নবারুণ ভট্টাচার্য (Nabarun Bhattacharya)। গত পঞ্চাশ বছরের বুদ্ধিজীবী-চিন্তক-লেখকদের সুদীর্ঘ নামের তালিকায় এক ব্যতিক্রমী ও শীর্ষস্থানীয় নাম। সমকালের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী বললেও খুব ভুল হয় না। এ হেন একজন মানুষ তথা শিল্পীর প্রয়াণ আসলে একটা যুগের প্রয়াণ। বেড়ে ওঠার বয়সে তাঁকে আমরা বরাবর সাধারণ মানুষদের ভিড়েই দেখেছি। নানাভাবে আজীবন সাহায্য করেছেন গরিব খেটে খাওয়া মানুষদের। সারাজীবন বিকল্প সংস্কৃতি ও রাজনীতির পরিসরের মানুষদের মুখ নবারুণ। তাঁদের কথাই আপোষহীনভাবে আজীবন লিখেছেন নবারুণ। লিখেছেন কোনও প্রতিষ্ঠানকে পরোয়া না করেই। আর আজ সেইসব লেখাই দুনিয়ার তামাম শ্রেষ্ঠ লেখকদের সাথে অনুদিত হচ্ছে গোটা দুনিয়ায়।
নবারুণ প্রয়াণের দিনে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েই প্রকাশিত হল আমার সম্পাদনায় নবারুণ বইটি। প্রকাশ করলেন আমার দুই শিক্ষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় ও সুমন মুখোপাধ্যায়। নবারুণেরও বহুকালের সহযাত্রী তাঁরা।
এ দিন বিকেল থেকেই প্রবল ঝড়জল চলছিল। তাই কীভাবে মানুষ আসবেন অনুষ্ঠানে, তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা ছিলই। কিন্তু সমস্ত চিন্তাকে উপেক্ষা করে যথাসময়ে হাজির হলেন নানা বয়সী নবারুণ অনুরাগীরা। সেখানে যেমন নবারুণের বন্ধুরা এলেন, তেমনই এলেন আমাদের প্রজন্মের নানা বন্ধুরাও। বড় খোলামেলা পরিবেশ ছিল এদিন। তাই অবাধে আড্ডা চলছিল। কোনও সেলেব্রিটিসুলভ প্যাঁচ ছিল না কোথাও।

সঞ্জয়দা বইপ্রকাশ করার পর বলছিলেন, সত্তর দশকে নবারুণ-অনন্য-সঞ্জয়দের রাসবেহারীর কাফেতে আড্ডার স্মৃতি। বলছিলেন, নবারুণের সাথে তাঁর আলাপ তথা প্রথিতযশাদের থেকে কীভাবে আলাদা ছিলেন তাঁরা…
আমি এরপর বলছিলাম, চার বছর ধরে কেন ও কীভাবে এ বই গড়ে উঠল তার গল্প। মূলত, সাংস্কৃতিক লুম্পেনাইজেশান ও ব্যংকরাপ্ট বুদ্ধিজীবীসমাজ আমাকে বাধ্য করছিল আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ ইন্টেলেকচুয়াল নবারুণের জীবনের নানা অজানা দিক বিশেষত তাঁর স্পিরিচুয়ালিটি-সাংবাদিকতা-থিয়েটারের দিকগুলোকে খুঁড়ে বের করতে। কেন না, তাঁর সম্পর্কে একটা কথাই বহুল প্রচলিত, তিনি গালাগালি লেখেন। অথচ তাঁর বিশ্বদর্শন নিয়ে কিন্তু কথা হয় না তেমন। সুমন মুখোপাধ্যায় তাঁর দীর্ঘ ভাষণে নবারুণের মতো একজন ম্যাভেরিককে নিয়ে কাজ করা ও মেশার মধ্যে দিয়ে যে বিশ্বদর্শনের সংশ্লেষ তা নানা তথ্য ও তত্ত্বের মধ্যে দিয়ে অনবদ্য ভাবে বললেন। বড় পরিশ্রম করে এই ভাষণ দিলেন তিনি অজস্র নোটস এবং নবারুণের লেখার অংশ পাঠের মধ্যে দিয়ে। নবারুণের প্রিয় সংগীত বা তাঁর প্রিয় লেখক বুলগাকভের কথাও বিস্তারে বলেন সুমন।

নবারুণের নানা বন্ধুরাও এসছিলেন এ-দিন। এঁরা কেউ বিখ্যাত নন কিন্তু এঁদের প্রত্যেকের ভেতরেই কোথাও না কোথাও নবারুণের সাথে দীর্ঘ পথচলার দাগ রয়ে গেছে। ঝড়জল উপেক্ষা করেই তাঁরা এলেন। নবারুণ বারবার বলতেন, মানুষের অপমান তাঁকে রাগিয়ে দেয়। সব মানুষের সম্মানই শেষ কথা ছিল তাঁর আচরণে। এই প্রবীণরা অর্থাৎ সমীরদা, বিমলদা, রঞ্জনদারাও শেষে মনখুলে নবারুণের সাথে সেই সম্মানেরই নানা স্মৃতি ভাগ করে নিলেন। কেউ বললেন থিয়েটারের কথা তো কেউ ভাষাবন্ধনের। গোটা অনুষ্ঠানটাই আয়োজনে ছিলেন সপ্তর্ষি প্রকাশনের সৌরভ মুখোপাধ্যায় ও স্বাতী রায়চৌধুরী। বড় যত্ন করে বইটিও ছেপেছেন তাঁরা। তাঁরাই তো প্রথম বড় ভাবে নবারুণকে প্রকাশ করে সাধারণের মধ্যে নিয়ে আসেন। তাই আমার সম্পাদনায় এ বই প্রকাশও কিছুটা গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো। বইটির অনবদ্য প্রচ্ছদ করেছেন বন্ধু ও গদ্যকার অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়।

নবারুণকে ঘিরে অল্পবয়সের মতোই আমাদের এই ফ্রন্ট গতকাল গড়ে উঠল অলৌকিকভাবেই। সেই চেনা ভাষাবন্ধন দপ্তরের সিগারেটের গন্ধ উড়ে আসছিল… উড়ে আসছিল নবারুণকে ঘিরে থাকা মানুষদের এদিনের উপস্থিতিতে সেই ভাইব্রেশন আবারও। উঠে আসছিল নানা স্মৃতি। নবারুণ সশরীরে উপস্থিত না থাকলেও, নিশ্চিতভাবে ছিলেন এ-দিন আমাদের সাথেই, আমার স্থির বিশ্বাস। নাহলে এত মানুষের একসাথে এই নাছোড় ঘোর তৈরি হত না কাল, আমি জানি… আমাদের এই অন্য রকম মানুষদের-অন্য রকম কলকাতার ফ্রন্ট দীর্ঘজীবী হোক… জারি থাক আমাদের এইসব জমায়েত…
ছবি তুলেছেন অনুষ্ক ঘোষাল
পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।