banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

উপন্যাস: আকাশপ্রদীপ: পর্ব ১

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

New Bengali Novel
সীমন্তিনী অনেক কথা ভাবছিল

প্রবাসের পটভূমিকায় লিখিত বলে উপন্যাসে ইংরিজি সংলাপ ও শব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে। 

পুঁইশাকগুলো লতিয়ে নেমেছে সামান্য ঢালু হয়ে আসা চালের উপর৷ সীমন্তিনীদের কলকাতার এই বাড়িটা খুবই অভিনব৷ সীমন্তিনীর প্রপিতামহের তৈরি এই বাড়ি প্রায় একশো বছরের পুরনো৷ আগেকার দিনের মানুষের দিল বড় হত৷ বাড়িটাও হৃদয় দিয়ে বহু যত্নে তৈরি করেছিলেন রায় বাহাদুর দুর্গাশরণ রায়৷ বাড়িটার সিলিংগুলো উঁচু উঁচু৷ কড়িবরগা পুরু ইঁটের দেওয়াল- বাড়িটা নিজেই যেন একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যক্তি৷ সীমন্তিনীর অন্তত সেইরকমই মনে হয়৷ আচ্ছা দুর্গাশরণের ব্যক্তিত্বও কি এমনই ছিল? জানে না সীমন্তিনী৷ জানার আর কোনও উপায়ও নেই৷ সময় থাকতে থাকতে যদি জিজ্ঞেস করে নেওয়া যেত বাবাকে বা ঠাম্মাকে! আজকাল শৈশব-কৈশোর মুহূর্তগুলি নিবিড় আর্তিতে আর একবার ফিরে পেতে চায় সীমন্তিনী৷ বয়স হবার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আশ্লেষে জড়িয়ে নিতে চায় নিজের ছড়িয়ে ফেলা জীবনটা- শীতের দিনে ওম্‌ ধরা আলোয়ানের মতো৷

দোতলার ছাদে বসে লতিয়ে আসা পুঁইলতাগুলোর দিকে তাকিয়ে সীমন্তিনী অনেক কথা ভাবছিল৷ প্রায় সন্ধ্যে হব হব৷ শীতের বেলা ছোট৷ অল্পেতেই ফুরিয়ে যায়৷ সীমন্তিনীর এই বাড়ি পৈত্রিক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত৷ বাস্তবিক, বাড়িটা প্রায় চার কাঠা জায়গা নিয়ে তৈরি হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে একসময় বেশ জরাজীর্ণ হয়ে গিয়েছিল৷ একবার তিন বছরের ব্যবধানে দেশে ফিরেই সীমন্তিনী আর অরুণাভর মনে হয়েছিল, সম্পূর্ণ ভাঙাচোরা হয়ে প্রোমোটারের দখলে চলে যাবার আগেই বাড়িটাকে সারানো দরকার৷ সেইবারই অরুণাভ কলকাতা কর্পেরেশনের রেজিস্টার্ড আর্কিটেক্টকে দিয়ে বাড়ির সংস্কারের ব্যবস্থা করে৷ দোতলা বাড়ির ছাদে উত্তরের অংশে ঘর তোলার পরিকল্পনা তখনই করা৷ পুবের দিকে বেশ কিছুটা জমি ছিলই৷ সেই জমিতে অল্প অল্প করে মাটি ফেলে গাছ লাগিয়ে শুরু হল বাগান করা৷ দোতলা আর তিনতলার ছাদেও টব সাজিয়ে ছাদ-বাগান৷ বরাবর বাগানের খুব শখ সীমন্তিনীর৷ 

বাড়িটায় তলভাঙার একটা খেলা আছে৷ দেড়তলার একটা উন্মুক্ত চাতাল, আড়াইতলার ছোট ছিমছাম স্টাডি এবং তিনতলার নিচু সিলিংয়ের এই ঘরের পরিকল্পনা, সবই সীমন্তিনীর মাথা থেকেই বেরিয়েছিল৷ সেবার দেশের এই বাড়ি সারানো নিয়ে বেশ অবসেসড্‌ হয়ে গেছিল ও৷ যেন একশো বছরের বাড়িটাকে নতুন সাজসজ্জা পরিয়ে, রং মাখিয়ে, কচি কচি দেখাবে৷ অবশ্য তার জন্য বাড়ির মূল কাঠামো দরজা-জানালা কিছু বদলানো হয়নি৷ সেই আগেকার খড়খড়ি দেওয়া জানালা, ডোরিক স্থাপত্যের থাম, সব রয়েছে আগেকার মতোই৷ ভিতরের স্টাইলে কিছু কিছু বদল ঘটেছে৷ দুটো ঘর ভেঙে একটা হলঘর হয়েছে৷ অতিথি আপ্যায়নের জন্য৷ অতিথি বলতে অল্প কিছু আত্মীয়স্বজন৷ সীমন্তিনীর পিসির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কালেভদ্রে যোগাযোগ ছিল পিসি বেঁচে থাকতে৷ এখন সবই ছাড়া ছাড়া৷ ছাদের ঘরটার লাগোয়া ঢাকা বারান্দা, যেখান থেকে ছাদে আসার পথ৷ ঢাকা বারান্দার ছাদের শেডে পুঁইশাকের ডাঁটা নামিয়েছে কবিতা আর রাইমা৷ গ্রামের মেয়ে ওরা৷ গাছপালার জন্য দরদ ওদের সহজাত৷ ওদের উপরই এখন বাড়ির যাবতীয় ভার৷ ওরা যদি ঠিকভাবে দেখাশুনো না করত, তবে কার ভরসায় সাধের বাড়ি রেখে যেত সীমন্তিনী!

