায় ভালবাসে এবং আমি সে ওকে ভালবাসি এটা ও জানে। কিন্তু যুক্তি দিয়ে অনুভব করি ওর প্রেমহীনতা।

বাস্তবিক আমার প্রেমের বেদনা অভিনব। হয়তো আমি যে সিঁড়ি দিয়ে উঠছি দেখি সেই সিঁড়ি দিয়েই ও নামছে, অবতরণকালীন ওর ক্ষণিক দৃষ্টি আমার চোখের ওপর পড়ে আমার বুকে স্নিগ্ধমধুর শিহরণ জাগিয়ে যায়। একটু আনন্দ, কিন্তু পরক্ষণেই বেদনায় মুষড়ে পড়ি। একটি ঘরে অনেক লোক, তার মধ্যে আমি যখন কথা বলি, তখন যদি দেখি ও আমার মুখের দিকে চেয়ে আমারই কথা শুনছে, তাহলে আমার কথা বলার চাতুর্য বাড়ে আরও বেশী, আমি আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়ি, এমনি ওর প্রতি আমার প্রেম। কিন্তু বড় ব্যথা।

বছর খানেক আগে আমার ওর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ঘটেছিল এবং আমিও সে সুযোগ অপব্যয়িত করি নি। অবিশ্যি ইতিপূর্বেই…র চেষ্টায় অস্বাভাবিকভাবে কথা বলার চেষ্টা আমাদের করতে হয়েছিল। ঘটনাটা তোকে একবার বলেছি, তবু বলছি আর একবার: একটা সভা-মতো করা হল, তাতে উপস্থিত থাকল…। সেই সভায় আমাদের কথা বলতে হল। প্রথমে সে তো লজ্জায় কথা বলতেই চায় না, শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করল, সিগারেট খাওয়ার অপকারিতা কী? আমি এতক্ষণ উদাস হয়ে (অর্থাৎ ভান করে) ওদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করছিলুম, এইবার অতিকষ্টে জবাব দিতে থাকলুম। কিন্তু সেদিন আর আলাপ এগোয় নি।            

এদিকে আমি উপলব্ধি করলুম ওর সঙ্গে কথা বলার অমৃতময়তা। তারপর থেকে ওর সঙ্গে আমার কথা বলার তৃষ্ণা অসীম হয়ে দেখা দিল এবং তৃষ্ণা আজও দূরীভূত হয় নি।

এর মাস খানেক পরে এল আর এক সুযোগ। আমাদের বেলেঘাটায় এল ও, কোনো কারণে। সারাদিন ও রইল কিন্তু কোনো কথা বললাম না ওর সঙ্গে। কিন্তু সন্ধ্যার পর এমন এক সময় এল যখন আমরা দুজনেই একটি ঘরে একা পড়ে গেলাম। দুইজনেই শুনছিলাম রেডিও। রেডিওতে গান হচ্ছিল, “প্রিয় আজো নয়, আজো নয়।” কিন্তু গানটাকে আমি লক্ষ্য করি নি এবং লক্ষ্য করার মতো মনের অবস্থাও তখন আমার ছিল না। কারণ কাছে, অতি কাছে ও বসেছিল, বোধহয় অন্যদিকে চেয়ে নিবিষ্ট মনে গানই শুনছিল, আর আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম ওকে, অত্যন্ত সুন্দর পোশাক-সজ্জিতা ওকে আমার বড় ভাল লাগল। ভেবে দেখলাম এক ঘরে থেকেও দুজনে কথা না বলা লোকচক্ষে নিতান্ত অশোভন। তাই অনেকক্ষণ ধরে মনে বল সঞ্চয় করে ডাকলুম-“…”! কিন্তু গলা দিয়ে অত্যন্ত ক্ষীণ কম্পিত স্বর বেরুল, ও তা শুনতে পেল না। এবার বেশ জোর দিয়েই ডাকলুম, ও তা শুনতে পেল। চমকে উঠে আমার দিকে চাইল। এবং আমিও এতক্ষণ ধরে ক্রমাগত মুখস্থ করা কথাটা কোন রকমে বলে ফেললাম, “ইচ্ছে হলে তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে পার।”

 

আরও পড়ুন: সুশোভন অধিকারীর কলমে: যামিনী রায়ের ছবি

 

ও মাথা নীচু করলে, কিছুই বললে না। মনে হল ও যেন রীতিমত ঘামছে। সেদিন আমার জীবনের শুভদিন ছিল, প্রাণভরে সেদিন ওর কথা পান করেছিলাম। তারও মাস খানেক পরে এসেছিল শেষ শুভদিন- সেদিন আমাদের কলকাতার প্রায় মাইল খানেক পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল। মোটরে করে আমরা উপক্রমণিকার বাড়িতে গিয়েছিলাম। ওর ইচ্ছা ছিল, আমার সঙ্গে ও সেদিন উপক্রমণিকার আলাপ করিয়ে দেবে। সৌভাগ্যবশত: মোটরটা আমাদের সেখানে নামিয়েই ফিরে যায়। আর আমারও ফিরতি পথে দুজনের সঙ্গ অনুভব করলুম। সেদিন নেশা লেগে গিয়েছিল ওর সঙ্গে চলতে, কথা বলতে। মনে করে দেখ, কলকাতার রাজপথে একজন সুন্দরী-সুবেশা মেয়ের পাশে –পাশে চলা কি কম সৌভাগ্যের কথা! ওর পাশে চলে, ওর এত কাছে থেকে, যে আনন্দ সেদিন আমি পেয়েছি, তা আমার বাকী জীবনের পাথেয় থাকল। ও এখন বিমান আক্রমণের ভয়ে চলে গেছে সুদুর…তে। আর আমি তাই বিরহ-বিধুর হয়ে তোকে চিঠি লিখছি আর ভাবছি রবীন্দ্রনাথের দুটো লাইন,-

“কাছে যবে ছিল পাশে হল না যাওয়া
দুরে যবে গেল তারি লাগিল হাওয়া”

আমার দ্বিতীয় সমস্যা আরও ভয়ঙ্কর। যদি আমার আত্মীয়রা জানতে পারে একথা, তবে আমার লাঞ্ছনার অবধি থাকবে না। বিশেষত, আমার বিশ্বাসঘাতকতায়… নিশ্চয়ই আমার সংস্পর্শ ত্যাগ করবে। অতএব এখন আমার কি করা কর্তব্য চিঠি পাওয়া মাত্র জানাস।

ইতি-
সুকান্ত ভট্টাচার্য

পুনশ্চ- মা-কে, বলিস এবার আর তাঁকে লিখলাম না বটে, কিন্তু শীগগিরই একখানা বৃহৎ লিপি তাঁর সমুখে উপনীত হবে আর তিনি নিশ্চয়ই তার বপু দেখে চমকে যাবেন।

 

*সারস্বত লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত ‘সুকান্ত সমগ্র’ থেকে পুনর্মুদ্রিত

বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com