১৯৭৫ সালের ১৯ জুন আমরা পাঁচ বন্ধু ছুটি কাটাতে পুরী (Puri) গেলাম। পাঁচ ছোকরায় মিলে অমন একটা বেড়ানো যে হয়, তা না ঘটলে বিশ্বাস করতাম না। তুলনা একটাই: নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা কাহিনির চার মূর্তির রোমাঞ্চকর রামগড় ভ্রমণ। আমাদের বেড়ানোয় অবিশ্যি চোর-ডাকাত ধরার অ্যাডভেঞ্চার ছিল না; যা ছিল তা হল এক ঐতিহাসিক ঘটনার বাঁকে ধরা পড়া।
আমরা পাঁচ মূর্তি— উত্তমদা (সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষের বড় ছেলে এবং হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডে আমার সহকর্মী), আমার পাড়ার বন্ধু মারোয়াড়ি যুবক লালা, যার গাওয়া রফি-মুকেশের গানে রাত নামত পুরীর (Puri) তটে, তুখোড় পড়ুয়া ও প্রাবন্ধিক অভিজিৎ (দাশগুপ্ত; কবি অলোকরঞ্জনের তুতো ভাই), রতন (যার সঙ্গে হালিশহরে সাধক রামপ্রসাদের ভিটেতে মা কালীর ঘরের মুখে দিনের পর দিন বলতাম) আর এই অধম। আমরা উঠেছিলাম বিএন আর-এর সেই দুরন্ত লজের এক্কেবারে গায়ে সদ্যনির্মিত ওড়িশা সরকারের পান্থনিবাসে। উফ, কী যে এক হোটেল! হে জগন্নাথ! বলতে গেলে বর্ণনার অতীত।
আমাদের ঘর দুটি ছিল কুড়ি ও একুশ নম্বর। দোতলার ঘর দুটিতে বিছানায় শুয়ে সমুদ্রদর্শন হত। একে নির্জন তট, তার ওপর পান্থনিবাসের এক্সক্লুসিভ বিচ। বোর্ডার বলতে আমরা, কয়েকটি বিদেশি দম্পতি ও কিছু বাঙালি নববিবাহিত যুগল। বিলিতি ছেলেমেয়েরা শর্টস আর বিকিনি চড়িয়ে বিচে বড় প্লাস্টিকের বল নিয়ে ভলিবল খেলা ধরত। কখনও সখনও আমাদের রতন গিয়ে তাদের সঙ্গে ভিড়ত। আর আমরা মূলত দিন কাটাতাম হয় জলে, নয় মদে। জল বলতে সে কী ঢেউ আর অবগাহন! আর তা মিটলে তখনকার বাজারের সেরা হুইস্কি অ্যারিস্টোক্র্যাটে জল মিশিয়ে গলাধঃকরণ। সঙ্গে বিচের ফেরিওয়ালার টাটকা ভাজা মাছের পদ। গল্পের মতো দিন শেষ হলে নামত ভূতের গল্পের রাত।

ভূতের গল্পের স্টক তখন আমার অগাধ। রাতের খাওয়াদাওয়ার পর বাতি নিভিয়ে শুরু হত সেইসব গল্প বুকে বালিশ আগলে উগরে যাওয়া। আমার একটা শেষ হলে উত্তম বা লালা ওদের ভৌতিক কেস নামাত। আমরা ভূতের গল্প বলতে বলতে শুনতে শুনতে ঘুমোই এটা জানাজানি হতে আমাদের রুমের বেয়ারা একটা অদ্ভুত গল্প শোনালো তিন দিনের দিন সন্ধ্যায়। আমাদের সেশন সেদিন ঘরের মধ্যে খাটে খাটে বসে। ড্রিংকসের জন্য ভাজাভুজি কিছু দিতে এসে অভিজিতের খাটটা দেখিয়ে সে বলল ‘ওই খাটটার একটা ব্যাপার আছে বাবুরা।’
সঙ্গে সঙ্গে সবাই আমরা উৎকর্ণ, ‘কী ব্যাপার? কী ব্যাপার?’
বেয়ারা প্লেটগুলো নামিয়ে ফের দেখাল খাটটা, ‘ওই খাট মাঝি মাঝি আপনা থিকা নড়ে। তাই না বাবু!’