– দিদি চা খাবেন আরেকবার?
কবিতা তিনতলার ঘরের জানালা বন্ধ করতে এসেছে৷ যদিও সীমন্তিনীর কলকাতার শীত এখন আর বিশেষ গায়ে লাগছে না৷ কিন্তু শীতকালে মশার উপদ্রব একটু বাড়ে৷ তাই শীতকালে পাঁচটা নাগাদ সন্ধ্যে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জানালা দরজা নিয়ম করে বন্ধ করা হয়৷
– নাঃ, এখন আর চা খাব না৷ সন্ধ্যেয় একটু বেরব৷ লাল্টুবাবুকে আসতে বলেছি৷ 

Old Building of Kolkata
বাড়ির মূল কাঠামো দরজা-জানালা কিছু বদলানো হয়নি

লাল্টু এই বাড়ির অনেকদিনের ড্রাইভার৷ সীমন্তিনীর বাবার আমলে তরুণ লাল্টু বাড়িতে গাড়ি চালাতেন৷ কাছেই থাকেন৷ সীমন্তিনীর বাবার এই এলাকায় ডাক্তার হিসেবে বেশ ভাল পসার ছিল৷ বাবার ফাইফরমাশ খাটা, ছোটখাটো সাহায্যের কাজও দিব্যি শিখে নিয়েছিলেন। এখন লাল্টুবাবুও অবসরজীবন যাপন করছেন৷ তাঁর দুই ছেলেই সুপ্রতিষ্ঠিত৷ উদ্বাস্তু হয়ে সত্তরের দশকে চলে আসে লাল্টুবাবুর পরিবার৷ এখানে ওখানে ভাসতে ভাসতে নেহাতই তরুণ লাল্টু রায় পরিবারে আশ্রয় পেয়েছিলেন৷ লাল্টু অকৃতজ্ঞ নন৷ এখন নিয়মিত গাড়ি না চালালেও, সীমন্তিনীরা এলে দরকার পড়লেই লাল্টুদা আসেন৷ বছর দুয়েক হল একটা ছোট গাড়ি কলকাতায় ব্যবহারের জন্য কিনে রাখা হয়েছে৷ সীমন্তিনীরা কলকাতায় আসার আগে, ব্যাটারি চেক করে যাবতীয় দেখভাল করে রাখে লাল্টু৷ এবার লাল্টুদা যেন আরও একটু বুড়ো হয়ে গেছে৷ চুল সম্পূর্ণ পাকা৷ ছোটখাটো চেহারাটা আরও যেন শীর্ণ, দড়িপাকানো৷ পিছনের সিটে বসে সীমন্তিনী আড়চোখে লক্ষ্য করছে লাল্টুকে৷
– লাল্টুদা, চুলগুলো এরকম সাদা হয়ে গেল কী করে? আগেরবার তো দেখলাম অল্প পাকা ছিল৷’
অকৃত্রিম বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করছে সীমন্তিনী৷ 
– চুলের আর কি দোষ বল বনু? বয়স তো নয় নয় করে কম হল না৷
লাল্টুদা একগাল হাসছে৷
– সামনের চৈত্রে সত্তর পেরবে৷
– সত্যি! তোমাকে দেখে মনে হয় না তো একদম!
– বয়স যে কীভাবে চলে যায় বনু৷ আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না৷ মনে হয় এই তো সেদিন শহিদনগরে রিফিউজি হয়ে টিনের চালের ঘরে এলাম৷ কতটুকুই বা বয়স তখন? মা লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করত৷ পাড়ার এক দাদাকে ধরে ড্রাইভিংটা শিখে নিয়েছিলাম৷ তারপর সেই যে তোমাদের দরজায় কী ভাগ্যে পৌঁছে গেলাম, ফটিকদাই নিয়ে গেছিল৷ আর আমার মুখটা দেখে ডাক্তারবাবুর যে কী দয়া হল৷ কী থেকে কী হল, সংসারটা ভেসে যেতে গিয়েও গেল না৷ 

গাড়ি চালাতে চালাতে পুরো স্মৃতিমেদুর ভঙ্গিতে কথা বলছে লাল্টুদা৷ ডাক্তারবাবু মানে সীমন্তিনীর বাবা অম্বিকাচরণ৷ তিনি ছিলেন দরাজহৃদয়৷ সীমন্তিনীর প্রপিতামহ দুর্গাশরণ রায় যখন কলকাতায় এসে এই বসতবাটিটি তৈরি করেন তখন তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল সব আত্মীয়কুটুম্বের জন্য এই বাড়ির দরজা খোলা রাখা৷ সীমন্তিনীর বাবাদের যৌবনে এ বাড়িতে মানুষজনের আনাগোনা লেগেই থাকত৷ দু’বেলা যৌথ পরিবারে পঞ্চাশ-ষাট জন লোকের পাত পড়ত৷ সীমন্তিনী আন্দাজ করতে পারে দুর্গাশরণের ঔদার্য এবং আভিজাত্য উত্তরাধিকারসূত্রে তার বাবা অম্বিকাচরণ রায়ও পেয়েছিলেন৷ দেশভাগ হয়ে যখন দলে দলে মানুষ এপারে আসতে থাকেন, তখন অম্বিকা স্কটিশ চার্চ কলেজে আইএসসি-র ছাত্র৷ শিয়ালদা স্টেশনে দলে দলে রিফিউজিরা আশ্রয় নিলে, তিনি সহপাঠীদের সঙ্গে দল বেঁধে গিয়েছেন তাদের তত্ত্বাবধান করতে, সে গল্প শৈশবে সীমন্তিনী অনেকবার শুনেছে৷

