আগের পর্বের লিংক: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০]
বেবিআন্টিকে খুব মনে পড়ে বালকের৷ এমন দাপুটে মহিলা, ওই বয়সে সে বলতে গেলে দেখেনি৷ বাড়িউলি দিদিমণি, যিনি বছরে দু’বার দু’মাস করে পূর্ববাংলার শেরপুর থেকে এসে বস্তিতে কাটিয়ে যেতেন, গমের মতো গায়ের রং, একমাথা কালো চুল, কিছু রুপোলি রেখা-সহ, টানা টানা চোখের ওপর রিমলেস চশমা, পরনে দামি তাঁতের শাড়ি, যিনি হাসি মিশিয়ে অপমানসূচক কথা বলতে পারতেন অক্লেশে, তিনিও বেবিআন্টির মতো দাপুটে নন৷ বেবিআন্টির দাপটটা অন্যরকম৷ গাড়িতে বসে দারোগা হম্বিতম্বি করলে তিনি বলেন,
– পহেলে গাড়িসে উতারিয়ে৷ দেন টক মি৷ ইউ নট মাই লর্ড৷ ওয়ারেন্ট হ্যায় আপকে পাস? হোয়াই সার্চ মাই রুম? ফাস্ট টক মি হোয়াই ইউ কাম৷ আই ক্রিমিনাল? ডোন্ট ডিস্টার্ব৷ গো গো৷
বলতে বলতে দরজার সামনে রাখা বালতি থেকে মগে করে জল তুলে নেন৷ বেগতিক দেখে পুলিশ পালায়৷ একবার নয়, কয়েকবার এই ছবি দেখেছে বালক৷ বড়ো হয়ে শুনেছে, বেবিআন্টির ঘরে গোলমাল ছিল৷ কিছু বেআইনি ব্যাপার-স্যাপার ছিল৷ দাগী লোকজন শেলটার নিত৷ পুলিশ মাসে মাসে পয়সা খেত৷ কখনও কখনও বেশি আদায় করতে গাড়ি নিয়ে হাজির হত৷ এবং বেবিআন্টি হিন্দি-ভাঙা ইংরেজি আর মগভর্তি জল নিয়ে তাড়া করতেন৷ আন্টির নাকি এক বস ছিল, যে পুলিশ অফিসার বা অফিসারদের দোস্ত৷
থারটিনাইন বাই ওয়ান, অর্থাৎ বালকের বসত-ঠিকানার গায়ে গলি, তারপর উকিলের বাড়ি, তারপর বেবি আন্টিদের বসতি৷ দোতলা বাড়ি৷ একতলা ইটের গাঁথনি, ঢালাই ছাদ৷ দোতলা কাঠের তৈরি, টিনের চাল৷ নীচে চারঘর৷ ওপরেও চারঘর৷ ওপরের একঘরে থাকে জলি-শিলারা৷ কাঠের সিঁড়ি৷ বালকের বড়ো হয়ে ওঠার পথে সেই সিঁড়ির ভূমিকা আছে৷ সে কথা পরে হবে৷ মনে আছে বেবিআন্টির চেহারা৷ বেঁটে, সাড়েচার ফুটের বেশি নয়৷ ছোট ও মোটা গলা৷ মধ্যপ্রদেশ বেজায় স্ফীত৷ স্কার্টের নীচে গোদা পা৷ রং বেশ কালো৷ ঘন কালো চুলে লাল নীল সবুজ রোলক্লিপ৷ সর্বদা ফিটফাট৷ কাজল লিপস্টিক৷ বেশিরভাগ সময় গম্ভীর৷ কখনও সখনও ভারি ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি৷ শুধু একটা দিন, রোববার, বেবিআন্টি আপাদমস্তক সাদা, চুলের ফিতে-গাউন মোজাচপ্পল-গ্লাভস, চার্চে যাবার সময়৷ দেখা হলে কোনওদিন বালককে ডেকে নিতেন,
– যাবি? কমলালেবু দিবে৷

