ছোটবেলায় ব্যাকরণ বই জানিয়েছিল, ‘পলান্ন’ সমাস ভেঙে হয় পল বা মাংস মিশ্রিত অন্ন অর্থাৎ বিরিয়ানির অনুরূপ কিছু একটা, যা পোলাও জাতীয়। শোনা যায় আর্মেনিয়া বা টার্কির “পিলাও” থেকে উদ্ভব এই পোলাও শব্দের, যার আভিধানিক অর্থ হল ঘি আর মশলাপাতি দিয়ে রাঁধা সুগন্ধী অন্ন। আফগানিস্থানের বিখ্যাত “বর পিলাউ”-এর খ্যাতি সর্বজনবিদিত। বিরিয়ানির অনুরূপ। পাখির মাংস দিয়ে রান্না ভাত।
ওদিকে পারস্য দেশের চিকিৎসাশাস্ত্রের পণ্ডিত আবু আলি ইবন্ সিনার লেখায় রয়েছে ‘পিলাফ’ বা ‘প্লোভ’ নামের মাংস মিশ্রিত একটি চালের পদের কথা। আবার এই ‘পিলাফ’ই হল উজবেকিস্তানের বিয়ের অনুষ্ঠানে পরিবেশিত এক অভিজাত পদ। তবে প্লোভ বা পিলাফ কিন্তু আলেকজান্ডারের আমলে গ্রিসে ছড়িয়ে পড়া এক সুস্বাদু খাদ্য। তাহলে? পোলাও শব্দের উৎস যে দেশ থেকেই হোক না কেন, তা পল মিশ্রিত পলান্ন। মধ্যপ্রাচ্যে ‘মাধবী মুরগি পোলাও’ নামে আর একটি ভাতের ডিশ খুব জনপ্রিয় যা এখনকার মোরগ পোলাওয়ের সমতুল।
বাসমতী চালের ভাতের মধ্যে তুলতুলে মুরগির টুকরো দেওয়া বাদশাহী মশলার মিশ্রণে এটি আমার নিজস্ব টেস্ট করা ডিশ। ডক্যু সস নামে এক ঝাল চাটনি দিয়ে খাওয়া হয়। আবার বাঙালি পোলাও কিন্তু ভোগের জন্য নিবেদিত পুষ্পান্নতেই গিয়ে থেমে থাকত, যদি না মোগল সংস্কৃতি বাংলার অন্দরে প্রবেশ করত। তবে সুগন্ধী চাল ছাড়াও পোলাওয়ের প্রধান অঙ্গ হল ভাল ঘি, কাজু-কিশমিশ-কাঠবাদাম আর ছোট, বড় দু’রকম এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি, জয়িত্রী, জায়ফল, শাজিরে, শামরিচ। আগে দেখেছি ঠাকুমা, দিদিমা পোলাওয়ের চাল ফোঁটার সময় নরম ন্যাকড়ার পুটুলির মধ্যে মশলা বেঁধে জলে দিয়ে দিতেন।
আখনির জলে পোলাও রাঁধা কিন্তু মুঘলদের ট্র্যাডিশন ছিল। সেটাই বাদশাহদের “ইয়াখনি পুলাও।” ওঁরা দিতেন কিশোরী রং। তারপর যেদিন মেটানিল ইয়ালোর নিষেধাজ্ঞা জারি হল, তখন হয় সাদা পোলাও নয় সামান্য হলুদ গুঁড়ো। আজকের বাসন্তী পোলাও, জাফরানি জর্দা পোলাও, নার্গিসি পোলাও, পিজ় পোলাও, সবজি পোলাও, যা-ই গালভরা নাম দিয়ে পোলাও কে নানাভাবে পরিবেশন করা হোক না কেন মূল পদ্ধতি এক।

আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরিতেও রয়েছে আকবরের আমলে পরিবেশিত ‘জার্দ বিরিঞ্জ’ বা হলুদ চালের কথা। ফারসি ভাষায় বিরিঞ্জ হল চাল। সেই ভাতের মূল উপাদানে সুগন্ধী চাল, চিনি, ঘি, ড্রাই ফ্রুটস, আদা এবং দারচিনির উল্লেখ রয়েছে। প্রণালীতে রয়েছে “দমপোক্ত” বা দমে বসিয়ে সেই ভাত রান্নার কথাও। তবে মাংস দেওয়া যেতেও পারে, এমন কথাও বলেছেন আবুল ফজল।
