(Nabarun Bhattacharjee)
সভ্যতার আয়না ভেঙে গেলে সাহিত্য তা সারিয়ে তোলে, ধুলো ঝেড়ে পরিস্কার করে এবং তুলে ধরে রাষ্ট্রশক্তির সামনে। সভ্যতা জীর্ণ হয়ে পড়লে লেখককে তাঁর মার্গ নির্দিষ্ট করতে হয়। আয়নার এক টুকরো কাচ হয়ে উঠবেন নাকি সেই আয়নার পিছনে লুকোবেন, সেই বিষয়ে কঠোর থাকা যে সময়ে উচিত ছিল, সেই সময়ে একজন মানুষ নিজস্ব পথ নিপুণভাবে নিয়ে গেছেন স্রোতের বিপরীতে। নবারুণ ভট্টাচার্য (Nabarun Bhattacharjee)। যেন পথের কাঁটাকে সযত্নে স্থান দিয়েছেন বুকের ভিতর জমে থাকা বারুদের মাঝখানে, আর বাই লেন দিয়ে এসেছে যত আখ্যান তা লালন করেছেন যত্নে। কেউ বলেছেন, নবারুণ (Nabarun Bhattacharjee) সাহিত্যকে ঘেঁটে দিয়েছেন, কেউ বলেন সুবিধাবাদী আবার কেউ বলেছেন প্রতিষ্ঠানবিরোধী। (Nabarun Bhattacharjee)
আরও পড়ুন: নবারুণ ভট্টাচার্যের উপন্যাস বা আখ্যান
সবকিছু পেরিয়ে আদ্যপান্ত রাজনৈতিক মানুষ হলেও ছিলেন প্রবলভাবে প্রগতিশীল ও সমালোচক। মানুষের কথাই ছিল তাঁর সৃষ্টির অন্যতম দিক। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় সৃষ্টি ও স্রষ্টা কোনও ক্ষেত্রে আলাদা মাত্রার হয়ে ওঠে। যদিও নবারুণ ছিলেন ব্যাতিক্রম। তিনি যেভাবে নিজেকে প্রতিস্থাপন করেছেন, তাঁর সৃষ্টিকেও নিয়ে গিয়েছিলেন সেই অমোঘ ধারায়। ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন বহরমপুরে জন্মগ্রহণ করেন মহাশ্বেতা দেবী ও বিজন ভট্টাচার্যের সন্তান নবারুণ ভট্টাচার্য, তিনি যেন নিজেই হয়ে উঠেছিলেন সমাজ দেখার টেলিলেন্স। আর সেই টেলিলেন্সে দেখা সমাজের ছিটকে যাওয়া নক্ষত্ররেখা ফুটে উঠছে ভাষার আদলে। বাবা বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে ছিল ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা ও কৃষক, শ্রমিক তথা মেহনতী মানুষের সংগ্রাম এবং মা মহাশ্বেতা দেবী ছিলেন আদিবাসী মানুষদের ক্ষমতায়নের কণ্ঠস্বর। এই দুইয়ের মেলবন্ধন নবারুণ ভট্টাচার্যের ব্যক্তিত্বে, সাহিত্যে, জীবন ধারায়। (Nabarun Bhattacharjee)
সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাত, তির্যক সমালোচনা, রাজনৈতিক সমীকরণ, মানুষের মুখের ভাষা তথা রাস্তাঘাটের তথাকথিত জীবন যেভাবে তাঁর লেখায় উঠে এসেছে, সেই রচনাশৈলী যেন এক বিশেষ ধারার জন্ম দিয়েছিল। তাঁর লেখায় উঠে আসে সমসাময়িক ঘটনার শ্লেষ, বিদ্রোহ, আকণ্ঠ সত্যতা।
সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাত, তির্যক সমালোচনা, রাজনৈতিক সমীকরণ, মানুষের মুখের ভাষা তথা রাস্তাঘাটের তথাকথিত জীবন যেভাবে তাঁর লেখায় উঠে এসেছে, সেই রচনাশৈলী যেন এক বিশেষ ধারার জন্ম দিয়েছিল। তাঁর লেখায় উঠে আসে সমসাময়িক ঘটনার শ্লেষ, বিদ্রোহ, আকণ্ঠ সত্যতা। পুঁজিবাদী কাঠামোর বিরোধী ছিলেন তিনি, ‘হারবার্ট’, ‘কাঙাল মালসাট’, ‘খেলনা নগর’, ‘লুব্ধক’ প্রভৃতি উপন্যাস প্রণালীতে এইসব চিত্র পরিস্কার ফুটে ওঠে। অন্যান্য উপন্যাস ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’, ‘অটো ও ভোগী’, ‘ফ্যাতাড়ু ও চোক্তার’, ‘মবলগে নভেল’ প্রভৃতি সাহিত্যের জগতে জন্ম দিয়েছিল বিরুদ্ধ স্বরের, জন্ম দিয়েছিল খ্যাতির প্রতি ঘৃণা ও সৃষ্টির প্রতি সৎ থাকার স্পর্ধা। ১৯৭০ সালে বারাসাতে ৮ জন বামপন্থী খুন হওয়ার পর তিনি লিখলেন ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ কবিতাটি, যা হয়ে উঠল সময়োত্তীর্ণ। ১৯৮৩ সালে ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ নামেই প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম কবিতার বই। আজও শাসকের রোষের সামনে এই কবিতাই হয়ে ওঠে প্রতিবাদের গণসঙ্গীত। জীর্ণ সভ্যতার ভিতর বারুদের দলিল তাঁর রচনা প্রবাহ। (Nabarun Bhattacharjee)
