Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বড়গল্প: তুলোর পাখি

কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়

জুন ১, ২০২৩

new story Kuntala Banerjee
new story Kuntala Banerjee
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

 

দিস ইজ আ ব্যাড আইডিয়া।

শব্দগুলো যতক্ষণে নিউরনে নিউরনে লঙ্কাকাণ্ড ঘটাল ততক্ষণে গুড মর্নিং জাতীয় কুশল বিনিময়ের সুযোগ পেরিয়ে গেছে। অন্যদিন হলে এ ভুল ওর হত না। গাড়ির দরজা বন্ধ করতে করতেই ও বলত, গুড মর্নিং। অথবা, চলুন ভাই। অথবা, লোকেশনে আসতে অসুবিধে হয়নি তো? অথবা লটবহর হাতে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে উঠলে, ঠিক লাস্ট মোমেন্টে এত তাড়াহুড়ো লেগে যায়। এগুলো ওর মতে বেসিক ভদ্রতা। আর সোশ্যাল অর্ডারে ওর থেকে নীচে অবস্থানকারী মানুষদের— কাজের লোক, ওয়েটার, ড্রাইভার— সঙ্গে ভদ্রতা করা নিয়ে ও বাড়তি সচেতন।

শরীর বেঁকিয়ে প্যাসেঞ্জার সিট আঁকড়ে গাড়ি ব্যাক করাচ্ছে ছেলেটা। কনসেনট্রেশনে কোঁচকানো ভুরু। পার্ক করা টাটা নেক্সন আর এক্স ইউ ভি সেভেন হান্ড্রেড গলিটার গলা টিপে ধরেছে। বাইশ কি তেইশ। ওর উনচল্লিশের তুলনায় বালক। ডিহাইড্রেটেড ত্বকের খানাখন্দে ব্রণস্মৃতি। গালে অপ্রতুল দাড়ির গুচ্ছ, দাঁতের ঠেলায় ঠোঁট বাকি মুখের তুলনায় সামান্য এগিয়ে। ঘাড় ও কান সংলগ্ন মাথা প্রায় ন্যাড়া, ব্রহ্মতালু থেকে কপাল পর্যন্ত ঘন চুলে সস্তা হাইলাইট। সোনালি প্রতিশ্রুতি জাগিয়ে আপাতত নোংরা খড়।

গুড মর্নিং মিসের অপরাধস্খালনের আশায় গলায় অ্যাপোলজি ফোটাল ও।

— এত সরু গলিতে পার্কিং…

— কত দেখাচ্ছে? অপ্রত্যাশিত ভারী গলা।

— হ্যাঁ?

— অ্যাপে ভাড়া কত দেখাচ্ছে?

 স্ক্রিন জ্বালিয়ে অংকটা আরেকবার দেখল ও। আটশো সাতচল্লিশ টাকা সাতান্ন পয়সা।

— ক্যান্সেল করুন। ক্যাশ দেবেন।

— অত ক্যাশ নেই আমার।

— পে টি এম করে দিন।

— পে টি এম নেই।

— গুগল পে? কুইক পে? ফোন পে?

man driving car

রিয়ারভিউ মিররের রাগী চোখদুটো থেকে চোখ নামিয়ে নিল ও। অসভ্য ছেলে। কাস্টমারের অসুবিধে করছে, ক্যাব কোম্পানিকে স্ক্যাম করছে। প্রতিবাদ করা হয় না বলে এদের এত বাড়। ও-ও করবে না, অন্তত আজ না। বলিউডি নীল এলিয়েনের ধাতব কণ্ঠে মগজভর্তি  ‘ব্যাড আইডিয়া, ব্যাড আইডিয়া’ চ্যান্টিং। ছেলেটার সঙ্গে যুদ্ধে নামলে হয়তো দশ মিনিটেই মুক্তি মিলত, কিন্তু মুক্তি ও চায় না। বা চাওয়া অসম্ভব। ঝড়ে-পড়া প্লেনে বসে মালকোষের পালটা প্র্যাকটিসের মতো। 

পরিণতি জেনেও পার্সটা হাঁটকাল। কয়েকটা কয়েন, একটা পাঁচশো, একতাড়া চকচকে দশ যেগুলো সম্পর্কে ও অনবহিত ছিল। শনিবার ঋতব্রত কে ওয়াই সি করাতে ব্যাংকে গেছিল বটে। যখনই যায় ছোট নোটের বান্ডিল তুলে আনে। দশ বারোটা করে নিজের আর ওর পার্সে ঢুকিয়ে দেয়। 

এমারজেন্সি ছাড়া বার করবি না। বলবি আমার খুচরো নেই, আপনি দিন। সবার থাকে, স্রেফ বাজিয়ে দেখে।  

এ টি এম-এ থেমে ক্যাশ তোলা যায়। পিন মনে আছে। কার্ডও সঙ্গেই আছে। অ্যাট লিস্ট থাকার কথা। যেদিন কপাল খারাপ সেদিন সবই সম্ভব। ছেলেটা যদি এ টি এম-এ দাঁড়াতে রাজি না হয়? খারাপ ব্যবহার করে? গুগল পে ডাউনলোড করেছিল একসময়, ছেলেটার মতোই কারও ঝুলোঝুলিতে। একগাদা পাসওয়ার্ড সেট করতে হয়েছিল যার কোনওটা নিয়েই এই মুহূর্তে শিওর নয় ও। 

টাইপ ইয়োর পিন। চারটে শূন্যস্থান। চারটে খাদ। ওর পা ফসকানোর অপেক্ষায়। 

পিন-এর ক্যান্ডিডেট হিসেবে জোরালোতম সম্ভাবনা ফোন নম্বরের শেষ চারটে ডিজিটের। না হলে জন্মদিন আর মাসের কম্বো। মাসছয়েক আগে একটা সিরিয়াস ঝগড়া মেটার পর সব নতুন অ্যাকাউন্টের পিন-পাসওয়ার্ড ঋতব্রতর জন্মদিন আর মাস দিয়ে সেট করেছিল। গুগল পে-টা তখনই খুলেছিল কি না কে জানে! অন্তত তিনটে অ্যাটেম্পট অ্যালাউ করবে আশায় ফোন নম্বরের শেষ চারটে ডিজিট টাইপ করল ও। ফোনের টিং টিং-এ চোখ চালিয়ে গিয়ার বদলাল ছেলেটা। এর কাছ থেকে থ্যাংক ইউ আশা করাও অন্যায়।

ওয়ান আওয়ার থার্টি ফোর মিনিটস টু রিচ ইয়োর ডেসটিনেশন।

ওয়ান আওয়ার থার্টি ফোর মিনিটস। দেড় ঘণ্টা। দেড় ঘণ্টা পর এমন একটা কিছু ঘটবে যেটা থেকে আর পিছু ফেরা যাবে না। 

woman with phone
অন্তত তিনটে অ্যাটেম্পট অ্যালাউ করবে আশায় ফোন নম্বরের শেষ চারটে ডিজিট টাইপ করল ও

