‘জয় মহেশমতি’, কথাটা নিশ্চয় মনে আছে। স্কুল, কলেজ, বাস, ট্রেন, মেট্রোয়, তখন একটাই আলোচনা—‘বাহুবলী’। প্রভাস, অনুষ্কা শেট্টি, রানা ডগ্গুবাটি অভিনীত ছবিটি বক্স অফিসে পুরো ঝড় তুলে দিয়েছিল। আর বাহুবলী ওরফে প্রভাস তখন হয়ে উঠেছিলেন আট থেকে আশির মহিলাদের প্রিয় পুরুষ। বাহুবলীর সাফল্যই প্রশস্ত করে দিয়েছিল প্রভাসের বলিউডে প্রবেশের রাস্তা। আর তারই ফল সুজিত পরিচালিত, শ্রদ্ধা কপূর অভিনীত প্রভাসের নতুন ছবি ‘সাহো’। ট্রেলার রিলিজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উন্মাদনার ঝড় বয়ে গেছিল তামাম ভারতবর্ষ তথা গোটা দুনিয়ায়। মনে করা হচ্ছিল বাহুবলীর রেকর্ডও নাকি ভাঙতে পারে এই ছবি। এ কথা মানতেই হবে প্রথম দিন বাহুবলীর রেকর্ড ছুঁতে না পারলেও বক্স অফিসে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটিয়েছে এই ছবি। কিন্তু দর্শকদের মন জিততে পারল কি? আদৌ কি ছবিটির গল্প নিয়ে লেখার মতো কিছু আছে?
অনেক আশা নিয়ে এই ছবিটি দেখতে বসেছিলাম। কিন্তু তিন ঘণ্টার পর হল থেকে বেরিয়ে মনে হল, আগে উঠে গেলেই বোধ হয় ভাল করতাম। সিনেমা তৈরি হয় গল্প বলার জন্য। কিন্তু আজকাল ভাল গল্প বলার লোক আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন আর কী বলছি না, কী ভাবে বলছিটাই যেন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে অবশ্য সাহো-কে ফুল মার্কস না দিয়ে উপায় নেই। স্পেশ্যাল এফেক্ট থেকে শুরু করে অ্যাকশন সিকোয়েন্স, গানের দৃশ্য হলিউডের সিনেমাকে রীতিমতো টক্কর দিতে পারে। ৩৫০ কোটি টাকার সাহো নাকি একেবারে চোখ ধাঁধিয়ে দেবে, প্রচারে বার বার এই কথাটাই উঠে আসছিল। কিন্তু ওইখানে শুরু আর ওইখানেই শেষ। প্রভাসের স্ক্রিন প্রেজেন্স নিয়ে প্রশ্ন তোলার জায়গা নেই, কিন্তু সিনেমায় নায়ক যদি তিন ঘণ্টা ধরে শুধুই এক নাগাড়ে লড়াই, বাইকে ধাওয়া আর ফাঁকে ফাঁকে নায়িকার সঙ্গে প্রেম করেন, তা হলে তাঁর অভিনেতা সত্ত্বাকে কি আর যথেষ্ট সম্মান দেওয়া যায়!
গল্প নিয়ে কিছু বলার মতো নেই। একেবারে ছকে বাঁধা স্টোরিলাইন। আর ঠিক ততটাই একঘেয়ে চিত্রনাট্য। বসে থাকাট দুঃসাহস মনে হতে পারে। সিনেমায় এক জায়গায় চাঙ্কি পান্ডের চরিত্রটি বলে ওঠে ‘ এমন যন্ত্রণা দেব, যে আর কিছু মনে থাকবে না।’ হক কথা। সাহো এমন মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে যে দর্শকদের কিছু মনে থাকবে না তা হলফ করে বলতে পারি।
গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম অপরাধ কেন্দ্রের সিংহাসন। ওয়াজি বলে কোনও একটি কাল্পনিক দেশে এর শাসনকেন্দ্র। যেখানে বিশাল বিশাল বাড়ি রয়েছে আর মাথা থেকে পা পর্যন্ত ট্য়াটু করা দশাশই সব গুন্ডা। জ্যাকি শ্রফের ‘রয়’ সেই সিংহাসনের শাসক। ভারতে এসেই যাঁর মৃত্যু হয়ে যায়। এ বার রাজ্য আর গদি কার হবে তা নিয়ে শুরু হয়ে যায় রেষারেষি, লড়াই, ষড়যন্ত্র। অন্য দিকে ২০০০ কোটি টাকার বিশাল চুরি হয়ে যায়। মুম্বই পুলিসের সবচেয়ে যোগ্য অফিসার অশোক (প্রভাস)-এর ডাক পড়ে সেই চুরির সমাধান করতে। জানা যায় এই কর্মকাণ্ডের পিছনে আছে শ্যাডো (নীল নীতিন মুকেশ) নামে এক রহস্যময় মানুষ। শুরু থেকে নানা রকম টুইস্ট দেওয়ার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। কিন্তু এতই লম্বা সময় লেগেছে শুধু ভূমিকা বাঁধতে, যে সিটে বসে উশখুশ করা ছাড়া আর উপায় থাকে না।