ওর প্রশ্ন সে-খাটে গেলাস হাতে বসা অভিজিৎকে। সঙ্গে সঙ্গে গেলাসে দ্রুত এক চুমুক দিয়ে অভিজিৎ বলল, ঠিক। ঠিক। কাল রাতেই তো মনে হচ্ছিল খাটটা যেন আস্তে করে ঠেলছে কে। চোখ খুলে দেখি তোমরা দিব্যি টানা ঘুম মারছ। তখন ভাবলাম, কী জানি বেশি নেশা করে ফেলেছি হয়তো। ফের চোখ বন্ধ করতে একটা খট খট কাঠের আওয়াজও পেলাম। সেই আওয়াজ গুনতে গুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।
প্লেটে প্লেটে ভাজা দিতে দিতে বেয়ারা বলল, ‘এটাই হয়। ঠিক কিনা? বলুন বাবু।’
অভিজিৎ বলল, ‘হয় তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু কেন হয়?’

বেয়ারাও তখন রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে শুরু করল, ‘সে দশ-বারো বছর তো হবেই। সে বাবুর ইয়াব্বড় চেহারা। তেল মেখে ডন-বটকি করে জলে নামতেন। রাজার মতো মদ-উদত্ত খেতেন। কী জানি আগের রাতে বেশি খেয়ে নিলেন কিনা! পরদিন যে জলে নামলেন আর ফিরলেন না। সেই থিকে অনেকেই বলেছে খাটে গোলমাল আছে। আপনারাও দেখুন।’
বেয়ারা যেতে লাইট নিভিয়ে আমাদের পান শুরু হল। লালা ধরল মুকেশের ‘কহি দূর যব দিন ঢল যায়ে’, যে-গান বাংলার আছে হেমন্তের গলায়… ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’। কী মুড সেদিন ওর! ভূতের গল্পের আসরকে কোথায় টেনে নিয়ে গেল গানে গানে! অন্ধকার ঘরে বসে আমাদের সবারই চোখ জানলা, দরজা পেরিয়ে দূরে অন্ধকার আকাশ, বিশাল বিশাল ঢেউয়ে তোলপাড় সফেন সমুদ্রের দিকে। সবারই মনে পড়ছে কোনও এক সময়ে এই ঘরেরই বাসিন্দা সেই ভদ্রলোকের কথা, এখনও যিনি রাতের বেলা অভিজিতের খাটটা দুলিয়ে দেন।
ভূতের অনুসঙ্গে কিছুটা বিভ্রান্ত অভিজিৎকে ওই রাতের মতো ওই খাটে সঙ্গ দেবার জন্য উত্তমদা বলল রতনকে। সেও এক কথায় রাজি, ভূতের ছোঁয়া পাবে বলে।
ঘটনা হল সে-রাতেও খাটের দুলুনি আর শব্দে ঘুম ভেঙেছিল অভিজিতের। পাশে রতন থাকায় ভয় ধরেনি ঠিকই, কিন্তু মাঝরাত্তিরে খাটের খটখটানিতে উঠে বসেছিল। পাশের খাটে শোয়া আমাকে ডেকেওছিল, না হলে অমন সময় জেগে উঠলামই বা কেন! উঠে দেখি বিছানায় বসে আছে অভিজিৎ। প্রায় এক গল্পের চরিত্রের মতো অন্ধকারে।
পুরীর এটাই বোধহয় রহস্য ও রোমাঞ্চ। যেই দিন ফুটল, অমনি এক অন্য, পুণ্য চেহারা সমুদ্রের কোলের শহরের। টোস্ট আর চা সাঁটিয়ে ফের আমরা উজ্জ্বল তটে। রাতের ভূত রাতেই হারিয়ে গেছে। আমরা বালিতে বসে তাল কষছি আগামী ২৫ জুন কীভাবে ফিরব। আমাদের ট্রেনের টিকিট কলকাতা-ভুবনেশ্বর, ভুবনেশ্বর-কলকাতা। আসার বেলায় আমরা ভুবনেশ্বরে নেমে রতনের দাদার বাড়িতে একদিন থেকে পরদিন ট্যাক্সি নিয়ে পুরী এসেছিলাম।
যাবার বেলায়ও ওখানে একরাত থেকে ট্রেন ধরার কথা। তবে এবার সকাল-সকাল ভুবনেশ্বরে পৌঁছনো যায়। বালিতে বসে এইসবই প্ল্যান হচ্ছিল, যখন একটু একটু করে মেঘ ঘনাতে শুরু করল। উজ্জ্বল তটে ক্রমশ ছায়া ঘনাতে থাকল। কোনওমতে স্নান সেরে হোটেলে ফিরতে দিব্যি দিন জুড়ে সন্ধে সন্ধে ভাব। উত্তমদা বলল, ‘এমন দিনে ভূত না এসে পারে না, বুঝলে শঙ্কর। পেটে মাল পড়লেই ভূত নামবে।