ব্যাড আইডিয়া। ব্যাড আইডিয়া। ব্যাড আইডিয়া।

মেবি এত টেনশনের কিছু নেই! মেবি ভালোই লাগবে! বা খারাপ লাগবে না! বা কিছুই লাগবে না! ওঠা-বসা খাওয়া-শোওয়ার মতো একটা ঘটনা হয়ে থেকে যাবে! কনসিকোয়েন্সহীন। মেবি বিয়ের বাইরে শরীর অতও হাতিঘোড়া কিছু না! মেবি প্রথমবার বলে ওর এ রকম বমি পাচ্ছে! মাথা ঘুরছে! আজকাল এ সব ঘরে ঘরে। হাঁটু নাচিয়েছে শিঞ্জিনী। ওর ব্যাপারটা শিঞ্জিনীকে বলেনি ও। প্রশ্নই ওঠে না। ইন জেনারেল কথা হচ্ছিল। বিবাহবহির্ভূত, বিবাহের সমান প্রাচীন— দেশকালজাতিবর্ণ নির্বিশেষে। জাপানে নাকি চিটিংই নর্ম। ফ্রান্সে নাকি অধিকাংশ বিবাহিত লোকের সাইড থাকে। রাখঢাক যত না ভয়ে, তার থেকে বেশি রোমাঞ্চরক্ষার তাগিদে। আবার আমেরিকাতে পরকীয়া মারাত্মক ট্যাবু। হয় না কি আর! কিন্তু ধরা পড়লে শেষ। সেদিনই একটা ট্রু ক্রাইম শো-তে দেখাচ্ছিল। অফিসের কাজে মহিলার দেশবিদেশ ঘোরাঘুরি। পুরুষ কোলিগ, দীর্ঘ প্লেনযাত্রা, হোটেলে রাত্রিবাস। একদিন অফিসফেরতা বর গাড়ি থেকে মালপত্র নামাচ্ছে ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে, ঝোপের আড়াল থেকে লাফ মেরেছে কোলিগ, কথা নেই বার্তা নেই তিনটে বুলেট গুঁজে দিয়েছে পেটে। বলে নাকি মাথার ভেতর গত তিনমাস ধরে কে বলে চলেছে প্রেমিকাকে অত্যাচার করছে প্রেমিকার বর, গো অ্যান্ড সেভ হার। বর স্পট ডেড, কোলিগ জেলে, দুটো বাচ্চা— একটা পাঁচ একটা তিন— পিতৃহীন। অ্যাডালটারি আইনের আওতায় পড়ে না ওদেশে, উস্কানি পড়ে। প্রেমিককে তাতিয়েছেন বরকে সরাতে, দাবি করে মহিলার কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে গেছে পুলিশ।

কোর্ট রেকর্ডিং-এর ক্লিপিং-এ জুরিদের মুখগুলো দেখছিল ও। খুনী আসামিদের দিকে চট করে তাকায় না জুরিরা, আগেও খেয়াল করেছে। খুনী, রেপিস্ট, ড্রাগলর্ড— এদের শাস্তি দিতে হেদিয়ে মরছে না কেউ। জুরি ডিউটি এড়াতে না পেরে বসে আছে। শক্ত ঘাড় কাঠগড়া থেকে ঘোরানো, দৃষ্টি উকিলের মুখে সাঁটা। স্বাভাবিক। হাতাহাতি না, চুরিচামারি না, একেবারে খুন। আজ হোক, কাল হোক, পঁচিশ বছর বাদে হোক একদিন না একদিন তো ছাড়া পাবে। তখন যদি মুখ মনে রেখে ঠিকানা বার করে …

মহিলার ব্যাপারে সে ভয় নেই। ঠিক সময় শাসন করলে এ সব ছেনালিপনার ভূত নেমে যেত, এত বাড়াবাড়ি হতে পেত না। বেটার লেট দ্যান নেভার। টুয়েলভ অ্যাংরি মেন অ্যান্ড উইমেনের কোঁচকানো ভুরু মহিলার দিকে। সাক্ষীর মিছিল। হ্যাঁ, দেখেছিলাম তো ঘন হয়ে বসেছিল। টেবিলের ওপর দিয়ে হাতও ধরেছিল যদ্দূর মনে পড়ছে। কোলিগের সিৎজোফ্রেনিয়ার হিস্ট্রি, মহিলা দাবি করেন জানতেন না। মহিলার ভঙ্গিও সুবিধের না। কাঁদছেন না। ভুল হয়ে গেছে বলছেন না। আর করব না তাও না। শান্ত গলায় বলে চলেছেন, বন্ধুত্ব করেছি। বরকে খুন করতে বলিনি। 

Hand on Bibel

কোলিগের যাবজ্জীবন। পঁচিশ বছর, উইদাউট প্যারোল। মহিলার কুড়ি, উইদাউট প্যারোল। মিলিয়ন ভিউস্। থাউজ্যান্ডস কমেন্টস্‌। 

হি ওয়াজ সিক, শি ওয়াজ ম্যানিপুলেটিভ। (লাইক: সাতশো সতেরো) 

শি ইজ আ মার্ডারার। (লাইক: এক হাজার চব্বিশ)

শি ডিজার্ভড লাইফ। (লাইক: ন’শো উনপঞ্চাশ) 

শি ডিড নট গেট জাস্টিস। (লাইক: চার)

রিপ্লাইঃ ব্লাডি ফেমিনিস্টস্‌। (লাইক: সতেরোশো নিরানব্বই)

ও সব ক্যাথলিক দেশ বলে অত বাড়াবাড়ি। অ্যাডালটারি ওদের অরিজিন্যাল সিন। আমাদের রাধার লিগ্যাসি ভুলিস না। শিঞ্জিনীর হাঁটু নেচেছে।

আরও পড়ুন- গল্প: তিন কন্যার জন্য

হোয়াটসঅ্যাপে তিনমাসে যা আঁচ পেয়েছে সৌম্যদীপ নন্দীর, খুনী টাইপ মনে হয়নি। অবশ্য হোয়াটসঅ্যাপে কতটুকুই বা আঁচ পাওয়া যায়। রক্তমাংসেই যায় না। আয়নাতে আরও কম। এই মুহূর্তে যে লোকটা সেজেগুজে ট্যাক্সি চড়ে বর ছাড়া অন্য পুরুষের সঙ্গে সেক্স করতে যাচ্ছে, এটাই বা কে? সৌম্যদীপের প্রিয় কবি লোরকা, প্রিয় পাখি ঘুঘু, চকোলেট এবং নারী দুই-ই সৌম্যদীপ ডার্ক ভ্যারাইটির পছন্দ করে। কম জানাটাই প্রেফার করেছে ও। এর সঙ্গে সম্পর্কে যাওয়ার তাগিদ নেই ওর। খুচরো চাইবি, ছাতা নিবি মনে করে, এখন মোমো খেলে ভাত খেতে পারবি না— এ সবের লোক খুঁজছে না। ফেসবুক জুড়ে সৌম্যদীপের চিত্রহারময় শৈশব, মেয়েদের পিঠ তাক করা অঞ্জলিময় কৈশোর। এদিকে হয়তো মাতাল বাবা রোজ বাড়ি ফিরে মায়ের চুলের মুঠি। ডিপ্রেসড মা রোজ অফিস থেকে ফিরে দরজা দিয়ে ঘুম। বাইরে চুপ দাঁড়িয়ে বালক সৌম্য, মাসখানেক বাদে যে ফ্ল্যাটের পেছনের ছাইগাদা থেকে তুলে আনবে চোখ না-ফোটা বেড়ালছানা, বালতির জলে চুবিয়ে রাখবে মুণ্ডু, জাস্ট কী করে দেখতে। গার্লফ্রেন্ডদের প্রসঙ্গ উঠতে স্মাইলি পাঠিয়েছে। সম্পর্ক টেঁকে না আমার। ভগবানই জানে কেন। হয়তো গার্লফ্রেন্ড পাশের টেবিলের লম্বা ছেলেটার ওপর থেকে দৃষ্টি বুলিয়ে আনলে স্লাট, এদিকে ছেড়ে যেতে চাইলে কবজির ওপর ব্লেড উঁচিয়ে কান্না। খাতা দেখা বা পেপার জমার সিজনে সেন্টার থেকে বেরোতে দশটা-এগারোটা হয় ঋতব্রতর, বেসমেন্টের পার্কিং জুড়ে তখন মোটা মোটা থামের ঠান্ডা ছায়া। একটার আড়ালে হয়তো ঘাপটি মেরে বসে থাকবে, নাগালে এলেই লাফিয়ে পেটে গুঁজে দেবে ফলা, ইন্ট্রা-অ্যাবডমিন্যাল ভ্যাসকুলেচর ফর্দাফাঁই। কিংবা হয়তো রক্ত দেখলে মাথা ঘোরে বলে বন্দুক জোগাড় করেছে। ফট ফট ফট। মুখ থুবড়ে পড়েছে ঋতব্রত। শপিং মলের আলোর নীচে দু’হাত উঁচু করে কাঁধ ছুঁয়ে মাপা কার্ডিগানের আকাশি ছাপিয়ে উঠছে লাল। গাঢ় লাল। দোমড়ানো চশমার পেছনে দিঘল চোখ অবাক তাকিয়ে দু’হাত দূরে ছিটকে পড়া কাস্ট ইন কন্টেম্পোরারি ইন্ডিয়া-র দিকে, যাকে ছুঁয়ে দেবে বলে গুঁড়ি মারছে রক্তের স্রোত।

