বাঙালি কারে কয়? মেলা ধানাই পানাই রেখে সোজা কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, যারা বাংলাভাষায় কথা বলে তারাই বাঙালি। কিন্তু যদি প্রশ্নটি হয় বাঙালিয়ানা, যা নিয়ে দুনিয়াসুদ্ধু বাঙালির এমন আকাশছোঁয়া অহংকার, সেটি কী বস্তু? তাহলে নিশ্চয়ই উত্তরটা অত সোজা হবে না। আসলে বাঙালিয়ানা ব্যাপারটা এমনিতে বেশ একটা গোলমেলে ধারণা: কিছু লক্ষণ, একটা মেজাজ, ভাবগত বা রুচিগত কিছু সংস্কার, সব কিছুর দিকে তাকানোর এক বিশেষ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বা একটু কড়া ভাষায় বলতে গেলে, একপ্রকার মুদ্রাদোষ।
মুদ্রাদোষ থাকলে মুদ্রাগুণও কিছু থাকার কথা বিলক্ষণ। সে সব যে একেবারেই কিছু নেই, তা বললে অবশ্য ভয়ানক অন্যায় হবে। কিন্তু সেই সব গুণাবলী (পড়ুন নামাবলি) গলায় ঝুলিয়ে বিমুগ্ধ বঙ্গজননীর সন্তানদল আপন গুণকীর্তনে নিত্যদিন এমনই মশগুল থাকে, যে মাঝে মাঝে মনে হয় বরং ঘাড়ে দোষাবলী চাপিয়ে ঘুরলে বোধহয় তারা নিজেদের প্রভূত উপকার করত। বাঙালির মতো আত্মকামী জাতির পক্ষে কঠোর আত্মসমালোচনা প্রাণদায়ী ওষুধের মতো আর সেই দাবাই যদি হয় কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার মতো উৎকৃষ্ট ও মোক্ষম কোনও নকশা, তাহলে তো তওবা তওবা ।
নকশা হিসাবে হুতোমের তুলনা তা নিজেই। নানা কারণে ওই রকম উপাদেয় বস্তু আর দ্বিতীয়টি সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাভাষায় নকশা লেখার বিপদ হচ্ছে, তার সঙ্গে সচেতন বা অচেতনে হুতোমের তুলনা এমনভাবে চলে আসে, যে সুবিচারটা কোথাও না কোথাও যেন একটা অনভিপ্রেত ধাক্কা খায়। সেটা বেশ দুর্ভাগ্যজনক। কারণ উপজীব্য বিষয়, পটভূমি, আঙ্গিক, ভাষাশৈলী আলাদা আলাদা হলে সার্থকতার মানদণ্ড তো আর এক হতে পারে না। তবে হাজার তর্কের পর সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে পরিশেষে বোধহয় দুটি কথা অনস্বীকার্য। এক, টেক্সটটি সুলিখিত (well written) কিনা আর দুই, অবশ্যই আস্বাদনের আনন্দ। এই দুই নিরিখে বিচার করলে বহুদিন পরে বাংলাভাষায় লেখা যে নকশামূলক আখ্যান পড়ে নিখাদ তৃপ্তি পাওয়া গেল সেটি শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সাত-পাঁচ নয়-ছয়’।

তৃপ্তির সবচেয়ে বড় কারণ, এটি একেবারেই আলাদা ঘরানার একটি রচনা। বাঙালিজাতির স্বরূপসন্ধানী উদ্যোগ। একটা ব্যাপারে হয়তো অনেকেই একমত হবেন, যে আমাদের এই যে উত্তর-ঔপনিবেশিক বাঙালি জীবনচর্চা বা মানসিকতার ধাঁচাটা মূলত উচ্চবর্গীয় ভদ্দরলোকীয় নির্মাণ। এর পরিসরে আসা প্রতিনিধিস্থানীয় মানুষজন কমবেশি প্রায় সকলেই উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির জাতক। তাদের আন্তরিক বিশ্বাস, যে তারা ভারতবর্ষীয় নরকূলের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শিক্ষিত, বিদ্যোৎসাহী, বুদ্ধিমান, বোদ্ধা, উদার ও আলোকিত একটি সম্প্রদায়। জ্ঞান, মননচর্চা, শিল্প-সাহিত্য-সংগীতপ্রেম, প্রগতিশীলতা, রুচি, পরিশীলন, রসবোধ, নম্রতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, কুসংস্কারহীনতায় তাদের