বেবিআন্টির ঘরে এলাকার কারও ঢোকার অনুমতি ছিল না৷ দরজায় জানালায় ফুললতাপাতা ছাপা মোটা কাপড় সারাক্ষণ৷ বালককে ঘরে ডেকে নিয়েছিলেন তিনি৷ পুঁচকে ঘর৷ তাতে পেল্লায় খাট প্রায় ঘরজোড়া৷ খাটের গা দিয়ে গলির মতো একটা পথ ভেতরের ঘরে ঢুকে গেছে৷ সে ঘর কখনও দেখেনি বালক৷ নরম গদি আর দামি চাদরে মোড়া খাটে বসবার অধিকারও পেয়েছিল বালক৷ সেই প্রথম খাটে বসা, খাটের আদরে৷ বাঁ দিকে দেয়ালে দারুনির্মিত যিশু খ্রিস্ট৷ ক্রুসিফিকেশনের সিকোয়েন্স৷ ঘরের পশ্চিমদিকে দেয়াল আলমারিতে নানা ডিজাইনের বোতল৷ বালক তখন আর তত বালক নয়৷ মদের বোতল চিনেছে নানাভাবে৷
– তুমি ফ্রেন্ডদের সঙ্গে খেলা করো আমি দেখি৷ কোন ইস্কুলে যাও? শিয়ালদা? সাইকেল আছে? বাই বাস? ইয়োর ফাদার’স জব? বিজনেস? নাথুমুদি কা পাস মেরা সামান হ্যায়৷ প্লিজ ব্রিং দা ব্যাগ৷ কী খাইবে? ক্রিম রোল ইয়া চকোলেট? জলি অ্যান্ড শিলা ব্যাড গার্ল৷ ইউ গুড বয়৷ ডোন্ট গো উইথ দেম৷ মিলনা নহি৷
বেবিআন্টির গায়ে ও ঘরে সুগন্ধ৷ মারফি রেডিয়ো বাজে দরজার বাঁদিকের দেয়ালে কাঠের স্ট্যান্ডে৷ জলিদের ঘরে যেতে কেন মানা, তা বোঝা গেল অনেক পরে। ততদিনে বালক বড়োমতো হয়ে গেছে৷
জলি আর শিলা দু’বোন৷ বেবিআন্টির ঘরের মাথায় যে কাঠের ঘর, সেখানে থাকে৷ দুই বোনকে বালক দেখেছে সন্ধের পর আনোয়ারের হোটেল থেকে ক্যানে খাবার নিয়ে যেতে৷ আনোয়ারের হোটেলের খদ্দেররা সবাই হয় ঘোড়াগাড়ি চালায় নয় ঘোড়ার দেখভাল করে৷ কাছেই আস্তাবল৷ গাড়ি রেখে খেতে আসে৷ ঘোড়ার গা ঘষে, খুরের নাল পালটে খেতে আসে৷ গোস্, শিককাবাব, রুটি৷ দুপুরে রাতে বেশ ভিড়৷ দুই বোন কথা বলতে বলতে আসত, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত, খাবার নিয়ে চলে যেত৷ বালকের চোখে চোখ পড়লে জলি হাসত৷ জলির সঙ্গে পরিচয়, বালক খুবই ছোট তখন৷ হঠাৎই কথা বলেছিল জলি৷ মিশনের মাথাখোলা জিপ রোজ দুপুরে এসে দাঁড়াত ভ্রাতৃ সঙ্ঘের গলির মুখে, বড়ো বড়ো হান্ডা-ভরতি খিচুড়ি আর ঘ্যাঁট নিয়ে। অর্ধেক ইট-অর্ধেক কাঠের অদ্ভুত বাড়ি থেকে, কেউ কেউ মজা করে বলত ‘দো-আঁশলা বাড়ি’, বেরিয়ে আসত মেয়েরা-মায়েরা গামলা-বাটি নিয়ে। জলি-শিলাও আসত, বালক দাঁড়িয়ে থাকত ফুটপাথের ধার ঘেঁষে। একদিন জলি বলল
– কুছ লেনেকা হ্যায়? যাও, ক্যান লেকে আও৷ স্ট্যান্ড ইন দা লাইন।
