banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

নবারুণ ভট্টাচার্যের উপন্যাস বা আখ্যান

ঋভু চট্টোপাধ্যায়

জুন ২৩, ২০২৩

Feature on novelist Nabarun Bhattacharya
Feature on novelist Nabarun Bhattacharya
Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

উপন্যাস শব্দটি ইংরেজি Novel শব্দের পরিভাষা রূপে গৃহিত হলেও এর অর্থ বাক্যারম্ভ (উপ-নি-অস্+ঘঞ+ভাব) আমরা সাধারণভাবে উপন্যাস বলতে গদ্যে লিখিত একটি দীর্ঘ কোনও উপস্থাপনাকে বুঝি, যার বিশাল পটভূমিতে ফুটে ওঠে সমাজ ও মানবজীবনের বিভিন্ন আখ্যানবর্তমানে বাংলায় ‘উপন্যাস’ নামে আমরা ঠিক যাকে বুঝি এর চর্চা তূলনামূলক নতুন হলেও রামায়ণ, মহাভারত এমনকি বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যের মধ্যেও উপন্যাসের বীজ লুকিয়ে আছে।

উনিশ শতকে পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাবে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত ‘নববাবুবিলাস’ নামক ব্যাঙ্গাত্মক রচনার মধ্যে উপন্যাসের লক্ষণ ফুটে উঠতে দেখা যায়। এরপর ভূদেব মুখোপাধ্যায় ও প্যারিচাঁদ মিত্রের হাত ধরে বাংলা উপন্যাস লেখা হলেও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে আধুনিক বাংলা উপন্যাসের জনক বলা হয়। বাংলা ভাষাতে এরপর বহু উপন্যাস লেখা হয়। কোনটি সামাজিক, কোনটি আঞ্চলিক, কোনটি আত্মজীবনীমূলক, কোনটি মনস্তাত্ত্বিক। সমাজের নিম্নবর্গের মানুষদের নিয়েও বাংলাতে বহু উপন্যাস লেখা হয়েছে, এই প্রসঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অদ্বৈত মল্লবর্মণ থেকে কমলকুমার মজুমদার, মহাশ্বেতা দেবী প্রমুখ ঔপন্যাসিকদের নাম করা যায়। এরপর বাংলা উপন্যাসের পটভূমিতে নকশাল আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, এমনকি বামপন্থা ও বাংলা উপন্যাসের বিষয় হয়ে ওঠে। কিন্তু যাকে নিয়ে আলোচনা করা হবে ইনিই একমাত্র বাংলা ঔপন্যাসিক যাকে নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক কোনওটার শেষ নেই। তাঁর উপন্যাসের শৈলী তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছেন এবং হয়ত তাঁর মৃত্যুর সঙ্গেই এই শৈলী শেষ হয়ে গেছে। আমি নবারুণ ভট্টাচার্যের কথা বলছি।

Nabarun Bhattacharya

বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক ভার্জিনিয়া উল্ফ তাঁর ‘Modern Fiction in The Common Reader’ লিখেছেন Life is not a series of gig lamps symmetrically arranged, life is luminous holo, a semi transparent envelope. এই প্রসঙ্গে অবশ্য Elizabeth Bowenএর কথা উল্লেখ করতে হয় তিনি তাঁর ‘Notes on writing a Novel’ গ্রন্থে লিখেছিলেন উপন্যাসের কোনও চরিত্রই ঔপন্যাসিকের তৈরি নয়— হয় খুঁজে বের করা, না হয় আগে থেকে মনের ভিতর থাকা, যা লেখার সঙ্গে বেরিয়ে আসে তিনি আরও বিশ্বাস করতেন, উপন্যাসের প্রত্যেকটি চরিত্র রাউন্ড চরিত্র হবেনবারুণের লেখার মধ্যেও এই এনভেলপের উপস্থিতি লক্ষ করি, যা পাঠকদের মুহূর্তের মধ্যে একটা ট্রান্সের মধ্যে নিয়ে যায় 