কোনও তুলনাই হতে পারে না। কিন্তু বাস্তব জীবনে, কথাবার্তায়, অন্যের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপে, প্রবৃত্তি ও অন্তঃকরণে পদে পদে ধরা পড়ে তাদের পাহাড়-প্রমাণ ইগো, হাড়ে-মজ্জায় জমে থাকা একধরণের অনিরাময়যোগ্য শভেনিজ়ম, একদা সাহেবদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেষি করে ঘোরার সুখস্মৃতিজাত সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্স, মেকি আভিজাত্যবোধ, ভ্রান্ত ইতিহাসচেতনা থেকে উঠে আসা একরকম কৌলীন্যের অহংকার আর জাত্যাভিমান।
শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই নকশায় ব্যঙ্গবিদ্রুপের প্রধান লক্ষ্য (টারগেট) উচ্চকোটির বাঙালির এই স্ববিরোধ ও দ্বিচারিতা, যা তাদের হাড়ে-মাসে বাসা বাঁধা এক দুরারোগ্য ব্যাধির মতো। নীরদচন্দ্রের স্বজাতি সমালোচনার লক্ষ্যস্থল ছিল তার আত্মঘাতী প্রবণতা, প্যারীচাঁদের ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর বাঙালির চরিত্র, কালীপ্রসন্নের উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি দালাল দাদনি বেনিয়ান দেওয়ানদের ভন্ডামি, আর শিবাজীর অনুচ্চকিত চোরা ব্যঙ্গের লক্ষ্যমুখ, অভিজাত কুলীন উচ্চবিত্ত বাঙালি পরিবারের ভেতর ঘরের আচার-আচরণ, আদব-কায়দা, কথাবার্তায় নিহিত বিচিত্র সব স্ববিরোধের চেহারা। একেবারেই স্বতন্ত্র কথনভঙ্গিতে সেই সব স্ববিরোধের অন্দরমহলে লেখক প্রবেশ করেছেন কুশীলবদের মুখনিঃসৃত ভাষার পথ দিয়ে। এই আখ্যানে ভাষা তাই নিছক ভাবনার বাহনমাত্র নয়, বরং ভাষাই হল এর অন্যতম প্রধান বিষয়।
ভঙ্গিতে ‘সাত-পাঁচ নয়-ছয়’ একটি স্মৃতিকথনমূলক আখ্যান হলেও আদতে তা লেখকের স্বকপোলকল্পিত। ভাবে বোধ হয়, যে অতিসম্পন্ন রাঢ়ীয় কুলীন ‘সাধুজ্জে’ পরিবার এর পটভূমি, বা যাঁদের জীবন-আঙ্গিক নিয়ে এই আখ্যানের কারবার, কথকের সেই গৃহের অন্দরমহলে প্রবেশাধিকার বুঝিবা আত্মীয়তাসূত্রে। বইয়ের ব্লার্বে আবার যেহেতু মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে আত্মরক্ষার তাগিদেই এই আখ্যান কর্তাহীন, কথক এখানে নিতান্ত এক বিযুক্ত দর্শক। এই বিযুক্তিই ন্যারেটরকে দিয়েছে ঈপ্সিত নিরপেক্ষতা ও কাম্য তির্যকতা। তবে এই আখ্যানের রঙ্গ ব্যঙ্গের অন্তরে যে ধরনের রসনির্মিতি আছে, তা কিন্তু একেবারেই বিদ্বেষপরায়ণ বা ম্যালিশিয়াস নয়। গদ্যের কাঠামোর মধ্যে ছত্রে ছত্রে ব্যবহৃত খোঁচা কিন্তু স্যাটায়ারের মতো জ্বালাময়ী নয়, বরং হিউমারের নির্মলতা মণ্ডিত, নম্র মেদুর।
একটা ব্যাপারে হয়তো অনেকেই একমত হবেন, যে আমাদের এই যে উত্তর-ঔপনিবেশিক বাঙালি জীবনচর্চা বা মানসিকতার ধাঁচাটা মূলত উচ্চবর্গীয় ভদ্দরলোকীয় নির্মাণ। এর পরিসরে আসা প্রতিনিধিস্থানীয় মানুষজন কমবেশি প্রায় সকলেই উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির জাতক। তাদের আন্তরিক বিশ্বাস, যে তারা ভারতবর্ষীয় নরকূলের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শিক্ষিত, বিদ্যোৎসাহী, বুদ্ধিমান, বোদ্ধা, উদার ও আলোকিত একটি সম্প্রদায়।
