(Poetry)
এক।
এই জনহীন দ্বীপে তুমি-আমি কীভাবে এসে পড়লাম, জানা নেই। তুমি একটি ব্রহ্মকমল হাতে দিয়ে বললে ‘যাও এবার নৈবেদ্য সাজাও, পুজোর আয়োজন সম্পন্ন করো’। আজ গুরু পূর্ণিমা। মা কামাক্ষার চরণে পাপড়ি নির্মোচনের দিন। বেদীর সামনে আমরা দুজন এসে দাঁড়ালাম। যেন এক অবিচ্ছেদ্য তন্ত্রের মুণ্ড-ধর। প্রত্নকালের এক শীর্ণকায়া সর্প আস্তানার নিমিত্ত বাসা এঁকে চলেছে তন্ত্রের ভেতর। সেই আশ্রয় মেখে আমরা উড়ে যাব আমাদের আদিম ডেরায়। রমনে মেতে উঠবে সারান্ডার জঙ্গল। হঠাৎ দরজা খুলে দেখব তোমাকে জাগিয়ে তোলার মতো পরম শিল্পে দশমিকের পর দশমিক বসিয়ে গেছি আজীবন। এই ভ্রান্ত প্রবাহে তুমি কি কেবল শূন্যস্থান কামনা করেছ? নিষ্পলক নয়নে চেয়ে থাকতে থাকতে অনুরাগ জাগে। নীল রৌদ্র জড়িয়ে নিই আশ্লেষে। (Poetry)
দুই।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে এখন অঝোরে। নীল জলের ওপর আছড়ে পড়ছে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটার আদর। তোমার শান্ত আঙুল প্রথম পেগ শেষ করে দ্বিতীয় পেগের পথে… আমার গ্লাসের বরফ হুইস্কির ভেতর জলকেলি করছে। কমলা মেঘ বড়ই প্রবঞ্চক আজ। গোধূলি আলোয় সে মেখেছে সান্ধ্য নির্যাস। জল আমায় টানে চিরকাল, সেকথা তোমার জানা। পুলের জলে অর্ধনগ্ন শরীর আমার, ভাসিয়ে দিই তৃষায়। ব্ল্যাক শর্টসে ধিকধিক করে তোমার সুঠাম পৌরুষ, বার্ধক্য সেখানে ব্যর্থ প্রতিদ্বন্দ্বী মাত্র। চেয়ে দেখি ভরাট কণ্ঠে তুমি গান ধরলে ‘এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে/উদ্ভ্রান্ত মেঘে’/মন চায় মন চায়/ওই বলাকার/পথখানি নিতে চিনে/আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে’। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি বন্যতার ধ্বনি। কাছে এলে তুমি, দেহের ভেতর জ্বলে ওঠে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। এই অগ্নি নির্বাপন করবে এমন সাধ্য জলের নেই। হাতের গ্লাস রেখে তুমি এগিয়ে এলে আমার দিকে। উষ্ণ আলিঙ্গনে ডুবিয়ে দিলে তোমার অধর পল্লব। কামুক শরীর তখন ফুঁসছে নেশায়। আমি টের পাচ্ছি, পাহাড়, মেঘ অতিক্রম করে যাবতীয় জল ছুটে আসছে, মিলবে মোহনায়। আমরা মিশে যাব, ভেসে যাব, ডুবে যাব পরষ্পরের ব্রহ্মপূজোয়। (Poetry)


তিন।