বিজন ভট্টাচার্য ও মহাশ্বেতা দেবীর একমাত্র সন্তান নবারুণ ভট্টাচার্যের জন্ম মুর্শিদাবাদে, পড়াশোনা বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুল ও আশুতোষ কলেজে প্রথমে ভুতত্ত্ব নিয়ে ভর্তি হলেও পরে সিটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর বিদেশি সংবাদপত্রের অফিসে কাজ আরম্ভ করেন, বেশ কিছু বছর কাজও করেন(১৯৭৩-১৯৯১)। বিষ্ণু দের ‘সাহিত্য পত্র’ কিছু দিন সম্পাদনার পর ২০০৩ সাল থেকে সম্পাদনা করতে আরম্ভ করেন ‘ভাষাবন্ধন’ পত্রিকাটি।

আরও পড়ুন: সাহিত্য আর বিপ্লব

নাটক ও কথাসাহিত্যের আবহে বেড়ে উঠলেও বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রথম পা রাখা কবি হিসাবে ১৯৬৮ সালে পরিচয় পত্রিকায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভাসান’ প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ এই ‘মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ হিন্দিতেও অনুবাদ হয়, তাই হিন্দি ভাষার মানুষ তাঁর লেখা সম্পর্কে পরিচিত ছিলেনতাঁর ‘হালাল ঝাণ্ডা’(১৯৮৭) বইয়ের সূত্রেও অন্য ভাষার পাঠকদের কাছে তাঁর পরিচিতি ছিলপ্রথম কবিতার বই দিয়ে আত্মপ্রকাশ হলেও কথাসাহিত্যে তাঁকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয় ১৯৯৩ সালের প্রথম দিকে ‘হারবার্ট’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হবার পর। স্বয়ং শঙ্খ ঘোষ তাঁর এক লেখায় বলেন, ‘গত পাঁচ বছরের মধ্যে এটিই সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।’ দেবেশ রায় বলেন, ‘এই একটা উপন্যাসেই প্রমাণ হয়ে গেছে নবারুণ একজন জাত ঔপন্যাসিক।’
এই উপন্যাসের জন্যে তিনি নরসিংহ দাস পুরস্কার(১৯৯৪), বঙ্কিম পুরস্কার(১৯৯৬) ও সাহিত্য আকাডেমি পুরস্কার(১৯৯৭) পান। এই উপন্যাসকে কেন্দ্র করে নাটক ও সিনেমাও তৈরি হয়েছে।

Bijan bhattacharya - Mahasweta Devi
বিজন ভট্টাচার্য ও মহাশ্বেতা দেবীর একমাত্র সন্তান নবারুণ

তাঁর লেখাতে বারবার বিভিন্ন রকমের ঝুঁকি নিয়েছেন তিনি। চোখের সামনে একদিকে যেমন নকশাল আন্দোলন দেখেছেন, অন্য দিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। হয়ত তাই নির্মমভাবে বলতে পারেন, ‘যে পিতা তার সন্তানের লাশকে শনাক্ত করতে ভয় পায়, আমি তাকে ঘৃণা করি।’ এই বাংলায় যখন নকশাল আন্দোলন, ঐ বাংলায় তখন সামরিক শাসন-বিরোধী আন্দোলন চলছে দুটো ক্ষেত্রেই শাসক ও শোষকের চরিত্র এক। নবারুণ তাঁর নিজের লেখাকে রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিসমের অংশ মনে করতেন। তিনি বলতেন, “কাফকা আমার কাছে একটা ল্যাবরেটেরি।” “যে তাগিদ থেকে আমি লিখি তার সঙ্গে বাজারের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে।” তাঁর উপন্যাস-সমগ্রের ভূমিকাতে ঠিক এভাবেই নিজের ঔপন্যাসিক-সত্তাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে সমস্ত পাঠকের কাছে অনুরোধও করেছেন, ‘আমার আখ্যান (উপন্যাস নয়) তার ব্যর্থতা ও সফলতার পাশে লেখাগুলির সাথে কোন রাজনৈতিক যোগসূত্র আছে কিনা..’ সেগুলিও বিচার করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, “ভালো ফুটবল খেলতে পারলে এ লাইনে আসতাম না।”

