উৎসর্গ: রূপসী বাংলার কবি, জীবনানন্দ দাশ
২৭
তোমাদের সুখী-দ্বারে পালাব ঢেলা মেরে… দেখিতে পাবেনাকো প্রেত-আমার…।
শান্ত দুপুরকালে— ঝিমিয়ে গৃহ সব… সবুজে ছেয়ে-গেছে ক্ষেত-খামার…।
সন্ধ্যায় উড়িয়াছে ভুলো-বাদুড়-একা; ঝাপসা কুয়াশায় দিশা না-পাই!…
বিছার সঙ্গে মিশে ভিজে খড়ের নীচে কত যে ঘুমায়েছি, ঠিকানা নাই…।
অলস সাপটি হয়ে শুয়েছি কোটরেও; বাহিরে শীত ঝরে… ঝুপসি-রাত…।
গুবরের স্বরে ডাকি; মেঠো ইঁদুর কাঁদি; জোনাকি নিভি, জ্বলে ধূম-চিতার…।
আজিকে ঘরের কোণে— একাকী দর্পণে; ভেসে কি ওঠে কোনও অলীক মুখ?…
অথবা কি অঘ্রাণে হিমের ক্ষত পেয়ে বদলে যায় কারও শরীরসুখ?…
কড়া নেড়ে চলে যাব— সদরে, সব দোরে— জানিতে পারিবে না শব্দ কার!
এ দেশে ফিরে দেখি: পালায়-পার্বণে সকলে গলা টেপে স্তব্ধতার!
আমার শরীর ফুঁড়ে উঠেছে মুথাঘাস… হরিৎ মধুকূপী… কোমল মন…।
বাতাসে দোলায় মাথা… সোহাগে টেনে নেয়… নরম-বুকে ভিজে রোমন্থন…।
হয়তো সে-হাওয়া সেজে ঝাঁপাব জানালায়… বোশেখি-ঝড়ে-ঝরা আমমুকুল…।
নির্জন দুপহরে সকল সুখী-দ্বারে এসেছে দেখা দিতে কালপুরুষ!…
২৮
সাদা ধুলো মেখে আছি— বাংলা ধূলিকণা… আশিরনখে তার মিঠে আদর…।
নদীর গন্ধে মেতে… উপুড় হয়ে ভাসি… সময় দেবে জানি— পিঠে পাথর…।
সত্যিকারের কোনও দরদীরাত এসে কথা না-রেখে গেছে; পৃথিবী তাই-
সুন্দরতর এত— পউষ-শ্যামজালে হৃদয় খুঁড়ে খালি পিরিতি পাই!
অপরাহ্ণের আভা চেনা অসুখ নিয়ে সেঁধোয় অনুভবে… টুকরো হই…।
ভাবি এ-মহাকালের অপার সংগ্রহে যেন বা আমি এক ক্ষুদ্র বই…।
রহস্য-প্রান্তরে কবিতা মেখে ফিরি… নবান্নের প্রাণে ছন্দ-মিল…।
অক্ষর ঝরে আহা দেহকোষের থেকে… শিশিরে মিশে যায় রক্তনীল…।
কে আর বাঁচিতে চায়! ঝিঁঝির স্বরে গাঢ় সরের মতো ঘন রাতনিবিড়…।
চোখ মটকায় প্যাঁচা অশ্বত্থের ডালে… বটের লাল ফলে শান্তিনীড়…
নক্ষত্রের আলো ভামের চোখে যেন… ছিন্ন পাখনায় গাঙফড়িং…
করমচা ঝোপে-ঝোপে শরীরী শিহরন… চাঁদের হাত শাদা শান্ত-হিম…
তারপর কিছু নাই— মুছিয়া গেছে সব— শূন্যপট চোখে ধাক্কা খায়…!
আমরা বুঝেছি যারা— এসব জাদুখেলা— কুহকী বাংলার হাতসাফাই…।

২৯
পাড়াগাঁর দাঁতে-লেগে কলকাতার ছোপ; কবে যে হয়ে গেল গ্লোবাল-ধাম…!
পিচের রাস্তাগুলো আঙুল-নেড়ে-ডাকে… আলোরবোর্ডে কোকাকোলার-দাম…
এ কোন বাংলাগ্রাম : ঘুমের ভিতরেও টাওয়ার একচোখে ভয় দেখায়…!