গড়িয়াহাটে গিয়ে টুকিটাকি কয়েকটা বাজার করল সীমন্তিনী৷ বাড়ির ছাদে কাপড় শুকোবার ক্লিপ, কবিতারা অনেকবার বলে দিয়েছে। এক বান্ডিল দড়ি, রণো আর অরুণাভর জন্য পাজামা, গেঞ্জি, দু-একটা টেবিল-ঢাকা, এসব গড়িয়াহাটের ফুটপাথে কিনে অদ্ভুত তৃপ্তি পায় ও৷ বস্টনে দোকানে গিয়ে সে সুখ নেই৷ কী ভেবে ফ্যাব ইন্ডিয়া আর বাইলুম ঘুরে গোটা পাঁচ-ছয় সালোয়ার কামিজ কিনে ফেলল রোহিণী আর তার নিজের জন্য৷ 

রোহিণী আর রণোর বিয়ে হয়েছে বছরখানেক৷ যদিও তার বহু আগে থেকেই ওরা এক ছাদের তলায় বসবাস করছে৷ সীমন্তিনী আর অরুণাভ এই ব্যাপারটা নিয়ে বহু ভেবেছে, তবু এই বিয়ের আগেই একত্রে থাকার ব্যাপারটায় দোষের কিছু পায়নি৷ তবু ব্যাপারটা ওরা পাঁচকান করেনি৷ তাহলেই ফিসফাস শুরু হয়ে যেত৷ রোহিণীর বাড়িতে অবধি কিছু জানত না৷ রোহিণীরা প্রবাসী বাঙালি৷ দিল্লিতে চিত্তরঞ্জন পার্কের বাসিন্দা৷ ওদের ধরনধারণ সবেতেই একটু প্রবাসের ছাপ৷ এই যে বিয়েতে এত শাড়ি পেল রোহিণী, তার অর্ধেকও এখনও ভাঙেনি বোধহয়৷ সীমন্তিনী ঠিক করেছে রোহিণীকে আর কখনও শাড়ি দেবে না৷ যা সব সময় পরে, প্যান্টস্‌ বা ড্রেস, তাই দেবে৷ সীমন্তিনী আজ গড়িয়াহাট বাজার থেকে আরও একটা জিনিস কিনেছে৷ ইলিশ মাছ৷ এই শীতে ইলিশের স্বাদ ভাল হয় না৷ কিন্তু কীই বা করা যাবে? শুধু জমিয়ে ইলিশ খাবার জন্যই বর্ষায় কলকাতায় আসা বিশেষ হয়ে ওঠে না৷ বেশিরভাগ শীতেই আসে ওরা৷ কখনও কখনও অরুণাভও আসে৷ তবে ওর কলকাতার জন্য টান নেই খুব একটা৷ ওর ছোটবেলায় ওর বাবা গবেষণার কাজ নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিলেন৷ তারপর পাড়ি জমান আমেরিকা৷ 

অরুণাভর বাবা মারা গেছেন বছর দু’য়েক হল, তবে মা আছেন৷ অরুণাভ আর সীমন্তিনীর থেকে পাঁচ ঘণ্টার ড্রাইভিং দূরত্বে থাকেন উনি৷ সীমন্তিনী মনে মনে খুব অ্যাডমায়ার করে ওর শাশুড়িকে৷ এই বয়সেও ড্রাইভ করে চলে আসেন ওদের কাছে৷ হঠাৎ মনে পড়তে একটা গাদোয়াল শাড়িও কিনে ফেলল সীমন্তিনী, শাশুড়ির জন্য৷ কালো জরিপাড়, ঘিয়ে রঙের জমি৷ চমৎকার মানাবে ওঁকে৷ সব সেরে বাড়ি ফিরতে প্রায় সাড়ে ন’টা বেজে গেল৷ ইলিশ মাছটা দু-চার জনের পক্ষে একটু বেশিই কেনা হয়ে গেছে৷ গাড়ি গ্যারাজে ঢুকিয়ে লাল্টুদা যখন চাবি রাখতে এল, তখন কয়েকটা মাছের টুকরো আলাদা করে লাল্টুদাকে দিয়ে দিল সীমন্তিনী৷ ইলিশ মাছ দেখে লাল্টুর মুখে হাসি আর ধরে না৷
– বনু, একবার জুলাই অগাস্টে এসো, ডায়মন্ড হারবারে পাইকারি বাজারে গিয়ে ইলিশ মাছ কিনে আনব৷ দামে অনেক সস্তা৷
– ফ্রেশ ধরা বলে স্বাদও নিশ্চয়ই বেটার হয়?
সীমন্তিনী শুধোয়৷ 
– অনেক বেটার৷ তবে আমাদের সেই পদ্মার ইলিশের ধারে কাছে লাগে না৷ বুঝলে বনু? সেই কোন দুধের বয়সে খেয়েছি, স্বাদ যেন এখনও মুখে লেগে আছে৷ 