মহিলাকণ্ঠে কান্না। হুইসিল। ছুটন্ত বুট।

Man Holding gun
হয়তো রক্ত দেখলে মাথা ঘোরে বলে বন্দুক জোগাড় করেছে। ফট ফট ফট।

মধ্যপ্রাচ্যের শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রের মদতপুষ্ট পাকিস্তানী আতংকবাদীর গুলি অক্ষয়কুমারের সিক্স প্যাক ঘেঁষে বেরিয়ে গেলে মুম্বইয়ের ফ্ল্যাটে ঘুম ভেঙে যায় সীমন্তিনীর, সন্তানের পাশ ছেড়ে ফোন তুলে কম্পিত কণ্ঠে শুধোয়, আপ ঠিক হো? সে জায়গায় ও এসি চালিয়ে ভোঁসভোঁস, যতক্ষণ না দরজায় দুমদুম। 

ভুঁড়িওয়ালা, গুঁফো পুলিশ। মাথায় টুপি। গলায় ধমক।

আপনি মিসেস বোস? 

ও নয়, কিন্তু ঘুমচোখেও স্পষ্ট এই সব চুলচেরার পরিস্থিতি এটা নয়। কাজ সেরে সোজা থানায় হাজির হয়েছে সৌম্যদীপ নন্দী, টেবিলে বন্দুক নামিয়ে উগরে দিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট থেকে উপকণ্ঠের রিসর্ট। অনুমতি-ফতি চুলোয় দিয়ে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ঘরে ঢুকে এসেছে পুলিশ। সোফাকাউচের ক্রিমকভার কুশনে, বেঁচে থাকতে যেগুলো ঘণ্টায় ঘণ্টায় থাবড়েথুবড়ে রাখত ঋতব্রত, ক্ষমতার ভার ন্যস্ত এবং দুই হাঁটু প্রশস্ত করে বসেছে।

উস্কানি দেননি মানে কী? গোটা বাঁশদ্রোণী জানে সৌম্য নন্দী বাইপোলার, আপনি জানতেন না? ঋতব্রত বোসের লাইফ ইনশিওরেন্সের নমিনি কে? আপনার স্বামী আপনাকে গাল দিতেন? ঠ্যাঙাতেন? অন্য মহিলার সঙ্গে লটরঘটর করতেন? তাহলে আপনি করতে গিয়েছিলেন কেন? ব্লাডি ফেমিনিস্ট।

এসিটা বাড়াতে বলবে নাকি? সকালে জোর করে কিছু খাওয়া উচিত ছিল। আর কতক্ষণ? এক ঘণ্টা দশ মিনিট? নাকি আরও কম? জোয়ানের শিশিটা ব্যাগে থাকার কথা। নেই। জলের বোতল হাতে ঠেকে। প্যাঁচ খুলে মুখের ওপর ধরতেই তীব্র বাঁক। বিকট হর্ন। সামনের টেম্পোটাকে ওভারটেক করতে যাচ্ছিল, ডানদিক থেকে বাইক ঢুকে গেছে। জানালা নামিয়ে গলা বাড়িয়ে চিৎকার করে বিশ্রী গালি দিল ছেলেটা। সপসপে পাড় গলার কাছ থেকে চিমটি দিয়ে তুলল ও।

ধরুন। গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে একখামচা টিস্যু বাড়িয়ে ধরেছে ছেলেটা।

থ্যাংক ইউ। টিস্যুর দলা শাড়িতে চেপে সিটে মাথা হেলাল ও। চোখ বুজল।

Depressed Woman

করার সময় চোখ বুজে থাকে? কুড়ি তলার ফোর বি এইচ কে-র হাওয়ায় প্রশ্নটা ভাসিয়েছে শিঞ্জিনী। বৃহস্পতিবার টিফিনবাক্স খুলে স্যান্ডউইচ তুলেছে, ফোন।

কুরুশের কাঁটাগুলো আছে? ফাইভে টেবিলঢাকা বানিয়েছিলি?

মা বানিয়েছিল।

আছে কি না বল।

মা নিজেই ফেলে দিয়েছিল পরীক্ষার পর।

শনিবার সকাল ফাঁকা তো? দশটা নাগাদ চলে আসিস। একটা ক্রোশে ক্লাব খুলছি। না না, কাঁটাফাটা লাগবে না, এমনিই আসিস। আরও কিছু লোকজন আসবে। কালেক্টিভ ফেমিনিন এনার্জি ফ্লো করাব।

দরজা খুলে সবিতা সরে যেতে বুককেসের সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি ঘুরে তাকিয়েছিল। বড় টিপ, গাঢ় লিপস্টিক, হ্যান্ডলুম শাড়ি, বেখাপ্পা ব্লাউজ। কোথায় যেন, কোথায় যেন… রাইট, শিঞ্জিনীর নবতম অনুগামী। কনফিডেন্স বাদে বাকিটা টুকে দিয়েছে। আমি তৃণা, জানিয়ে, গলা নামিয়ে যেন পরীক্ষা চলছে, জিজ্ঞাসা করেছিল, শিঞ্জিনীদি কি বই মেনশন করেছিল কোনও ক্লাবের জন্য? আসলে আমার হোয়াটসঅ্যাপ হ্যাং করে গেছে কাল থেকে। 

ওর বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া দেখে শুধরে নিয়েছিল। ওহ, সরি। আপনি বুক ক্লাবের জন্য আসেননি বুঝি?

কাঁচাপাকা খোঁপা। পঞ্চাশের শেষ বা ষাটের শুরু। হাতিছাপ বেডকভারে হাতব্যাগ ছুঁড়ে দোলনাচেয়ারের দখল নিয়েছিলেন। দূর, রান্নাবান্নায় অত ইন্টারেস্ট নেই আমার। শিঞ্জিনী বলে, ইউটিউবে রণবীর ব্রারের রান্নার ভিডিও দেখেন তো, ওই যথেষ্ট।

ছোট চুল বড় দুল। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে আমজনতার উদাসীনতায় আতংকিত। শিঞ্জিনীও নাকি। সবাই মিলে একটা কিছু করলে হয়। 

কাঁধকাটা টি, ক্যাপ্রি, কাস্তে-চালানো হেয়ারস্টাইল। জীবনের লক্ষ্য বাঙালি মহিলা কবিদের সাজপোশাকের স্টিরিওটাইপ ভাঙা ও কবিতায় সেক্সের অভাব ঘোচানো।

আলোচনা যে ওইদিকেই গড়াবে আঁচ করা উচিত ছিল ওর। পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়ষট্টির বিবাহিত মহিলারা একজোট হলে, অপরিচয়ের বাধা কাটলে, আলোচনা সেক্সের দিকেই গড়ায়। বা সেক্সের অভাবের দিকে।

Kitty party
পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়ষট্টির বিবাহিত মহিলারা একজোট হলে, অপরিচয়ের বাধা কাটলে, আলোচনা সেক্সের দিকেই গড়ায়

ও শুনেছিল বেশি, বলেছিল কম। স্বভাব বলে, তাছাড়া বললে বড়াইয়ের মতোও শোনাত। কারণ ওর আর ঋতব্রতর অ্যাকচুয়ালি সেক্স লাইফ বলে কিছু আছে। ওরা বেরিয়েছে কি না, বাড়িতে কেউ এসেছে কি না, এলে কতক্ষণ আছে ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে শনিবার রাত আটটা থেকে বারোটার মধ্যে যে কোনও একটা সময় ওদের সেক্স হয়। স্টেপ ওয়ান, স্টেপ টু, স্টেপ থ্রি (ওর ফেভারিট)। চেঞ্জ অফ ভিউ। স্টেপ ফোর, ফাইভ এবং সিক্স। পার স্টেপ পাঁচ থেকে সাড়ে ছয়, সব মিলিয়ে আধঘণ্টা থেকে চল্লিশ মিনিট।