খাবার দিতে-আসা ‘মে গাড ব্লেস ইউ’ লালদাড়ি হাফপ্যান্ট সাহেবকে কী যেন বলে দিল, বালক দু’হাতা খিচুড়ি পেয়েছিল, জলি হেসেছিল৷ এরপর প্রায়ই বাটি হাতে চলে আসে বালক৷ জলির সঙ্গে দেখা হয়৷ জলি হাসে৷ দিদির মতো অনেকটা৷ দুই বোন তখন ব্যাপটিস্ট মিশন স্কুলে পড়ে৷ স্কুলের পথেও দেখা হয়৷ কবে যেন ওরা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিল৷ বালক যখন ক্লাস নাইন বা টেনে, খিচুড়ির গাড়ি আর আসে না, জলি একদিন ওদের ঘরে নিয়ে গেল৷ ওদের মা শ্যামলা ছিপছিপে মহিলা তক্তপোশে বসে ছিলেন মুখ গুঁজে৷ কথা বলেননি৷ কিছুক্ষণ থেকেই বালক চলে আসে৷ আবার একদিন নিয়ে গেল জলি৷ এভাবে আসা-যাওয়া শুরু৷ জলি কোনও কাজে নীচে গেছে তখন, মহিলা বললেন,
– ইস ঘর মে আয়া মত করো, জলিকা ফাদার লাইক নহি করতা৷ তুমলোগ রিফুজি হ্যায়, হিন্দু হ্যায়৷
জলিকে বলেছিল বালক৷ জবাবে জলি বলে,
– আমাদের বাবা আসে না৷ যারা আসে মায়ের কাছে আসে৷ মায়ের সঙ্গে থাকে৷ বহোত ফালতু হ্যায় ইয়ে লোগ৷ ন্যাস্টি৷

বালকের জীবনে জলি-শিলার পর্ব এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত৷ হয়নি৷ স্পষ্ট মনে আছে, লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের পেছনে সন্ধের নির্জন রাস্তায় প্রায় ছুটছিল শিলা৷ একা৷ বাসরাস্তার দিকে৷ বালক তাকে দেখতে পায়৷ পেছন থেকে ডাকে৷ শিলা দাঁড়ায়৷ জিজ্ঞেস করে কী হল? শিলা তার হাত ধরে৷ সে কাঁপছিল৷ কাঁদছিল৷ কিছু বলে না৷ বাসরাস্তা ধরে খানিক এগিয়ে তারা চিত্তরঞ্জন মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের পাশ দিয়ে সুরেশ সরকার রোড ধরে৷ বাড়ির কাছাকাছি না-আসা পর্যন্ত এই পথটা সেদিনের বড়ো হতে-থাকা বালকের হাত ধরে হেঁটেছে শিলা৷ বলে,
– বাড়িতে কিছু বোলো না৷ দিদিকে কিছু বোলো না৷
বাড়ির দরজার কাছে এসে বালকের জামা ধরে টানে শিলা৷ তেমন বালক নয় সেই ছেলে উঠে পড়ে সিঁড়িতে৷ আলো নেই৷ শব্দ যা আছে দূরে দূরে৷ তাকে জাপটে ধরে মেয়ে৷ এতদিন ব্যবধানে থেকে, লুকিয়ে লুকিয়ে যা দেখেছে ছেলেটি, সেই শরীর অনতিনম্র নিটোল স্তনদ্বয়ের তাপ নিয়ে জড়ায় তাকে৷ আরো কিছু করে নারী৷ বিদ্যুতের তীব্র প্রবাহে ছেলেটির পেশিসকল শক্ত হতে থাকে৷ শিলা চুল ধরে তার মাথা টেনে চুম্বন করে অবশিষ্ট সিঁড়ি ভেঙে পালায়৷ বালক নিজেকে সামলে ধীরে ধীরে নেমে আসে৷ বেশ কয়েকদিন ওই অদ্ভুত বাড়ির দিকে যায়নি৷ মুখ বন্ধ রাখার উপহার? হঠাৎ খবর পেল, শিলা কোথায় চলে গেছে৷ পুলিশ এসেছিল ওদের বাড়িতে৷ সে কিছুই জানতে চায় না৷ শুধু ভেবেছে, ওই ঘটনা ঘটতে দেওয়া ঠিক হয়নি৷ ধীরে ধীরে জলি কেমন যেন হয়ে গেল৷ বালকের দিকে তাকায় না৷ গভীর রাতে ওদের ঘর থেকে মাতাল গলায় গানের কান্না বা কান্নার গান ভেসে আসে৷ জলির গলা৷ ওর মায়ের গলাও কি আছে সঙ্গে?