তখনও কী ভূত সে আমাদের কপালে কল্পনাতেও আসেনি। যত সন্ধে ঘনায় ততই তাণ্ডব বাড়ে ঝড়ের। চিরকাল ঝড় দেখেছি শহরে, সোঁ সোঁ করে ধেয়ে জানলা দরজা ভাঙচুর করাও দেখেছি, তারপর শহর ভাসিয়ে বৃষ্টি আর বৃষ্টিও দেখেছি। কিন্তু এ তো এক ভিন্ন, ভয়ংকর তুলকালাম! হাওয়ার আওয়াজ যে তখন কত ডেসিবেলে ভগাই জানে! আমরা বারান্দা থেকে দেখছি আঠারো-কুড়ি ফুটের ঢেউয়ের দেওয়াল এসে আছড়ে পড়ছে তটে, তারপর সে-জল ধেয়ে এসে পান্থনিবাসের একতলা ভাসাচ্ছে।
আমরা সকালের ট্রেন ধরার জন্য বাক্স গোছানো শুরু করলাম। কখন কারেন্ট যায় কে জানে? বলতে নেই, ঝড় বাদলই ভূত ভাগিয়ে ছাড়ল। ডিনার টাইম শুরু হতেই ডিনারে বসা হল আর নটার মধ্যে লাইট নিভিয়ে ঘুম। কারণ সকাল-সকাল স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট করে ট্রেনের জন্য স্টেশন পৌঁছনো আছে।

ঝড়বাদলার জন্যই হয়তো সব্বাই সে-রাতে জব্বর ঘুমোলাম। আর সবারই বলতে গেলে একই সঙ্গে ঘুম ভাঙল সাত-সকালে ঝড়ের ঝাপটায়। ছ’টাও বেজেছে কিনা সন্দেহ, তারই মধ্যে হোটেলের চারপাশ ভেঙে তছনছ হয়ে জলে থৈ থৈ। খবর পেলাম রেল সার্ভিস বরবাদ, দিনের মতো গাড়িঘোড়া ক্যান্সেলড। নীচে ডাইনিং হলে যুগান্তকারী খবরটাও পাওয়া গেল— প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশে এমার্জেন্সি রুল জারি করেছেন!
সবাই আমরা সবার মুখ চাওয়া-চাওরি করছি। এবার উপায়? ক্যাশও তো ফুরোনোর মুখে, এবার ফেরাটা হবে কী করে? যদি আরও হোটেল-খরচ চুকোতে হয় আর নতুন করে কাটতে হয় রেলের টিকিট? তখন ফের শরণ নিতে হল ওড়িশার বড়সড় পদাধিকারী আই এ এস অফিসার দাদার। ফোন করতেই তিনি বললেন, ‘আপনারা আরেকটা দিন সবুর করে যান পান্থনিবাসে। ওই বাড়তি বিল আমি এখান থেকে মিটিয়ে দিচ্ছি। আর আটকে পড়া ট্রেন কাল চালু হচ্ছে। আপনাদের ট্রিপ সরাসরি কলকাতা করার ব্যবস্থা করছি। আজকের দিনটা পুরী এনজয় করুন।’

তাই হল। দুপুরের দিকে আমরা গেলাম জলে থৈ থৈ পুরী শহরে জগন্নাথ দর্শনে। জলে ভাসছে মন্দিরের সামনের মস্ত চাতাল। দেখা হল সেই থাম যার পাশে দাঁড়িয়ে শ্রীগৌরাঙ্গদেব জগন্নাথ দেখতেন। তবে বাজার ঘুরতে এমার্জেন্সির প্রাথমিক প্রভাব চোখে পড়ল। লোক, বিক্রিবাটা সবই কম। তারই মধ্যে এক দোকানে ঢুকে কিছু কেনাকাটা সামলালাম আমরাও। আমি মা’র জন্য জগন্নাথ ও সুভদ্রার দুটি পুতুল মূর্তি নিলাম আর মনে মনে ভালোবেসে ফেলা সদ্যযুবতী ইন্দ্রাণীর (বউ হল তো আরও তিন বছর পর) জন্য একটা লাল-সোনালি পাড়ের কালো ওড়িশি শাড়ি।
পরদিন ট্রেন ধরে যখন কলকাতার পথে এগোচ্ছি, জানলা দিয়ে দেখি ঝড়বাদল থেমে পুরী ফের সেই সুন্দর পুরী। যা কিছু ঝড়ঝাপটা তখন হাতে ধরা ইংরেজি খবরের কাগজে, যার প্রথম পাতা জুড়ে একটাই খবর— ভারতে জরুরি অবস্থা জারি!
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।