‘শিল্পের জন্য শিল্প’— এই তত্ত্বে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন নাতিনি বড় হয়েছিলেন বঞ্চিত নিপিড়িত মানুষের মধ্যে। হয়ত এই জন্যেই চিরকাল ঘৃণা করেছেন সাহিত্যের নামে ঢ্যামনামিকে, ঘেন্না করেছেন সেইসব মানুষরূপী রাক্ষসদের, যারা কারখানার জমি কেড়ে হাজার হাজার মানুষের পেটে লাথি মেরে আকাশচুম্বী ইমারত তৈরি করে তার ভেতরে থাকে, আর সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিক কৃষকদের গুন্ডা বা বেশ্যা হতে বাধ্য করে। নবারুণ বারবার তাদের হয়েই কলম ধরতে চেয়েছেন, কারণ তাঁর মতে লেখক চিয়ারলিডার নয়। 

তাঁর লেখাতে বারবার বিভিন্ন রকমের ঝুঁকি নিয়েছেন তিনি। চোখের সামনে একদিকে যেমন নকশাল আন্দোলন দেখেছেন, অন্য দিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। হয়ত তাই নির্মমভাবে বলতে পারেন, ‘যে পিতা তার সন্তানের লাশকে শনাক্ত করতে ভয় পায়, আমি তাকে ঘৃণা করি।’

তাঁর ‘হারবার্ট’ প্রকাশিত হয় ‘প্রমা’ পত্রিকার শারদ সংখ্যায়সম্ভবত প্রকাশক সুরজিৎ ঘোষের ব্যক্তিগত উৎসাহে শোনা যায় শঙ্খ ঘোষ ও দেবেশ রায়ের পাশাপাশি মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ও উপন্যাসটি পছন্দ করেন। এমনকি সেই সময় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কলকাতার একটি নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন থাকবার সময় ‘হারর্বাট’ পড়েনউপন্যাসটির সব থেকে চমকপ্রদ বিষয় হল শহুরে খিস্তি ও রাস্তার কথাবার্তার সাথে সেই সময়কার নব্বই-এর দশকের আধ্যাত্মিকতাউপন্যাসটি শুরু হয় বিজয় চন্দ্র মজুমদারের একটি কবিতার দুটি লাইন দিয়ে, ‘চরণে বন্ধন নাই, পরাণে স্পন্দন নাই/ নির্বাণে জাগিয়া থাকি স্থির চেতনায়’, এরপর প্রতিটি পরিচ্ছেদে এরকম আরও কবিতার ছোট ছোট অংশের ব্যবহার আমরা পাই, এবং অদ্ভুত ব্যাপার হল সমগ্র উপন্যাসের আত্মার সাথে এই পঙক্তিগুলির একটা যোগসূত্র আছেযদিও একটি সাক্ষাৎকারে নবারুণ নিজে বলেছেন, ‘আমি অত কিছু ভেবেচিন্তে লিখিনি’ 

‘হারবার্টের’ হিন্দি অনুবাদ করেন মুনমুন সরকার ও ইংরেজিতে অনুবাদ করেন জ্যোতি পঞ্জোয়াতিনবারুণ নিজে লিখেছেন, ‘হারবার্ট লেখার সময় দুনিয়ার বামপন্থার শোচনীয় অবস্থা ছিল