ডাক্তারবাবু মানে সীমন্তিনীর বাবা অম্বিকাচরণ৷ তিনি ছিলেন দরাজহৃদয়৷ সীমন্তিনীর প্রপিতামহ দুর্গাশরণ রায় যখন কলকাতায় এসে এই বসতবাটিটি তৈরি করেন তখন তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল সব আত্মীয়কুটুম্বের জন্য এই বাড়ির দরজা খোলা রাখা৷ সীমন্তিনীর বাবাদের যৌবনে এ বাড়িতে মানুষজনের আনাগোনা লেগেই থাকত৷ দু’বেলা যৌথ পরিবারে পঞ্চাশ-ষাট জন লোকের পাত পড়ত৷ সীমন্তিনী আন্দাজ করতে পারে দুর্গাশরণের ঔদার্য এবং আভিজাত্য উত্তরাধিকারসূত্রে তার বাবা অম্বিকাচরণ রায়ও পেয়েছিলেন৷ দেশভাগ হয়ে যখন দলে দলে মানুষ এপারে আসতে থাকেন, তখন অম্বিকা স্কটিশ চার্চ কলেজে আইএসসি-র ছাত্র৷ শিয়ালদা স্টেশনে দলে দলে রিফিউজিরা আশ্রয় নিলে, তিনি সহপাঠীদের সঙ্গে দল বেঁধে গিয়েছেন তাদের তত্ত্বাবধান করতে…

পদ্মার ইলিশের স্মৃতি উথলোচ্ছে লাল্টুর মনে৷ ঘাড় নাড়তে নাড়তে ইলিশের বাটি নিয়ে চলে যায় ও৷ সীমন্তিনীর করুণা হয় একটু৷ পদ্মার ইলিশের স্মৃতি বোধহয় মনে থাকা সম্ভব নয় লাল্টুর৷ যখন ওরা ছিন্নমূল হয়ে আসে তখন লাল্টু বালক মাত্র৷ তারপর নিশ্চয়ই অভাবের সংসারে স্মৃতিচারণা হত পদ্মার ইলিশের৷ বড়দের মুখে শুনে সেই স্মৃতিই ওর মাথায় কোষে কোষে ঢুকে গেছে৷ দেশভাগের পরের সেই মানুষগুলোর ভাবনাচিন্তা, অনুভূতিগুলো ধরে রাখার জন্য আজও তেমন কোন আর্কাইভ নেই৷ খাওয়ার পর শুতে দশটা বেজে গেল৷ তিনতলার ঘরে হাল্কা করে রবিশংকরের বাজনা চালিয়ে শুয়ে পড়েছে সীমন্তিনী৷ কালকে উঠে একবার এয়ার ইন্ডিয়া অফিসে টিকিট কনফার্মেশনের জন্য ফোন করতে হবে৷

(২)

অ্যান্টনি হরোউইটজ-এর ‘দ্য সেনটেন্স অব ডেথ’-এর শেষ কয়েকপাতা রুদ্ধশ্বাসে পড়ে চলেছেন অরুণলেখা৷ অরুণলেখা সেন৷ থ্রিলার, বিশেষত এরকম টানটান থ্রিলারের মধ্যে বেশ একটা উত্তেজনা আছে৷ শেষ অবধি কী হল, অপরাধীর পরিচয় পাঠক যা ভাবছিল, সেটাই মিলল কিনা, এসব উন্মোচন করার মধ্যে একটা মজা আছে৷ এই বয়সেও যে কোনও ভাল থ্রিলার অরুণলেখার অতি প্রিয়৷ অবশ্য বুড়ো বয়সে এসে এই বাতিকের জন্ম হয়নি৷ গোড়া থেকেই ছিল রক্তের মধ্যে৷ প্রথম প্রথম বিলেতে গিয়ে টেলিভিশনে যে কোনও থ্রিলার হলেই স্বামী-স্ত্রী জমিয়ে বসে পড়তেন, বাবাইকে ঘুম পাড়িয়ে৷ সেটা সাতের দশকের গোড়ার দিক৷ কলকাতায় তখনও টেলিভিশন আসেনি৷ তাই প্রথমদিকের বিলেতবাস পর্বে বিবিসি ওয়ান বা বিবিসি টু-তে রহস্যে মোড়া সিনেমা দেখার মজাই ছিল আলাদা৷ জ্যোতির্ময় অধিকাংশ সময়েই ঘুমিয়ে কাদা– আর তিনি গোল গোল চোখ করে রুদ্ধশ্বাসে দেখে চলেছেন রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনি! হিচককের সব সিনেমাই বারবার দেখেও আশ মিটত না৷ এখনও অরুণলেখা চোখ বুজলেই অনায়াসে চলে যেতে পারেন ওই দিনগুলোতে, যখন চেস্টারটন রোডের সেই ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে ঘনিয়ে আসছে রাতের আঁধার, পথের ঝোলানো আলোর বিচ্ছুরণ হচ্ছে ক্যাম নদীর জলে, নদীর উপরে ফুটব্রিজে কমে এসেছে মানুষের আনাগোনা, লিভিং রুমের ডিভানে বাবাইয়ের ফুলের মতো মুখখানা একটু অস্পষ্ট, ওপাশে আধশোয়া হয়ে জ্যোতি ঝিমোচ্ছেন, আর ঘর অন্ধকার করে কোণের সাদাকালো টিভি-সেটের সামনে নিবিষ্ট হয়ে অরুণলেখা দেখে চলেছেন গ্যাসলাইট, ভার্টিগো, বা দ্য ম্যান হু নিউ টু মাচ।