যা চেয়েছিলাম, চাইনি এভাবে তাকে ভাসিয়ে দিতে। কয়েক পা এগোতেই দেখলাম বৃষ্টি থেমে গেল। অথচ তুমি এখনও আমায় স্নান করিয়েই চলেছো। পূজারী যেভাবে দেবীর আরাধনা করেন, সেভাবেই মায়া জড়িয়ে দিচ্ছ আঁচলে আমার। আচ্ছন্ন হয়ে আছি একথা বলতে দ্বিধা নেই। কামড় লেগে থাক জ্বরের গায়ে। জল আর আকাশ মুখোমুখি শোবে আজ। যাবতীয় ভার নামিয়ে দেবে পরষ্পরের বক্ষে। রমন করতে করতে তারা ভুলে যাবে কবিতার কথা। ভুলে যাবে বেঁচে থাকার রঙ আসলে গাঢ় নীল। গোলাপী রঙের অভিযোগ রেলিঙে শুকোতে দিই। তুমি এসে উল্টেপাল্টে দাও। ম্যাজিকের মতো উবে যায় ব্যথার অক্ষর।
সিসিফাসের ন্যায় পাথর ঠেলা ব্যর্থ জীবনে অমোঘ সত্য এই যে ‘তুমি আছো’। অনন্ত ধারার স্পন্দনে এই থেকে যাওয়া টুকুই গোপনে বেজে ওঠে। বাতাস দেয় প্রাণে। কানে কানে এসে বলে যায় ‘তুমি শুধু আমার’। চোখ বুজে আসে আবার আশ্লেষে… (Poetry)
সাদা-কালো লেখা: রাহুল পুরকায়স্থ
চার।
নীরবতার পিঠে মকশো করে তৈরি করি অন্ধকারের সাঁকো। সেই নীলাভ আঁধার থেকে একটি দুটি চাঁদ খসে পড়ে কখনও। কৃত্রিম আলোয় ভরে ওঠে চারপাশ। যেন এক অস্থায়ী আলেয়া কোথা থেকে এসে নীল ঢেলে যায় কোটরে। আইরিশে তখন সেরুলিয়ান রাত্রিধুতুরা। বালির ঘর দেখা যায় দূরে, জ্যোৎস্না সুরঙ্গে। বেঁধেছিলাম দু’জনে। আজ সেখানে কুয়াশা। কুয়াশার ভেতর তুমি জলের পরিধি আঁকো। আমি সেখানে চেনা, প্রিয় উচ্চারণগুলো হাতড়াতে থাকি। খুঁজে পাই না। অশ্রুরঙে ভরাট করি গোটা পরিধি। তারপর সেই জলভর্তি আলপথ বরাবর হেঁটে যাই। হেঁটেই যাই। কেউ এসে পথ আটকায় না। কেউ এসে বলে না ‘এই গ্যালাক্সি, এই গ্রহাণু তোমার নয়’। ও রোদ, ওয়েসিস দেখাও কেন অমন করে? বড় সাধ হয়, তোমার কাছে ছুটে যাই, পাত পেড়ে তরঙ্গ খাই। ওই যে হাতপাখায় যেমন সবুজ-নীল-লাল তরঙ্গ খেলা করে, তেমন করে সাজাই অন্তরের প্রতিটি কোণ। যেমন করে মুচকি হেসে তাকাও তুমি, যেমন করে ফুলকি ছড়াও ঘিয়ের মাঝে। কামড় দাও বল্লভ। আমি চাই দারুচিনির মতো মটমট করে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাক সবটুকু দেওয়াল। শিকড়ের গায়ে আঙুল ছুঁয়ে দেখো, মাটি কামড়ে পড়ে আছে সকাল। আর আমি… আত্মজীবনী লিখতে বসে লিপিবদ্ধ করছি জল, ধান, গোপন লাঙল… (Poetry)

অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
ডিজিটাল ও মুদ্রিত মাধ্যমে সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত
মোহনা মজুমদারের জন্ম কলকাতায়। অঙ্কে স্নাতকোত্তর। প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ শব্দলেখা থেকে ''যতোটা অপ্রকাশিত'(ই-সংস্করণ)। ২০২২ এ বইতরণী থেকে প্রকাশিত হয়েছে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'বিহান আলোর লিপি' ও ২০২৩ আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় অক্ষর সংলাপ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'উৎসারিত ও সলিলোকুই'।