Nabarun

মুশকিল হল উপন্যাসটি সিনেমা হয়ে নন্দন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির সময় বেশ জটিলতা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয় নবারুণের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ভোগী’ ১৯৯৩ সালে ‘বারোমাস’ শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এবং ২০০৭ সালে ‘অটো ও ভোগী’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ‘অটো’ উপন্যাসের সাথে। দুই উপন্যাসেই নবারুণ তুলে আনেন এক নেমেসিস, দেখা যায় এই মৃত্যু উপত্যকায় মানুষ নামের চরিত্রের কেবলমাত্র দুটিই ভূমিকা হতে পারে— নিঃশব্দ ঘাতক অথবা পরাজিতের। ‘ভোগী’ উপন্যাসটি এই সমাজের ভোগবিলাস ও সাধারণভাবে বেঁচে থাকবার একটা দ্বন্দ্ব, যার মূল বিষয় হল, ‘অল আউট কোরাপসন এবং তার থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে সোসাইটির চেষ্টা’ ভোগী এই সমাজ থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, ‘যাওয়ার সময় পুঁটুলিটা নালার জলে ফেলে দেয় কিছুটা ঘোলা জল হাতে নিয়ে মাথায় দেয়’ ভোগী যাকে মিথিল নিয়ে বাইরে বের হয় ও পরিচয় দেয়, ‘ কি বলব, সাধুসন্তের মতোই মানুষ, নাম হল ভোগী’ এই ভোগী অটো ড্রাইভারের গালিগালাজ শুনে আনন্দ পায়, অথচ  ‘সব আগে  থেকে বুঝতে পারে’ নবারুণের আরও অনেক উপন্যাসের মত এখানেও কবিতার ব্যবহার বেশ প্রাসঙ্গিকএই কবিতা কখনও মিমির সনেট, ‘সঙ্গমরত টিরানো সোরাস/ কন্ডোম দিয়ে করে প্রাতরাশ’ অথবা ‘ডাইনে আল্লার তলোয়ার/ বামেতে মহম্মদের ঢাল’ কখনও বা এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কবিতার প্রসঙ্গও টানা হয়উপন্যাসের বিষয়টিকে নবারুণ এক কথায় বলেছেন, ‘ক্যাপিটালের সাথে হিউমানিটির লড়াই’ তবে শেষটি বেশ অদ্ভুত, অ্যাবরাপ্ট, একটা সিনেমাটোগ্রাফিক পরিবেশে উপন্যাসটি শেষ হয়

নবারুণের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ভোগী’ ১৯৯৩ সালে ‘বারোমাস’ শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এবং ২০০৭ সালে ‘অটো ও ভোগী’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ‘অটো’ উপন্যাসের সাথে। দুই উপন্যাসেই নবারুণ তুলে আনেন এক নেমেসিস, দেখা যায় এই মৃত্যু উপত্যকায় মানুষ নামের চরিত্রের কেবলমাত্র দুটিই ভূমিকা হতে পারে— নিঃশব্দ ঘাতক অথবা পরাজিতের। ‘ভোগী’ উপন্যাসটি এই সমাজের ভোগবিলাস ও সাধারণভাবে বেঁচে থাকবার একটা দ্বন্দ্ব, যার মূল বিষয় হল, ‘অল আউট কোরাপসন এবং তার থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে সোসাইটির চেষ্টা।’ 

‘আজকাল’ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় ‘অটো’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে। পরে ‘অটো’ ও ভোগী গ্রন্থাকারে একসাথে প্রকাশিত হয়। ‘অটো’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র চন্দন, সে ভাড়ার অটো চালায়, অন্য দিকে অটো আটকে দুষ্কৃতি ধরে, ঝগড়া ঝামেলা করে, গুলিও করে, নেশা করে। তার সঙ্গে থাকে আরও কয়েকটি চরিত্র, যেমন মিউটুয়াল ম্যান, চন্দনের বউ মালা, হেডব্যান্ড। চন্দনকে তার সমাজে সবাই ধ্বজো বলে ডাকে। উপন্যাসটিতে আমরা এই সমাজের ঝুপসি (কম আলো, তবে অন্ধকার নয়) জীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি এই সমাজকে নতুনভাবে দেখতে পাই।

১৯৯৬ সালে ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকার শারদ সংখায় ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থাকারে প্রকাশের পাশে উপন্যাসটি মঞ্চস্থও হয়।‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ উপন্যাসের মূল বক্তব্য, ‘সমাজতন্ত্রের জন্য রাস্তায় গরিব ভিখিরি ও কোন প্রাণীর উৎসাহ থাকলেও যুদ্ধ হচ্ছে না।’ উপন্যাসটিতে প্রথাগত কোনও কাহিনি নেই, আছে কিছু আখ্যানমূলক বর্ণনা। মূল চরিত্র রণজয়। নকশাল আন্দোলনের সাথে যুক্ত, স্বপ্ন দেখে, আবার অ্যাসাইলামেও থাকতে হয়। উপন্যাসটিতে সত্তর দশকের কলকাতার বাস্তব অবস্থাটির বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও বর্ণনাটি খণ্ড খণ্ড ভাবে করা।