জ্যোতির্ময় খুব ঠাট্টা করতেন৷
– অরুণের কী পছন্দ জান তো? গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আততায়ী গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে, অরুণ বলছে – বাঃ বাঃ৷ এবার আততায়ী এসে নিরীহ মেয়েটাকে খুন করে গাড়ির বুটে ভরে দিল৷ অরুণ বলল – দারুণ তো? কিংবা নৃশংস হেসে কিলার মৃতের দেয়ালে বাণী লিখে চলেছে, অরুণের চোখে মুখে স্বর্গীয় আভা৷
বন্ধুদের রসিয়ে রসিয়ে বলতেন জ্যোতির্ময়৷ 
– তুমি এসব দেখ কখন? সিনেমাই বলো বা আমার রিঅ্যাকশন? সবসময়ই তো দেখি বাবাইয়ের পাশে মটকা মেরে শুয়ে আছ৷
অরুণলেখা প্রতিবাদের চেষ্টা করতেন৷
– ওই তো! যা দেখার, যেটুকু দেখার, ওর মধ্যেই দেখে নিই৷ সব জিনিস চোখ খুলে দেখার দরকার হয় না৷
মিটিমিটি হাসতেন জ্যোতির্ময়৷ জমিয়ে আড্ডা দেওয়ায় জ্যোতির জুড়ি ছিল না৷ সেই আমুদে স্বভাবটা বাবাইও একটু পেয়েছে৷ জিনিটা আবার সম্পূর্ণ বিপরীত৷ ভীষণ সিরিয়াস৷

দ্য সেনটেন্স অব ডেথ শেষ করে অরুণলেখা বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ৷ এই এলাকাটা বড্ড নিস্তব্ধ, শুনশান, পাতা পড়লেও যেন আওয়াজ শোনা যায়৷ এখন অবশ্য পাতা পড়ার দিনও শেষ, শুধু বরফ চারিদিকে৷ মাঝে মাঝে মনে হয় এই শীতঋতু বুঝি অনন্ত৷ চারপাশে যতদূর চোখ যায় শুধু বরফ৷ রাস্তাগুলো বরফের চাদরে মোড়া৷ বাইরে থাকা গাড়িগুলোতে বরফের আস্তরণ৷ গাছের মাথাগুলো তুষারাবৃত৷ অরুণলেখাদের বাড়ির পাশে একটা এক একরের জঙ্গল আছে৷ সেখানে গাছেরা সবাই পর্ণমোচী নয়৷ এই জঙ্গলও তাঁদের বাড়ির লাগোয়া সম্পত্তি৷ অরুণলেখা ছোটবেলায় শান্তিনিকেতনে বড় হয়েছেন৷ দ্বারন্দার পাশে ইলামবাজারের জঙ্গল ছিল বটে, কিন্তু সেই জঙ্গল কেনার চিন্তা মাথায় আসত না৷ এখানের দর্শন সম্পূর্ণ আলাদা৷ অর্থ থাকলে বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি কেনা যায়৷ কেনা যায় আস্ত একটা দ্বীপ৷ ধনী আমেরিকানরা কী যে কিনতে পারে আর কী পারে না, সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই অরুণলেখার৷ বর্তমান প্রেসিডেন্ট কিছুকাল আগে ডেনমার্ক সফরে গিয়ে গ্রিনল্যান্ডটা কিনতে চেয়েছিলেন৷ তাতে ডেনমার্ক বলেছিল– সরি, গ্রিনল্যান্ড ইজ নট অ্যাভেলেবল্‌ ফর সেল৷ কথাটা মনে পড়ায় নিজের মনেই একচোট হাসলেন অরুণলেখা৷

