(Norway) যাওয়ার প্ল্যান তো প্রধানত অরোরা দেখতে। কিন্তু লেডি অরোরা এমনই যে ধরা দিতেও পারেন নাও পারেন। যদি দেখতে না পাই, তাহলে দুঃখ কাটাবো কী দিয়ে! ভেবে দেখলাম উপায় একটা আছে! দারুণ দারুণ সব খাবার দিয়ে মন ভরিয়ে না হয় বাড়ি ফিরব। (Norway)
অন্য কোথাও গেলে প্রথমেই সে দেশের টুকটাক ভাষা শিখে ফেলি, আর ফ্লোরা ফওনার লিস্ট, আর সব চেয়ে আগে যেটা করি খাবারের তালিকা মুখস্থ করে ফেলি।এবারে একটু গোল বাঁধলো। নামের বানানে দেখি যেখানে সেখানে কনসোনেন্ট বসে। ফোনটিক্স এর কোনও নিয়ম দিয়েই উচ্চারণ পারছি না! অতএব, কাগজ পেন নিয়ে লিস্ট করতে বসলাম, শুধু লিস্টে কী হবে! বেকারির খাবার তো মাছের রেস্তোরাঁয় খুঁজলে হবে না! তাই বিবরণও লিখলাম, সঙ্গে কিছু রেস্তোরাঁর নাম। (Norway)

রওনা দিলাম, কিন্তু মনে মনে জানি, ড্যানসিং অরোরা না দেখতে পেলে সব কিছুই হয়তো বিস্বাদ লাগবে। তারপরের গল্পটা একদম রূপকথার মতো। বরফে মোড়া শহর ট্রমসোতে নামার আগেই উড়োজাহাজ থেকে কীভাবে লেডি অরোরা আমাদের মন মুগ্ধ করলেন, এবং পর পর কয়েকদিন বিমোহিত করে রাখলেন – সেই সব কথা। সেদিন মাঝরাতে এক আকাশ তারা আর সবুজ লাল আলোর নীচে কনকনে ঠান্ডায় বরফে শুয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। কীরকম একটা ভারমুক্ত লাগল। পর পর তিন রাত জাগব বলে হালকা খাবার খাচ্ছিলাম। অতএব ভারমুক্ত মন বলল, বেশ খানিক ঘুমিয়ে কাল থেকে লেগে পড়ো খাদ্য অভিযানে। (Norway)
সবাই রাতের দিকে রেস্তোরাঁতে ভিড় জমায়। খুঁজতে খুঁজতে ঢুকলাম Kaia নামে একটি বিস্ত্রোতে। বুকিং লাগে না।তবে মালিককে বেশ একটা হেডস্যারের মতো “মে আই কাম ইন স্যার” গোছের প্রশ্ন করে ঢুকতে হয়।ব্যাস! তাতেই খুশি হয়ে উনি সুন্দর টেবিলে সুন্দর খাবারের ব্যবস্থা করেন। রাস্তার ধারে, সমুদ্রের পাশে, প্লেটে খাবার, পেটে খিদে, আর কী চাই!
সূর্যও পরদিন বহু দেরি করে উঠল, আমিও, দুজনেরই রাজ্যের কুঁড়েমি! যাই হোক ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে যখন রেডি হলাম, পেটে তখন ইল্লল বাতাপি ঢুকে তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। গোটা তিমি খেলেও হজম হয়ে যাবে যেন। ইয়েস! এই একটা জায়গায় আমি তিমিঙ্গিল বলে বুক ফুলিয়ে কইতে পারি। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় যখন তিমি শিকার নিষিদ্ধ, নরওয়ে সরকার এখনও নিষেধাজ্ঞা লাগু করেনি। (Norway)
মিনকি হোয়েল খেতে, ইল্লল বাতাপি ভরসায় বেরিয়ে পড়লাম।
**********************************************
এক পা হাঁটলেই হার্বার। আর ধার দিয়ে আরেকটু এগোলেই একটা দারুণ রেস্তোরাঁ, ‘ফুল স্টিম’। বল্গা হরিণের সিং, ফিশারম্যানদের নৌকো, পিপে সারি সারি, আর শুকনো মাছ, কিন্তু কোনও বিকট গন্ধ নেই। অ্যাম্বিয়েনস এমন মনে হবে এই নৌকো করে মাছ ধরে এনে খাচ্ছি। (Norway)