১৯৯৮ সালে ‘তথ্যকেন্দ্র’ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নবারুণ বলেন, “শারদীয়ার লেখালেখি নিয়ে আমি খুব একটা ব্যস্ত থাকি না। তবে আগামি পুজোতে ‘প্রতিদিন’-এ একটা উপন্যাস লেখার কথা আছে।” এই লেখাটি হল ‘খেলনা নগর’। খেলনা আর পুতুল ঘিরে ৪৮৭ জন মানুষের এক উপনিবেশ, সেখানে যেমন প্রেমিক-প্রেমিকা থাকে তেমনিই থাকে উইন্ডচিটার নামে এক বহিরাগত। উপন্যাসটি আমাদের অনিশ্চয়তার ভরা এক সময়ের চাকার সামনে দাঁড় করায়, যেখানে প্রতিমুহূর্তে আমাদের লড়াই করে যেতে হয়। এই উপন্যাসটি প্রকাশ পাবার আগেই সুশীল গুপ্তার মাধ্যমে হিন্দিতে অনুবাদ হয়। নবারুণ এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নির্মমতার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। ‘খেলনা নগর’ উপন্যাসটি নবারুণের অন্যান্য উপন্যাসের মতই ভোগবাদ আর সমাজবাদ দ্বন্দ্ব। এখানে লরিতে ক্লিনার হিসাবে কাজ করতে আসা কুমার প্রেমে পড়ে জিশার। সেই সঙ্গে উপস্থিত হয় উইণ্ডচিটার, যার আসল পরিচয় জানা যায় না, আরো কিছু চরিত্র থাকে যাদের ৮/৯ বলে সম্মোধন করা হয়। ‘খেলনা নগর’ আদপে একটি কারখানা, যে কারখানাটির উপর নিউট্রন বোমা পড়ে, যাকে কেউ কেউ ‘ক্যাপিটালিস্ট বম্ব বলে।’ এই উপন্যাসেও নবারুণের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মতামতটি খুব স্পষ্ট। তিনি লেখেন, ‘বড়লোকের দেশে এসব আবর্জনা তৈরি করলেও জমতে দেয় না, গরিব দেশগুলোতে পাচার করে দেয়।’ আসলে এই সাম্রাজ্যবাদের কাছে বাকি পৃথিবী একটা খেলনানগর মাত্র।

তাঁর প্রথম ধারাবাহিক উপন্যাস হল ‘কাঙাল মালসাট’। এটিই লেখকের সব থেকে বড় উপন্যাস। প্রায় ১৮টি পরিচ্ছেদে এটি প্রকাশিত হয়, এমনকি গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময়েও শেষ তিনটি পরিচ্ছেদ সংযোজিত হয়, তারপর ২০০৩ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে ‘ভাষাবন্ধন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসে লেখক সচেতনভাবে একটি অন্য ধরনের নির্মাণ কৌশল ব্যবহার করেছেন। তিনি নিজে বলেছেন ‘ডায়ালগের উপর জোর দেবার চেষ্টা করা হয়েছে, তার সাথে আছে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা।’  উপন্যাসটিতে জাদুবাস্তবতার আড়ালে অন্য আরেক আখ্যানের জন্ম দেয়। সমাজব্যবস্থা, বাস্তবতা, মিডিয়া তৎকালীন শাসক সবের মাঝে তৈরি হওয়া নেক্সাস কীভাবে একটি মানসিক বিদ্রোহের জন্ম দেয় তারই দলিল এই উপন্যাস। আমরা বেশ কিছু অদ্ভুত চরিত্র পাই, যেমন ফ্যাতাড়ু, চোক্তার। এই উপন্যাসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল— বাংলা অপশব্দের বহুল ব্যবহার। অবশ্য শ্রী দেবেশ রায় উপন্যাসটির মধ্যে একটি অচেতন স্থূলতা লক্ষ করেছেন।

Kangal Malsat
সুমন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় 'কাঙাল মালসাট' ছবির পোস্টার