গত চার বছরে ক’টা শনিবার মিস হয়েছে গুণে বলে দিতে পারে ও। যেবার ওর ডেঙ্গু হল। আরেকবার ডিপার্টমেন্টের পিকনিকে ফুটবল খেলে ঋতব্রত গোড়ালি ভাঙল। আরেক শনিবার ওরা ছিল দেওরিয়াতালে। সন্ধের মধ্যে হোমস্টেতে নেমে আসার কথা, ঝড় উঠল। মুফ্‌তে অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনায় তাঁবু খাটিয়ে ফেলল অন্‌শুল আর গরিমারা, ঝড়ের ঝাপটায় ফুলে ফুলে উঠল নীলরুপোলি পলিয়েস্টার। কফি হাতে লণ্ঠন ঘিরে এ তো কিছুই না, কোথায় কোন ট্রেকে আরও কত মারকাটারি বিপদের মুখে পড়েছে, ফলাও করতে লাগল একের পর এক। ভালো ছাত্রের মতো ঠিক জায়গায় ভুরু তুলছিল আর হাঁ করছিল ঋতব্রত। মাঝে মাঝে ওর দিকে তাকিয়ে বলছিল, ভাবা যায়? ‘সিরিয়াসলি’-র সংগত সেরে কফিমাগের শরীরে কম্পিত শিখার দিকে তাকিয়ে ও ভাবছিল, একটা শনিবার গেল। 

কারণ একটা শনিবার গেলে আবার একটা শনিবারের অপেক্ষা। সাতটা স্টেপ যেমন ছ’টা হয় না কিংবা আটটা, তিরিশ মিনিট যেমন আঠাশ হয় না কিংবা চল্লিশটা পঞ্চাশ, শনিবারটা শনিবারই থাকে, কখনও বুধবার হয়ে যায় না। 

হলে কেমন হত, ভাবনাটা আজকাল প্রায়ই আসে ওর। স্টেপ ওয়ানের পর দড়াম করে স্টেপ ফাইভ। ছয় ছুঁয়ে আবার দুইয়ে ফেরত। ও রেডি হচ্ছে তিনের জন্য, এমন সময় বিনা বাক্যব্যয়ে ঋতব্রত শুরু করে দিল পাঁচ। কিংবা সাড়ে ছ’মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পরও স্টেপ ফোরে মুভ অন করে যেতে ঋতব্রতকে পারমিশন দিল না ও, থ্রি-তেই আটকে রাখল। আর এই সবই ঘটল কোনও রোববারের সন্ধেয়, বৃহস্পতিবারের শেষরাতে কিংবা বুধবারের বিকেলে।

ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। 

সিলিং-এ চোখ সেঁটে বর্ষীয়সী দুলে চললেন, হাতির শুঁড়ের স্টিচ নখ দিয়ে খুঁটতে লাগলেন মেন্টাল হেলথ, বাঁকুড়ার ঘোড়ার গলার ঘণ্টায় টুংটাং তুললেন কবি, সবিতা টেবিলে কফির ট্রে নামাতে থাকল। সকলেই স্মরণ করতে লাগল যে যার বরের সঙ্গমকালীন চোখ। 

খোলা? নাকি বোজা?

বোকার মতো আই কনট্যাক্ট করে ফেলেছে তৃণা। শিঞ্জিনী দৃষ্টির আঁচ বাড়ায়। তৃণা ঠোঁট চাটে।

বোজা।

অন্য কাউকে ভাবছে। শিঞ্জিনী হাঁটু নাচায়। আধবোজা চোখে একপেশে হাসে। যেরকম হেসে টিফিন পিরিয়ডে বলত, গরমের ছুটির দুপুরবেলা একটা হাওয়া দেয় দেখিসনি? ওটাই ভূত।

Deoria_Tal
আরেক শনিবার ওরা ছিল দেওরিয়াতালে

সেদিনের পর থেকে শনিবার রাত আটটা থেকে বারোটার মধ্যে, ওরা বেরিয়েছে নাকি বাড়িতে কেউ এসেছে, এলে কখন বিদায় হয়েছে ইত্যাদি বুঝে ঘটনাটা যখন শেষমেশ ঘটে, পাঁচ থেকে ছ’নম্বর স্টেপের মাঝের কোনও বিন্দুতে বাঁ চোখ এককুচি, তারপর পুরো, ডান চোখ একফালি, তারপর পুরো খুলে ফেলে ও। পর্দাচোঁয়া গলির ল্যাম্পে ঋতব্রতর সিরিয়াস মুখ। বন্ধ চোখ। কাকে ভাবছে ঋতব্রত? দীপিকা পাডুকোনের ছবি দেখে একদিন বলছিল, কারা যে একে সুন্দরী দেখে। সম্ভবতঃ দীপিকা পাড়ুকোনকে। সানি লিওনিকেও হতে পারে। ঋতব্রত খুব সম্মান করে সানি লিওনিকে। সাবঅল্টার্নের আলটিমেট উত্থান।

হতেই পারে এমন কাউকে যাকে ও চেনে না। কনফারেন্সের কো-প্যানেলিস্ট, গতমাসে কোপেনহেগেন থেকে ফেরা-ইস্তক যার রিসার্চের প্রশংসা থামাতে পারছে না ঋতব্রত। টুইটারে খুঁজে পাওয়া প্রথম না-পাওয়া প্রেম, যার সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি কোনওদিন। কিন্তু অচেনা লোককে চিহ্নিত করে মজা নেই। আরও অন্তত সাড়ে চার মিনিট বাকি আছে আন্দাজ করে ও ব্রেনস্টর্মিং চালিয়ে যায়। ডিপার্টমেন্টে দিনের বারো ঘণ্টা কাটায় ঋতব্রত, ওখানের কেউ হওয়ার চান্সই বেশি। অনেককেই ও চেনে। গত বছর টপ থ্রি জার্নালের একটায় ঋতব্রতর পেপার অ্যাকসেপ্টেড হওয়ার উদযাপনে সিগনিফিক্যান্ট আদারস সহ গোটা ডিপার্টমেন্টকে চাইনিজ খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন উল্কা চ্যাটার্জি। ঋতব্রতদের চেয়ারপার্সন।

হয়তো উল্কা চ্যাটার্জিকেই। আঠেরো ঘণ্টা কাজ করেন, চব্বিশ ঘণ্টা কাজের কথা ভাবেন। একটা মিনিমাম স্পিডের কমে হাঁটেন না। প্যানেলে যতক্ষণ না মহিলা বক্তা ঢোকানো হচ্ছে গলাবাজি চালান। কনফারেন্সের প্রথমদিন শুধু ছাত্রীদের শাড়ি পরিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে অতিথিদের দিকে ফুল ছোঁড়ানোর জবাবে দ্বিতীয়দিন শুধু ছাত্র এবং পুরুষ জুনিয়র প্রফেসরদের, যাদের মধ্যে ঋতব্রতও ছিল, লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে ফুল ছোঁড়ান। আজ ডেনভার, কাল ডাবলিন, পরশু নানজিং। দেশিবিদেশি প্রাইজ, সরকারি বেসরকারি অ্যাডভাইসরি কমিটিতে সিট, ডাইনে বাঁয়ে পাবলিকেশন। কাগজে ছবি, চ্যানেলে বিশেষজ্ঞের বাইট্‌স্‌। টেকো, হুমদো, ষাটোর্ধ্ব পুরুষ অ্যাকাডেমিকস্‌দের ভিড়ে চার ফুট দশ ইঞ্চির একটি তুবড়ি।

উঁহু, উল্কাকে ভাবছে না ঋতব্রত। বালিশের কোণাটা কাঁধের নীচ থেকে সরিয়ে কমফর্টেবল হয় ও। আরও তিন মিনিট।