মুঘলাই রসনাসংস্কৃতি ভারতীয় হিন্দুস্তানি সংস্কৃতির সঙ্গে এক অদ্ভুতভাবে মিশে গেছে। বদলেছে ভারতবাসীর স্বাদকোরক। হিন্দুস্তানি সংস্কৃতি বলতে কোনও ধর্মীয় সংস্কৃতি নয়, সেই সংস্কৃতিকে বোঝানো হচ্ছে যার জন্ম হয়েছিল আগ্রা তথা পূর্বের অগ্রনগর শহরে। তবে তারও আগে মুঘলরা ছিল আফগানিস্তান ও ইরানের মধ্যবর্তী কোনও এলাকার এক যাযাবর গোষ্ঠী। তাদের আদিনিবাস ছিল মঙ্গোলিয়ায়। মূলত তাদের সংস্কৃতি এবং সত্ত্বা অর্ধ-পারসিক ও অর্ধ-মঙ্গোলীয়। যখন বাবর ভারতবর্ষের একটি অংশ দখল করতে সক্ষম হন ও স্থায়ীভাবে ভারতেই বসবাস করতে শুরু করেন তখন ভারতবর্ষীয় আবহাওয়া বা সংস্কৃতি কোনওটাই তাঁর পছন্দ হয়নি।

উত্তর ভারতীয়রা মূলত নিরামিষভোজী হওয়ায় মাংস দিয়ে রান্না করা খাবার সেখানে মিলত না। ফলে বাবর ইরান থেকে পারস্যের বাবুর্চিদের নিয়ে আসেন যারা পারসিক রন্ধনশৈলীতে খাবার প্রস্তুত করত। পরবর্তীকালে বাবর তাঁর অধীনে কর্মরত স্থানীয় বাবুর্চিদের পারসিক ও স্থানীয় রন্ধনশৈলীর সমন্বয়ে এক নতুন পদ্ধতিতে রান্না করার নিদান দেন। ফলে হিন্দুস্তানি রন্ধনশৈলী তথা মুঘলাই খাবারের জন্ম হয়। আকবরের সময়ে ইরান-আফগান-আরব থেকে বহু লোক ব্যবসা ও চাকরি করতে লাহোর-দিল্লির দিকে আসে। তখন পারসিক-আরব সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় পরিবেশের আরও গভীর সমন্বয় হয়। ভারতীয় খাদ্যাভাসের সঙ্গে পারসিক, আরবীয় ও তুর্কি খাদ্যাভাসের হয় মেলবন্ধন। শেরশাহ, শাহজাহান এবং অওরঙ্গজেব দ্বারা পরিপূর্ণতা পায় মুঘলাই খাদ্যশৈলী। ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় এই মোঘলাই রন্ধনশৈলী বিবর্তিত হয়েছে৷
বেশিরভাগ খাদ্য-ইতিহাসবিদের মতে বিরিয়ানি এসেছে ইরান থেকে। মুঘল দরবারের বাবুর্চিদের হাতে তৈরি হত মোগলাই বিরিয়ানি। বাংলাদেশের মোগলাই খানার ইতিহাসের লেখক ও ফুড ব্লগার সারা তমান্না লিখেছেন,
বিরিয়ানি কাজাকিস্তান থেকে তৈমুরলংয়ের সঙ্গে এসেছিল। বিরিয়ানির আবিষ্কর্তা হিসেবে এককভাবে কারো নাম না থাকলেও ভারতীয় উপমহাদেশে এর আগমন যে মোঘলদের হাতেই আর কাচ্চি বিরিয়ানির মূল রেসিপি যে এসেছে তুর্কিদের কাছ থেকে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই খাবারে তারা লবঙ্গ, হিং, মাখন, গোলমরিচ, এলাচ ও স্থানীয় মশলার সংমিশ্রণ ঘটাত। নবাবদের রসনাপূরণ করে প্রশংসা আর ইনাম পেতে সদাজাগ্রত ছিল সেযুগের বাবুর্চিরা। তাই নতুন নতুন রকমারি পোলাও রান্নার চেষ্টা করতেন। আনারদানা পোলাও, বা ন’রঙের চাল দিয়ে তৈরি নবরতন পোলাও ইত্যাদি তাঁর মধ্যে অন্যতম।

আইন-ই-আকবরিতে পাওয়া প্রণালী অনুসারে মোটামুটি চারজনের জন্য জর্দা বিরিঞ্জে পোলাও রেসিপিও এরকম:
‘১০সের চাউল, ৫ সের মিছরি, ৩.৫ সের ঘি, কিসমিস, আধ সের করে কাজু বাদাম, পেস্তা বাদাম, এক পো লবন, আধ পো আদা, জাফরান, দারুচিনি।’ কেউ কেউ আবার এতে মাংসও দিত। সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী মুমতাজ মহল সৈন্যশিবির পরিদর্শনে এসে সেনাদের অবসাদগ্রস্ত দেখে তাদের জন্য বিশেষ সুষম খাবার রান্নার নির্দেশ দেন, যা নাকি পরে বিরিয়ানি নামে পরিচিত হয়। মুঘল দরবারের সেই বিরিয়ানি কিম্বা সিপাহী বিদ্রোহের আমলের সেই বিরিয়ানি আমাদের কাছে অনেকটা পরিচিত এখন। সিপাহী বিদ্রোহের পর দরবারের চাকরিচ্যুত সেনা ও বাবুর্চিরা দোকান খুলে বিরিয়ানি বিক্রি করা শুরু করে। বর্তমানে দিল্লি ও দিল্লির আশেপাশের এলাকাগুলোতে পাওয়া যায় মোগলাই বিরিয়ানি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারস্যে বসে লেখা “পারস্যে” প্রবন্ধেও পেলাম এক মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে পারস্যের সাদাতাবাদ গ্রামে মধ্যাহ্নভোজনের বর্ণনায় সেই পারসী পোলাও এর নাম। পেলাম আর দুয়ে দুয়ে চার করলাম।
“দীর্ঘ এলম্ বনস্পতির ছায়াতলে তন্বী জলধারা স্নিগ্ধ কলশব্দে প্রবাহিত। এই রমণীয় উপবনে ঘাসের উপর কার্পেট বিছিয়ে আহার হল। পোলাও মাংস ফল ও যথেষ্ট পরিমাণে ঘোল।”
ছাপাখানার আবির্ভাবে বাংলায় খাবারদাবার নিয়ে আলোচনা শুরু হয় আর প্রকাশিত হয় প্রথম রান্নার বিষয়ক বিশ্বেশ্বর তর্কালংকার ভট্টাচার্যের রান্নার বই ‘পাকরাজেশ্বর’। ১৮৩১ সালের ‘সমাচার দর্পণ’-এ এই বইয়ের প্রকাশের খবর ছাপা হয়। সম্ভবতঃ বাংলার প্রথম রান্নার বই এটি । সেখানেও রয়েছে নানাবিধ পলান্নর কথা। সেখানে পলান্ন অবশ্যই মাংসে রাঁধা পোলাও যেখানে চাল ‘মাংসভবরস’ অর্থাৎ স্টকে সেদ্ধ করা।
কমলালেবুর খোসাসেদ্ধ দিয়ে রাঁধা ‘কমলাপলান্ন’, ‘নরগিসিপলান্ন’, সুজির ‘গোধূমপলান্ন’, ভাজা পোলাও বা ‘ভর্জ্জিত পলান্ন’, মাংসের আখনি তৈরি করে রাঁধা ‘মোতঞ্জনপলান্ন’ (এখনকার রেস্তোঁরার মেনুতে দেখা মোতি পোলাও মনে করুন পাঠকবন্ধুরা), ‘বার্ত্তাকুপলান্ন’ বা বোঁটাসহ বেগুন ঘিয়ে আধভাজা করে তাতে ফুটো করে আখনির মাংসের পুর ভরা বেগুনের পোলাও, ‘প্রিয়পলান্ন’, কিমা দিয়ে রাঁধা পোলাও বা ‘শীরাজি পলান্ন’, ক্ষীর, চিনি দিয়ে রাঁধা ‘ক্ষীরশর্কঘ্নপলান্ন’, মাংসের বড়ার পোলাও বা ‘লোকমাপলান্ন’, কিমাপুরী আচ্ছাদিত পোলাও ‘পুরীপলান্ন’, আমের রস ও কিশমিশ ইত্যাদি মেশানো ‘আম্রপলান্ন’, নারাঙ্গ বা কমলালেবুর আকারে ভাজা কিমার বল দিয়ে রাঁধা ‘নাগরঙ্গপলান্ন’ সমুচা পোলাও বা মাংসের সিঙ্গারা দিয়ে রাঁধা ‘সোমসাপলান্ন’ এর উল্লেখ রয়েছে।
এছাড়া দুটি অভিনব পলান্নের নাম পাওয়া গেল, যার একটি কাঁচা মুগডাল-গরমমশলা-আদা-জিরে-তেজপাতা দিয়ে রাঁধা পাখির মাংসের পোলাও বা ‘খেচরপলান্ন’ আর অন্যটি আস্ত পাখির পেটে আদা আর কিশমিশ পুরে কাবাব করে রাঁধা ‘কাকোপলান্ন’।
*ছবি সৌজন্য: Spicy World, Avacare, The Epicurean Feast
*তথ্যসূত্র:
প্রথম আলো
পাকরাজেশ্বর – তর্কালংকার বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য
মুঘলাই খাবারের ইতিহাস – মেহেদী আবেদিন
*ভিডিও সৌজন্য: Youtube, Bong Eats
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।