লতা-ছাওয়া যোনিপথে কংক্রিটের থাবা; পকোড়া-মোমো-চাউ সন্ধ্যে খায়!…
যাই তবে ফিরে যাই— আহিরীটোলা আর বাদুড়বাগানের কলকাতায়…
মিনার-বাড়ির-দেশ; পাথুরিয়াঘাটায়… টেরিটিবাজারের জলমাথায়…!
কোথায় তিলোত্তমা, শহর ইয়াবড় ময়দানব হাসে অট্টহাস!…
উড়ালপুলের সারি, হাজার সিসি-চোখ, ঝটিতি ক্যাব, ক্লাবে মত্তশ্বাস…।
ইকোপার্কের ঘ্যামে… শপিংমল-জাঁকে… ছড়ায় বৈভব নিউটাউন…
হাইরাইজের মাথা— অহং বসে এসে : টপফ্লোরের গ্লাসে—‘ভিউ দারুণ’!
অদ্ভুত মায়াবলে অদেখা রঙ দিয়ে এঁকেছে ছবি বুঝি চেরাগ-জিন!…
হ্যারিসন রোড ঘুরে ফিয়ার লেন ছুঁয়ে হেঁটে যেতাম কত যে রাতদিন…
মনুমেন্টের টঙে তারারা মজলিশি… আলোগাছের মতো গ্যাসলাইট-
ফিরবে না; তবু দ্যাখো নবীন নগরেও অন্ধকারে হাসে ছ্যাতলা-ইট!…

৩০
আমার মুখের ’পরে… খোলা বুকের ’পরে… অঝোর শ্যামাপোকা… আনন্দের…
দেয়ালির দীপ জ্বেলে আবার আসিয়াছে গহীন অন্তরে মাতন ফের…!
আজন্ম দেখিতেছি হেমন্তের নারী… প্রতিটি ঋতু তবু প্রথম, এই-
কুয়াশার চুলে ঢাকা নম্র দেহখানি… সিক্ত বুকে কভু বসন নেই…!
বুনো হাঁস পাক খায়… মৃদু সুবাস ঘাসে… ঝিলের আরশিতে মেঘের মুখ…
এত রূপ ভালোবেসে চোরকাঁটায় বিঁধে… পেয়েছি নেশানীল প্রেমে অসুখ…
হৃদয়েও পালাবাঁধা : মনসা-বেহুলার… গৌড়বঙ্গের লোককথার…।
জীবন ঘুমিয়ে ভাঙা চড়াইয়ের ডিমে… গুল্ম-শ্যাওলায়… বনলতায়…
আবার আসিব নিতে আতাক্ষীরের স্বাদ… সিঁদুররাঙা লিচু… আশফলের…
দেখিব আঁচলহীনা ধানকাটার মাঠ… শুনিব পাতা ঝরে বাঁশ-বটের…
হঠাৎ দেখিবে এক সুদর্শন তার ডানায়-ছিঁড়ে-ফ্যালে আঁধার-সাঁঝ…
ধবল বক ফেরে একেলা মেঘকানা… খঞ্জনার গানে বাঁচার সাধ…
ঝর্নাকলমখানি হয়তো রয়ে যাবে… লেখার ঘর… প্রিয় জানালা সেই…!
যদিই আসি গো ফিরে— পাব না সব নদী…। বাংলা থাকিবে না বাংলাতেই।
*ছবি সৌজন্য: Facebook, health.am, Telegraph
অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৭৬ সালে। এখন রিষড়ার বাসিন্দা। মূলত কবি হলেও ছড়া এবং গদ্যসাহিত্যেও সমান আগ্রহ। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯৯৫-তে ‘দেশ’ পত্রিকায়। প্রথম কবিতার বই ২০০০ সালে। ভারত সরকারের সংস্কৃতি-মন্ত্রকের অধীনে ‘জুনিয়ার ফেলোশিপ’ নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলা কবিতা নিয়ে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত, সম্পাদনাও করেছেন। কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা নয়। পেয়েছেন কৃত্তিবাস পুরস্কার, তুষার রায় সম্মাননা।