রুক্মিণী সাহানি। অক্সফোর্ড থেকে মাস্টার্স সেরে আপাতত ঋতব্রতর আন্ডারে পি এইচ ডি। ঋতব্রতর থেকেও বেশিক্ষণ বই মুখে বসে থাকতে পারে নাকি। কাশ্মীরী মায়ের কমপ্লেকশন, পাঞ্জাবি বাবার বোন স্ট্রাকচার। আলাপ হওয়ার সতেরো মিনিটের মধ্যে ‘ম্যাম’ ডেকেছিল মিনিমাম তেরো বার। স্পষ্ট দেখছিল ও, ঋতব্রত সামনে এলেই মেয়ের শিরদাঁড়ায় অদৃশ্য টান। যেকোনও অসতর্ক মুহূর্তে স্যালুট ছিটকে উঠবে কপালে, “সার! ইয়েস সার!” আর্তনাদে গোড়ালি লাথি ঠুকবে।

নোপ। নট রুক্মিণী।

women men kissing silhouette
উঁহু, উল্কাকে ভাবছে না ঋতব্রত

ঋতব্রত স্টেডিলি গন্তব্যের দিকে এগোয়। ও তল্লাশির গতি বাড়ায়। রেস্টোর‍্যান্টের গোল টেবিলে ওর ডানপাশে উল্কা, উল্কার পাশে রুক্মিণী। চশমাপরা অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, কী যেন নাম, হাসিহাসি মুখে ঝুঁকে পড়েছে রুক্মিণীর দিকে। চশমাটাকে তুলে ড্রিংকস তালিকা পরীক্ষা করছেন প্রফেসর আগরওয়াল। একটাই মেনুর ওপর মাথা ঠোকাঠুকি করছেন অশোক এবং দীপিকা চক্রবর্তী— এই দুজন নাকি নার্সারি থেকে কখনও আলাদা স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়েননি, পঁচিশ বছর ধরে পড়াচ্ছেনও এক ডিপার্টমেন্টে। ঋতব্রতর বছর পাঁচেকের সিনিয়র নাইডু, যাকে টপকে ফুল প্রফেসর হয়েছে ঋতব্রত, হাত নেড়ে ওয়েটারের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। ঋতব্রত হেসে উঠেছে সশব্দে। ঋতব্রতর চোখে চোখ রেখে ঠোঁট টিপে হাসছে শৈলজাও। শৈলজা নাইডু। মেদুর। লাবণ্যময়। কথা প্রায় বলেই না। যদি এবং যখন বলে, কান প্রাণপণ খাড়া রাখলেও দু’চারটে শব্দ মিস হয়ে যায়। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে শৈলজার অয়েল পেন্টিং-এর প্রদর্শনীর তথ্য দেওয়ার সময় দুই হাত পকেটে পুরে মংকস্ট্র্যাপের ডগায় ভর দিয়ে হাইট পাঁচ সাত থেকে পাঁচ সাড়ে সাত করে নেয় নাইডু। নাইডুর গ্র্যান্টের খবর দিতে শৈলজার মুখ মেদুরতর হয়। দুজনার মধ্যবর্তী বাতাস প্রাপ্তি ও তৃপ্তিতে ফুলেফেঁপে ওঠে। একটি ফাটলও রাখে না যেখান দিয়ে রাতের মেসেঞ্জার ঢুকে পড়তে পারে। আস্ত রিসর্টের দুপুর তো দূর অস্ত।

ঋতব্রত ফিনিশিং লাইন ছোঁয়। পেট্রল পাম্পে গাড়ি ঢোকে। আয়নাতে ছেলেটার চোখ। বেশিক্ষণ লাগবে না। ফাঁকা আছে।

 

একটু বেশিই ফাঁকা। অ্যাটেন্ডেন্টহীন চত্বরে কালো পাইপ দোলানো তিনটে ডিসপেনসার। অফিসঘরের দরজায় শুকনো গাঁদার সেমি-সার্কল। ছেলেটা গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে যায়। দরজায় ফ্রেমে হাতের ভর দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে উঁকি মারে। পেছন ফিরে কোমরে হাত দিয়ে এদিকওদিক তাকায়।

ও-ও নামে। কুঁচি ঝাড়ে। তপ্ত বাতাসে দীর্ঘশ্বাস নেয়। গিঁট ছাড়াতে ঘাড় ডাইনেবাঁয়ে ঘোরায়। আকাশের দিকে তোলে। লাল রঙের ছড়ানো জাল গলে রোদ চোখ ছোঁয়। একেই বোধহয় বৃক্ষ বলে। কাণ্ড হু হু উঠে গেছে, ডালেরা ছড়িয়েছে নিজের নিজের পার্সোন্যাল স্পেস রক্ষা করে। পাতাহীন। লাল ফুলে ভরা।

ঋতব্রত থাকলে নাম বলে দিত। ও বড় হয়েছে বেহালার সরকারি কোয়ার্টারের বহুতল বস্তিতে। কলাগাছ চিনতে পারে, বছরপাঁচেক হল নারকেল, সুপুরি গোলায় না। ঋতব্রতর ছোটকাকুরা এখনও কাটোয়ার বাড়িতে থাকেন। পুকুরটুকুর আছে, প্রচুর গাছপালা। ঋতব্রত বলে বাগান, ও মনে মনে ডাকে জঙ্গল। দোতলার যে ঘরটাতে ওরা গেলে শোয়, জানালা দিয়ে জঙ্গলের কিয়দংশ দেখা যায়। কাকিমার বাপের বাড়ি ঢাকা বিক্রমপুর, রাঁধতে জানেন। গলা পর্যন্ত খেয়ে, জানালা দিয়ে আসা পুকুরের হাওয়ায় ঋতব্রত টপ করে ঘুমিয়ে পড়ে। ড্যাম্পের গন্ধ তীব্র, অচেনা পাখির ডাক তীক্ষ্ণ হয়। জানালার শিকে হাত রাখে বলিষ্ঠ ডাল। ও পিছিয়ে আসে। ঋতব্রতর দুই হাত ফাঁক করে সেঁধিয়ে যায়। একমুহূর্ত আঁকড়ে ঋতব্রতর আলিঙ্গন শিথিল হয়। জ্যোৎস্নার ব্যাকলাইটিং-এ প্রকাণ্ড গাছ প্রকাণ্ডতর হয়। চোখ জ্বালা করে তবু দৃষ্টি সরাতে সাহস হয় না ওর।

shimul
পাতাহীন। লাল ফুলে ভরা

পরদিন সকালে লুচিতরকারির প্লেটের সামনে বসে নাম জানতে চায়। 

দোতলার জানালার বাইরে ওই বড় গাছটা কী? বট?

ডাইনিং টেবিলে বাকি মুখেরা তাকাতাকি করে।

গোলাপখাসটার কথা বলছে। ঋতব্রত মাথা নাড়ে। জঘন্য। 

তুই খেয়েছিস ও গাছের আম? খুড়তুতো ভাই নিশান, জে এন ইউ-র মডার্ন হিস্ট্রিতে ঢুকেছে, দাদাকে চার্জ করে।

নাঃ।

মা, তুমি খেয়েছ?

হলে তো খাব। পাতের ওপর মেলা ওর দশ আঙুলের ফোঁকর দিয়ে চতুর্থ লুচি গলিয়ে দেন কাকিমা। এসে ইস্তক একটা আম হতেও দেখিনি।

আমি জন্মে ইস্তক দেখিনি। কাকু হাসেন। গাছটা নিষ্ফলা। 

চাপ নিয়ো না বৌদি, ওটা হাইলি বট।

***  

ছেলেটা অবশেষে একজনকে জোগাড় করেছে। নীল উর্দি পরা লোকটা হেলেদুলে হাঁটছে। ছেলেটা ওর দিকে তাকাচ্ছে, সম্ভবতঃ ভাবভঙ্গিতে তাড়ার চিহ্ন মেপে নিতে। চাতালে ছত্রাকার ফুলেদের থেকে অপেক্ষাকৃত টাটকা একটা তুলে নেয় ও। নাকের কাছে ধরে। গন্ধ নেই। বেশ বড়  ফুল। শাটল ককের মতো, চওড়া লাল পাপড়িরা ডালেদের মতোই স্বাতন্ত্র্যবাদী, আলগা আলগা। পলাশ? পলাশফুলও তো লাল হয় প্রব্যাবলি। নাকি সেটা রঙ্গন? 