বেবিআন্টি একইরকম৷ ইচ্ছে হলে ডাকেন৷ বাহাদুরকা দুকান সে দো চকোলেট লাও৷ কোনওদিন দেখেও দেখলেন না৷ থমথমে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন৷ একটা দিন কিন্তু তিনি ডাকবেনই৷ মহালয়ার আগের দিন৷ কাল ভোরে আসবি৷ চা খাবি আমার সঙ্গে৷ বালক কখনও ভুল করেনি৷ ঠিক সময়ে হাজির হয়েছে৷ তখনও রাজনীতির ছোঁয়া লাগেনি জীবনে৷ পাড়ায় রেডিয়ো ক’টা আর তখন৷ বেবিআন্টির মারফি রেডিয়ো দরজার কাছে টেবিলে বসানো৷ ঘরের বাইরে দুটো চেয়ার৷ একটা আন্টির৷ অন্যটা বালকের৷ অক্টোবরের ভোরে তখন ঠান্ডা আবছা অন্ধকার৷ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে মহিষাসুরমর্দিনী৷ যুদ্ধের ঝনঝনা৷ আন্টি মাথা থেকে একটা একটা করে রোলারক্লিপ খোলেন৷ আশপাশে আরো কয়েকজন দাঁড়িয়েছে৷ আলো ছড়িয়ে পড়ছে৷ পবনের কয়লার দোকান খুলল৷ বেবিআন্টি ঘরে ঢুকে চা নিয়ে এলেন৷ ছিদামবাবু গম ভাঙানোর কল চালু করার তোড়জোড় করছেন৷ মেনকার মা হয়তো পরিপূর্ণ চতুর্থ গর্ভ নিয়ে সবজির দোকানের ফুটপাথ ধোয়াচ্ছেন৷ আকাশে শঙ্খ বাজছে৷ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ধাতব স্বরে উচ্চারণ করছেন ‘ইয়া দেবী…।’ (চলবে)
*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৩ সেপ্টেম্বর
*ছবি সৌজন্য: Wikipedia
মধুময়ের জন্ম ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহে, কিশোরগঞ্জে। লেখাপড়া কলকাতায়। শৈশব-যৌবন কেটেছে স্টেশনে, ক্যাম্পে, বস্তিতে। গল্প লিখে লেখালেখি শুরু। পরে উপন্যাস। বই আখ্যান পঞ্চাশ, আলিঙ্গন দাও রানি, রূপকাঠের নৌকা। অনুসন্ধানমূলক কাজে আগ্রহী। পঞ্চাশের মন্বন্তর, দাঙ্গা-দেশভাগ, নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে কাজ করেছেন। কেয়া চক্রবর্তী, গণেশ পাইন তাঁর প্রিয় সম্পাদনা। প্রতিমা বড়ুয়াকে নিয়ে গ্রন্থের কাজ করছেন চার বছর। মূলত পাঠক ও শ্রোতা।