Holi
দোল (Holi) ২০০০, বারাসাত। প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রী সম্পূর্ণা পাল মায়ের সঙ্গে যাচ্ছিল মামার বাড়ি। পাশের পাড়াতেই। সামনের বাড়ির বারান্দা থেকে ছুটে এল একটা সুন্দর, নরম, রং-ভরা লাল বেলুন। বেলুনটি এসে তার মুখে লাগে।
হোলি (Holi) ২০২০, বেহালা। সত্তরোর্দ্ধ প্রকাশ জয়সওয়াল পাড়ার দোকানে সুগারের ওষুধ কিনতে যাচ্ছিলেন। একদল ছেলে হাতে রং নিয়ে ‘দাদু দাদু’ বলে মাখাতে আসে। দাদু বাধা দেওয়ার চেষ্টাও করেননি। ফতুয়া থেকে মাথা, মুখ, কিছুক্ষণের মধ্যে কিছুই আর চেনা যায় না।
সম্পূর্ণা আজ এক চোখ দিয়ে দেখে। তার একটি চোখের রেটিনা ছিঁড়ে যায় সেই রং বেলুনের আঘাতে। অনেক বার অপারেশন করেও সেই চোখ আর ঠিক হয়নি।প্রকাশ জয়সওয়ালের এক চোখের কর্নিয়া ঘা হয়ে, পরবর্তীকালে সাদা হয়ে যায়। ওই চোখটা দিয়ে তিনি শুধু আলোটুকুই বুঝতে পারেন।
কুড়ি বছরের ব্যবধানে উপরের ঘটনা দুটো কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়। প্রতি বছর দোলের দিন এবং তার আগে পরে এরকম শ’য়ে শ’য়ে দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে।আমাদের টনক নড়েনি। যদি নড়ানো যায়, সেই দুরাশাতেই এই লেখার অবতারণা।
আবির বা বিভিন্ন রঙে উপাদান হিসেবে থাকে ক্ষার, অভ্র, কাচের গুঁড়ো, প্রুসিয়ান ব্লু। চোখের বিভিন্ন রকম পর্দায় এদের ক্ষতির পরিমাণ মারাত্মক। এই অ্যালকালি-ধর্মীয় বস্তুগুলি অ্যাসিডের থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর। এদের রাসায়নিক প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত হয় রং-ভরা বেলুনের মিসাইলের মতো ভৌত অভিঘাত। দোলের দিন যারা বিচিত্র ও বিকৃত মানসিকতা নিয়ে রং খেলতে বের হয়, তারা অনেকেই প্রকৃতিস্থ থাকে না। মারামারি লেগেই থাকে এবং তার থেকে চোখে আঘাতের ঘটনা প্রতি বছরই বিপুল সংখ্যায় ঘটতে থাকে।
চোখের রোগীরা দোলের অভিশাপ বয়ে বেড়ান সারা জীবন ধরে:
- চোখের লোম পড়ে গিয়ে, চোখের পাতা কুঁকড়ে, মণি অস্বচ্ছ হয়ে যেতে পারে।
- বিভিন্ন রকমের রাসায়নিকের প্রভাবে চোখের মণিতে ইনফেকশন হয়ে, মণি ফুটো হয়ে যেতে পারে।
- বেলুনের আঘাতে বা রঙের ফলে ছানি পড়ে যেতে পারে।
- চোখের ভেতরে রেটিনাতে বা রেটিনার সামনে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
- কোনও কোনও রোগীর রেটিনা ছিঁড়ে গিয়ে বরাবরের মতো দৃষ্টিও চলে যায়।
- কখনও বা গোটা চোখটাই ফেটে গিয়ে, অস্থি-কোটর থেকে বেরিয়েও আসতে পারে।
- চোখের পাতা পড়ে গিয়ে, কুঁকড়ে, বিকৃত হয়ে গেলে, প্লাস্টিক সার্জারি করে তা ঠিক করার চেষ্টা করা হয়। অনেক সময় একাধিকবার অপারেশন করতে হয়।
- চোখের মণি অল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে ওষুধেই সেরে যায়; বেশি হলে মণি প্রতিস্থাপন করতে হতে পারে।