চেস্টারটন রোডে ট্রিনিটি কলেজের সেই অ্যাপার্টমেন্টটায় কাচের জানালার বাইরে বরফের চাঁই জমে থাকতো৷ কোনওটা উপর থেকে নীচে ঝুলত, কোনওটা নীচ থেকে উপরে উঠত৷ ছোট্ট বাবাই নিজের খেয়ালে স্ট্যালাগটাইট, স্ট্যালাগমাইট বলে বলে সারা ঘর ঘুরে বেড়াত৷ জিনি জন্মেছিল অমনই এক শীতের দিনে, যখন সামনের একচিলতে নদীটা সম্পূর্ণ জমে গেছে৷ সে বছরই জমা নদীর উপর খেলাচ্ছলে হাঁটতে গিয়ে একজন ছাত্র মারা যায়৷ উপরের বরফের আপাত-নিশ্ছিদ্র আস্তরণকে ভেদ করে তলার বরফঠান্ডা জলের মধ্যে তলিয়ে গিয়েছিল সে৷ তার দু’দিন বাদেই ঠান্ডাটা আশ্চর্যরকম কমে এল৷ ফেব্রুয়ারীর শীতশেষের এক ভোরে পৃথিবীর আলো দেখল জিনি৷ অ্যাডেনব্রুকস্‌ হাসপাতালের একটি উইং, রোজি হসপিটালের দোতলায় কাচের ঘরে অরুণলেখাকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল৷ পাশের কটে নবজাতিকা৷ জ্যোতি বাবাইকে নিয়ে বসেছিলেন খাটের পাশে৷ বাইরে নীচে বরফ ভেদ করে নরম সবুজ কার্পেটের মতো ঘাস উঁকি মারছিল কোথাও৷ বাবাই অবাক হয়ে কুঁকড়ে ঘুমিয়ে থাকা বোনের দিকে তাকিয়ে বলেছিল
– ক্যান আই টাচ দ্যা ডল?
জ্যোতি বলেছিলেন
– আফটার শি গেট্‌স ব্যাক হোম৷ অ্যান্ড শি ইজ নট অ্যা ডল৷ শি ইজ ইয়োর সিস্টার৷
– হোয়াট শ্যাল আই কল ইট? রোজি, অ্যাজ ইন দ্যা হসপিটাল?
– উই উইল নেম হার জিনিয়া- দ্য নেম অফ আ ফ্লাওয়ার!
– ইয়েস, জিনিয়া, দ্যাট্‌স গুড৷ উই ক্যান কল হার জিনি ট্যু, দ্যা লিটিল জিনি অফ আলাদিন৷

জ্যোতি আর অরুণলেখা হাসছিলেন৷ জ্যোতি অরুণলেখাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন
– তোমার পছন্দ হয়েছে তো নাম? তোমার টবের বাগানে তো জিনিয়া ছিল না৷ এবার জিনিয়া আমাদের আসন্ন বসন্ত দিনের বার্তা বয়ে নিয়ে এল৷
খুব সুন্দর করে কথা বলতেন জ্যোতির্ময়৷ ভিতরে কোথাও একটা কাব্যিক মেজাজ ছিল৷ সেই থেকে জিনিয়া৷ জিনিয়া থেকে জিনি৷ ডাক নামটা জিনিই হয়ে গেল বাবাইয়ের কল্যাণে৷ প্রথম বিদেশের মাটিতে পা রাখেন ছ’বছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে৷ তিন বছরের মাথায় জিনি এল৷ তাদের পরিবারের বৃত্তটি সম্পূর্ণ হল৷ অন্ততঃ অরুণলেখার তাই মনে হত৷ তারপর বহুকাল গড়িয়ে গেছে৷ পরিবার, সংসার সম্পর্ক কোন কিছুই আর ধ্রুবসত্য নয়– সময় নিপুণ হাতে ঘাড়ে ধরে বুঝিয়েছে তাঁকে৷ একসময় যেসব জিনিস আঁকড়ে ধরে বেঁচেছিলেন, তারা কবে যেন দূরতর হয়ে কক্ষচ্যুত হয়ে বেরিয়ে গেছে তাঁর আকর্ষণ থেকে৷ একসময় জ্যোতির্ময়কে ছাড়া একটা দিনও থাকার কথা ভাবতে পারতেন না৷ এখন তো তিনবছর হল জ্যোতি ছাড়াই এতবড় বাড়িতে তিনি আছেন৷ একাই। বাবাইরা অবশ্য অনেকবারই বলেছে ওদের কাছে গিয়ে থাকার জন্য৷ জ্যোতির্ময় থাকতেও বলত, আর এখন তো প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই অরুণলেখাকে নিয়ে মহা চিন্তা ওদের৷ বিশেষ করে সীমন্তিনীর৷ বড় ভাগ্য করে এই মেয়েটিকে পুত্রবধূ হিসেবে পেয়েছেন তিনি৷ সবই মহারাজের কৃপা৷ বড় আন্তরিক মেয়েটা৷ এক একবার মনে হয় ভাগ্যচক্রে যদি আমেরিকায় এসে সংসার না পাততেন, তবে এত ভাল সম্পর্ক হত না তাঁর ছেলের বউয়ের সঙ্গে৷ দেশের আর পাঁচটা শাশুড়ি বউয়ের মতো তাঁদেরও হয়ত নিত্য কোন্দল লেগে থাকত৷ 

london-house
চেস্টারটন রোডে ট্রিনিটি কলেজের সেই অ্যাপার্টমেন্টটায় কাচের জানালার বাইরে বরফ জমে থাকত