নেপাল থেকে কাজ করতে আসা দাদা, যিনি নরওয়েজিয়ান আর ইংরিজিই বলছিলেন, ওনাকে খাবার আনতে বললাম। Hvalbiff এইচ না ভি কোনটা কীভাবে উচ্চারণ করব। নেপালি দাদা কায়দা করে কইলেন ‘ভালবিফ’… হোয়েল স্টেক, একটা ওনিয়ন সস আর সঁতে করা সবজি, আলুর সাথে চলে এলো। আর এলো ফিনবিফ (Finnbiff) …বলগা হরিণের স্বাদু মাংস, নুন মরিচ,মাখন তেলে হালকা ভেজে, ক্রিম মাখিয়ে ভালো করে সেদ্ধ করা। সার্ভ করলো দুর্দান্ত একটা আলু সেদ্ধ মাখা আর ছোট্ট লাল লিঙ্গনবেরির সাথে। (Norway)

তিমি মাছটির স্বাদ খুব ভালো, তবে একদম অনন্য এবং নরম সুস্বাদু হলো ফিনবিফ।এর সঙ্গে ছিল নরওয়েজিয়ান বিয়ার পিলস্নার (Pilsner)। আর সবার শেষে এলো হার্ট অ্যাটাক! যখন নেপালি দাদা বিল হাতে নিয়ে এলো। ততক্ষণে আট দিয়ে গুন করা অভ্যেস হয়ে গেছে। সংখ্যাটা এদেশের মতনই শুধু ইউনিটটা আলাদা! মানে এই বিল দিয়ে মাসের মুদির বাজার হয়ে যায় আর কী। (Norway)
***********************************************
পরদিন মনে জোর এনে বললাম, জীবন তো একটাই কালিদা! পেট ভর্তি করতে পকেট হালকা করেই ফেলি!

সেদিন দুপুরে হেঁটে ওই পাহাড়ি শহর ঘুরে তখন পেটে ছুঁচো দৌড়াদৌড়ি করছে.. লাঞ্চ করতে আরও খানিক হেঁটে পৌঁছে গেলাম ম্যাকিনভার্সটাড রেস্টুরেন্ট (Maskinverkstedet restaurant), যা আমি ভুলেও উচ্চারণ করছি না বাবা! মানুষজন যে ওখানকার জীবনযাত্রায় কত খুশি, সেটা বুঝিয়েই অর্ডার নিলেন ঝলমলে হাসিখুশি এক সপ্রতিভ তরুণী। খুব ভালবাসে কাজকে, বোঝা গেল। সুন্দর নরওয়েজিয়ান টাচ এর রেস্তোরাঁ। (Norway)

Slow cooked pork belly, লাল বাঁধাকপি আপেল, সেলেরি, ওরেঞ্জ সস, রোস্টেড পটাটো আর ওয়ালনটস দিয়ে Verkstedets pickled herring and potato, একটা পটাটো কেকের নিচের লেয়ার, যেরকমটি আগে খাইনি।বাইরে মুচমুচে ব্রাউন আবরণ আর ভিতরে নরম আলু, তার ওপরে পিকল্ড হেরিং, পিকল্ড ওনিয়ন আর দিল লিভস ছড়ানো। (Norway)

আর নরওয়েজিয়ান কড গ্রেটিন (Norwegian Cod Gratin), গ্র্যাটিন যেমন হয় আর কী, টপিংয়ে ওপরে আলু, মটরশুঁটি বেকন ইত্যাদি দেওয়া! সবকিছুরই প্লেটিং দেখে দেখে তো সাজিয়ে রাখতে মন করছিল।

*****************************************
সেদিনই রাতে গেলাম ডিনার সারতে। যেকটা রেস্তোরাঁ লিস্টে ছিল, সবগুলোই দেখি ফুল। ডিনার করার মন করলে, আগে থেকে বুক করা ভালো। সবাই রাতের দিকে রেস্তোরাঁতে ভিড় জমায়। খুঁজতে খুঁজতে ঢুকলাম Kaia নামে একটি বিস্ত্রোতে। বুকিং লাগে না। তবে মালিককে বেশ একটা হেডস্যারের মতো “মে আই কাম ইন স্যার” গোছের প্রশ্ন করে ঢুকতে হয়।ব্যাস! তাতেই খুশি হয়ে উনি সুন্দর টেবিলে সুন্দর খাবারের ব্যবস্থা করেন। রাস্তার ধারে, সমুদ্রের পাশে, প্লেটে খাবার, পেটে খিদে, আর কী চাই! (Norway)

