৬
বাতাসে একটা ‘চিল্’ (Chill) রয়েছে৷ ‘ফল’ (Fall) বলে অ্যামেরিকানরা এই সময়টাকে৷ পাতা ঝরার সময়৷ পাতা ঝরার আগে পর্ণমোচী বৃক্ষগুলি শেষবারের মতো একবার রাঙিয়ে নিতে চায় নিজেদের৷ চারিদিকে রঙের খেলা৷ রঙের যে কত রকম শেড হয়, কতরকম কম্বিনেশন, রঙ-রঙিন পাতাগুলি ঝরে যাবার আগে শেষবারের মতো সাজিয়ে নেয় নিজেদের– যেন উৎসবের সূচনা হচ্ছে, এদেশে আসার আগে জানাই ছিল না রোহিণীর৷ এই সময়টা বেশ লাগে ওর৷ এবার তো ও খুশিতে ডগমগ হয়ে আছে৷ এবার ওর শ্বশুরবাড়ি একেবারে জমজমাট৷
সত্যিই বহুকাল বাদে সীমন্তিনীদের বাড়িতে একসঙ্গে এত লোক এল৷ এই প্রথমবার দিল্লি থেকে রোহিণীর মা-বাবা এসেছেন৷ অরুণলেখা তো পুজোর অনেক আগে থেকেই এবার আছেন ছেলের বাড়ি৷ অরুণাভ এবার বেশ জোর করেই মাকে নিয়ে এসেছে নিজের কাছে৷ বলেছে, ‘শীতটা কাটিয়ে যাও আমাদের সঙ্গে৷ বাড়ি বাড়ি করে অস্থির হোয়ো না৷ আই উইল টেক গুড কেয়ার অফ ইওর বাড়ি৷’ সত্যিই কথা রেখেছে অরুণাভ৷ পাশের একজন নেবারকে একটা চাবি তো দিয়ে এসেছেই, সপ্তাহে সপ্তাহে একটু দেখভাল করার জন্য৷ উপরন্তু দু-এক মাস বাদে বাদে ও বা সীমন্তিনী গিয়ে দেখে আসছে সব ঠিকঠাক আছে কিনা৷ একটা বাড়ির কম সমস্যা নয়৷ বাইরে লনের ঘাসগুলো সামারে বড়ো হয়ে যায়৷ সেগুলো লন মোয়ার দিয়ে ছাঁটতে হয়৷ এখন অবশ্য শীত এগিয়ে আসছে৷ ঘাস ছাঁটার সমস্যাটা বড় নয়৷ কিছুদিন বাদেই বরফ পড়ে পড়ে সমস্ত ঘাসজমি বরফে ঢাকা পড়বে৷ তৈরি হবে সাদা তুষারের আচ্ছাদন৷ কিন্তু তখন আবার অন্য সমস্যা৷ হিটিংটা সবসময় মিনিমামে চালিয়ে রাখতে হবে৷ আজ শনিবার ডাইনিং টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে এদেশে থাকার এসব দৈনন্দিন সমস্যার বিষয় নিয়েই আলোচনা হচ্ছে৷
প্যানকেকের টুকরো ছিঁড়ে মুখে পুরতে পুরতে অমিয় অকৃত্রিম বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন
– কেন, বাড়িতে না থাকলেও হিটিং অন করে রাখতে হবে কেন? কারেন্ট কনজাম্পসন হবে তো তাতে? বিশাল বিল আসবে না?
– সেটা আসা বরং মন্দের ভাল অমিয়দা৷ ওটুকু বাঁচাতে গেলে অন্যদিকে বিশাল খরচ হয়ে যাবার চান্স৷
সীমন্তিনী কিচেন থেকে আরও একসেট গরম প্যানকেক এনে নামিয়ে রাখল টেবিলে।
– জানেন না এই ইলেকট্রিক বিল বাঁচাতে গিয়ে আমার এক বন্ধুর কী অবস্থা হয়েছিল?
– কী হয়েছিল?
শিপ্রা ওধার থেকে জিজ্ঞাসা করলেন৷ এবার সীমন্তিনী নয়, রোহিণীই টেক-আপ করেছে গল্পটা৷
– বাবাঃ! সে এক কাণ্ড৷ মাম্মার বন্ধু সুস্মিতামাসি একবার শীতের সময় এক মাসের জন্য দেশে গেছেন৷ ফেরৎ এসে ঘরে ঢুকে দেখেন ঘরে নোংরা দাগ৷ সোফাসেট থেকে সবকিছুতে স্টেইন৷ বাথরুম আর কিচেনের জলের পাইপটা ভিতরে জল বরফ হয়ে গিয়ে পাইপ ফেটে সমস্ত বাড়ি ড্যামেজ করেছে৷ কী অবস্থা ওঁদের৷ বসা তো দূরস্থান, দাঁড়াবার জায়গা নেই৷ তখন লঙহল ফ্লাইট থেকে নেমে কোথায় জেটল্যাগ কাটাবেন তা-না, তখন দৌড়াও প্লাম্বার ডাকতে, ইন্সিওরেন্সের সঙ্গে ঝগড়া করতে৷ বিশ্রী অবস্থা৷
– শুধু তাই! দেড় মাস ওদের হোটেলে থাকতে হয়েছিল, যতক্ষণ না থরো রিপেয়ার হয়ে বাড়ি ঠিক হল৷
সীমন্তিনী বলল।
– হোটেলে দেড় মাস? অনেক খরচ তো?
– খরচটা ইন্সিওরেন্স কোম্পানিই দিয়েছিল শেষ অবধি৷ কিন্তু ভোগান্তিটা ভাব৷ একেবারে বাড়ির কাঠের মেঝে অবধি জলে পচে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ কার্পেটের তলা দিয়ে জল ঢুকে৷ দেওয়ালে কালো কালো বিশ্রী দাগ৷
সীমন্তিনী মুখ কুঁচকেছে, যেন দাগটা নিজের দেয়ালেই দেখছে৷
– ব্রেকফাস্ট খেয়েই তো পেট ভরে গেল৷ সীমন্তিনী, লাঞ্চটা ভাবছি বাদই দিই৷
অমিয় একটা তৃপ্তির উদগার তুলছেন৷
– মামণি, অমিয়কে দুটো নাড়ু বের করে দাও৷
অরুণলেখা সীমন্তিনীকে বললেন৷ শিপ্রা হাঁ হাঁ করে উঠলেন,
– মাসিমা, নাড়ুর এখন কোনও প্রশ্নই নেই৷ সন্দেশই তো খেলেন উনি৷ ওবেলা খাবেন’খন৷
অরুণলেখা একটু ভাবলেন।
– তা ঠিক৷ শরীর বুঝে খাওয়াই ভাল৷
খাওয়ার পর নীচে নেমে গিয়ে লেকের ধারে বসলেন সকলে৷ সকলে মানে অমিয়, শিপ্রা, অরুণলেখা আর রোহিণী৷ সীমন্তিনী এক্ষুণি আসতে পারবে না৷ প্রতি শনিবার একটি কোরিয়ান মেয়ে আসে তাকে ঘরের কাজে সাহায্য করার জন্য৷ প্রথম প্রথম যখন বিয়ে হয়ে এসেছিল, তখন ওকে যাবতীয় কাজ একাই করতে হত৷ অরুণাভ কাজেকর্মে খুব দক্ষ৷ অরুণলেখা মেয়ে আর ছেলের মধ্যে কোনও তফাৎ করেননি৷ বিদেশে থাকলে সবাইকেই কাজ করতে হয় হাতে হাতে৷ নয়তো সংসারের গৃহিনীর উপর বেশি চাপ পড়ে যায়৷ তবে অরুণাভর ইচ্ছে থাকলেও, উপায় ছিল না কোনওদিনই৷ ব্যস্ত ডাক্তার হিসেবে সংসারে সে সময় দিতে পারেনি৷ তবে ধাপে ধাপে উন্নতি হয়েছে ওর কাজে৷ এখন যতটুকু অবসর পায়, নিজের শখগুলোই সাধ্যমতো মেটাতে চেষ্টা করে অরুণাভ৷ শখ বলতে গল্ফ খেলা৷ আর মাঝে মধ্যে সাঁতার৷ সাঁতার অবশ্য সামারে বেশি কাটার সুযোগ৷ তবে গল্ফটা সুযোগ পেলে প্রায় প্রতি শনিবারই খেলতে যায় অরুণাভ৷ গত সপ্তাহ থেকে শ্বশুর শাশুড়ি এসেছেন বলে রণোও আসছে শনিবারগুলোয়৷ আবার সোমবার ফিরে যাচ্ছে৷ অরুণাভও সেই সকালে জিম করে, হসপিটালে চলে গেছে৷ দেড়টা নাগাদ ফিরে লাইট লাঞ্চ করে ও চলে যাবে গল্ফ খেলতে৷ গত সপ্তাহে রণোও গেছিল বাবার সঙ্গে৷ ওদের বাড়ি তিন মাইলের দূরত্বে গল্ফ ক্লাবের মেম্বার অরুণাভ অনেক বছর ধরে৷ এমনিতে শীত না থাকলে বাইকেই যায় অনেকসময়৷ এখন শীত পড়তে শুরু করেছে বলে গাড়িতেই যাবে হয়তো৷ গত সপ্তাহে রণো আর অরুণাভ বাইক চালিয়ে গল্ফ খেলতে যাচ্ছেন দেখে অমিয় বিস্ময়ের সুরে বলেছিলেন,
– এবারে আস্তে আস্তে কালচার শক হচ্ছে৷ দিল্লিতে আমরা বাপ-ব্যাটায় বাজার করতে যাই মাঝে মাঝে রবিবার হলে৷ আর এখানে বাপ-ব্যাটা যাচ্ছে গল্ফ খেলতে৷
– শ্বশুরই বা বাদ থাকে কেন? সামনের স্যাটারডে আফটারনুন রেডি থাকবেন অমিয়দা৷ আপনিও আমাদের সঙ্গে গল্ফ খেলবেন৷
– রক্ষে কর৷ এই বয়সে আর লোক হাসাতে পারব না৷
অমিয় জোড়হাত করে মজার ভঙ্গিতে বলেছিলেন৷

রণো এখনও এল না কেন? সীমন্তিনী একটু অস্থির বোধ করছে৷ কিচেন থেকে নাম্বার টিপে ফোন করছে ইন্টারকমে৷ তাদের বাড়িও এখানে অন্য অনেক বাড়ির মতো পুরোদস্তুর তিনতলা৷ অ্যাটিকের ছোট বন্দোবস্তটাকে ধরলে চারতলাই বলা যায়৷ অ্যাটিক বা চিলেকোঠার ঘরও চমৎকার করে সাজানো৷ তিনতলা থেকে বেসমেন্টের একতলা অবধি ইন্টারকম দিয়ে সংযুক্ত৷ ইন্টারকমে বেসমেন্টের বাইরে যেদিক দিয়ে লেকের দিকে বেরনোর দরজা, সেখানেও স্পিকার রয়েছে৷ রোহিণী ধরেছে৷
– কী বলছ মাম্মা?