ছেলেটা কাছে এসে দাঁড়ায়। হয়ে গেছে, চলুন।

অফিসঘরের কাচে রোদ্দুর। কমলা কোল্ড ড্রিংকস।

এরা জোয়ান রাখে?

ছেলেটা ভুরু কোঁচকায়। অফিসঘরের দিকে হাঁটে। দরজায় দুই হাত ভর দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে কথোপকথন করে। দু’আঙুলে প্লাস্টিকের শিশি তুলে ধরে চেঁচিয়ে বলে, মৌরি আছে। স্বচ্ছ শিশির ভেতরে লাল সবুজ নীল দানা। মৌরি কম, চিনি বেশি। মাথা, হাত একসঙ্গে নেড়ে ‘না’ করে ও। 

শিশি অফিসঘরের ভেতর ফেরত যায়। আবার কথোপকথন। ব্যাকপকেট থেকে ওয়ালেট বার করে টাকা দেয় ছেলেটা। ছোট প্লাস্টিকের প্যাকেট ছেঁড়ার চেষ্টা করতে করতে ওর দিকে হাঁটে। অবশেষে দাঁত লাগায়। প্লাস্টিকের টুকরো থু করে ফেলে কুটকুটে কালো লজেন্স বার করে ওর হাতে দেয়।

আদা লজেন্স। এটাতেও কাজ দেবে। একটা লজেন্স নিজের মুখে পোরে ছেলেটা।

কত নিল?

ছেলেটা ওর হাতে ধরা ফুলটার দিকে ভুরু নাচায়। লজেন্সটা এক গালে সরিয়ে বলে, শিমুলফুল। এ সময় খুব হয়। 

এটা শিমুলগাছ? দৃষ্টি তোলে ও। লাল জাল রোদে অল্প অল্প কাঁপছে। শিমুলতুলো এই গাছেই হয়? 

নিচু হয়ে গাঢ় বাদামি, অলমোস্ট কালচে জিনিসটা তুলে নেয় ছেলেটা। আমন্ড শেপের কিন্তু সাইজে আমন্ডের থেকে বড়। এগুলো পাকবে, শুকোবে, তারপর ফাটবে। ফেটে সাদা সাদা রোঁয়ার মতো তুলো, চারদিকে উড়ে বেড়াবে। আঙুলে ঢেউ তুলে তুলোর ওড়াউড়ি নকল করে।

বাদামি ফলটা ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখে ব্যাগে পোরে ও। ঋতব্রত এটা চিনবে না নির্ঘাত। গুঁড়ির গায়ে যেখানটায় রোদ পড়েছে কিন্তু মানুষের পা পড়ার চান্স কম, ফুলটাকে ঠেস দিয়ে বসায়। গাড়িতে ফিরে আসে।

Shimul Ful

 

ফ্লাইওভার ফুরোয়। ব্লু টুথে ছেলেটা হাসে। হোলিতে পিকনিক হবে। বড় হাঁড়ি ম্যানেজ হয়ে যাবে মেসোর ক্যাটারার থেকে। তিন কেজি পাঁঠায় কত কেজি পেঁয়াজ লাগবে? পাঁচশো গ্রামে কী হবে বোক্… গলা নামায়। সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আঙুল বোলায় ফোনের স্ক্রিনে। ওপর-নীচ, ডান-বাঁ। যেদিকে যাও রাস্তারা রক্তবর্ণ। গলি ধরে। মুদির দোকান। ইস্ত্রির ঝুপড়ি। গোলবারান্দাওয়ালা হলদে দোতলা বাড়ি। ফলকে ‘মায়ের’টুকু পড়তে পড়তেই গাড়ি হুস করে এগিয়ে যায়। ‘আশিস’ না ‘আঁচল’ অজানা থেকে যায় আজীবনের মতো। 

টাইম টু ডেস্টিনেশন আরেকবার চেক করবে কী না ভাবে ও। ঋতব্রত বলে, ঘনঘন ঘড়ি দেখলে সময়ের স্পিড বাড়ে কমে না, একই থাকে।

তোমার কবে সময় হবে বল! সাতচল্লিশ দিনের মাথায় জানতে চেয়েছিল সৌম্যদীপ। দেখা-টেখা নয়, কথাটা উঠেছিল শোয়ারই। হাঁপ ছেড়েছিল ও। সৌম্যদীপের প্রতি শ্রদ্ধাও জন্মেছিল কিছুটা। দিনের আলোর মতো সত্যিটাকে কফি খাওয়া, আড্ডা মারার ময়ূরপুচ্ছ পরাতে হলেই ওর লজ্জা করত বেশি। 

বুধ, শুক্র হবে না। মঙ্গলবার সন্ধে ছ’টার পর, বৃহস্পতিবার তিনটের পর ফ্রি। সোমবার সারাদিন ফাঁকা।

তুমি চাইলে শনি-রবি…

শনিবার হবে না। উত্তরটার আকস্মিক সপাটতায় নিজেই লজ্জা পেয়ে জুড়েছিল, কেন অন্যদিন তোমার অসুবিধে?

আমার কীসের অসুবিধে! ছুটি নিয়ে নেব তুমি যেদিন বলবে। সাধারণত লোকে শনি-রবি দেখা করতে চায়, তাই বললাম। অবশ্য বরের বোধহয় ছুটি থাকবে শনিবার, তাই না? 

স্মাইলি পাঠিয়েছিল সৌম্যদীপ।

ও উত্তর দেয়নি। এসবের মধ্যে বরকে ঢোকাতে নিজেকে পর্যন্ত অনুমতি দেয়নি, অন্য কাউকে দেওয়ার প্রশ্নই নেই। ডিল ফেয়ার রাখতে সৌম্যদীপের ব্যক্তিগত পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন করেনি। ওর কৌতূহলও নেই। 

Whatsapp Chat
স্মাইলি পাঠিয়েছিল সৌম্যদীপ

একটু আউটস্কার্টসে, বাট ভেরি নাইস। ভেরি রেসপেক্টেবল। রিসর্টটা তখনই রেকমেন্ড করেছিল সৌম্যদীপ। দেড় সেকেন্ডও ভাবতে হয়নি। বন্ধুর মুখে শোনা মনে হয়নি। জীবনে প্রথম কিংবা দ্বিতীয়, এমনকি তৃতীয়বার যাচ্ছে বলেও মনে হয়নি। ডাজন্‌ট ম্যাটার। হোয়াট ম্যাটারস যে আজ সোমবার, এখন খটখটে দুপুর, এবং আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে…

টায়ার-কংক্রিট সংযোগের শীৎকার, হর্নের আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষার অভিঘাতে ওর শরীরটা সামনে ছিটকে গেল। প্রথম ও দেখল স্টিয়ারিং-এর ওপর হুমড়ি খাওয়া ছেলেটার বিস্ফারিত চাউনি, অনুচ্চার আর্তনাদের হাঁ। দূরে স্লো মোশনে ঘাড় ঘোরাল সাদা-উর্দি ট্রাফিক পুলিশ এবং একে একে আরও অনেকগুলো মাথা, তাদের ঠিকরে বেরোতে চাওয়া চোখ, কারও কারও মুখ থেকে চিৎকার বেরিয়ে এল, কারও কারও হাত উঠে এসে সে চিৎকার চাপা দিতে চাইল, কেউ কেউ মুঠোবদ্ধ হাত ছুটে আসার ভঙ্গিতে উত্থিত করল, কেউ কেউ ছুটতে শুরু করল। ওর দিকে। না, ওর দিকে নয়। ভিড়ের দৃষ্টিপথ অনুসরণ করে ওর দৃষ্টি থামল উশকোখুশকো, শুষ্ক চুলের একটা ছোট্ট মাথায়, বাতাসে তোলা একটি ছোট্ট মুঠোয়, মুঠোয় ধরা প্লাস্টিকের মোড়কে তিনটে রুগ্ন গোলাপফুলে।