- বেলুন বা ঘুসির আঘাতে কনীনিকা (Iris) ছিঁড়ে গেলে তারও অপারেশন করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর সারা জীবনই আলো সহ্য করতে অসুবিধা হয়।
- বেলুনের আঘাতে অসময়ে ছানি পড়ে গেলে সে ছানি অপারেশন করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
রেটিনা বা তার সামনের জেলি জাতীয় ভিট্রিয়াসে রক্তক্ষরণ হলে প্রায়শই অপারেশনের প্রয়োজন হয়। রেটিনা ছিঁড়ে গেলে অপারেশন করা ছাড়া উপায় থাকে না। অনেক সময় স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি কখনই ফিরে আসে না। আর নিতান্ত দুর্ভাগ্যবশত যদি গোটা চোখটাই ফেটে যায় (globe rupture), তাহলে পুরো চোখটাই বাদ দিয়ে ফেলে, পরবর্তী সময়ে কৃত্রিম চোখ লাগাতে হতে পারে।
আনন্দের, প্রেমের উদযাপনের এই অসাধারণ রঙের উৎসবে লাগামছাড়া হুল্লোড় কত মানুষের জীবনে ডেকে আনছে অন্ধকার! চোখ বাঁচানোর লড়াই জারি রাখার সঙ্গে সঙ্গে, যে হঠকারিতার জন্য এই বিপদ ডেকে আনা হল তা যদি এড়ানো যায়, তবেই এই বার্ষিক চক্ষুনিধন যজ্ঞ বন্ধ করা সম্ভব।
সিম্প্যাথেটিক অপথ্যালমিয়া (Sympathetic Ophthalmia) নামে একটি মূর্তিমান দুঃস্বপ্নেরও অস্তিত্ব আছে। এক চোখে কোন ধারালো বস্তুর আঘাত থেকে দুচোখেরই অন্ধত্ব হতে পারে। এভাবেই এক আঘাত থেকে খুব ছোটবেলায় দুচোখেরই দৃষ্টি হারান ল্যুই ব্রেইল; পরবর্তীকালে যাঁর ব্রেইল সিস্টেম দৃষ্টিহীনদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়ে ওঠে।
দোলের দিন তাই চোখ বাঁচাতে চোখ ঢাকা চশমা পরে (যদি অসতর্কভাবে দোল খেলতেই হয়) খেলা যেতে পারে, যাঁরা কন্টাক্ট লেন্স পরেন, তাঁরা অবশ্যই কন্টাক্ট লেন্স খুলে রাখবেন। যাদের সঙ্গে খেললে বা যেখানে গেলে রঙের, আনন্দের এই উৎসব অভিশাপ হয়ে উঠতে পারে , তাদের বা সে ধরনের জায়গা এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। আর যদি দুর্ভাগ্যক্রমে রঙের হাত থেকে চোখ বাঁচানো না-ই যায়, প্রাথমিকভাবে খুব ভালো করে পরিষ্কার জল দিয়ে চোখ ধুয়ে চেষ্টা করতে হবে যতটা সম্ভব রং যাতে বার করে দেওয়া যায়। কোনভাবেই চোখ ডলা চলবে না। বড় একটা বাটিতে ভর্তি করে খাবার জল নিয়ে তার মধ্যে চোখ ডুবিয়ে পিটপিট করলে সুফল পাওয়া যায়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চোখের ডাক্তারের কাছে বা নিকটবর্তী হাসপাতালে তো যেতেই হবে।
আনন্দের, প্রেমের উদযাপনের এই অসাধারণ রঙের উৎসবে লাগামছাড়া হুল্লোড় কত মানুষের জীবনে ডেকে আনছে অন্ধকার! চোখ বাঁচানোর লড়াই জারি রাখার সঙ্গে সঙ্গে, যে হঠকারিতার জন্য এই বিপদ ডেকে আনা হল তা যদি এড়ানো যায়, তবেই এই বার্ষিক চক্ষুনিধন যজ্ঞ বন্ধ করা সম্ভব।
ছবি সৌজন্য: Flickr, Wikimedia commons
পেশায় চক্ষুচিকিৎসক। রোগী দেখা ও অপারেশনের বাইরে সময় কাটে লেখালেখি, ফটোগ্রাফি, আবৃত্তি, জঙ্গল আর ঝর্ণাকলম নিয়ে। প্রকাশিত বইয়ের নাম 'পাঁচমিশালি আফ্রিকা'।
One Response
প্রয়োজনীয় লেখা।