বস্তুত অনেক বছর দেশে যাননি অরুণলেখা৷ একসময় শান্তিনিকেতনের ‘পূবালী’ বাড়ির চৌহদ্দি ছিল তাঁর দেশে ফেরার আকর্ষণ৷ তারপর বছর কয়েক দমদমের পাড়ায় শ্বশুরের ভিটেতে কেটেছে৷ ওখানেই বাবাইয়ের জন্ম৷ তারপর জ্যোতির সঙ্গে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বছর পাঁচেকের বিলেতবাস৷ আর তারপর দিশাহীন নাবিকের মতো লগি ঠেলতে ঠেলতে এই সবপেয়েছির দেশে আসা৷ ইংল্যান্ডে থাকার সময়ই কলকাতার চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছিলেন জ্যোতি৷ বাস্তবিক, ইংল্যান্ডবাসই তাঁদের পরিবারটিকে অনেক বদলে দেয়৷ বদল ঘটেছিল মানসিকতায়৷ জ্যোতি তাঁর কৈশোর থেকেই ছিন্নমূল হবার যন্ত্রণা জানতেন৷ তাঁদের উদ্বাস্তু পরিবারটি সব হারিয়ে একবস্ত্রে হয়তো আসেনি৷ স্বাধীনতার কিছু আগেই সরকারি চাকরিতে ইন্ডিয়ার অপশন দিয়ে মানে মানে পাততাড়ি গুটিয়েছিলেন খুলনার সেনহাটি গ্রাম থেকে৷ ৪৭-এর আগে এসেছিলেন বলেই হয়তো জ্যোতির পরিবারটি অনতিবিলম্বেই মতিঝিলে ঝিলের পাড়ে আড়াই কাঠা জমির উপর দোতলা বাড়িও করতে পেরেছিলেন৷ তবুও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শাশুড়ি মা হা-হুতাশ করতেন ছেড়ে আসা বাড়ির ভুঁইচাঁপা গাছটির জন্য৷ জ্যোতি অবশ্য ওসবের ধার ধারতেন না খুব বেশি৷ জীবনের শুরুতেই বুঝে নিয়েছিলেন জীবনে চিরস্থায়ী বলে কিছু নেই। সেইজন্য কি? অরুণলেখা অন্ততঃ তেমনই বুঝেছিলেন জ্যোতির চরিত্র৷ দমদমে থিতু হওয়া, কলকাতায় চাকরি, এইসব ছেড়ে দিয়ে স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে বিলেত পাড়ি দিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য, ট্রিনিটির পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ থেকে আমেরিকার চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই, সাতের দশকে চাকরি পাওয়াও সহজতর ছিল৷ মার্কিনী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার অফার পাওয়ার পর ইংল্যান্ড থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে আবার সমুদ্রপাড়ি৷ এবার অতলান্তিক৷ 

জিনি জন্মেছিল অমনই এক শীতের দিনে, যখন সামনের একচিলতে নদীটা সম্পূর্ণ জমে গেছে৷ সে বছরই জমা নদীর উপর খেলাচ্ছলে হাঁটতে গিয়ে একজন ছাত্র মারা যায়৷ উপরের বরফের আপাত-নিশ্ছিদ্র আস্তরণকে ভেদ করে তলার বরফঠান্ডা জলের মধ্যে তলিয়ে গিয়েছিল সে৷ তার দু’দিন বাদেই ঠান্ডাটা আশ্চর্যরকম কমে এল৷ ফেব্রুয়ারীর শীতশেষের এক ভোরে পৃথিবীর আলো দেখল জিনি৷ অ্যাডেনব্রুকস্‌ হাসপাতালের একটি উইং, রোজি হসপিটালের দোতলায় কাচের ঘরে অরুণলেখাকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল৷ পাশের কটে নবজাতিকা৷ জ্যোতি বাবাইকে নিয়ে বসেছিলেন খাটের পাশে৷ বাইরে নীচে বরফ ভেদ করে নরম সবুজ কার্পেটের মতো ঘাস উঁকি মারছিল কোথাও৷ 

আসার পর দু’একবার হাসতে হাসতে বলেওছিলেন জ্যোতির্ময়,
– বুঝলে অরুণ! আমি যে বয়সে সেনহাটি থেকে ট্রেনে চেপে শিয়ালদা এসেছিলাম, বাবাই ঠিক সেই বয়সে কেম্ব্রিজ থেকে ফিলাডেলফিয়া এসেছে৷ একেই বলে জেনারেশন গ্যাপ৷ 
অরুণলেখাও ছাড়েননি ৷ বলেছিলেন,
– হ্যাঁ, এখন তো এসেছে৷ ক’দিন এখানে থাকে দেখ৷ তোমার তো কোনও জায়গাই বেশিদিন ভাল লাগে না৷ এবার কয়েক বছর বাদে তোমার হয়তো মনে হবে, নাঃ, চাঁদে গিয়ে বসবাস করলে ভাল হত৷ তখন আমাদের নিয়ে চাঁদে যাবে৷ 
– হ্যাঁ, তা যা বলেছ! আমি তো চন্দ্রাহত হয়েই রয়েছি গোটা জীবন ধরে৷ কিন্তু না, আবার নতুন জায়গায় নাও যেতে পারি৷ হয়তো বলব, ‘এবার ফিরাও মোরে, ধানসিড়িটির তীরে, এই বাংলায়৷ 
জ্যোতির্ময় বলছিলেন মৃদু হাসতে হাসতে৷ তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দুষ্টুমির হাসি হাসছিলেন অরুণলেখার দিকে তাকিয়ে– 
– কি? ধরতে পারলে না তো? 
– কী ধরতে পারলাম না?
– এই যে কেমন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জীবনানন্দকে মিলিয়ে দিলাম!
আবিষ্কার করে খুব রাগ হয়েছিল অরুণলেখার৷ সত্যিই ধরা উচিত ছিল৷ তিনি নিজে তো সাহিত্যের ছাত্রী!