ভীরু, কাল্পনিক, মনোটোনাস কেন্দ্র থেকে সরে গিয়ে তিনি জন্ম দিয়েছিলেন বাস্তবধর্মী, প্রতিবাদী, দৃঢ় চেতনাধর্মী, সামাজিক ছোটগল্পের। ‘হালাল ঝান্ডা’, ‘ফ্যাতাড়ুর কুম্ভীপাক’, ‘ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক’, ‘ফ্যাতাড়ু বিংশতি’ প্রভৃতি গল্পগ্রন্থ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। ১৯৭৩ সাল থেকে দীর্ঘদিন বিদেশি সংস্থায় কাজ করে ১৯৯১ সালের পর থেকে কবি বিষ্ণু দে –র পত্রিকা ‘সাহিত্যপত্র’ সম্পাদনা করেন। দীর্ঘদিন ‘নবান্ন নাট্যগোষ্ঠী’ পরিচালনা করেছিলেন। ২০০৩ সালের পর ‘ভাষাবন্ধন’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে তাঁর ‘হারবার্ট’ উপন্যাসের জন্য তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের দেওয়া কথাসাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘বঙ্কিম পুরস্কার’ ২০০৭ সালে নন্দীগ্রাম গণহত্যার প্রতিবাদ স্বরূপ পুরস্কার ফেরত দেন। ১৯৯৭ সালে ‘হারবার্ট’ উপন্যাসের জন্য নবারুণ ভট্টাচার্য ভারত সরকারের থেকে ‘সাহিত্য আকাদেমি’ পুরস্কার গ্রহণ করেন। (Nabarun Bhattacharjee)
‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমার রিমেক প্রসঙ্গে নবারুণ ভট্টাচার্য বলেছিলেন: “এমন এক লুম্পেনের সমাজে আমরা বাস করছি, যেখানে কোনও পরিচালক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতে পারেন না ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমাটি তিনি রিমেক করবেন।”
নবারুণ ভট্টাচার্যের দাদু ছিলেন বিখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব মণীশ ঘটক, আত্মীয় ছিলেন ঋত্বিক ঘটক। এই দু’জন মানুষের সংস্পর্শে তাঁর ভিতর জন্ম হয়েছিল সমাজকে শিল্পীর নজরে দেখার গভীর বোধ। যা তাঁর রচনায়, কথায় বারবার উঠে আসে, এমনকি ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমার রিমেক প্রসঙ্গে নবারুণ ভট্টাচার্য বলেছিলেন: “এমন এক লুম্পেনের সমাজে আমরা বাস করছি, যেখানে কোনও পরিচালক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতে পারেন না ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমাটি তিনি রিমেক করবেন।” (Nabarun Bhattacharjee)
পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘হারবার্ট’, ‘কাঙাল মালসাট’ প্রভৃতি উপন্যাসকে চলচ্চিত্রায়ন করেছেন এমনকি মহানগর@কলকাতা সিনেমাটিও নবারুণ ভট্টাচার্যের রচনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করেন। তাঁর রচনা থেকে সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত সিনেমা সেন্সর করা হলে নবারুণ ভট্টাচার্য বলেন, “এটা কখনোই সম্ভব নয় যে, আজকের দিনে আমি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় লিখব। আমি সাম্প্রতিক মানুষের ভাষায় লিখি। সরকারের প্রতি শিল্পের তির্যক দৃষ্টি থাকলেই আইনি সমস্যা না করে সহনশীল হলে তাদেরই ভালো।” নবারুণ ভট্টাচার্যের রচিত ফ্যাতাড়ু বেশ কিছু নাটকের মূল চরিত্র হয়ে উঠেছে। (Nabarun Bhattacharjee)
নবারুণ ভট্টাচার্য সাহিত্যের সঙ্গে আপোস করেননি কোনোদিন। যে জীবন তিনি দেখেছেন তাই লিখেছেন। এমনকি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ভাষা ও স্ল্যাং তাঁর লেখায় অনন্য মাত্রা পেয়েছে।
নবারুণ ভট্টাচার্য সাহিত্যের সঙ্গে আপোস করেননি কোনোদিন। যে জীবন তিনি দেখেছেন তাই লিখেছেন। এমনকি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ভাষা ও স্ল্যাং তাঁর লেখায় অনন্য মাত্রা পেয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন, কমিউনিস্ট হলেও সমালোচনা করেছেন বামপন্থার কাঠামো, ক্ষমতার ব্যবহার, অবস্থান, নীতি নিয়ে। ২০১৪ সালের ৩১ জুলাই আন্ত্রিক ক্যান্সারের কারণে মৃত্যু হয় তাঁর। যদিও তাঁর কণ্ঠস্বরের মৃত্যু হয়নি। আজকের সমাজে আজও তাঁর রচনা প্রবাহমান। (Nabarun Bhattacharjee)
অরিন চক্রবর্তী। উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাতে বেড়ে ওঠা। সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা। ছোট পত্রিকা প্রিয়, শব্দের ভিতর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে এই জীবন।
One Response
পড়ে খুব ভালো লাগলো, অরিনকে অভিনন্দন…