– হ্যাঁরে, রণো কিছু বলেছে কটা নাগাদ পৌঁছবে?
– এমা! আমি একদম ভুলে গেছি৷ রণো গতকাল বলে দিয়েছে ওর এক কলিগের সঙ্গে বিজনেস লাঞ্চ আছে৷ ওর পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে৷
সীমন্তিনী ফোনটা ছেড়ে দিয়েছে মৃদু একটু বকুনি দিয়ে৷
– বলবি তো একটু মনে করে৷ তুই জানিস আমার কি পরিমাণ টেনশন হয়৷
সত্যি বলা উচিত ছিল রোহিণীর৷ ও জানে মাম্মার এই একটা মাত্র দোষ৷ অ্যাংজাইটি ডিসর্ডার৷ পরিবারের লোকেদের নিয়ে বিকট রকম দুশ্চিন্তা করতে থাকে সীমন্তিনী৷ বিশেষত কেউ ঠিক সময়ে না ফিরলে৷ যত বয়স বাড়ছে, তত এই একটা রোগ মাথা চাড়া দিচ্ছে ওর ভিতর৷ বাবাইয়ের ফিরতে একটু দেরি হলে ঘন ঘন ফোন করতে থাকে সীমন্তিনী৷ বুক ধড়ফড় করে প্যানিক অ্যাটাকের উপক্রম হয়৷ কাউন্সেলরের কাছে এই সমস্যাটা নিয়ে বেশ কয়েকবার বলেছে সীমন্তিনী৷ বাঁধা বুলির মতো একই উপদেশ দেয় ওরা৷ ডিপ ব্রিদিং, যোগা, মেডিটেশন৷ পারলে ওষুধ না খাওয়া৷ সীমন্তিনী যেহেতু বছরে একবার করে কলকাতা যায়, তখন চেনা ওষুধের দোকান থেকে নার্ভ স্যুদিং ওষুধের একটা বছর চলার মতো স্টক নিয়ে আসে ও৷ মাঝে মধ্যে এক-আধটা খায় মনকে শান্ত করতে৷ এটা ওর রোগ৷ কিছু একটা খারাপ হবে, কোনও দুর্ঘটনা ঘটবে, এমন আশঙ্কায় সর্বদা সিঁটিয়ে থাকা৷
– যে জীবনটা বাঁচছ, সেটাও তো পুরো এনজয় করতে পারছ না, কালকে কী হতে পারে, সেটা ভেবে আজকের এই মুহূর্তের আনন্দটুকু ধ্বংস করে ফেলছ তুমি মাম্মা৷
রণো একসময় অনেক বুঝিয়েছে মাকে৷ এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে৷ বুঝে গেছে এই স্বভাব এই বয়সে আর পাল্টানো সম্ভব নয়৷ রণোর এখন নিজস্ব সংসার হয়েছে৷ মাম্মার জন্য আর সেরকম কনসার্ন না থাকাটাই তো স্বাভাবিক৷ অরুণাভ অবশ্য এভাবে ভাবে না৷
– ডোন্ট মেক লাইফ কমপ্লিকেটেড ফর এ নন-ইস্যু৷ জীবনে এমনিতেই অনেক জটিলতা৷ কোন অ্যাডাল্ট লাইফে জটিলতা নেই?
অরুণাভ অনেকবার বলেছে সীমন্তিনীকে৷ রণো এখনও ওরা নিউইয়র্ক গেলেই এক একদিন এক একটা রেস্তোঁরায় খাওয়ায়, ভালো ভালো মিউজিক্যাল অপেরা, কি অন্য ধরনের নতুন শো-এর মহার্ঘ্য টিকিট কেটে রাখে মাম্মা আর বাবাইয়ের জন্য৷ এসব আজকাল কোন্ ছেলে করে? সীমন্তিনীও জানে সে কথা৷ এদেশে বড় হওয়া ছেলেমেয়ে তো ছোটো থেকেই একটু আলগা আলগা৷ আজকাল দেশেও দেখে ছেলেমেয়েরা বাপ মায়ের জন্য ভাবে খুব কম৷ সীমন্তিনী দেখেছে ওর প্রজন্মের লোক, ওর বন্ধু রুমা, স্বামীর সঙ্গে বোম্বেতে থাকে বলে নিজের মায়ের লেক গার্ডেন্সের বাড়ি বিক্রি করে মা-কে কীভাবে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দিয়েছে৷
শিপ্রা এর মধ্যে হাঁসফাঁস করতে করতে উপরে উঠে এসেছেন৷ একটা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে পড়াতেন শিপ্রা৷ সদ্য রিটায়ার করেছেন৷ স্বামী-স্ত্রী দুজনেই রিটায়ার করলেন বলেই এবার একেবারে তিনমাসের জন্য বেরিয়ে পড়েছেন৷ শিপ্রা খুব কথুকি৷ মুখে যেন কথার খই ফুটছে৷ তবে মানুষটা সাদামাটা৷ কোনও ঘোরপ্যাঁচ নেই৷ মা-বাবা এমন চমৎকার বলেই রোহিণীও ভালো৷
– কিছু সাহায্য করব সীমন্তিনী?
– না গো শিপ্রাদি! তুমি বস৷ এখানে একটু জিরোও৷
বলে কিচেনের বেতের হাইচেয়ার একটা সীমন্তিনী টেনে দিল কাছে৷
– এখানে এসে থেকেই তো শুয়েবসেই আছি৷ এত শুয়ে বসে থাকার তো অভ্যেস ছিল না কোনওকালে৷ স্কুলে পড়িয়েছি৷ বাড়ি এসে আবার বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িকে অ্যাটেন্ড করেছি– যত দিন ওঁরা ছিলেন৷ তা শ্বশুরমশায় তো চলে গেছেন…
একটু হিসাব করছেন শিপ্রা৷
– একুশ বছর হয়ে গেল৷ শাশুড়ি অবশ্য তিন বছর হল গেছেন৷ শ্বশুর একদিনের অ্যাটাকে চলে গেছিলেন৷ তখন তো আমার ছেলেমেয়ে একজন দশ, একজন সাত৷
একটু দম নিলেন শিপ্রাদি৷ সেই সুযোগে সীমন্তিনীও টুক্ করে বলল,
– তাও তো তুমি দেখেছ৷ এই জেনারেশনের কেউ তো আর মা-বাবার জন্য কেয়ারই করবে না৷
সঙ্গে সঙ্গে কথাটা লুফে নিয়েছেন শিপ্রা।
– তুমি এই জেনারেশন কি বলছ ভাই? আমার সম্পর্কে দেওররা, ওঁর পিসতুতো ভাই, আমারই বয়সী ওরা৷ একজন একটু ছোট, একজন বড়৷ ঘন্টু আর রন্টু তো দেখলাম তাদের মাকে সোদপুরের ওখানে একটা ওল্ড এজ হোমে রেখে দিল বছরের পর বছর৷ দুটো বোনও তো ছিল৷ চার ভাইবোন ওরা৷ পালা করেও তো রাখতে পারত? নোবডি বদার্ড৷
সীমন্তিনীর মনে পড়ল।
– পিসিঠাম্মা বলত বোধহয় রোহিণী, তাই না!
– ঠিক বলেছ৷ ও খুব ভালবাসত ওর পিসিঠাম্মাকে৷ ওদের বিয়ের সময় কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল পিসিকে৷
মনে আছে সীমন্তিনীর৷ রণোদের বিয়ের সময় ওই বৃদ্ধাকে দুধসাদা একটা গরদ দেওয়া হয়েছিল মাস্টার্ড রঙের পাড়ের৷ পিসিঠাম্মার খুব পছন্দ হয়েছিল শাড়িটা, রোহিণী বলেছিল৷
– এখন কেমন আছেন তোমার পিসশাশুড়ি?
– আর থাকা! এই তো মাস চারেক আগে মারা গেলেন ভদ্রমহিলা৷ ওই হোমেই৷ কাজে চিঠি এল৷ চিঠি তো না৷ আজকাল তো সব ই-কার্ড আসে৷ হোয়াটস্অ্যাপে৷ তাতেই জানতে পারলাম৷ তোমার দাদা খুব আপসেট হয়েছিলেন৷ পিসি মারা গেছেন, সেজন্য নয়৷ কিন্তু চার ছেলেমেয়ে থাকতে যেভাবে জীবনের শেষ বছরগুলো বৃদ্ধাশ্রমে কাটাতে হল, সেইটা নিয়ে খুব আপসেট ছিলেন উনি৷ কিছুদিন আগে ভেবেওছিলেন একবার পিসিকে চিত্তরঞ্জন পার্কের বাড়িতে এনে রাখবেন৷ শাশুড়ি মারা যাবার পর ওই ঘরটা তো খালি পড়েই থাকে৷
– তা তোমরা নিয়ে এলে না কেন?
– অন্য সব আত্মীয়স্বজন বারণ করল৷ আমার দুই ননদ বলল, ‘তোর কি দরকার দাদা! ওদিকে ওরা হয়তো ভাববে কোনও হিডেন অ্যাজেন্ডা আছে৷’ মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি৷ আজকাল জানো তো কারোর কোনও উপকারও লোকে ভাল মনে নেয় না৷ ভাবে কোনও স্বার্থ আছে৷ আজকাল লোকের মনগুলো বড়ই ছোট হয়ে গেছে৷
কিচেনে বসে ফলের রস খাচ্ছেন দুই বেয়ান৷ আগেকার দিন হলে তাঁরা পরস্পরকে বেয়ান বলে ডাকতেন৷ রোহিণীর দাদা যেমন অরুণাভ আর সীমন্তিনীকে আঙ্কল-আন্টি সম্বোধন করে, সেরকম সীমন্তিনীদের প্রজন্ম ভাবতে পারত না৷ শুধু রোহিণীর দাদা কেন, রণো নিজেও তো তার শ্বশুর-শাশুড়িকে আঙ্কল-আন্টি বলে৷ রোহিণী অবশ্য সীমন্তিনী-অরুণাভকে মাম্মা আর বাবাই বলেই ডাকে৷ অরুণাভর ক্ষেত্রে ওটা ওর ডাক নামও বটে৷ ওর মা-বাবা ওকে বাবাই বলেই ডাকতেন৷ পরে রণোও বাবা না ডেকে ‘বাবাই’ ডাকতে শুরু করল৷ এখন রোহিণীও ওই নামই পছন্দ করছে ডাকার জন্য৷ অরুণাভর আজ ফিরতে দেরি হবে৷ টেক্সট মেসেজ করেছে ও একটু আগে৷ নিকি বহুক্ষণ হল কিচেনের অল্পস্বল্প কাজ সেরে ঘর পরিষ্কার করে চলে গেছে৷ শনিবার বেশ সকাল সকালই ও এসে যায় ছোট্ট গাড়ি চালিয়ে৷ শিপ্রা আর অমিয় এদেশে এসেছেন প্রথমবার৷ অমিয় কোম্পানির সূত্রে কয়েকবার জার্মানি আর ইটালিতে গেছেন৷ শিপ্রা দেশের মধ্যে বেড়িয়েছেন৷ হাল আমলে হংকং আর ব্যাঙ্কক গেছেন একবার করে কয়েকদিনের জন্য৷ কিন্তু আমেরিকায় আসাটা দু’জনের পক্ষেই সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা৷
মাম্মার এই একটা মাত্র দোষ৷ অ্যাংজাইটি ডিসর্ডার৷ পরিবারের লোকেদের নিয়ে বিকট রকম দুশ্চিন্তা করতে থাকে সীমন্তিনী৷ বিশেষত কেউ ঠিক সময়ে না ফিরলে৷ যত বয়স বাড়ছে, তত এই একটা রোগ মাথা চাড়া দিচ্ছে ওর ভিতর৷ বাবাইয়ের ফিরতে একটু দেরি হলে ঘন ঘন ফোন করতে থাকে সীমন্তিনী৷ বুক ধড়ফড় করে প্যানিক অ্যাটাকের উপক্রম হয়৷ কাউন্সেলরের কাছে এই সমস্যাটা নিয়ে বেশ কয়েকবার বলেছে সীমন্তিনী৷ বাঁধা বুলির মতো একই উপদেশ দেয় ওরা৷ ডিপ ব্রিদিং, যোগা, মেডিটেশন৷ পারলে ওষুধ না খাওয়া৷
শিপ্রা এসে অবধি যা দেখছেন, হাঁ হয়ে যাচ্ছেন একেবারে৷ গত সপ্তাহে সদ্য এসে নিকিকে গাড়ি চালিয়ে আসতে দেখে অবাক হয়েছিলেন৷
– আগে শুনেছিলাম বিলেত আমেরিকায় লোকে কাজের লোক রাখা অ্যাফোর্ড করতে পারে না৷ আর এ তো দেখছি কাজের মেয়ে গাড়ি চড়ে কাজ করতে আসছে৷ পৌঁছনোর পরেই তুমি ওকে কফি খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে, ওর কি কাজ করার আদৌ দরকার আছে সীমন্তিনী?
সীমন্তিনী শুধু বলেছিল,
– গাড়ি এখানে একটা নেসেসিটি শিপ্রাদি৷ আমাদের দেশের মতো লাক্সারি নয়৷
অরুণলেখাও এইসব কথোপকথন শুনছিলেন৷
– আমাদের শান্তিনিকেতনে যেমন সাঁওতাল মেয়েরা অনেকসময় সাইকেলে চড়ে মাথায় ফুল গুঁজে বাড়ি বাড়ি কাজ করতে আসে, এখানে তেমনি এরা আসে গাড়ি চড়ে৷ সুন্দর করে মেক-আপ করে৷
নিকির স্বামী ওকে ছেড়ে চলে গেছে অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে৷ দুটি বাচ্চাকে ও একাই মানুষ করছে৷ নিকি খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আর খুব চটপটে৷ দ্রুতহাতে ও উপরের বেডরুমগুলোর বিছানা পাল্টায়৷ নতুন বেডশিট আর কভার পরায়৷ ফার্নিচার ডাস্টিং করে সমস্ত বাড়ির, হুভার দিয়ে কার্পেট পরিষ্কার করে, বেসমেন্টে ওয়াশিং মেশিন থেকে সব কাচা, আধা শুকনো কাপড়, চাদর ভাঁজ করে নির্দিষ্ট ড্রয়ারে ভরে রাখে, রোদালো দিনে স্যাঁতস্যাঁতে পর্দা, চাদর মেলে দেয় টাঙানো ক্লোদস্ লাইনে৷ ইতিমধ্যে সীমন্তিনীর রান্না হয়ে গেলে সমস্ত বাসন পরিপাটি করে সাজায় ডিশওয়াশারে ধোবার জন্য, টেবিলে খাবার প্লেট সাজিয়ে রাখে ন্যাপকিন সহযোগে৷ মাঝে কোনও সময় বাড়ি থেকে আনা স্যান্ডউইচ খেয়ে নেয়৷ বাড়ির পিছন দিকে বাগানে যাবার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ফুকফুক করে সিগারেট খায় একটু৷ আর ওর সঙ্গে একটু গল্প করলেই হেসে গড়িয়ে পড়ে৷ ছোটো চেরা চোখ দুটো, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক, মাথার চুল চুড়ো করে বেঁধে নেট লাগানো, যাতে কুচো চুল অসাবধানে উড়ে গিয়ে না পড়ে কোথাও, আর একমুখ হাসির আড়ালে নিকি যে জীবনধারণের জন্য এমন কঠিন লড়াই করে, তা ওকে দেখে বোঝার উপায় নেই৷
৭
এবার পুজোটা খুব এনজয় করেছেন অরুণলেখা৷ জন্মসূত্রে ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম তাঁর৷ সেজন্য তাঁরা, মানে তিনি এবং তাঁর দাদা, ছোটবেলায় পুজোটাকে তেমন নিজের জিনিস বলে মনে করতেন না৷ তার চেয়ে অনেক বেশি প্রিয় ছিল মাঘোৎসবের দিন ছাতিমতলায় জড়ো হয়ে প্রার্থনা, পৌষমেলায় পাঠভবনের স্টলে বসা, আর বসন্তোৎসবে হলুদ শাড়ি পরে ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’ গাইতে গাইতে আম্রকুঞ্জ প্রদক্ষিণ করা৷ কতদিন আগে সেসব ফেলে এসেছেন৷ মনে হয় যেন গত জন্মের ঘটনা! পুজোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হল বিয়ের পর৷ জ্যোতির্ময়ের পরিবারে বিয়ে না হবার যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল না তেমন৷ জ্যোতির্ময়ের দু’বোন হাসি আর খুশি শান্তিনিকেতনে পড়তে এসেছিল৷ জ্যোতির্ময়ের বাবা কলকাতার একটি কলেজে পড়াতেন দেশভাগের পর এসে৷ হাসি ছিল অরুণলেখার সমবয়সী৷ ও-ই ওর দাদার সঙ্গে ঘটকালির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়৷ জ্যোতির্ময়কে শান্তিনিকেতনে এনে অরুণলেখার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পিছনে হাসির একটা গভীর অভিসন্ধি ছিল৷
জিনিয়ার সঙ্গে অরুণলেখা তরুণী হাসির খুব মিল পান৷ জিনি আর বাবাই দুজনেই জ্যোতির গড়ন পেয়েছে৷ ওইরকম শার্প ফিচার্স, টকটকে ফর্সা রঙ৷ হাসি অত ফর্সা ছিল না৷ কিন্তু গালে কোথায় যেন একটা টোল পড়ত৷ জিনির বহিরঙ্গ সম্পূর্ণ অন্যরকম৷ ছোট করে চুল ছাঁটা, প্যান্ট-শার্ট ছাড়া পরে না ও৷ চোখে রিমলেস চশমা, বয়সের তুলনায় জিনিকে অনেক বাচ্চা দেখায়৷ কিন্তু হাসলে জিনির গালেও একটা টোল পড়ে৷ অবিকল ওর বড়পিসির মতো৷ তরুণী হাসির একঢাল চুল আর শাড়ি পরা চেহারা মনে পড়ে অরুণলেখার৷ এবারে জিনিকে প্রায় দু’বছর পরে দেখলেন অরুণলেখা৷ শেষ দেখা হয়েছিল রণোর বিয়েতে৷ রণো ওর ভাইপো হলেও খুব মাইডিয়ার সম্পর্ক৷ জিনি যে শেষ পর্যন্ত এসে উঠতে পারবে– সে ব্যাপারে খুব নিশ্চিত ছিল না কেউ৷ কিন্তু জিনি এসেছিল ঠিক৷ সেবার রুণকে নিয়ে এসেছিল৷ হৈ হৈ করে অংশ নিয়েছিল এখানে রিসেপশানে৷
তারপর এই আসা জিনির৷ রণো আর রোহিণী গিয়েছিল পিসিকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে৷ বস্টন এয়ারপোর্ট থেকে অরুণাভদের বাড়ি আসতে প্রায় সওয়া এক ঘণ্টা লাগে৷ জিনিকে দেখে চমকে গেছিলেন অরুণলেখা৷ মেয়ের আসল বয়স তো তিনি জানেন৷ আটচল্লিশ পেরলো জিনি কে বলবে ওকে দেখে ? দেখে মনে হচ্ছে রণোর থেকে একটু বড়৷ জিনি একটা নামী পাবলিশিং হাউসের বেশ জাঁদরেল এক কর্মী৷ কিন্তু কথাবার্তায় পুরোপুরি মার্কিনি৷ ওকে আর বাংলাটা কোনওভাবেই বলাতে পারেননি জ্যোতির্ময় বা অরুণলেখা৷ ও বাংলা বোঝে, কিন্তু বলে না একেবারেই৷ বিয়েও করেছিল অ্যামেরিকানকে৷ টেঁকেনি দশ বছর পেরিয়েও৷ রুণের জন্ম বিয়ের বেশ কয়েক বছর পর৷ রুণ এখন ঠিক আঠেরো৷ কিন্তু ওর মানসিক বয়সটা দশ৷ সবসময়ই শরীর আর মনের বয়সের মধ্যে এই ফারাক থেকে যাবে৷ রুণ এক বিশেষ ধরণের অটিজমে আক্রান্ত৷ স্পেশাল চাইল্ড৷ এই ব্যাপারটা শুধু জিনি নয়, অ্যালেক্সও খুব সযত্নে রক্ষা করে৷ বাইরের লোকের করুণা বা দয়া রুণের প্রাপ্য নয়, দরকার একটু সহমর্মিতা– এই বিষয়টায় ওরা সম্পূর্ণ একমত৷ হয়তো এইসব ভেবেই এবার রুণকে অনেনি জিনি, একাই এসেছে৷ আফটার অল এবার রোহিণীর মা-বাবা আছেন৷ ওঁদের সঙ্গে প্রথম আলাপ হচ্ছে। সেখানে ওঁরা রুণ সম্পর্কে অযাচিত কৌতূহল প্রকাশ করলে জিনির ভাল লাগত না৷ জিনি অবশ্য বলেছে যে এবার ও ইস্টকোস্টে একটা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে এসেছে৷ ওদের কোম্পানি ব্যবসা আরও ছড়াতে চায়৷ সেজন্যই আসা৷ কাকতালীয়ভাবে এই সময়ে পুজো পড়ে গেছে৷ ক’দিন এখানে কাটিয়ে ও নিউ ইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া ওসব দিকে যাবে৷ তারপর ফেরার পথে আবার আসবে৷ এখন অরুণাভদের বাড়িতেই অরুণলেখা আছেন বলে সবার সঙ্গেই দেখা হয়ে যাচ্ছে৷

জিনির অবশ্য গোড়া থেকেই শিপ্রা আর অমিয়র সঙ্গে খুব জমে গেছে৷ বিশেষ করে অমিয়র সঙ্গে৷ অনেক বছর পরে এবার জিনি ভাইফোঁটা দিল বাবাইকে সেই ছোটবেলার মতো৷ অমিয়ও দিব্যি জিনির দাদা বনে গিয়ে অরুণাভর পাশে বসে পড়লেন ফোঁটা নিতে৷ তাই দেখে সীমন্তিনী আর শিপ্রা বললেন,
– আমরাই বা ছাড়ব কেন?
সুতরাং শিপ্রা অরুণাভকে এবং সীমন্তিনীও অমিয়কে ফোঁটা দিলেন৷ অরুণলেখা রণোকে ফোঁটা দিলেন৷ শুধু রোহিণীরই ফোঁটা দেওয়া হল না৷ ওর দাদা দিল্লিতে৷ রণো অবশ্য ইয়ার্কি মেরেছিল-
– ইউ ক্যান গিভ মি ফোঁটা ইফ ইউ লাইক, অ্যালং উইথ দিদান৷ অর আই ক্যান গিভ ইউ বউফোঁটা৷
– ইয়ার্কি মারিস না রণো৷
রোহিণী ছদ্মকোপে ঘুঁষি পাকিয়েছিল৷ চন্দন বেটে আর দূর্বা গুছিয়েই ওর আনন্দ৷ শিপ্রা এবার চন্দনকাঠ আর পাটা নিয়ে এসেছেন সীমন্তিনীর জন্য আর পাঁজি আনতেও ভোলেননি৷ তাই তো ভাইফোঁটার তারিখ খেয়াল হল৷ শিপ্রার সঙ্গে সীমন্তিনীদের পুজো কমিটির কর্তাব্যাক্তিদের জমে গেছে খুব৷ মিলি বোস তো শিপ্রাকে চোখে হারাচ্ছেন৷ ঘট বিসর্জন দিয়ে ঠাকুর তোলা আর বিজয়ার পর্ব চুকিয়ে যখন ফাঁকা কমিউনিটি হলে আড্ডা হচ্ছিল, তখন চোখ বড় বড় করে মিলিদি বলেছেন,
– সীমন্তিনী! তোমার এই বেয়ানকে তো ছাড়া চলবে না৷ এ তো রত্নখনি একটি৷
সীমন্তিনী আন্দাজ করতে পারছিল মিলিদি বড্ডই পছন্দ করছেন শিপ্রাকে৷
– সে তো বটেই৷ শিপ্রাদি থেকে গেলে আমাদের কোনওই আপত্তি নেই৷
সীমন্তিনীও হেসে বলেছিল।
– না৷ অনেস্টলি, এত ভাল হেল্পিং হ্যান্ড আমি তো এই চল্লিশ বছর ধরে কখনও পাইনি৷
সীমন্তিনী লক্ষ করেছিল আড্ডায় বসে থাকা অন্যান্য মহিলাদের মুখগুলো একটু অন্ধকার হয়ে গেছিল৷ শিপ্রার প্রশংসা করতে গিয়ে ঘুরিয়ে যে অন্যদের নিন্দে করে ফেললেন মিলিদি, সেটা কি উনি সচেতনভাবে করলেন? যাই হোক পরিস্থিতিটা কোনওরকমে সামলে গেছিল৷
পুজো পেরিয়ে ভাইফোঁটা, থ্যাঙ্কসগিভিংও শেষ৷ জিনি ফিরে গেছে বেশ কিছুদিন হল৷ শিপ্রা আর অমিয় এখন নিউ ইয়র্কে। রণোর ওখানে কয়েকদিন কাটিয়ে ওঁরা দিল্লি ফিরে যাবেন৷ পরের বছর ছেলের বিয়ে দেবার ইচ্ছে ওঁদের৷ রোহিণীর দাদা একটি পাঞ্জাবি মেয়েকে পছন্দ করেছে৷ সেই বিয়ে হলে রণো-রোহিণী তো বটেই, সীমন্তিনী আর বাবাইও যাবে দিল্লি৷ ওরা অনেক করে অরুণলেখাকেও বলে গেছে।
– মাসিমা, আপনার কিন্তু বিয়েতে যেতেই হবে৷ যাতে সবার সুবিধা হয়, তাই ডিসেম্বরে বিয়ে দেব৷ অঘ্রানটা থাকতে থাকতে৷ আপনার যাওয়াটা কিন্তু মাস্ট৷
শিপ্রা বারবার বলেছেন৷ অমিয়কে মৃদু ঝঙ্কার দিয়ে বলেছেন
– কিগো! তুমি বল মাসিমাকে আসতে! নয়তো মাসিমা ভাববেন ছেলে কিছু বলছে না৷
স্ত্রীয়ের তাড়নায় অমিয়ও ঘাড় নেড়েছিলেন৷
অমিয় মৃদুভাষী, কিন্তু রসিক মানুষ৷ তার ফলে অরুণলেখার বিশেষ পছন্দের মানুষ হয়ে উঠেছেন এই ক’মাসে৷ আজ নির্জন সন্ধ্যেয় বসে অরুণলেখার মনে হল, গত কয়েকমাসে এই বাড়িতে যত আনন্দ তিনি পেয়েছেন, সমস্ত জীবনে খুব বেশিবার এরকম আনন্দবোধ করেননি৷ জ্যোতির্ময় চলে যাবার পর শেষ সাড়ে তিন বছর সম্পূর্ণ একা কাটিয়েছেন৷ তার আগেও অনেকদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন জ্যোতি৷ তখনও সবকিছু একাই সামলেছেন৷ বাবাই বারবার আসতে বললেও লম্বা সময় কখনও নিজের বাড়ি ছেড়ে থাকেননি৷ কিন্তু এবারে আসার পর থেকেই অরুণলেখা টের পাচ্ছেন, বয়স থাবা বসিয়েছে তাঁর উপর৷ হঠাৎই যেন অনুভব করছেন সারা শরীর মন জুড়ে ক্লান্তি৷ এমনিতে সন্ধ্যে হলেই টিভি দেখেন অরুণলেখা৷ রাজনীতি কখনওই টানেনি তাঁকে৷ শুধু বারাক ওবামা যেবার প্রথম প্রেসিডেন্ট হলেন, সেবার কয়েকদিন মন দিয়ে যাবতীয় খবর, অনুষ্ঠান দেখেছিলেন তিনি৷ ইদানিং বেশি দেখেন ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট বা ট্র্যাভেল অ্যান্ড লিভিং৷ বাবাইদের এখানে লিভিং রুমে পুরো একটা দেওয়াল জুড়ে বিশাল টিভি৷ বেসমেন্টে আলাদা টিভি, সেটাও তাঁদের ফিলাডেলফিয়ার বাড়ির চেয়ে ঢের বড়৷ সময় থাকলেই অরুণাভ বেসমেন্টে বসে ফুটবল দেখে৷ অ্যামেরিকান ফুটবলের খেলোয়াড়রা খুব মুশকো মুশকো, বিশালকায় এবং পেটানো চেহারার৷ ওরা নিজেরা খেলে, নাকি পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করে, অরুণলেখা বুঝে উঠতে পারেন না৷
সন্ধ্যেবেলা হলেই সীমন্তিনী ঘরে ঘরে ধূপ জ্বেলে দেয়৷ আজও ধূপ জ্বালতে এল৷ অরুণলেখা খুব শীতে বাইরে বেরন না একেবারেই৷ ঘর থেকেই বাইরেটা দেখেন৷ আজও উনি বিকেল থেকেই জানলার পাশে একটা চেয়ারে বসে আছেন৷
– আলো জ্বালাওনি মামণি?
সীমন্তিনীর গলার আওয়াজে ফিরে তাকালেন অরুণলেখা৷
– জ্বালিয়ে দেব? আলো?
– তুমি বরং ওপাশের হাল্কা আলোটা জ্বেলে দাও৷ আমি এখানে বসে বসে একটু দেখি৷
সীমন্তিনী আজ তিরিশ বছর ধরে দেখছে শাশুড়িকে৷ অরুণলেখা সুন্দরী নন, কিন্তু ওঁর চেহারা এবং গোটা ব্যক্তিত্বের মধ্যে এমন এক ধরণের দূরায়ত ব্যাপার আছে, যা অচেনা লোকের মধ্যেও সম্ভ্রম উদ্রেক করে৷ ওঁর মধ্যে এমন কিছু রয়েছে, যে ওঁকে উপেক্ষা বা অবহেলা করা অসম্ভব৷ সীমন্তিনী কিছু বলল না, নিঃশব্দে সিলিংয়ের আলোগুলো একেবারে হাল্কাভাবে জ্বেলে দিল৷ ডিমার দিয়ে আলো কম বেশি করার সিস্টেম আছে সব ঘরেই৷ এই বাড়ি কেনার সময় এইসব খুঁটিনাটি প্রতিটি জিনিস ওদের দেখে বেছে করতে হয়েছিল৷ ঘরে ডিমার থাকার জন্য কেন যেন অরুণাভর কাছে কৃতজ্ঞবোধ করল ও৷ হালকা র্যাপ-অন কম্বল নিয়ে এসেছে একটা৷
– মামণি, এটা গায়ে দিয়ে বস৷
অরুণলেখার মনের মধ্যে একটা প্রসন্নতা খেলা করে গেল৷ যদিও ঘরে চমৎকার হিটিং, গায়ে দেবার জন্য কম্বল দরকারই পড়ছে না, তবুও সীমন্তিনী যে প্রতিটি ছোট ছোট জিনিস খেয়াল রাখে, সেটা ভেবে আপ্লুত লাগল ওঁর৷

বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বরফ পড়া শুরু হয়েছে৷ প্রথম যখন বিলেত গেলেন সেবারই জানুয়ারি মাসে প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলেন অরুণলেখা৷ শুধু তিনি নন, জ্যোতির্ময় আর বাবাইয়েরও সেই প্রথম বরফ৷ একদিন সকালে উঠে পর্দা সরিয়ে জ্যোতি দেখেছিলেন সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্য৷ বরফের ফ্লেক্সগুলো হালকাভাবে দুলতে দুলতে একটু তেরছাভাবে নেমে আসছে মাটির দিকে৷ কলকাতায় থাকতে অরুণলেখার ধারণা ছিল বরফ বুঝি বৃষ্টির মতোই সোজা নামে নীচের দিকে৷ জ্যোতি ডেকে তুলেছিলেন অরুণলেখাকে।
– অরুণ, দেখবে এসো৷
স্ত্রীর চোখে হাত দিয়ে জানলার সামনে নিয়ে গিয়ে চোখ থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন হাতের চাপা৷ তখন তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এমন খুনসুটি সবসময়ই চলত৷ সামনে তাকিয়ে অরুণলেখা নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেননি যেন৷ এরকম দুলকি চালে তুষারকণারা নামে, যেন ওদের হাতে অনন্ত সময়, জানতেন না তিনি৷ ক্রমে তুষারপাত বাড়ল৷ তেরছা থেকে আর একটু খাড়াভাবে নীচে নামতে লাগল বরফের কণাগুলো৷ কিছুক্ষণ বাদে ভরিয়ে ফেলল মাটি৷ প্রথমে ক্ষীণ, তারপর ক্রমশঃ পুরু হতে লাগল বরফের আস্তরণ৷ যেন সাদা চাদর বিছিয়ে রাখা মাঠ, রাস্তা, গাড়ি, বাড়ির আনাচেকানাচে, মাথায়, সর্বত্র৷ একটু বেলা হতেই পুত্রের হাত ধরে বরফে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন তাঁরা৷ বাবাই ছোট্ট ওয়েলিংটন বুট পরে গট্ গট্ করে বরফে হেঁটে নেচেকুঁদে ভারি আমোদ পাচ্ছিল৷ অরুণলেখা ভাবলেন, সেই প্রথম তুষারপাতের অভিজ্ঞতারও পঞ্চাশ বছর হল৷ বাবাইয়ের সেই স্মৃতি মনে আছে কিনা কে জানে! অরুণলেখারই মনে হয় সেই বাড়ি, সেই তুষারপাত যেন বিগত কোনও জন্মের স্মৃতি৷
পঞ্চাশ বছর ধরে বরফ পড়া কম দেখেননি তিনি৷ এই মরশুমের প্রথম বরফ পড়ছে আজ৷ প্রতিবারই প্রথম বরফ পড়ার দিনে তাঁর ভিতরে সেই প্রথমবারের স্মৃতি উসকে ওঠে৷ প্ররোচনা দেয় পায়ে পায়ে স্মৃতির ঝরা পাতার মধ্যে পা ফেলতে৷ স্মৃতির ভিতর পা ফেলে ফেলে খুব সন্তর্পণে হাঁটতে লাগলেন অরুণলেখা৷ সীমন্তিনী কিছুক্ষণ পরে খাবার নিয়ে এসে দেখল অরুণলেখা ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ চোখ দুটো আধবোজা৷ স্বপ্নের ভিতরে হাঁটছেন অরুণলেখা৷ বাইরে ঘন হয়ে পড়া বরফ প্রতিফলিত হয়ে যেন আরও সাদা বলে ভ্রম হচ্ছে ওঁর সাদা চুলগুলো৷ যেন রূপকথার কোনও বুড়ি মৎস্যকন্যা ওই লেকের জল থেকে সদ্য উঠে এসে এলিয়ে পড়ে রঙিন এক সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে রয়েছেন৷ সীমন্তিনী ওঁর গায়ে কম্বলটা খুব সাবধানে আরও একটু ভাল করে ঢাকা দিয়ে দিল৷
৮
‘১৩৪২ সনের ১১ই কার্ত্তিক খুলনায় সেনহাটি গ্রামে আমার জন্ম হয়৷ ইংরাজিতে সেদিন ২৬ অক্টোবর৷ ১৯৩৫ সন৷ কৃষ্ণা চতুর্দ্দশীর সেই রাতে আকাশে অসংখ্য তারা ফুটিয়াছিল কিনা, ইতিহাস সে সম্পর্কে নীরব৷ তবে মধ্যরাতে চতুর্দ্দশী পার হইয়া অমাবস্যা লাগিয়াছিল৷ আমরা বরাবরের শাক্ত পরিবার৷ আমাদের বসতবাটির মধ্যে একটি ঘর আঁতুড়ঘর হিসাবে ব্যবহৃত হইতো৷ সেই ঘরে মা সন্ধ্যা হইতেই প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করিতেছিলেন৷ তুলসী ধাত্রী আসিতে আসিতে রাত দশটা হয়৷ ঠিক রাত্রি দুই ঘটিকায় আমি ভূমিষ্ঠ হই৷ সে রাত্রে মেয়েমহলে কেহ ঘুমায় নাই৷ নাড়ি কাটিবার পর আমাকে মুছাইয়া কাঁথা জড়াইয়া মায়ের সন্নিকটে দেওয়া হয়৷ সেই রাত্রে বহির্বাটিতে আমাদের পারিবারিক শ্যামাপূজা অনুষ্ঠিত হইতেছিল৷ দালানে ঠাকুর্দা এবং আমাদের জ্ঞাতিগুষ্ঠি মায়ের চরণতলে বসিয়াছিলেন৷ পরদিন প্রভাতে আলো ফুটিবামাত্র ঠাকুর্দা তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র, আমার বাবাকে লইয়া আমার মুখদর্শন করিতে আসিলেন৷ শুনিয়াছি বাবার সহিত ঠাকুর্দার এক অতি মনোজ্ঞ কথোপকথন হইয়াছিল৷ আমার ঠাকুর্দার ক্রোড়ে দেওয়া হইলে, রক্তাম্বর পরিহিত আমার ঠাকুর্দা রহস্য করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘ভূত চতুর্দ্দশীর রাতে জন্ম৷ আমাদের গৃহে বাবা ভূতনাথ আসিয়াছেন বংশধর রূপে৷ ইহার ভূতনাথ নাম হওয়াই সঙ্গত৷ আমার রবীন্দ্রভক্ত বাবা উত্তরে বলিয়াছিলেন, ‘কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার শেষে প্রথম আলোর রশ্মির মতোই আমাদের পরিবারে এই শিশু নতুন আশা-আকাঙ্খার প্রতিভূ হইয়া আসিয়াছে৷ অন্ধকারের, অশুভ শক্তি বিনষ্টির জন্য যেমন আলোকসজ্জা করিয়া দীপাবলি পালন করি, তেমনই আলোর বার্তা উহার মধ্যে৷ সুতরাং এই শিশুর নাম হওয়া উচিত জ্যোতির্ময়৷ সেই হইতে জ্যোতির্ময় নামই চলিয়া গেল৷ তবে ভূতনাথ নামটি সম্পূর্ণ বাতিল হইল না৷ আমার পরিবারের বয়স্ক লোকেরা, আমাকে ভুতু বলিয়াই ডাকিতে লাগিলেন৷’
একটা আবিষ্কারের আনন্দ থেকে বার বার রোহিণী পড়ছে লাইনগুলো৷ এত বড় একটা খাতা, সম্পূর্ণভাবে তার ডিসকভারি৷ দাদাইয়ের লেখা নিজের জীবনী৷ খাতাটা এমন জায়গায় ছিল, যেখানে ওটার থাকার কথা ছিল না৷ বেশ কিছুদিন ধরেই অরুণাভ আর জিনিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফিলাডেলফিয়ার বাড়িটা বিক্রি করে দেবে৷ কোনও তাড়াহুড়ো নেই৷ কিন্তু আস্তে আস্তে ও বাড়ির পাট গোটাবার কথা ভাবছে ওরা৷ এর পিছনে একটা বড় প্র্যাকটিক্যাল কারণ আছে৷ অরুণলেখা আস্তে আস্তে অশক্ত হয়ে পড়ছেন৷ শরীর হয়তো তেমন ভাঙেনি বরং আশি বছর বয়সের তুলনায় ভালই আছে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে৷ আগে যেমন অরুণলেখা অনেক সময় গাড়ি নিয়ে অরুণাভদের কাছে চলে আসতেন, ইদানিং তা আর পারছেন না৷ লাস্ট চেক-আপের পর অরুণাভ নিজেই লক্ষ্য করছিলেন, মায়ের মেন্টাল অ্যালার্টনেসজনিত একটা সমস্যা আছে৷ চাবি কোথায় রেখেছেন খুঁজে পাচ্ছেন না৷ জরুরি কাগজপত্র অতি সাবধানে রেখে পরমুহূর্তে ভুলে যাচ্ছেন কোথায় রেখেছেন৷ জিনিয়া যখন এসেছিল, তখন দুই ভাইবোন কথা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মাকে এখন আর বাইরের হেল্পের উপর নির্ভর করে একা রাখা ঠিক হবে না৷ অরুণাভ আর সীমন্তিনী অনেকদিন ধরেই বলে যাচ্ছিল অরুণলেখা যাতে ওদের কাছে চলে আসেন৷ অরুণলেখাই রাজি হচ্ছিলেন না৷ অত বছরের বাড়ি৷ দু-এক বছর থাকলেই মায়া পড়ে আর এতকাল এ বাড়িতে কাটিয়ে, বাবাই আর জিনি জোর করলেই তিনি এই বাড়ি ছেড়ে চলে আসবেন কী করে? এখন তিনি নিজের বাড়ি ছেড়ে ছেলের বাড়িতে থাকতে রাজি হয়েছেন বটে, কিন্তু শর্ত দিয়েছেন– মাঝে মাঝে ও বাড়িতে তাঁকে নিয়ে যেতে হবে৷ বাড়ি যে বিক্রির কথা হচ্ছে, তা এখনও অরুণলেখা জানেন না৷
জ্যোতির্ময় চলে যাবার পর শেষ সাড়ে তিন বছর সম্পূর্ণ একা কাটিয়েছেন৷ তার আগেও অনেকদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন জ্যোতি৷ তখনও সবকিছু একাই সামলেছেন৷ বাবাই বারবার আসতে বললেও লম্বা সময় কখনও নিজের বাড়ি ছেড়ে থাকেননি৷ কিন্তু এবারে আসার পর থেকেই অরুণলেখা টের পাচ্ছেন হঠাৎ বয়স থাবা বসিয়েছে তাঁর উপর৷ হঠাৎই যেন অনুভব করছেন সারা শরীর মন জুড়ে ক্লান্তি৷ এমনিতে সন্ধ্যে হলেই টিভি দেখেন অরুণলেখা৷ রাজনীতি কখনওই টানেনি তাঁকে৷ শুধু বারাক ওবামা যেবার প্রথম প্রেসিডেন্ট হলেন, সেবার কয়েকদিন মন দিয়ে যাবতীয় খবর, অনুষ্ঠান দেখেছিলেন তিনি৷ ইদানিং বেশি দেখেন ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট বা ট্র্যাভেল অ্যান্ড লিভিং৷ বাবাইদের এখানে লিভিং রুমে পুরো একটা দেওয়াল জুড়ে বিশাল টিভি৷
বাড়ি যখন বিক্রি হবেই, তখন আর পুরনো জিনিসপত্র রেখেই বা কী লাভ? কিন্তু সীমন্তিনী শোনেনি৷ অরুণাভ বা জিনির মতো বাস্তববাদী সে নয়৷ বাস্তববাদী হলে কলকাতায় তার নিজের পৈত্রিক বাড়ি অত যত্নে সে রেনোভেট করত না৷ পুরনো জিনিসের উপর সীমন্তিনীর খুব মায়া৷ তাছাড়া যদি পরে কখনও মামণি বলেন, বাবাই না হয় সব ধরে ফেলে দিল, তুমিও কি একটু ভাবলে না একটা গোটা সংসারের জিনিস হাতবদল হয়ে যাচ্ছে? সত্যিই তো অচেনা অজানা দেশে অরুণলেখা বহু যত্নে সাজিয়েছিলেন তাঁর সংসার৷ ‘খেলাঘর’ নাম দিয়েছিলেন বাড়ির। এদেশে কেউ বাড়ির নাম দেয় না৷ কিন্তু জ্যোতির্ময়-অরুণলেখা বাড়িটা কেনার সময় সামনে একখণ্ড পাথরের উপর কার্সিভ হাতের লেখায় খোদাই করিয়েছিলেন শব্দটি৷ জ্যোতির্ময়ের দেওয়া নাম৷ ভিতরে কোথাও রবীন্দ্রানুরাগের ব্যাপারটা রয়ে গেছিল৷ সীমন্তিনী তাই মাসকয়েক আগে রোহিণীকে ভার দিয়েছিলেন বাড়ির ভিতরে ছড়ানো ছিটোন কাগজ, খাতাপত্রগুলো গুছিয়ে ফেলার৷ বইগুলো যদি রোহিণী চায় নিতে পারে৷ নয়তো জ্যোতির্ময় সত্তর বছর বয়স অবধি যে ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছেন, তাদের লাইব্রেরিতেই জ্যোতির্ময় সেনের নামে ডোনেট করে করে দেওয়া হবে কয়েক হাজার বই৷ রোহিণী ঠিক করেছে বইগুলো থেকে সাহিত্যের আর ইতিহাসের বইগুলো নেবে সে৷ রণোকে জিজ্ঞেস করে দেখবে বিজ্ঞান বা ওয়ার্ল্ড মিউজিক নিয়ে বইয়ের কোনওটায় ও উৎসাহী কিনা! সবই ডিজিটালি অ্যাভেলেবল্, তাই ভবিষ্যতে সবটাই ভারচুয়াল হয়ে যাবে৷ কেউ আর বই হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখবে না৷ গন্ধ শুঁকবে না৷ সেই দিনের আর খুব বেশি দেরি নেই৷ সেই ভবিষ্যৎ দেখতে চায় না রোহিণী৷ রণো যেমন সব বই-ই কিনে পড়তে পছন্দ করে৷ রোহিণী এক ঘর আসল বইয়ের মধ্যে বসে থাকতে ভালোবাসে৷ মাম্মা কাজটা দেবার পর ও প্রায়ই ফিলাডেলফিয়ার বাড়িতে আসে৷ বই বাছার কাজটা এখনও হয়নি৷ কিন্তু কাগজপত্র, ফাইল এসব অনেকটাই অর্গানাইজ করেছে ও, কোনটা ফেলার, কোনটা রাখার৷ সেইভাবে বাছতে বাছতেই একদিন অ্যাটিকে কতকগুলো নোটবুক, পুরনো কাগজ এসবের মধ্যে থেকে এই বাঁধানো মোটা খাতাটা আবিষ্কার করেছে রোহিণী৷ পড়তে পড়তে বুঝতে পারে এটা দাদাইয়ের নিজের হাতে লেখা আত্মজীবনী৷
খাতাটা একটু অদ্ভুত৷ সাধুভাষায় লেখা বেশিরভাগ অংশ৷ যখন যেমন করে লিখতে ইচ্ছে করেছে ঠিক সেই ইচ্ছেকেই প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন জ্যোতির্ময়৷ হাতের লেখাটা মুক্তোর মতো প্রথমদিকে৷ পরে ক্রমশঃ লেখার ছাঁদটা খারাপ হচ্ছে৷ একটু কাঁপা কাঁপা৷ সোনারঙে এম্বস করা বাঁধানো খাতাটা কোথা থেকে আনিয়েছিলেন জ্যোতির্ময়, সেটাও রহস্য৷ রোহিণী দিল্লিতে মানুষ হয়েছে বলে কাজ চালানো বাংলা লিখতে শিখেছে৷ তবে সাধুভাষায় একটু ঠোক্কর খায়৷ কিন্তু এই লেখাটা ওকে আশ্চর্যরকম আকর্ষণ করেছে৷ রোহিণী এখন পা তুলে বসেছে ঘরের কোণে রাখা ইজিচেয়ারটাতে৷ এটা জ্যোতির্ময়ের লাইব্রেরি৷ দেওয়াল জোড়া র্যাকে কত বই৷ ইংরেজির পাশাপাশি বাংলার কালেকশনও ঈর্ষণীয়৷ রোহিণী জানে জ্যোতির্ময় একসময় নামকরা আর্কিটেক্ট ছিলেন৷ আর্কিটেকচারে পিএইচডি করেছিলেন ইংল্যান্ডে গিয়ে৷ ইচ্ছে করলে উনি ডিগ্রি নিয়ে স্ত্রী-ছেলেমেয়েকে নিয়ে ফিরে আসতে পারতেন কলকাতায়৷ দমদমে কোথায় যেন বাড়ি ছিল ওঁদের? ফিরলেন না কেন? কিসের তাড়না ওঁকে শেষ পর্যন্ত অ্যাটলান্টিকের এধারে এনে ছাড়ল?
জ্যোতির্ময়কে রোহিণী দু’একবার দেখেছে৷ প্রথমবার দেখেছিল একটা থ্যাঙ্কসগিভিং ব্রেকে রণো যখন ওঁকে এ বাড়িতে প্রথম নিয়ে আসে৷ একা নয়, পাঁচ-ছজন বন্ধুবান্ধবের একটা দলের সঙ্গে রোহিণীও সেবার আসে দাদাই-দিদানের বাড়িতে৷ তাদের মধ্যে রোহিণী ছাড়া অন্য সবাই ছিল অবাঙালি৷ রোহিণী বাঙালি শুনে দাদাই বিশেষ খুশি হয়েছিলেন৷ কলকাতা না হোক, দিল্লির একজন বাঙালি রণোর বন্ধুর গ্রুপে আছে বলে৷ যদিও সেবার অন্য বন্ধুরা ছিল বলে, বাংলায় কথাবার্তা বলার খুব একটা সুযোগ হয়নি৷ টুকটাক দু-একটা কথাবার্তা ছাড়া৷ দিল্লিতে ওদের কতদিন ধরে বসবাস, আদিবাড়ি কোথায় ছিল, কয় ভাইবোন ওরা– এরকম দু’একটা মামুলি প্রশ্ন করেছিলেন জ্যোতির্ময়৷ রোহিণীর বেশ মনে আছে, ওর আদিবাড়ি কোথায় ও ঠিক বলতে পারেনি৷ সেবার টার্কি রোস্ট খাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে পাশের জঙ্গলটা এক্সপ্লোর করা এসবে সময় কেটে গিয়েছিল৷ রোহিণী খুব অবাক হয়েছিল ওই বড় জঙ্গলটাও জ্যোতির্ময়দের সম্পত্তির অংশ শুনে৷ কারোর বাড়ির সঙ্গে যে এমন একটা আস্ত জঙ্গল ফ্রি হতে পারে, ধারণাই ছিল না রোহিণীর৷ সে সময়ে অনেক কিছু দেখেই বড্ড অবাক হত ও৷ যেমন রণোদের বাড়ি প্রথম গিয়ে ভীষণ অবাক হয়েছিল৷ কারোর বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া এমন একটা আস্ত লেক থাকতে পারে? লেকের মধ্যে আবার দিব্যি গাছপালা লাগানো একচিলতে একটা আইল্যান্ড? লেকটা অবশ্য মাম্মাদের একার নয়৷ এখানে একটা লেকের চারদিক ঘিরে বেশ কয়েকটা করে বাড়ি থাকে, যেগুলো লেকটার চারপাশে একটা প্রতিরক্ষা প্রাচীরের মতো ঘিরে থাকে৷ এক-একটা লেক ওই কয়েক ঘর পরিবারের নিজস্ব৷ প্রত্যেকেই তার পাশের ঘাসজমিতে বসতে পারে৷ নিজস্ব গার্ডেন চেয়ার নিয়ে যতক্ষণ ইচ্ছে৷ প্রথম যেবার মাম্মাদের বাড়ি এল, তখন লেক আর ওই ঘাসজমি দেখে ছানাবড়া হয়ে গেছিল চোখ৷ তখন অবশ্য রণোর সঙ্গে বিশেষ বোঝাপড়া খানিকদূর এগিয়েছে৷ বাবাই ওকে বুঝিয়েছিল, এইভাবে পরিকল্পনা করেই বাড়িগুলো তৈরি৷ একটা খোলা বড়ো জায়গা বেছে প্রথম মাঝখান দিয়ে লেকটা কাটা হয়৷ তারপর বাড়িগুলো তৈরি হয় তার চারপাশ দিয়ে একটু করে গ্যাপ রেখে৷ তারপর সেগুলো বিক্রির জন্য বাজারে আসে৷ ন্যাচারাল লেকের পাশেও অনেক বাড়ি থাকে অবশ্য৷ তবে সেগুলোর প্ল্যানিং আলাদা৷ বাবাই যখন একটু একটু বাংলা আর অধিকাংশ ইংরেজিতে এইসব বোঝাচ্ছিল, তখন ও অবাক হয়ে বাবাইকে দেখছিল৷ বাবাই খুব ছোট বয়েস থেকেই এখানে মানুষ৷

নিজের ভাবনার স্রোতে কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে রোহিণী৷ তার নিজেরও এই দেশে আসার প্রায় বারো বছর হতে চলল৷ এদেশ অনেককে অনেকভাবে পাল্টে দেয়৷ চলনে-বলনে, মানসিকতায়৷ রোহিণীও কি বদলে যাচ্ছে ভিতরে ভিতরে? জ্যোতির্ময় কি পাল্টে গিয়েছিলেন ভিতরে ভিতরে? চল্লিশ বছরের প্রবাস কি বদলে দিয়েছিল তাঁর খোলনলচে? জানা হয়নি উনি বেঁচে থাকতে৷ আরও একবার দেখা হয়েছিল জ্যোতির্ময়ের সঙ্গে৷ সোফোমোর নাকি জুনিয়র ইয়ারে ফল ব্রেকের সময় ওরা দিন চারেকের জন্য এসেছিল এই বাড়িতে৷ সেই সময় পুজো পড়েছিল সেবছর৷ সে বছর মাম্মা পুজোর সময় কলকাতায় ছিল৷ বাবাই চিরকালই ব্যস্ত ডাক্তার৷ সেবার রণো ঠিক করেছিল ফিলাডেলফিয়াতে আসবে ফল ব্রেকে৷ তখন রোহিণীর সঙ্গে সম্পর্ক অফিসিয়াল৷ রোহিণীও ওর সঙ্গে এসেছিল স্বাভাবিকভাবেই৷ জ্যোতির্ময় তখন রীতিমতো অসুস্থ৷ একটা ব্রেন স্ট্রোকে আংশিক চলৎশক্তিবিহীন করে দিয়েছিল ওঁকে৷ কথা জড়িয়ে গেছিল৷ অরুণলেখা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারত না কথা৷ তখন উনি কখনও ওঁর চারপাশের ঘটমান বর্তমান সম্পর্কে সচেতন থাকতেন, কখনও অন্য সময়ে সাঁতার কাটতেন৷ হঠাৎ একটা দৃশ্য মনে পড়ে গায়ে কাঁটা দিল রোহিণীর৷ ঠিক এই চেয়ারটাতেই বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল জ্যোতির্ময়কে৷ অদূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল ওরা৷ বিকেল কটা হবে তখন? রোহিণীর মনে নেই ঠিক৷ হঠাৎ খেয়াল করল জ্যোতির্ময় ঘড়ঘড়ে গলায় কিছু বলছেন৷
– কিছু বলছ দাদাই?
রণো কাছে গিয়ে একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করেছিল৷ জ্যোতির্ময় ঘোলাটে দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছিলেন,
– বলছি আ-কা-শ-প্র-দী-প৷
খুব টেনে টেনে বলছিলেন জ্যোতির্ময়৷
– উনি আজকাল ওইরকমই কথা বলেন৷
অরুণলেখা এগিয়ে এসেছিলেন এবার।
– কী বলছ?
অনেকক্ষণ চুপ করেছিলেন জ্যোতির্ময়৷ কথা বলতে কষ্ট হত খুব৷ জিভ জড়িয়ে যেত৷ অনেকক্ষণ বাদে উনি আবার টেনে টেনে বলেছিলেন
– প্রদীপ জ্বালত৷’
জ্বালত বা জ্বাল– কী বললেন ঠিক বোঝা যায়নি৷ অরুণলেখা বলেছিলেন,
– সন্ধ্যে দেবার কথা বলছ তো? সে তো রোজই দিই সন্ধ্যে পড়লে৷
অরুণলেখা ব্রাহ্ম বাড়ির মেয়ে৷ কিন্তু শ্বশুরবাড়ির কিছু কিছু সংস্কার উনি গ্রহণ করেছেন৷ তার মধ্যে একটা সন্ধ্যের সময় প্রদীপ জ্বেলে ঠাকুরের সামনে ধূপকাঠি জ্বেলে দেওয়া৷ অরুণলেখার স্টোর এরিয়াতে ছোট্ট তাকে ঠাকুর বসানো৷ ওঁর শাশুড়ির ধারা উনি এটুকু রিচুয়াল পালনের মধ্যে দিয়ে ধরে রাখতে চেয়েছেন৷ অরুণলেখার কথা শুনে সচল হাতটা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে নেড়েছিলেন জ্যোতির্ময়৷ খুব হতাশ, যেন কথাটা সঠিক বোঝাতে পারছেন না৷ তারপর সম্পূর্ণ নিঃশব্দ হয়ে গেছিলেন৷ রণো ঘাড় নাড়তে নাড়তে খুব দুঃখিতভাবে রোহিণীকে বলেছিল,
– দাদাই ফ্রিকোয়েন্টলি ফলস ইনটু শর্ট টার্ম মেমোরি ল্যাপ্স দিজ ডেজ৷
পুরো পরিস্থিতি দেখে রোহিণীরও খুব অসহায় লাগছিল৷ দু’জন নিঃসঙ্গ বৃদ্ধবৃদ্ধা৷ তাঁরা যে গল্প করে সময় কাটাবেন তারও উপায় নেই৷ একজন বলতে চেষ্টা করছেন, আর একজন প্রাণপণ বুঝতে চাইছেন৷ কিন্তু কোথাও একটা ফাঁক রয়ে যাচ্ছে৷ এরকম হওয়াটাই কি অবশ্যম্ভাবী পরিণতি? তার আর রণোর জীবন কি এমনই হবে পঞ্চাশ বছর পরে?
কারোর বাড়ির সঙ্গে যে এমন একটা আস্ত জঙ্গল ফ্রি হতে পারে, ধারণাই ছিল না রোহিণীর৷ সে সময়ে অনেক কিছু দেখেই বড্ড অবাক হত ও৷ যেমন রণোদের বাড়ি প্রথম গিয়ে ভীষণ অবাক হয়েছিল৷ কারোর বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া এমন একটা আস্ত লেক থাকতে পারে? লেকের মধ্যে আবার দিব্যি গাছপালা লাগানো একচিলতে একটা আইল্যান্ড? লেকটা অবশ্য মাম্মাদের একার নয়৷ এখানে একটা লেকের চারদিক ঘিরে বেশ কয়েকটা করে বাড়ি থাকে, যেগুলো লেকটার চারপাশে একটা প্রতিরক্ষা প্রাচীরের মতো ঘিরে থাকে৷ এক-একটা লেক ওই কয়েক ঘর পরিবারের নিজস্ব৷ প্রত্যেকেই তার পাশের ঘাসজমিতে বসতে পারে৷
আজ সেই ঘটনার পাঁচ বছর পর সেটা আবার মনে পড়ল রোহিণীর৷ দেওয়ালে টাঙানো জ্যোতির্ময়ের ছবি৷ বৃদ্ধ নয়, যুবক জ্যোতির্ময় ছবি থেকে রোহিণীর দিকে চেয়ে মৃদু হাসছেন৷ যখন প্রথম ইংল্যান্ডে যান, তখনকার ছবি এটা৷ রণোর সঙ্গে কি অসম্ভব মিল ওই যুবকের৷ শুধু রণোর গোঁফ নেই আর এটা পঞ্চাশ বছর আগের সিপিয়া রঙের ছবি, এই যা৷ রোহিণীর হঠাৎ আগাপাশতলা জানতে ইচ্ছে করছে ছবির ওই না-চেনা মানুষটিকে৷ কেমন ছিলেন যুবক জ্যোতির্ময়, যিনি তাঁর আগের জীবনের লড়াই পেরিয়ে স্বপ্নের উড়ানে পার হয়ে যান একের পর এক মহাদেশ? নতুন দেশে, নতুন মানুষদের সমাজে বসবাস শুরু হয়৷ প্রদীপ নয়, সেদিন ওই অল্পচেনা বৃদ্ধ আকাশপ্রদীপের কথাই বলতে চাইছিলেন৷ রণোর কাছে না হলেও রোহিণীর কাছে বেশ চেনা শব্দটা৷ কোথায় যেন শুনেছে৷ হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে ওর৷ একটা গান ছিল৷ ওর বাবা অমিয় খুব গাইতেন একসময় ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে৷’ সার্চ সার্চ৷ রোহিণীর মোবাইল ফোন মুহূর্তের মধ্যে ইউটিউব খুলে দিয়েছে৷ এই তো! লতার গান৷ ৫৯-এ গাওয়া৷ ‘আমার নয়ন দুটি শুধুই তোমারে চাহি, ব্যাথার বাদলে যায় ছেয়ে৷ ‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে৷’ রোহিণীর হাতে সোনার জলে বাঁধানো খাতাখানা৷ বাইরে জঙ্গলের প্রান্তসীমা দিয়ে অন্ধকার ঘনাচ্ছে দ্রুত৷ রোহিণী মনে মনে বলছে ‘তোমাকে খোঁজার জন্য যদি আমার সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরোতে হয়, আমি তৈরি৷ খাতার ক্লুটা অলরেডি পেয়ে গেছি৷ এই মিসট্রিটা, এই গোলকধাঁধার জীবন যা বেয়ে তুমি এখানে পৌঁছেছিলে, তাকে ট্রেস করতে করতে ফিরব আমি৷ একেবারে উৎস অবধি৷ ইটস্ এ চ্যালেঞ্জ টু মি’৷ ফ্রেমে বাঁধানো যুবক জ্যোতির্ময় গোঁফের ফাঁকে মুচকি হাসছেন৷ কোনও উত্তর দিচ্ছেন না৷
৯
‘Man proposes, God disposes-এর চেয়ে বড় সত্য আর কী আছে? সেনহাটির জীবন কতদিন আগে পিছনে ফেলিয়া আসিয়াছি৷ তবু এই জীবনসায়াহ্ণে পৌঁছাইয়া বারবার মনে হয় সেই স্কুল বাড়িখানি এখন কি আর আছে? গ্রামে আমার প্রপিতামহের প্রতিষ্ঠিত একটি মন্দির ছিল৷ বাসুদেব স্বপ্নে আমার পূর্বপুরুষকে বলিয়াছিলেন, সমুদ্রতটে যাইয়া আমার মূর্তি কুড়াইয়া পাইবি৷ শৈশবে পিতামহের মুখে শুনিয়াছি, সেই স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী তাঁহার পিতামহ বালু হইতে এক কষ্টিপাথরের কৃষ্ণমূর্তি খুঁজিয়া পান৷ সেই বিগ্রহ দেবজ্ঞানে পূজিত হইতে থাকেন৷ পরবর্তীকালে মন্দির নির্মাণ করিয়া বিগ্রহ ওই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ আমরা শৈশবে দেখিয়াছি, ওই বাসুদেব মন্দিরের গাত্রে এই স্বপ্ন-বাসুদেবের কাহিনী খোদাই করা রহিয়াছে৷ ভৈরব নদীর সমীপে এই মন্দিরে নিত্যপূজা হইত এবং প্রতিদিন দুইশত লোক অন্নভোগ প্রসাদ পাইত৷ ৪৩-এর মন্বন্তরের সময় এই অন্নভোগ বন্ধ হইয়া যায়৷ আমি তখন অষ্টমবর্ষীয় বালকমাত্র৷ সেসময় লোকে অনাহারে, অর্ধাহারে কোনক্রমে কালাতিপাত করিত এ আমার চোখে দেখা বোধহয়৷ অথবা পরে কথা প্রসঙ্গে একথা বড়োদের কাছে শুনিয়াছি। সেই শোনা ঘটনাই এতকাল পরে প্রত্যক্ষ করিয়াছি বলিয়া ভ্রম হয় কিনা, তাহা বলিতে পারি না৷’

এই পর্যন্ত পড়ে রোহিণী মুখ তুলে থাকাল৷ বলল,
– ডু ইউ নো দেয়ার ওয়াজ এ ফেমিন ইন ৪৩?