সমস্ত লেখাটি জুড়ে বুদ্ধিদীপ্ত গদ্যের যে আবাদ, তা থেকে পরিপুষ্ট শস্যদানার মতো হিউমারের মজা তুলে নিতে নিরঙ্কুশ মনোযোগের সঙ্গে পড়তে হবে এর বাক্যগুলির শব্দসংস্থাপন: “সেই দ্বাদশ শতকে, কতিপয় ভাগ্যবানের শিরোপর পড়েছিল গৌঢ়েশ্বর বল্লালসেনের আশিসহস্ত— সেই হাত তো আর বিংশ শতকে খর্ব হয়ে যায়নি। কুলীনী মৌরসিপাট্টা অধিগত যাঁদের, বিজাতীয় ঝঞ্ঝাঝাপটা সামলাবার ক্ষমতাও তাদের অপার। ওই যে উনিশ শতকীয় অত রলরোল, ইঙ্গবঙ্গীয় বর্ণসংকরের কেলেঙ্কার, তা কি ঝাঁকালেও বহুত, নাড়াতে পেরেছে আদৌ, জাতকুলীনদের? সুতরাং, বরেন্দ্রভূমি বা রাঢ়াঞ্চলের উচ্চবামুনদের ভাষাসংস্কার যে অতীব শানিত হবে, হাজারো মিশ্রনেও বিশুদ্ধ, শত অধীনতা সত্ত্বেও স্বাধীন, এতে বিস্ময়ের কী আছে? এই যেমন, রাঢ়প্রদেশের বাঁড়ুজ্জে, মুখুজ্জে, চাটুজ্জে, মহাজোটে ‘সাধুজ্জে’— আভিধানিক শব্দকৌলীন্য ঘুচিয়ে মুছিয়ে রাঢ়ীয় রূঢ়ীঅর্থে অর্থবান হওয়ার অধিকার তো এঁদের বংশগত।”
প্যাথোলজি সেন্টারে যেমন রোগ নির্ণয়ের জন্য রক্তের নমুনা পাঠানো হয়, তেমনি এই নকশামূলক আখ্যানের যে কোনও একটি অংশের নমুনা কাচের স্লাইডে নিয়ে অণুবীক্ষণ করলে অবিলম্বে বেরিয়ে আসতে থাকবে উচ্চবর্গীয় বাঙালির অন্যকে খাটো চোখে দেখা, ধর্ম জাতপাত নিয়ে নাকসিঁটকানি, বচনসর্বস্বতা, নির্লজ্জ চাটুকারিতা, শক্তের ভক্ত নরমের যম মানসিকতা ইত্যাদি শতেক ভাইস-এর রিপোর্ট কার্ড। সে-হেন তাচ্ছিল্য বা হেনস্থার একটি জলজ্যান্ত স্যাম্পেল মুখোটি বংশজাত মহাদিগগজ বাড়ির সেজকর্তার সঙ্গে কবিলাল চিত্রকরের মোলাকাত–
— ‘কে হে কোথাকার আমদানি?’
— ‘আজ্ঞে, মেদিনীপুর।’
— ‘মেদিনীপুরীয়া! ভিখ মাগানিয়ার সদর মোকামের মাল! মাপ করো বাপু, ভিখ-টিখ মিলবে না…’।
এ জাতীয় অজস্র উদাহরণে এই নকশাবিশেষে বাঙালির যে মুখটি ধরা পড়েছে, তা সকলেরই অত্যন্ত চেনা। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই নিয়ে এইভাবে কেউ আলোকপাত করেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই । লেখককে অকুণ্ঠ প্রণতি জানাই আত্মসমীক্ষার এহেন এক স্বতন্ত্র ভাষাপথ নির্মাণের জন্য।
গ্রন্থ: সাত-পাঁচ নয়-ছয়
লেখক: শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক: দে’জ পাবলিশার্স
বিনিময়: আড়াইশো টাকা
*ছবি সৌজন্য: Amazon ও লেখকের সংগ্রহ
এ যুগের অন্যতম কথাকার তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়র জন্ম ১৯৭৮ সালে, কৃষ্ণনগরে। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত গল্প-উপন্যাস লেখেন দেশ, আনন্দবাজার পত্রিকা, সানন্দা, আনন্দমেলা-সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। উল্লেখযোগ্য উপন্যাস - উত্তরপুরুষ, মর্মমেঘ, ভ্রান্তিডানা, ব্রাহ্মণী ইত্যাদি। ২০১১ সালে পেয়েছেন বর্ণপরিচয় সাহিত্য সম্মান, দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত 'মায়াকাচ' উপন্যাসের জন্য। ২০১৬-তে নতুন কৃত্তিবাস পুরস্কার ও ২০১৭-তে বাংলা অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত।