banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বইয়ের কথা: পাণ্ডু- একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Pandu novel by Tamal Bandopadhyay

প্রায়শই মহাকাব্য হয়ে ওঠে জাতির জীবনে তাৎপর্যময়, অর্থাৎ তাতে জাতীয় ইতিহাস আর আকাঙ্ক্ষা রূপায়িত হয় এক এক সুবিশাল উত্তুঙ্গ চেহারায়। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী একদা বলেছিলেন, রামায়ণ-মহাভারতের মতো মহাকাব্য বিশাল বনস্পতির তুল্য, যা কালে কালোত্তরে আশ্রয় দেয় পথিককে। আদি ও সাহিত্যিক মহাকাব্য, দু’ধরন সম্পর্কেই কথাটি প্রযোজ্য। গিলগামেস (৩০০০ খ্রিস্টপূর্ব), ইলিয়াড ও অডিসি (১০০০ খ্রিস্টপূর্ব) থেকে রামায়ণ বা মহাভারত (আনুমানিক ৩০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ) পুরনো উদাহরণ। এই সব ধ্রুপদী রচনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সাহিত্যিককে নতুন সৃষ্টির প্রেরণা দিয়েছে। কোনও ঘটনা, কোনও সঙ্কট, কোনও চরিত্র উত্তরসূরীর দৃষ্টিতে সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এইভাবে ক্লাসিক হয়ে ওঠে চিরায়ত।

গত একশো বছর বা তার বেশি সময়ে কথাসাহিত্য এবং চলচ্চিত্র মহাকাব্যিক বনস্পতিতে মনোযোগী হয়েছে। কথাসাহিত্যিকরা ব্যক্তিক ও জাতীয় ভাগ্য পরিক্রমার বিপুলত্বে মহাকাব্যিক সম্পদে আশ্রয়ী। কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে মবি ডিক (১৮৫১), যুদ্ধ ও শান্তি (১৮৬৫-৭২), স্টেইনবেকের দ্য গ্রেপস অফ রথ (১৮৬১), ডঃ জিভাগো (১৯৫৭) কয়েকটি উদাহরণ। গোরা, ঢোঁড়াই চরিত মানস, গণদেবতা, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, বাংলা সাহিত্যে এমন কয়েকটি বিশিষ্ট উদাহরণ। উত্তরাধুনিক চিন্তকরা এমন ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’কে নস্যাৎ করতে চাইলেও মহাকাব্যিক উপন্যাস শেখা হচ্ছে স্বদেশে, বিদেশে। পুরনো চরিত্র নতুনভাবে আসছে, মহাকাব্যিক অলঙ্কারের ব্যবহার তো আছেই।

বস্তুত, রামায়ণ অপেক্ষা মহাভারতকে উপন্যাসের (বা গল্পের) বিষয় করে তোলা, তার নানা জটিলতার স্বরূপ বিশ্লেষণ যে খুবই কঠিন, এ নিয়ে মতদ্বৈধ থাকার নয়। তরুণ কথাকার তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় মহাভারতের ‘পাণ্ডু’ চরিত্রটি ও তাঁর পরিজন নিয়ে চমৎকার একটি উপন্যাস লিখেছেন। সে বইটি নিয়ে দু’চার কথা বলব বলেই এতখানি গৌরচন্দ্রিকা। আরও প্রাসঙ্গিক কিছু বক্তব্য আছে। আধুনিক লেখকও বারে বারে সন্ধানী হয়ে পৌঁছন রামায়ণ বা মহাভারতে। সেখানে পাঠক হিসেবে লেখকের কাছে আমাদের প্রত্যাশা কোথায়? কাহিনি পুরনো, চরিত্র পুরনো, কিন্তু ভাষ্য একালের, স্বরায়ণ একালের। সেটা যদি পাই তবেই পুরাণভিত্তিক প্রসঙ্গের শিল্পরূপের সার্থকতা। পাশ্চাত্য পুরাণকথাও একাধিক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে বাংলা কবিতা বা উপন্যাসে। অনেক সময়ই মানবজীবনের সত্য উপলব্ধিকে প্রকাশের উদ্যোগ কথাকার নিয়েছেন, পুরাণের মাধ্যমে। পুরাণ হয়ে ওঠে যুগের কথা। মহাশ্বেতা দেবীর ‘দ্রৌপদী’ গল্প যেমন। তবে মূল প্রসঙ্গ সংহত পরিসরে আসতে পারে লেখায়।

 

আরও পড়ুন: বেদব্রত ভট্টাচার্যের কলমে: বিদুর 

 

এভাবেই পুরাণের আধুনিক ভাষ্য উপস্থাপিত হয় পাশ্চাত্যে বা প্রাচ্যে। বর্তমানের সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি ফুটিয়ে তুলতে লেখক ব্যবহার করেন পুরাণকে। সেই উদ্দীপন লেখনীর সামর্থ্যে সঞ্চারিত হয় পাঠক-মনে। যেমন— বাংলা গল্প-উপন্যাস বা কবিতায় চম্পকনগর, বেহুলা, সত্যবান, বিদুর অর্জুন প্রভৃতি প্রসঙ্গ। এটা খুব শক্ত কাজ। মনে হয় ভাষার ক্লাসিক দ্যুতি রপ্ত করা একটা জরুরি কাজ। বাক্যবন্ধ, প্রবচন বা বিশেষ বিশেষ শব্দ লেখককে রপ্ত করতে হয়। তবেই তা আধুনিক প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হতে পারে। পুরনো প্রসঙ্গ, পুরনো চরিত্রকে নতুন আবহে স্থাপন, দুই যুগ যুগান্তরের সম্মিলনকে কে কেমনভাবে করবেন সেটা দেখার। যদি শিল্পশ্রম যোগ্য ও সার্থক হয় তখনই ফুটে ওঠে আদর্শ চিরন্তন ইতিহাস।

শিশিরকুমার দাস বলেছেন, ভারতবর্ষের কতিপয় ভাষার ক্ষেত্রে লেখক-পাঠক সমাজে পাশ্চাত্য বিষয় ও রীতিতে আগ্রহ থাকলেও লেখকেরা সনাতনী ‘থিম ও ফর্ম’ বিষয়ে যথেষ্ট কড়া সমালোচনা করলেও ‘পৌরাণিকতা’কে গুরুত্ব দিয়েছেন। উপরন্তু পুরাণের যে জাতীয় চরিত্র রয়েছে (Pan-Indian Character of the myths), সে আকর্ষণ লেখক, পাঠক, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সমাজে যথেষ্ট— প্রবচনে, প্রবাদে, কিছু আভিধানিক ব্যবহারে তা ধরা পড়ে। ইতিহাসের উপাদানসমূহের পাশাপাশি পুরাণের প্রবল ‘binding force’ চোখে পড়ে। মহাভারতের বিশাল শাখাপ্রশাখা সমন্বিত উপাখ্যানে চিত্রাঙ্গদা, দ্রৌপদী এবং অভিমন্যু, কর্ণ, কৃষ্ণ, দুর্যোধন, ভীষ্ম, অর্জুন, অশ্বত্থামা, যযাতি গুরুত্ব পায়। বাংলাতে কৃষ্ণকেন্দ্রিক উপন্যাসও অনেক। ‘বিদুর’কে নিয়ে উপন্যাসও পাচ্ছি। অবশ্য কোন চরিত্র বা উপাখ্যান লেখক বেছে নেবেন, সেটা অনেকটাই তার লেখক মনস্তত্ত্বনির্ভর। তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সাম্প্রতিক উপন্যাসে বেছে নিয়েছেন পাণ্ডু রাজা ও তার স্ত্রীদের। মনে হয় ইতিপূর্বে, অন্ততঃ বাংলায়, আর কেউ এই রাজা ও রানিদের ঔপন্যাসিক গুরুত্ব দেননি।

গত একশো বছর বা তার বেশি সময়ে কথাসাহিত্য এবং চলচ্চিত্র মহাকাব্যিক বনস্পতিতে মনোযোগী হয়েছে। কথাসাহিত্যিকরা ব্যক্তিক ও জাতীয় ভাগ্য পরিক্রমার বিপুলত্বে মহাকাব্যিক সম্পদে আশ্রয়ী। কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে মবি ডিক (১৮৫১), যুদ্ধ ও শান্তি (১৮৬৫-৭২), স্টেইনবেকের দ্য গ্রেপস অফ রথ (১৮৬১), ডঃ জিভাগো (১৯৫৭) কয়েকটি উদাহরণ।

পাণ্ডু সংক্রান্ত গল্প-কাঠামোটি নিম্নরূপ— বিচিত্রবীর্যের দ্বিতীয় ক্ষেত্রজ পুত্র, অম্বালিকার গর্ভজাত পাণ্ডু। ভীষ্ম তাকে বেদ, গদা, ধনুর্বিদ্যা শেখান। বড়ভাই ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ বলে পাণ্ডু রাজা, কুন্তী ও মাদ্রী তার স্ত্রী। নানা দেশভ্রমণ, মগধরাজ হত্যার পর পাণ্ডু দুই স্ত্রী নিয়ে মৃগয়াতেই সময় কাটাতেন, ধৃতরাষ্ট্র প্রয়োজনীয় উপকরণ পাঠাতেন। মৃগয়াকালে সন্তানকে বাণবিদ্ধ করায় মুনি কিন্দম শাপ দেন পাণ্ডুর কামকালে মৃত্যুর। দুই স্ত্রী-সহ প্রব্রজ্যা, শতশৃঙ্গ পর্বতে তপস্যা। নিঃসন্তান থাকলে স্বর্গপ্রবেশ অসম্ভব, কিন্তু সন্তান জন্মদানে অক্ষম থাকায় ক্ষেত্রজ পুত্রের চিন্তা। কুন্তী ক্ষেত্রজ পুত্রে আপত্তি জানালেও শেষ পর্যন্ত যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুনকে জন্ম দেয়। মাদ্রীর পুত্রদ্বয় নকুল ও সহদেব। একদা মদনাক্রান্ত পাণ্ডু মাদ্রীকে বলপূর্বক গ্রহণ করা কালে পাণ্ডুর মৃত্যু হয়, মাদ্রী সহমৃতা হন। গঙ্গাতীরে রাজোচিত সাড়ম্বরে কশ্যপ মুনি কর্তৃক শবদাহ, পাণ্ডুর ইন্দ্রলোক প্রাপ্তি। (পৌরাণিকা – অমল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ২য় খণ্ড) এ গল্পের কিছুটা তমাল ব্যবহার করেন, কিছু বর্জন করেন উপন্যাসের স্বার্থে, তার আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির স্বার্থে।

আঠাশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত ‘পাণ্ডু’ উপন্যাসে তমাল শুরু করেন অরণ্য সমাবৃত প্রাসাদোপম আবহের বর্ণনায়, তার ভার্যাদ্বয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপনে। বনবাসের সিদ্ধান্ত রাজা পাণ্ডুর স্বেচ্ছাসিদ্ধান্তে। যোগসূত্র থাকে ভীষ্ম, বিদুর প্রভৃতির সঙ্গে। ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্বজনিত সীমাবদ্ধতাও গল্পে গুরুত্ব পায়। এরপর কাহিনি এগিয়ে চলে স্ত্রীদের সাহচর্যে, মৃগয়ানিষ্ঠ রাজার গতিবিধিতে, দিগভ্রষ্ট রাজার সঙ্গে ঋষি চিরঞ্জীবের সাক্ষাতে, বিচিত্রবীর্যের কাম-প্রীতি এবং পাণ্ডুর ‘বিষাদ’কে গুরুত্ব দিয়ে। নিপুণ চেতনায় পাণ্ডুর যৌন অক্ষমতা, তার দুর্বোধ্য গতিবিধি, ঋষি কিমিন্দম ও দুর্বাসার কথা তুলে আনেন তমাল। একদিকে বীরত্ব, এবং অন্যদিকে যৌনাতিরেক, চমৎকার সংমিশ্রিত। প্রকৃতিবর্ণনা প্রয়োজনীয় আবহ নির্মাণ করে। নানা মুনি, দেবতা, যৌনাতিরেক ও ব্যর্থতাজনিত বিষাদ চরিত্রটিকে আধুনিক মহিমা দেয়। দশম অধ্যায়ে হস্তিনাপুর থেকে আসা প্রয়োজনীয় উপকরণ কথা, প্রকৃতি ব্যবহারের গুরুত্ব ও রচনাসাফল্য চোখে না পড়ে পারে না। ঋষিগণের সহযোগী সক্রিয়তা লৌকিক ও অলৌকিকের বেণীবন্ধন করে। 

পুরাণের আধুনিক ভাষ্য উপস্থাপিত হয় পাশ্চাত্যে বা প্রাচ্যে। বর্তমানের সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি ফুটিয়ে তুলতে লেখক ব্যবহার করেন পুরাণকে। সেই উদ্দীপন লেখনীর সামর্থ্যে সঞ্চারিত হয় পাঠক-মনে। যেমন— বাংলা গল্প-উপন্যাস বা কবিতায় চম্পকনগর, বেহুলা, সত্যবান, বিদুর অর্জুন প্রভৃতি প্রসঙ্গ। এটা খুব শক্ত কাজ।

চতুর্দশ অধ্যায়ে ভীষ্ম কর্তৃক বসানো কুরুসেনাপল্লী যেমন, তেমনই পঞ্চদশ অধ্যায়ে পাণ্ডুর শারীরিক ক্রমঅবনতির উল্লেখ, ষোড়শ অধ্যায়ে ঋষি কিমিন্দমের আশ্রম ঘিরে ফেলা, তার কামুকতা, অভিশাপ— এ দুটোই মূল ঘটনাপ্রবাহের অনুসারী। অভিশাপে বিশ্বাস অবশ্য প্রাচীন বিশ্বাস, যদিও আধুনিক জীবনে মনোজগতে তার অধিষ্ঠান আছেই। ব্যাসের বারংবার আগমন এবং রাজার পুত্র কামনা চরিতার্থ করার ভূমিকা লক্ষণীয়। পূর্বজন্ম বিশ্বাস, (পৃ. ১০৩) তাও আছে। বিংশতিতম অধ্যায় থেকে পাণ্ডু চরিত্রের কিঞ্চিৎ রূপান্তর— সিংহাসনস্পৃহা এবং যে কোনও উপায়ে পুত্র উৎপাদন— এই দুটি বৈশিষ্ট চোখ টানে। অন্যদিকে দুই স্ত্রীর মধ্যেই পাতিব্রত্য যেমন, তেমনই ক্ষেত্রজ উৎপাদনে কুন্তীর নীতিবোধ, শেষ পর্যন্ত স্বামীর কাতরতার কাছে সম্মতি— এসব আধুনিক ভাবনাকে উদ্রিক্ত করে। মাদ্রীর ক্ষেত্রে অবশ্য লেখক নীতিবোধের এই ব্যাপারটা দেখাননি, কিন্তু মাদ্রীর পোশাকে প্রলুব্ধ রাজা যখন কামনা উদ্দীপ্ত হয়ে রমণে প্রবৃত্ত হন তখন মৃত্যু আসে অনিবার্য অভিশপ্ততায়।

জীবন ক্রমশঃ বিকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে (পৃ. ১১৯), জীবন বড়ই দুরূহ, অনিশ্চিত, সমস্যা সংকুল (পৃ. ১১৩), জীবন রণভূমির চেয়ে কঠিন (পৃ. ১০১), অবসাদবিষে আচ্ছন্ন, বিপর্যস্ত, দিশাহারা (পৃ. ৯৯), জীবন ক্রমান্বয় রহস্যময় (পৃ. ৮৩) বাসকষ্ট, শিশুসুলভ জেদ, পাহাড় ভাঙা, বিশৃঙ্খলা হাওয়া, বাতাসের শীতল আক্রমণ (পৃ. ৫৬) স্মরণ করিয়ে দেয় কাম্যুর ‘The Myth of Sisyphus’-কে, কারণ পাণ্ডু বলেন চিকিৎসককে ‘আমি অনুশীলনে রত রয়েছি, শৈথিল্য আনছি না অভ্যাসে।’ অবসান ও বিষাদ, যেমন, তেমনি সিসিফাসের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা– এসবই আধুনিক বৈশিষ্ট্য, যা লেখক আরোপ নয়, সঞ্চার করে দেন উপন্যাসটিতে। পুরাণের আধুনিকীকরণ তাঁর পূর্বসূরীদের পথ বেয়ে সাফল্য এনেছে তাঁর ক্ষেত্রে।

 

আরও পড়ুন: তৃষ্ণা বসাকের কলমে কিরাতের কথা

 

ভাষার ধ্রুপদী গঠন ও দ্যুতি রক্ষা করে রচনা, চরিত্র ও পরিস্থিতির বয়নে পুরাকাল ও আধুনিককালের সংবর্ত রচনা বড় কঠিন কাজ। গল্পকে রোম্যান্টিক করে তুলে কার্যসিদ্ধির একটা চাতুর্যকৌশলে আবহনির্মাণ নষ্ট হয়ে যায়। আবহ রচনার দক্ষতা নির্মাণে প্রস্তুতি প্রয়োজন। ইতিপূর্বে তমালের যে ক’টি গল্প বা উপন্যাস পড়েছি, তাতে এই কঠিন চর্যা ছিল না। দু’ একটি উদাহরণ দিই। বিদুরের বিবাহে মহারাজ পাণ্ডুর অস্থিরতা, কারণ, সিংহাসন প্রাপ্তি। তীক্ষ্মবুদ্ধি কুন্তী তখন বলেন— ‘সঙ্গত কারণেই উনি ব্যথিত হয়েছেন, কাম্য অবকাশ আত্মসমীক্ষা ও মৃগয়ায় অতিবাহিত করতে পারলে ওর চিত্তচাঞ্চল্য প্রশমিত হবে আশা করি।’ (পৃ. ১৯) কিংবা বিষধর সাপ দেখে পাণ্ডু যখন নির্বাক, সেই সময়ের বিবরণে— ‘রাজা বাক্যহীন, আপাতত তাঁর সমস্ত মনোযোগ আকর্ষণ করে নিয়েছে ওই দ্বিজিত্ব ভূজঙ্গের ঈষৎ বঙ্কিম দুই দাঁত, বিষ-নিষ্কাশন রত অবস্থাতেই ঋষি-বৈদ্য চোখ তুলে তাকান তাঁর দিকে। (পৃ. ২৪) কিংবা অস্তায়মান সূর্যের বর্ণনায় লেখা—‘গিরিশিখরের কিনারে নেমে এসেছেন দেব দিবাকর। সারাদিন ধরে ছড়ানো আলোকজাল ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিচ্ছেন দৃশ্যপট থেকে। সূর্যাস্তের পর রং বদলাতে শুরু করে চরাচর। বাম প্রান্তে বনের গভীরে মিশে গেছে যে পথ, বহিরাগতদের এদিকে আসার সেটিই একমাত্র সন্মার্গ।’ (পৃ. ৪১) অথবা মনোজটিলতার উন্মোচন হিসেবে— ‘মাটির নিচে যেমন সপ্ত-পাতাল, মনের গভীরে তেমনি রয়েছে আরও অনেক মন।’ (পৃ. ৪৩) বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। 

Tamal bandyopadhyay
যৌনসঙ্গমের বিশদ বিবরণের প্রলোভনে পা দেননি তরুণ লেখক

যৌন সঙ্গমের বিশদ উপস্থাপনার একটা প্রলোভন ছড়িয়ে আছে এ উপন্যাসে। সেই একাধিক পরিস্থিতির বর্ণনায় এই তরুণ লেখক নিজেকে ভেসে যেতে দেননি। যেমন— অপ্সরা প্রসঙ্গে অধিগত লেখক উল্লেখ করেন রম্ভা, মেনকা, ঘৃতাচী, তিলোত্তমা, মঞ্চঘোষা, প্রম্লোষ্কা, বিদ্যুৎস্পর্শা প্রভৃতির কথা (পৃ. ৪৭)। উপমা চিত্রকল্প নির্মাণে চমৎকৃতি— ‘নিয়তি সে যেন এক অন্ধ-গণৎকার।’ (পৃ. ৫০) বা, ‘চোখের কোণ যেন কোষমুক্ত তরবারি।’ (পৃ ৭৩) আপন আত্মাকে বিমুক্ত করুন। স্বাধীন, স্ববন, স্বতন্ত্র। শরৎ আকাশে মেঘের মতো নির্ভার, নির্মম বাতাসে শিমুল তুলনার উড়ন্ত বীজের মতো, শ্বেত পারাবতের সূক্ষ্ম পালকের মতো…’ (পৃ. ৭৬) অথবা ‘প্রবল এক অসহায়তা অতিকায় কোনও সর্পের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে, দিগন্তপ্লাবী হতাশা মস্তকহীন কবন্ধের মতো গ্রাস করতে আসছে দশদিক থেকে’ (পৃ. ১০৩) — এখানে বাস্তব ও অলৌকিকের সংমিশ্রণ লক্ষণীয়। ‘সূর্যর উত্তরগতি আরম্ভ হয়েছে। সপ্তাশ্ববাহী রথে আরূঢ় সৌরদেবতা সঞ্চরণ শুরু করেছেন মকররাশি থেকে কর্কটরাশির দিকে।’ (পৃ. ১২৬) এমন কিছু উদাহরণ দিলাম ধ্রুপদী চমৎকারিত্বের। তমালের ভাষা ধার করেই বলা যায়, ‘সুনির্মিত ভাস্কর্যের মতো ত্রুটিহীন।’ (পৃ. ১৪৫)

এবার পুনরায় ফিরে আসি প্রাচীন কথাবৃত্তান্তে আধুনিকতা সঞ্চারের ক্ষেত্রে। পাণ্ডু মৃগয়াসফল বীর। কিন্তু তাঁর দু’টি আকাঙ্ক্ষা— পুত্রলাভের জন্য তীব্র ব্যাকুলতা, প্রয়োজনে অবিবেকী আকাঙ্ক্ষা এবং সেই সন্তানকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করা। এই দুই অভীপ্সা প্রাচীনকালের হলেও অর্বাচীনকালেরও বটে। পশু-অধ্যুষিত জগতে নিজ অস্তিত্বের প্রশ্নে, নিজের অধিকার বুঝে নির্মমতা ও কঠোরতা জরুরি— এটিও কালান্তরের অমোঘ সত্য। সর্বোপরি যে আঁধার, অবসাদ, বিষণ্ণতা, অব্যক্ত যন্ত্রণা, তা তো আধুনিক কবি জীবনানন্দের লেখায় পেয়েছি বহুবার। 

প্রজনন অক্ষমতার বিকল্প এ যুগে আসছে চিকিৎসা-বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে, বিবেকবোধে স্তরান্তর ঘটছে। জীবনার্থ অন্বেষণে সময়ের প্রশস্ততায় অর্থ পরিস্ফুটনের কথাও চিরকালের। সত্য যত কঠিন হোক, প্রকৃত বীর সেই সত্য গ্রহণে তৎপর হয়, একথাও রবীন্দ্রনাথ বলেছেন বারংবার। অবসাদ বিষে আচ্ছন্নতা, বিপর্যস্ততা, দিশাহারা হওয়া ত্রিশ ও পঞ্চাশের কিংবা তৎপরবর্তী বাংলা ও বিশ্বকবিতায় জেগে আছে। ফলে তরুণ কথাকার দৈবী আবহে লালিত বিচিত্রবীর্য পুত্রের জীবনকে বিশ্বাসযোগ্য ও রক্তমাংসল জীবন-মৃত্যুর অভিজ্ঞান করে তুলতে পেরেছেন। প্রচ্ছন্ন ও নিহিত নানা ইঙ্গিতের পরিস্ফুটন উপন্যাসটিকে করে তোলে এ কালের। 

ভাষার ধ্রুপদী গঠন ও দ্যুতি রক্ষা করে রচনা, চরিত্র ও পরিস্থিতির বয়নে পুরাকাল ও আধুনিককালের সংবর্ত রচনা বড় কঠিন কাজ। গল্পকে রোম্যান্টিক করে তুলে কার্যসিদ্ধির একটা চাতুর্যকৌশলে আবহনির্মাণ নষ্ট হয়ে যায়। আবহ রচনার দক্ষতা নির্মাণে প্রস্তুতি প্রয়োজন। ইতিপূর্বে তমালের যে ক’টি গল্প বা উপন্যাস পড়েছি, তাতে এই কঠিন চর্যা ছিল না। 

উপন্যাসটি পড়তে পড়তে সহসা ডি এইচ লরেন্সের ‘লেডি চ্যাটার্লিজ় লাভার’-এর কথা (১৯২৮) মনে পড়ে যায়। যখন ক্লিফোর্ড বুঝতে পারে যে তাঁর স্ত্রী সন্তান চান, তখন ক্লিফোর্ড তাঁকে কোনও একজন প্রজননক্ষম মানুষ খুঁজে নেবার কথা বলে। সুতরাং মেলর্স-সম্পর্ক নিছক যৌনতাবাহী নয়। ভূমিকায় রিচার্ড হগার্ট তাই বলেন, উপন্যাসটি আধ ইঞ্চি করে এগিয়ে যাবার গল্প ‘to shake off the habits of a society which manages to be smutty and ashamed at the same time about sexual question.’ লরেন্সের উপন্যাসের মতোই এই তরুণ বাঙালি কথাকারের বইটি মোটেই মশলাদার বা চটক-সর্বস্ব উপন্যাস নয়। আরও মনে পড়ছে এলিয়ট কথিত পোড়ো জমির বন্ধ্যাত্ব ও বিপর্যয়ের কথা। জীবনানন্দ বারে বারে হতাশা, অবসাদ, বিষণ্ণতার কথা বলেছেন। ‘পাণ্ডু’ উপন্যাসের একটি কেন্দ্রীয় ভাবনা বলয়ে আছে ‘অভিশাপ’ প্রসঙ্গ। আমার মনে পড়ে যায়, কাম্যু কথিত ‘দি মিথ অফ সিসিফাস’-এর কথা (১৯৪৩)। কেমন করে মানবজীবন হয়ে ওঠে অ্যাবসার্ড, সব রাঙা কামনার শিয়রে এসে বসে ধূসর মৃত্যুর মুখ। ‘We come to understand the thought of Camus only after we have probed the full significance of this optimism about man and his pessimism about human destiny.’ (Thomas L. Hanna)

সব শেষে একটি কথা না-বললেই নয়। বিশাল বনস্পতিতুল্য মহাভারত বারে বারে আধুনিকতার, সাম্প্রতিকতার দরজায় কড়া নেড়ে গেছে। পাঠককে মহাভারত-প্রাণিত আধুনিকতার মুখোমুখি করে দেওয়ার জন্য লেখককে ধন্যবাদ।

 

গ্রন্থ: পাণ্ডু
লেখক: তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশক: দেজ পাবলিশিং
প্রকাশকাল: বইমেলা ২০২২
বিনিময়: ৩০০ টাকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com