স্মৃতির আকাশ থেকে
(Alokeranjan Dasgupta)
২০১১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকের এক দুপুর, জোড়াসাঁকোর মহর্ষিভবনের উদ্দেশ্যে চলেছি কয়েকজন। বিধান সরণির ওপর সাংঘাতিক যানজট। গাড়ি আর এগোতে চায় না, ওদিকে জোড়াসাঁকোর বিচিত্রাভবনে তপন সিংহ ফাউন্ডেশন আয়োজিত রবীন্দ্র চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সময় এগিয়ে আসছে। অলোকদা অর্থাৎ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বসে আছেন গাড়ির পেছনের সিটে আর আমি সামনে। হঠাৎই অলোকদা আমাকে বললেন ‘অরিজিৎ, তুমি কীভাবে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ হয়ে বসে আছ!’ কথা বলায় এমন শব্দচয়ন আলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর পক্ষেই সম্ভব। সেদিন যে অনুষ্ঠানে আমরা যাচ্ছিলাম, সেখানে অলোকদা ছাড়াও অতিথি হয়ে এসেছিলেন অমিতাভ চৌধুরী, দেবতোষ ঘোষ। কিন্তু আমরাই দীর্ঘক্ষণ আটকে ছিলাম যানজটে, যদিও আমি সেই মুহূর্তে খুব বেশি চিন্তিত ছিলাম না। আর আমার সেই অবস্থা দেখেই অলোকদা ওই মন্তব্যটি করেছিলেন। (Alokeranjan Dasgupta)
একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি : অরিজিৎ মৈত্র
(Alokeranjan Dasgupta) কবিরা ভবিষ্যৎ দেখতে পান কি না, জানি না! সেইদিনের অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে অলোকদা আমার প্রসঙ্গে হঠাৎ বলেছিলেন, ‘জীবনে চলার পথে যতরকম ওঠা-পড়া এবং ঝড়-ঝঞ্ঝা আসে, সেগুলিকে অরিজিৎ খুব সহজে অতিক্রম করে যেতে পারে কারণ ও শিল্প-সংস্কৃতির মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছে বলে’, সেই দিনগুলিতে কিন্তু ভাল থাকলেও পরবর্তীকালে বিব্রতকর এবং বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে দীর্ঘদিন যেতে হয়েছিল।’ অলোকদার সঙ্গে অনেক বছরের সুন্দর সম্পর্ক ছিল বিশেষ করে ওঁর প্রথম পরিচয় আমার মার সঙ্গে কলকাতা দুরদর্শনের কারণে। পরে আমার সাংবাদিকতার প্রয়োজনে অলোকদার বাড়িতে আমি, সহকর্মী ও বন্ধুদের সঙ্গে একাধিকবার যাতায়াত করি আর কাজের প্রয়োজনে গেলেও অলোকদার স্নেহ আর গল্প এবং তাৎক্ষণিক তৈরি করা সব শব্দ যেমন মুগ্ধ করত তেমনই কৌতুকবোধ জাগিয়ে তোলে। বিদগ্ধ মানুষটির মুখে সব সময় হাসি। (Alokeranjan Dasgupta)
একদিন গেলাম কলকাতা নিয়ে ওঁর একটা লেখা নিতে। সেই লেখায় কত যে নতুন শব্দ ভাবা যায় না! সেইদিনই আমার কাছে থাকা রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক একটা শৌখিন ডায়রি ওঁকে দেখালাম, প্রথমেই জানতে চাইলেন কারা লিখেছেন এবং কেন ওঁকে দিয়ে লেখাইনি। বললাম যোগাযোগের আর সাহসের অভাবে হয়ে ওঠেনি। বললেন, ‘কেন এইতো এসেছ’। আমার উত্তর ছিল, ‘আজ তো এসেছি কর্মসূত্রে’, এরকমই চলত আমাদের কথাবার্তা।
যিনি অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে সৃজনশীল চিন্তায় দূর প্রবাসে রাইন নদীর দেশে নিমগ্ন থাকতেন, তিনিই আবার আমাদের মধ্যে আরও সহজতর হয়ে মাঝে মধ্যে তাঁর রসিক মনের দু’একটা উদাহরণ তুলে ধরে আমাদের নির্মল আনন্দ দিয়ে হাসাতেন।
এই বাড়িতেও শঙ্খদার মত এক থালা মিষ্টি, আর তার সঙ্গে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সহজ আলোচনা। এখন বৌদ্ধিক আলোচনা সহজ কথায় হলে মনে হয় জাত যাবে। যিনি অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে সৃজনশীল চিন্তায় দূর প্রবাসে রাইন নদীর দেশে নিমগ্ন থাকতেন, তিনিই আবার আমাদের মধ্যে আরও সহজতর হয়ে মাঝে মধ্যে তাঁর রসিক মনের দু’একটা উদাহরণ তুলে ধরে আমাদের নির্মল আনন্দ দিয়ে হাসাতেন। সেইসব দিনের কথা এখন মনে হয় গত জন্মের কোনও এক ভোরে দেখা সুখস্বপ্ন। যা হঠাৎ ভেঙে গেলে মেঘলা দিনের মন খারাপ গ্রাস করে। (Alokeranjan Dasgupta)
বর্তমান সমাজ, দেশ আর রাজনীতি আমাদের হাসি কেড়ে নিয়েছে। এই পীড়াদায়ক পরিস্থিতিতে অলোকদা’র মত মানুষদের অভাব ভীষণভাবে অনুভূত হয়। কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজন মেটাতে তখন প্রায়ই যাদবপুরে তাঁর বাড়িতে যাতায়াত শুরু হয়েছে, এই সময় রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। তার ফলে রাজ্যের ভাল-মন্দ নিয়ে শঙ্খদার মত জানতে চাইলেন একদিন। অলোকদা জানতেন শঙ্খদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে। তাঁর প্রশ্নের উত্তরে শুধু বলেছিলাম, ‘শঙ্খদা অল্প কথার মানুষ, ওঁর নীরবতার মধ্যেই তো অনুভূতি লুকিয়ে আছে।’ (Alokeranjan Dasgupta)
আরও পড়ুন: স্মৃতির আকাশ থেকে: পরবাসী, চলে এসো ঘরে
(Alokeranjan Dasgupta) এর কিছুদিন পরে আকাদেমি সংলগ্ন একটি মঞ্চে সকালে এক অনুষ্ঠানে অলোকদা এলেন, সেই অনুষ্ঠানে অনেকের সঙ্গে আমার কর্মক্ষেত্রের এক উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের একজন ছিলেন, তাঁর চোখে ছিল রোদ চশমা। আমি লক্ষ করছিলাম অলোকদা মঞ্চে বসে বারে বারে তাঁর দিকে তাকাচ্ছেন, অনুষ্ঠান শেষ হলে রোদচশমা পরা ভদ্রলোকের পরিচয় জানতে চাইলেন অলোকদা, শুনে কৌতুক করে হেসে বললেন, ‘ডনের থেকে সাবধানে থেকো।’ এরকম আরও অনেক মজা, অনেক গল্প বাকি রেখে অলোকদা সুদূর প্রবাসে জীবনকে বিদায় জানালেন। এঁদের মত মানুষদের ছাড়া আমাদের জীবন যেমনভাবে চলার, তেমনভাবেই চলছে।
জীবন আমার চলছে যেমন
তেমনিভাবে সহজ কঠিন
দ্বন্দে ছন্দে চলেই যাবে। (Alokeranjan Dasgupta)
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।