লালের আভাস বনেটের নীচে তলিয়ে গেল।  

রাস্তায় পা ঠেকানোরও আগে টের পেল ও, নিশ্ছিদ্র, নিরবচ্ছিন্ন, বিশ্বস্ত এবং পরিচিত প্রাচীর ঘিরে দাঁড়াচ্ছে চেতনার চারপাশে। শব্দ, গন্ধ, উত্তাপ, উত্তেজনা, স্ট্রেস এবং স্মৃতির যাবতীয় বিক্ষেপ শরীর ও মগজ থেকে টেনে ছুঁড়ে ফেলছে। একটা বিরাট স্টপওয়াচ যেন গুনতি রাখছে প্রতি সেকেন্ডের। ও মুভ করছে দ্রুত, কোমরে আঁচল গুঁজছে, পাশ থেকে এগিয়ে আসছে ছেলেটার হাত। কিন্তু ততক্ষণে দুটো চাকার মাঝখান থেকে ন্যাতানো শরীরটা কোলে তুলে নিয়েছে ও। এগোচ্ছে, গাড়ি থেকে নামার সময়েই যে লাল যোগচিহ্নটার অবস্থান দেখে নিয়েছিল, সেই দিকে। ছেলেটা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে ধরেছে। দোকান ফাঁকা। কাউন্টারের ওপারে ডেস্কটপে টাইপ করা টাকমাথা ভদ্রলোক বাইফোকালের ওপর দিয়ে ওর দিকে তাকাচ্ছেন।

ছেলেটাকে ফাঁকা মেঝেতে সাবধানে নামাল ও। হার্ডলি পাঁচ, সাড়ে পাঁচ বছর বয়স। বোজা চোখের পাতা কাঁপছে অল্প। হাফপ্যান্ট, চেকশার্টের তিনটে বাদে বাকি বোতাম ছেঁড়া। বোতামগুলো খুলে বুকের ওপর হাত রাখে ও। এয়ারওয়েজ ক্লিয়ার। রক্তাক্ত হাঁটু হাতে তুলে নেয়। প্যালপেট করে। বাইফোকাল ভদ্রলোক কাউন্টার পেরিয়ে এসেছেন।

ভেঙেছে?

মনে হচ্ছে না। সফট টিস্যু ড্যামেজ। একটু সাবান জল আনুন। 

সাবান জলের সঙ্গে বিটাডিনও নিয়ে আসেন ভদ্রলোক। আর কিছু লাগবে?

টি ব্যাক্ট। গজ। ব্যান্ডেজ। বাচ্চাটার হাঁটু পরিষ্কার করতে করতে বলে ও।  ভদ্রলোক ফিরে যান। দরজার বাইরে জমে ওঠা ভিড় ঠেলে ট্রাফিক পুলিশ ঢুকে আসে।

ছেলেটা হাঁটুতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাশে। ফিসফিস করে বলে, চোখ খুলেছে।

বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে হাসে ও। কী নাম তোর?

বাচ্চাটা কেঁদে ওঠে। 

একটা জুস এনে দে ওকে।

reckless Driving
স্টিয়ারিং-এর ওপর হুমড়ি খাওয়া ছেলেটার বিস্ফারিত চাউনি, অনুচ্চার আর্তনাদের হাঁ

ছেলেটা দৌড়ে যায় জুস আনতে। ও ক্ষতে টিব্যাক্ট লাগায়, রোলার ব্যান্ডেজ বাঁধে। ট্র্যাফিক পুলিশকে বলে, বাড়িতে একটা খবর দেওয়া দরকার।

আমি চিনি ওকে। ফ্লাইওভারের ওপারে থাকে। দাঁড়ান। পুলিশটা বেরিয়ে যায়।

পুলিশটা দোকানের বাইরে যায়। গোলাপের তোড়া হাতে আরও দুটো বাচ্চা উঁকিঝুঁকি মারছিল, পুলিশটার কথা শুনে তারা গাড়ির স্রোত এড়িয়ে ছুটে রাস্তা পেরোয়। একটু পর একটা রোগা লোক, ছেলে বলাই উচিত, বাবা হওয়ার পক্ষে বয়সটা কমের দিকেই, দোকানে ঢোকে। বাচ্চাটার সঙ্গে মুখের মিল স্পষ্ট। দৃষ্টিতে চিন্তার থেকেও বেশি ভয়।

কিছু হয়নি। ছড়ে গেছে জাস্ট। আমি ওষুধ দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছি। আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করে ও। উত্তর পাবে না জেনেও জিজ্ঞাসা করে রিসেন্টলি বাচ্চাকে টেটভ্যাক দেওয়া হয়েছে কি না। নীরবতা। একটা টেটভ্যাক আনতে বলে। বাচ্চাটা চিৎকার করে। ছেলেটা ভোলানোর চেষ্টা করে। আরে পিঁপড়ে কামড়ায় না তোকে? তার বেশি একফোঁটা লাগবে না, মাক্কালি। ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, ঠিক কি না? 

সিরিঞ্জটা বার করে, তুলো চেপে ধরে ও বলে, কীরকম পিঁপড়ে তার ওপর ডিপেন্ড করবে। লাল, নাকি ডেঁয়ো, নাকি সুড়সুড়ি।

ওষুধ কিনে দেয়। ব্যান্ডেজের রোল। বাবাকে বলে, কাল ব্যান্ডেজটা খুলে দেখবেন। সম্ভবত শুকোতে শুরু করবে, না করলে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। তবে নিয়ে যাওয়ার দরকার হবে না। টি-ব্যাক্টের টিউবটা দেখায়। এটা লাগিয়ে আবার ব্যান্ডেজ বেঁধে দেবেন। সাদা-সবুজ বাক্সের ওষুধটা পাঁচদিন খাওয়াবেন একটা করে। ব্যথা হলে, এই সাদা বড়িটা। দিনে দুটোর বেশি না। অগমেন্টিন আর ক্যালপলের স্ট্রিপ ফের প্লাস্টিকে পুরে দেয়।

যদিও ব্যথা করবে না, আমি শিওর। বাচ্চাটার হাত হাতে নেয়। নাম বললি না তো এখনও?

ওর নাম অরিন্দম। বাবার মুখে এতক্ষণে রিলিফ।

বাঃ, কী ভালো নাম।

রাস্তায় বেরিয়ে আসে সবাই। ভিড় পাতলা হয়ে গেছে। এক হাতে জুসের বোতল আঁকড়ে বাবার কাঁধে মুখ রেখে রাস্তা পার হয়ে যেতে যেতে বাচ্চাটা ওর দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকে। টাটা করে ও। ছেলেটাও করে।

পুলিশের দিকে ফিরে জানতে চায়, আর কিছু করার আছে?

নাঃ। বাচ্চাগুলো প্রচণ্ড রেকলেসলি ছোটাছুটি করে। একদিন খারাপ কিছু একটা ঘটবে। ভালো সামলেছ। ছেলেটার কাঁধ চাপড়ে দেয় পুলিশ। সাবধানে চালিয়ো।

কার্ড বার করে পুলিশের হাতে দেয় ও। কালপরশু একবার খবর নেব। তার মধ্যে দরকার হলে ফোন করবেন। ঘাড় হেলিয়ে হেলমেটে হাত ছুঁইয়ে পুলিশ নিজের অবস্থানে ফিরে যায়। ফোন বার করে কথা বলে। 

Injection syringe
সিরিঞ্জটা বার করে, তুলো চেপে ধরে ও বলে, কীরকম পিঁপড়ে তার ওপর ডিপেন্ড করবে

রোদের তাত বেশ বেড়েছে। আঁচল কোমর থেকে খুলে কপাল মোছে। এলোমেলো শাড়ি গোছাতে গিয়ে লাল দাগটা চোখে পড়ে। বাচ্চাটাকে কোলে তোলার সময় লেগেছিল নিশ্চয়। রক্ত শুকিয়ে, ছেতরে আছে তসর জমিতে। ছেলেটা দৌড়ে গাড়ি থেকে জলের বোতল নিয়ে আসে। আঁজলা করে জল নিয়ে ঘষতে থাকে দাগটার ওপর। 