রণো একটু ভাবছে।
– নো, আই ডিডন্ট্৷ হোয়াই?
– কারণ দাদাইয়ের নোটবুকে ফেমিন-এর রেকর্ড আছে৷ অ্যান্ড আই অ্যাম কিউরিয়াস তোর ইন্ডিপেন্ডন্সের আগের বেঙ্গল বিষয়ে কতটা নলেজ।
রোহিণী একটু ঠাট্টার সুরে কথা বলছে, কিন্তু কথাটার মধ্যে সত্যি আছে৷ রণো যে বাঙালি হয়েও ওর নিজের দেশের ইতিহাস সম্পর্কে আদৌ ওয়াকিবহাল নয়, সেই বিষয়টা ওকে খুব ভাবায়৷ রোহিণী দেশভাগ এবং রেফ্যুজি হয়ে চলে আসা মানুষদের পুনর্বাসন নিয়ে সদ্য ডক্টরেট পেয়েছে ৷ রণো একটু ভাসাভাসাভাবে উল্টে পাল্টে দেখেছে বটে থিসিসটা৷ তবে দেশভাগ বা স্বাধীনতা নিয়ে খুব একটা উৎসাহ দেখায়নি৷ কিন্তু এবার ওকে এরকম উদাসীন আর থাকতে দেওয়া যাবে না৷ রণোর মধ্যে বাঙালি সত্তার ব্যাপারটা জাগিয়ে দেওয়া খুব জরুরি৷ রণো নিজেকে অ্যামেরিকান বলে ভাবে৷ যেহেতু ও জন্মেছে, বড় হয়েছে এখানে, হাতে গোনা কয়েকবার দেশে গেছে, সেজন্য এদেশের সংস্কৃতিই ও নিজের বলে জানে৷ বিবাহসূত্রে রোহিণীরও এখন অ্যামেরিকান পাসপোর্ট৷ কিন্তু ওর মধ্যে ভারতীয় আইডেন্টিটি তো তা বলে মুছে ফেলতে পারে না? সেটা কি আঠেরো বছর অবধি দেশে বড় হবার ফল, নাকি পার্টিশন, ট্রমা, মেমোরি, আইডেন্টিটি এসব নিয়ে পড়াশোনা করেছে বলেই ওর মধ্যে শিকড় খোঁজার বাসনা এত প্রবল, ঠিক বুঝে উঠতে পারে না রোহিণী৷ নিরন্তর একটা দোটানায় ভুগতে থাকে ও এই দ্বিধাবিভক্ত মনটা নিয়ে৷ অথচ আমেরিকার সংস্কৃতি, সমাজ সবই ওর বেশ পছন্দের জিনিস৷ এই যে কলেজে পড়ানো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইব্রেরিতে বসে থাকা, হাইওয়ে দিয়ে লং-ড্রাইভ এবং এখানকার স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপন, এসবে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে গেছে ও৷ গত দশ বছর ধরে এদেশ তার প্রাচুর্য, সুযোগ আর স্বাধীন জীবনযাপনের ম্যাজিক দেখিয়ে টেনে নিয়েছে ওকে৷ তবু জ্যোতির্ময়ের এই লেখাটা খুঁজে পাওয়ার পর থেকে কতগুলো প্রশ্ন বুকের মধ্যে বিজগুড়ি কাটছে অনবরত৷ আশি-পঁচাশি বছর আগের একটা সময় একটা জীবন ক্রমাগত মরীচিকার মতো হাতছানি দিচ্ছে ওকে৷ খাতাটা না পেলে কোনও গন্ডগোল ছিল না৷ এখন আর পরিত্রাণের উপায় নেই৷
ওর মনের অস্থিরতা বোধহয় টের পেয়েছে রণো৷ অনেকক্ষণ ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রণো কী যেন ভাবছে৷ প্রায় পাঁচ মিনিট বাদে ও বলল,
– ফর সাম টাইম ইউ আর অ্যাজ ইফ ইন এ ট্রান্স রোহিণী? ইজ দ্যা নোটবুক বদারিং ইউ দ্যাট মাচ?
রোহিণী উত্তর দিচ্ছে না৷ দশ বছর ধরে রণো দেখছে ওকে৷ ওর চোখে যে রোহিণীর ভিতরের অস্থিরতা ধরা পড়বেই, তা খুব স্বাভাবিক৷ রণো আবার বলল,
– ডোন্ট লেট ইয়োরসেল্ফ বি ক্যারেড অ্যাওয়ে বাই দিজ চান্স এনকাউন্টার অফ দ্যাট নোটবুক৷ ওটা তো হিডেনই থেকে যেতে পারত৷ এখন একটু রিল্যাক্স কর৷ চল বেরবে? সাম ফ্রেশ এয়ার মাইট হেল্প ইউ৷
রোহিণী ঘাড় নাড়ছে।
– নাঃ ডোন্ট ফিল লাইক গোইং আউট৷ কিন্তু রণো…
ও একটু ভাবছে কীভাবে বলবে বিষয়টা।
– ইট ইজ মাই জার্নি৷ কখনও কখনও একটু হেল্প চাইব তোর কাছে৷ নাউ দ্যাট আই হ্যাভ ডিসকভার্ড দিস নোটবুক, আই ক্যান নট উইশ ইট অ্যাওয়ে৷ এখন তো আমিও তো আ পার্ট অফ ইওর ফ্যামিলি , আমার একটা কমিটমেন্ট রয়েছে এটা এক্সপ্লোর করার৷
– অফকোর্স আই উইল হেল্প ইউ, বাট হাউ? কী এক্সপ্লোর করবে তুমি?
রণো একটু কনফিউজডভাবে বলছে৷
– একটা অচেনা লোককে৷ তোর দাদাই৷ জ্যোতির্ময় সেনের গোটা ট্রাজেকটরিটা বুঝতে হবে আমাকে৷ তুই হয়তো ঠিক বুঝতে পারবি না, হিস্ট্রির স্টুডেন্ট হিসেবে আমার একটা দায় আছে, নিজের কাছে দায়৷ সেই ভৈরব নদীর ধারে সেনহাটিতে যে জীবনটার শুরু, সে কোন পরিস্থিতি আর ঘটনার মধ্যে দিয়ে ভাসতে ভাসতে আসছে উদ্বাস্তু হয়ে, তারপর আবার নতুন জার্নি, ইংল্যান্ড ঘুরে অ্যাটলান্টিক পাড়ি দিয়ে থিতু হচ্ছে অন্য এক নতুন মহাদেশে৷ এই গোটা জীবনটাকে বুঝতে হবে রে আমার৷
না, এত কথা মুখে বলে না রোহিণী৷ ও শুধু একটু হাসে রহস্যময়ী অচেনা এক নারীর মতো৷ তারপর মুখে বলে
– বলব৷ তোকে সব বলব৷ তুই শুধু একটু পাশে থাকিস৷ (চলবে)
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৪ অগস্ট ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Artzolo, Saatchi Art, Pixels
অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।
4 Responses
ভালো লাগছে খুব। গল্প এগোনোর অপেক্ষায় আছি।
থ্যাংক ইউ!
আগের 2 পর্বের চাইতেও ইন্টারেস্টিং এই পর্ব।ঘটনার সূত্রগুলো পাক খেয়ে সব দানা বাঁধতে শুরু করেছে।মনে হচ্ছে প্রিন্ট আউট নিয়ে ফাইল বন্দী করে পড়লে বেশী উপভোগ্য হয়ে উঠবে আমার কাছে।আর একটু চরিত্র সূচি ও তাদের কানেক্টিভিটিও বানানো দরকার, উপভোগ্যতা বাড়ানোর জন্য।
থ্যাংক ইউ! ভাল লাগছে জেনে দারুণ লাগছে। আমি ফ্যামিলি ট্রি ইচ্ছে করেই দিইনি, কারণ সম্পর্কগুলোর মধ্যে একটা রহস্য আছে, সেটা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হওয়াই ভাল।