এ ছবি হচ্ছে অনেকটা ‘সব পেয়েছির দেশ’-এর মতো। যুক্তি-তক্কো এ সব নিয়ে কোনও মাথা ব্যথা নেই। আর তা বোঝা হয়ে যায় প্রভাসের নায়কোচিত এন্ট্রি দেখেই। বস্তির প্রতিটা বাড়ির মাথায় দৌড়চ্ছে প্রভাস, সমস্ত দুষ্কৃতিদের এক হাতে শেষ করছেন। এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু বাড়ির ভিতর পাইথন এবং ব্ল্যাক প্যান্থারের উপস্থিতিটা মেনে নেওয়া যায় না। অশোক আবার এতটাই ক্ষমতাশীল যে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত কী ভাবে পৌঁছে যায় বোঝা যায় না। আর যখন সে অপরাধীদের মারধোর করছে না, তখন তাঁর কাজ সহকর্মী আন্ডারকভার অফিসার অমৃতার (শ্রদ্ধা কপূর) সঙ্গে একটু নাচগান করা। এর মাঝে অবশ্য একটি ব্ল্যাক বক্সের কথাও বলতে হয়। অপরাধ সাম্রাজ্যের চাবিকাঠি যে এর সঙ্গে কোনও ভাবে জড়িত তা বোঝাই যায়। মোদ্দা কথা চেনা ছকের বাইরে মোটে বেরতে পারেনি এই সিনেমা। তা হতেই পারে, কিন্তু ছবির গতিও এত মন্থর যে ধুন্ধুমার অ্য়াকশন সিকোয়েন্সেও তেমন হাততালি পড়ে না।
প্রভাস চেষ্টা করেছেন। একাধারে নেচেছেন, গুন্ডাদের পিটিয়েছেন, নায়িকাকে বাঁচিয়েছেন, জামা খুলে সিক্স প্যাক দেখিয়েছেন। কিন্তু বাহুবলীর প্রভাসকে পাওয়া যায়নি। সেই এক্স-ফ্যাক্টর এখানে পুরো শূন্য। নায়িকার সঙ্গে প্রেমের রসায়ন মোটে জমেনি। শ্রদ্ধা কপূর এখানে পুলিশ অফিসার ঠিকই। কিন্তু যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়ার সুযোগ পাননি। দেখতে অসম্ভব গ্ল্যামারস লেগেছে। প্রভাসের হিন্দী উচ্চারণ যেমন কানে লাগে, ঠিক ততটাই বিরক্তি লাগে শ্রদ্ধার চরিত্রটির বার বার প্রভাসের অনুমোদন খোঁজা। এক দিকে আমরা যখন নারীদের সমান অধিকার নিয়ে এত কথা বলি, সেখানে এক জন মহিলা হওয়ার সুবাদে পুলিশ ডিপার্টমেন্টে শ্রদ্ধার চরিত্রের মজার পাত্র হওয়াটা মেনে নেওয়া যায় না। আর সবচেয়ে হাস্যকর নিজে পুলিশ হওয়া সত্ত্বেও প্রভাসের চরিত্রটিকেই তিনি নিজের রক্ষাকর্তা মনে করেন। বাকি চরিত্রের কথা আর নাই বা বললাম। চাঙ্কি পান্ডে, মন্দিরা বেদী, নীল নীতিন মুকেশ, টিনু আনন্দের মতে অভিনেতাদের বিন্দুমাত্র ব্যবহার করা হয়নি।
এই ধরনের সিনেমা নতুন নয়। মিশন ইম্পসিবল থেকে জেমস বন্ড, বহু সিনেমাতেই কিন্তু সে ভাবে লজিক থাকে না। আমরা প্রশ্নও করি না। এমনকী সলমান খানের সিনেমাও আমরা দেখতে হলে ভিড় করি। সাহো-র সমস্য়াটা অন্য জায়গায়। মাইন্ডলেস সিনেমা হলেও তার আপ্রাণ চেষ্টা জাতে ওঠার। পরিচালক ভেবেছেন দর্শকদের একেবারে নাড়িয়ে দেবেন। তা হয়েছে ঠিকই, মাথার সমস্ত কল কবজা একেবারে নাড়িয়ে ছেড়েছেন। ছবির শেষে সিক্য়ুয়েলের ইঙ্গিত মেলে। আশা করি সেটা যেন ইঙ্গিতই থেকে যায়!