কিন্তু না৷ বাংলায় আর ফেরা হয়নি ওঁদের৷ ধানসিড়ি দূরস্থান, দমদমের বাড়িতে, এমনকী শান্তিনিকেতনেও শেষ কবে গেছেন, মনেই করতে পারেন না অরুণলেখা৷ তেতাল্লিশ বছর ধরে এই ফিলাডেলফিয়াতে রয়ে গেছেন ৷ শেষ পর্যন্ত এখানেই শিকড় খুঁজে পেয়েছিলেন জ্যোতির্ময়৷ শেষ কয়েক বছর, যখন স্ট্রোক হয়ে আংশিক চলৎশক্তিবিহীন হয়ে পড়লেন, তখন স্বয়ংক্রিয় হুইলচেয়ার চালিয়ে দিনের শেষে শোবার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় বসতেন উনি৷ টি-পটে সুন্দর করে সাজিয়ে চা নিয়ে আসতেন অরুণলেখা৷ একসঙ্গে বসে স্বামী-স্ত্রীর গল্প করতে করতে চা খাওয়া, কত বছরের অভ্যেস৷ শেষ দিকে আর বেশি কথা বলতেন না জ্যোতির্ময়৷ ধবধবে সাদা চুল, ফর্সা চেহারার জ্যোতিকে দক্ষিণ আমেরিকান বলে ভুল করত বাইরের মানুষেরা৷ দূরে জঙ্গল পেরিয়ে যেখানে সূর্য ডুবছে, সেদিক পানে তাকিয়ে থাকতেন নিঃশব্দে৷ একদিন চা খেতে খেতে হঠাৎ জঙ্গলের গাছগুলোর দিকে আঙুল তুললেন৷
– ঐ যে …..
– ঐ যে কী? কী বলছ?
জ্যোতির কথা জড়িয়ে গিয়েছিল স্ট্রোকের পর৷ অরুণলেখা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারত না সব৷
– শ্যাওড়া গাছ৷ দেশে থাকত না? এগুলো এখানকার শ্যাওড়া৷ আশ শ্যাওড়া৷ আমাকে যদি খুঁজতে চাও …..
দম নিয়ে ঈষৎ থেমে থেমে বলছিলেন জ্যোতির্ময়৷
…তবে আমি চলে যাবার পর ওই গাছগুলোর মাথায় তাকিয়ে দেখো৷ দেখবে হঠাৎ একটা ফসফরাসের আলো৷ যেমন গ্রামে জোনাকিদের পাখায় আলো হয়৷
– আঃ! কি সব অলুক্ষুণে কথা বলছ? চলো টিভি দেখবে চল!’
মুখে বললেও বুকটা কেঁপে উঠেছিল অরুণলেখার৷

– রাগ কোরও না অরুণ৷ সত্যি বলছি৷ জীবনের এতটা সময় তো এখানেই কাটালাম৷ আমাদের এই বাড়ি, এই যে কালো মাটির বাসা, শ্যামল সুখের ধরা, এইটাই তো আমার একেবারে নিজের৷ তাই …
আবার দম নিচ্ছিলেন জ্যোতির্ময়৷
… সেই যে গাঁয়ে দেশে ব্রহ্মদত্যিরা থাকে না বেলগাছে? কেন থাকে? মায়া কাটাতে পারে না বলেই তো, এখানে তো বেল গাছ নেই, কিন্তু ঐ শ্যাওড়াগুলো৷ ওখানে খুঁজো, ওখানে আমাকে পাবে৷

ঈষৎ একটু হাসি ছিল কি জ্যোতির চোখে? বুঝতে পারেননি অরুণলেখা৷ আজ আর তেমন করে মনে পড়ে না৷ রাত ঘন হয়েছে৷ বইও শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ৷ ঘুমটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অতি দ্রুত কমে যাচ্ছে৷ ঘুমের ওষুধ পারতপক্ষে খান না অরুণলেখা৷ আজও খেলেন না৷ নিস্তব্ধ নিঃঝুম রাত্রির গন্ধ আছে, নিরেট একটা আকৃতি আছে৷ সেই রাত্রির সঙ্গে নিবিড় নৈকট্যে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ৷ জঙ্গলটা এখন খুব স্পষ্ট৷ গাছগুলোর মাথায় স্তূপীকৃত বরফ৷ মনে হচ্ছে তুষারবৃক্ষরা দাঁড়িয়ে আছে নিরুচ্চার৷ অরুণলেখা যেন অনন্তকাল নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলেন তুষারাবৃত বৃক্ষচূড়ার দিকে৷ বেশি বরফে চারিদিক আলোকিত হয়ে যায়৷ একটা ঘোর লাগা শ্বেতশুভ্র কুহেলিকার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি এবং বিভ্রমের সীমানা পেরিয়ে অন্য কিছু খুঁজে চলেছেন অরুণলেখা৷ কিন্তু তিনি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না৷

 

 

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১০ অগস্ট ২০২২
*ভেতরের ছবি সৌজন্য: Murari Purkait, Fine art America

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

11 Responses

  1. ঝরjhore নির্মেদ গদ্যে লেখা উপন্যাসের প্রথম কিস্তি দারুন লাগলো।সাগ্রহে পড়বো পরবর্তী কিস্তি গুলো।
    লেখিকা কে অভিনন্দন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com