খেলাম। অবশ্যই Norwegian Salmon বেকড, ফরেস্টার চিজ প্যাপ্রিকা দিয়ে গ্রেটিনেটেড সঙ্গে কিছু সঁতে করা সবজি আর আলু বেকড। Arctic fish and chips – ক্লিপ ফিশ দিয়ে ফিশ এন্ড চিপস। আর Norwegian Scallops Gratin ,স্ক্যালপের খোলায় পরিবেশন করা। নরওয়েজিয়ান স্ক্যালপ সমুদ্র থেকে ফ্রেশ তুলে আনে ডাইভাররা। (Norway)
*************************************
পরদিন একটি বোটে চেপে আর্কটিকে ঘুরলাম। ১০৭ বছরের পুরনো সারাই করা কিন্তু একদম মডার্ন নৌকোতে আর্কটিক ওশনে ভ্রমণ সেরে ফিরতি পথে হাঁটতে হাঁটতে দেখি মাছের বাজার। কিন্তু কোনও আওয়াজ নেই, একটা হালকা মিউজিক। আর নানান রকম টাটকা আর শুকনো মাছ। মাছের ডিম মানে ওই ক্যাভিয়ার। কাঁচাও কেনা যায়। আর কিছু মাছ ওরা ওখানেই রান্না করে দেয়। (Norway)

লাঞ্চ করলাম, স্নো ক্র্যাব দিল লিফ, হোয়াইট সস আর অল্প ক্যাভিয়ার দিয়ে। সঙ্গে একটা Sea Urchin, কাঁচা, বরফের ওপর সার্ভ করা, লেবু দিয়ে। খানিকটা ডাবের মতো, একটু মিষ্টি একটু সল্টি খেতে, জাস্ট অসাধারণ। কদিন ধরে লক্ষ্য করলাম, ওখানকার লোকেরা মাইক্রোগ্রিন খুব ভালোবাসে, প্রায় সব খাবারেই গার্নিশে মাইক্রোগ্রিন..

**********************************************
লাঞ্চ সারতে সারতে সূর্য ডুবে গেল। সন্ধ্যে নামল শহরে। হঠাৎ ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে চোখে পড়ল ছোট্ট একটা বার! বসার কয়েকটা জায়গা বাইরে। চারপাশে বরফ ঘেরা। আমরা শুধু রেইন ডিয়ার হটডগ আর হট চকলেট খেলাম। বারের নাম Raketten bar, পৃথিবীর সব চেয়ে ছোট বার। (Norway)

**********************************************
ওদিকে লিস্ট মিলিয়ে দেখি নরওয়ের ন্যাশনাল রেসিপিটাই টেস্ট করা হয়নি। Fårikål , ল্যাম্ব আর বাঁধাকপি সবজি দিয়ে কমফর্ট ফুড, ষ্টু। একটা ছোট্ট ক্যাফে, আর্ট ক্যাফে বিস্ত্রো। সুন্দর হোমমেড খাবার, যত্ন করে সাজিয়ে পরিবেশন করা। আগে থেকে সময়টাও বলে রেখেছিলাম।

টেবিলে রেখে গেল Farikal, Smoked Salmon (Rokt Laks) আর Norwegian Shrimp Salad… সঙ্গে ছিল Aquavit, নরওয়েজিয়ান ভদকা, দিল বা ক্যারাওয়ে ফ্লেভার সমেত।
*******************************************
সেদিন ছিল আমাদের শেষ রাত ওই শহরে। হোটেলে ফিরে আবার লিস্ট খুলে বসলাম। বলতে তো ভুলেই গেছি, হোটেলের বুফেতে অনেক কিছুই লিস্ট মিলিয়ে খেয়েছি।

Lefse – ওখানকার ট্র্যাডিশনাল ফ্ল্যাট ব্রেড, Brunost – অসাধারণ স্বাদের একটু মিষ্টি একটু কনডেন্সড দুধ এর মতো খেতে লালচে রঙের চিজ, Kjottkaker – মিটবল, গ্রেভিতে Kumla – আলুর ডাম্পলিং, Krumkake – মজাদার ওয়াফল কেক। আর বুফেতে মন ভরে খেয়েছি নরওয়েজিয়ান সামন ..

খাওয়া বাকি থাকল অনেক কিছু – Smalahove, শিপ হেড রান্না করা আরও নানান মাছ আর এল্ক..
*******************************************
বাড়িতে ফিরে গল্প শুনতে শুনতে মা বলে উঠল, “সান্তা কীকরে আসবে এবার? বলগা হরিণ খেয়ে ফেললি? মায়া লাগলো না?”
উত্তরটা জানা কিন্তু দুঃখটা বড্ড অজানা।
ছাগলের চোখের কি কম মায়া মা? ফুড চেন আর পিরামিড এর রুলই হলো, “To eat or be eaten”!!
ছবি সৌজন্য: লেখক
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।