এখানেই রাখ।

ডেস্টিনেশনের একশো মিটার আগে বলে ওঠেন মহিলা। দশ হাত দূরে কয়েকটা ঝুপড়ির জটলা। একটা চায়ের। আরেকটা পানের। সামনের বেঞ্চে বসে কয়েকটা লোক গুলতানি মারছে। পায়ের কাছে ধুলোর ওপর গোল্লা পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে একটা কুকুর। ঝুপড়ি পেরিয়ে  যেখানে রাস্তার একটা শাখা বাঁদিকে ঢালু নেমে গেছে, একটা বিশাল উঁচু হোর্ডিং। চেনা। শহরের আরও অনেক জায়গায় দেখেছে ও। একটা হেভি আলিশান ঘর। লালচে আলো, সাদা ফটফটে বিছানার ওপর লাল ভেলভেটের চাদর। ভেলভেটে আধশোয়া হয়ে মুখ টিপে হাসছেন টালিগঞ্জের হায়েস্ট পেইড নায়িকা। লাল টপ, কালো স্কার্ট। মাইলখানেক পা পেরিয়ে আট ইঞ্চির হিল।

হিল বরাবর চোখ নামিয়ে হোর্ডিং-এর ছায়ায় দাঁড়ানো লোকটাকে দেখতে পেল ও। এক হাতে সিগারেট, অন্য হাতে মোবাইল। লম্বা, ফর্সা। লোকটাকে চেনা চেনা লাগে ওর। বিতৃষ্ণা জন্মায়। মহিলার চোখও লোকটার ওপর স্থির। রিয়ার ভিউ মিররে দু’চারবার চোখ চালিয়ে মহিলার মুখের ভাব বোঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কাঠ হয়ে বসে আছেন। চট করে নামবেন বলে মনে হচ্ছে না। ইঞ্জিন বন্ধ করে ও।

চিনতে পেরে যায় ও। লোকটার সঙ্গে রাজু বসাকের হেভি মিল। হাইট, দাঁড়ানোর ভঙ্গি, সব। রাজু সাউথ ক্যালকাটায় জন্মালে আর ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লে এই লোকটা হত। দেখলেই মনে হয় সারা গায়ে সর্ষের তেল মেখে জীবনের মাঠে নেমেছে, যত প্যাঁচেই পড়ুক সুড়ুৎ করে পিছলে বেরিয়ে যাবে। মা পইপই করে বারণ করেছিল। দিদিটা পাঁঠা, চেহারা দেখে আছাড় খেল।

দিদির মুখটা মনে করল ও। নিয়মিত করে, কারণ না করলে একদিন আর মনে পড়বে না। যদিও, ওর চেষ্টা সত্ত্বেও এখনই কি একটু একটু ঝাপসা হয়ে আসেনি? এই সময়টাতেই, স্কুলের পরীক্ষা শেষ হলে মায়ের সঙ্গে মামাবাড়ি যেত ওরা। জানালার পাশ নিয়ে প্রবল সংগ্রাম প্রত্যেকবার। চারটে স্টেশন বাকি থাকতেই রেললাইনের দুপাশে লালের বন শুরু হত। মামার বাড়ির পেছনে উঁচু উঁচু শাল শিমুলের ফাঁকা জঙ্গল। জঙ্গলের মেঝে যেন রোজ ঝাঁট দেয় কেউ। একদিন দুপুরে দিদি ধাক্কিয়ে ঘুম থেকে তুলে দেখিয়েছিল। হাওয়া বইতে শুরু করেছে,আর সাদা তুলোর রোঁয়ায় ভরে গেছে গোটা জঙ্গল। দৌড়ে বেরিয়েছিল ওরা। দিদি দৌড়ত না, উড়ত। তাল রাখতে হৃৎপিণ্ড জিভের ওপর দপদপাত। দিদি উড়ছিল, হাওয়ায় উড়ছিল দিদির চুল, ফ্রকের বেল্ট। জঙ্গল জুড়ে উড়ছিল সাদা তুলোর দল। 

অদৃশ্য হয়ে গেল হোর্ডিং, ভেলভেট চাদর, হিলতোলা জুতো, সিগারেটের ধোঁয়া, মোবাইলের নিরবচ্ছিন্ন স্ক্রোলিং। এই দুপুরটার জায়গায় ওই দুপুরটা নেমে এল চরাচর জুড়ে। গাড়ির ভেতর বসে রইল ওরা দুজন। ওদের ঘিরে উড়তে লাগল সাদা তুলোর পাখিরা। গাড়ির ছাদে, চাকায়, ওয়াইপারের কিনারায় জমতে লাগল, জমতে লাগল, জমতে লাগল।

 

 

ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons, Pixabay, Pexels, Freepic, Freestockimage, Wikipedia,  

Author Kuntala Bandyopadhyay

বাংলা মিডিয়াম। মফঃস্বল। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে নিজেকে অপদার্থ প্রমাণ করে মাধ্যমিকের বাংলার নম্বরটা মনে করে একটা শেষ হাত-পা ছোড়া। প্রায় একদশক ব্লগার থাকার সংযম দেখিয়ে অবশেষে ছিলা ছিঁড়ে গল্প লেখা। মূলতঃ ওয়েবজিনে। সাহস বাড়লে একদিন উপন্যাসও লিখে ফেলতে পারেন। কাজেই “মন ছুঁয়ে গেল” ইত্যাদি বলে সাহস দেওয়ার আগে দু’বার ভাবুন। পেশাকে ভালোবাসেন না, নেশা বলতে ফুচকা। ভূত বা ঈশ্বর কাউকেই বিশ্বাস করেন না; একজনকে মারাত্মক ভয় পান। কবীর সুমনের গান না শুনলে জীবনটা কেমন হত কল্পনা করার চেষ্টা করে রেগুলার ব্যর্থ হন। পাক্কা খবর রাখেন, মোবাইল ফোনই কল্কি অবতার।

Picture of কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়

কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলা মিডিয়াম। মফঃস্বল। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে নিজেকে অপদার্থ প্রমাণ করে মাধ্যমিকের বাংলার নম্বরটা মনে করে একটা শেষ হাত-পা ছোড়া। প্রায় একদশক ব্লগার থাকার সংযম দেখিয়ে অবশেষে ছিলা ছিঁড়ে গল্প লেখা। মূলতঃ ওয়েবজিনে। সাহস বাড়লে একদিন উপন্যাসও লিখে ফেলতে পারেন। কাজেই “মন ছুঁয়ে গেল” ইত্যাদি বলে সাহস দেওয়ার আগে দু’বার ভাবুন। পেশাকে ভালোবাসেন না, নেশা বলতে ফুচকা। ভূত বা ঈশ্বর কাউকেই বিশ্বাস করেন না; একজনকে মারাত্মক ভয় পান। কবীর সুমনের গান না শুনলে জীবনটা কেমন হত কল্পনা করার চেষ্টা করে রেগুলার ব্যর্থ হন। পাক্কা খবর রাখেন, মোবাইল ফোনই কল্কি অবতার।
Picture of কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়

কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলা মিডিয়াম। মফঃস্বল। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে নিজেকে অপদার্থ প্রমাণ করে মাধ্যমিকের বাংলার নম্বরটা মনে করে একটা শেষ হাত-পা ছোড়া। প্রায় একদশক ব্লগার থাকার সংযম দেখিয়ে অবশেষে ছিলা ছিঁড়ে গল্প লেখা। মূলতঃ ওয়েবজিনে। সাহস বাড়লে একদিন উপন্যাসও লিখে ফেলতে পারেন। কাজেই “মন ছুঁয়ে গেল” ইত্যাদি বলে সাহস দেওয়ার আগে দু’বার ভাবুন। পেশাকে ভালোবাসেন না, নেশা বলতে ফুচকা। ভূত বা ঈশ্বর কাউকেই বিশ্বাস করেন না; একজনকে মারাত্মক ভয় পান। কবীর সুমনের গান না শুনলে জীবনটা কেমন হত কল্পনা করার চেষ্টা করে রেগুলার ব্যর্থ হন। পাক্কা খবর রাখেন, মোবাইল ফোনই কল্কি অবতার।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com