‘আমার যেমন অধিকার আছে, মশারও অধিকার আছে আমাকে কামড়াবার।’ লুব্ধক উপন্যাস প্রসঙ্গে এটিই ছিল নবারুণের ভাবনা। উপন্যাসটি ‘দিশা’ সাহিত্য পত্রিকার শারদা ১৪০৭ (২০০৩) সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ‘ইউ.এস সার্জিকাল কর্পোরেশন নামের একটি সংস্থা শল্য চিকিৎসার জন্য একটি বিশেষ ধরণের স্টেপলার বানাত, তা কতটা কার্যকর সেটা দেখানোর জন্য জীবন্ত কুকুরদের ব্যবহার করা হত।’ এই উপন্যাসটির বিষয় সেই ভাবনা থেকেই নেওয়া। অনেকে এই উপন্যাসটিকেই নবারুণের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলেন। বিষয়বস্তু কলকাতা শহর থেকে নেড়ি কুকুরদের উৎপাটন। চরিত্র কয়েকটি নেড়ি কুকুর, যাদের নাম ‘কান গজানো’, ‘সাদাটে’, পাটকিলে। এদের কারোর গায়ে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারা হয়, কেউ মারা যায় অ্যাক্সিডেন্টে, কারোর বাচ্চাদের অত্যাচার করা হয়। কুকুর মারবার বিভিন্ন পরিকল্পনা করা হয়, যেগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হিটলার তাঁর নাৎসি জমানায় প্রয়োগ করেছিলেন, এমনকি শেষ দিকে দেখা যায় কাজ না করলে বা শারীরিক শক্তি না থাকলে মানুষ ও কুকুর কারোর কোনও পার্থক্য হয় না। তাই বয়সকালে বড়লোকের বাড়ির পোষা জিপসি আর রাস্তার নেড়ি কানগজানোর মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। আবার প্রয়োজনে কুকুর বিড়াল উভয়ে উভয়ের বন্ধু হয়ে যেতে পারে। আসলে উপন্যাসটি একটি প্যারবেল, যেখানে নবারুণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা, আশাহীনতাকে ব্যাখ্যা করেছেন। কারণ, ‘মানুষ আর কুকুরের মধ্যে স্নায়বিক ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি যদি অভিন্ন হয়।’ এই উপন্যাসেও আমরা বেশ কিছু কবিতার উল্লেখ পাই। ‘অলৌকিক ভিক্ষাপাত্রের মত চাঁদ/ দাঁতে কামড়ে ছুটে যাচ্ছে রাতের কুকুর।’ অথবা ‘রাস্তায় মানচিত্র হয়ে ঘুমায় কয়েকটি ক্লান্ত কুকুর।’ কবিতার পাশে ‘চে‘গুয়েভারার দিনলিপি’ এমনকি ‘নৈষ্কর্মা সিদ্ধিতে’ মানুষের সাথে কুকুরের সমগোত্র বিষয়ে একটি শ্লোকেরও ব্যবহার করেন। সেই সঙ্গে উল্লেখ করেন শাটলবক্স পরীক্ষা ও লাইকা প্রসঙ্গ। 

নবারুণ_ভট্টাচার্য

নবারুণের ‘মসোলিয়াম’ উপন্যাসটি অন্য ধরণের উপন্যাস হলেও অনেকেই এর সঙ্গে ‘কাঙাল মালসাট’-এর মিল পান। উপন্যাসটির আঙ্গিকে জাদুবাস্তবতার অনন্য ব্যবহার পাঠকের মন কাড়ে। সেই সঙ্গে আছে তীব্র স্যাটায়ার। সমাজের সব স্তরে যেভাবে অবনমন হয়েছে তার একটি জ্যান্ত দলিল এই উপন্যাসটি। নবারুণের অন্য উপন্যাসের মতো এখানেও বেশ কয়েকটি কবিতার ব্যবহার হয়েছে, সেই সঙ্গে রয়েছে খিস্তির ব্যবহার। তবে এই উপন্যাসে এই খিস্তির ব্যবহার খুব বেশি মাত্রায় রয়েছে। স্যাটায়ারের তীব্র ফলাতে বিদ্ধ হয় সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। তাই কবি পুরন্দর ভাট, ‘বাল সিরিজের’ কবিতা লেখে, সাপ্তাহিক ‘ভ্যামপায়ার’ পত্রিকা  এক হাজারটি কপি প্রকাশিত হলেও মাত্র তিন কপি বিক্রি হয়, অথচ প্রচুর বিজ্ঞাপণ জোগাড় করে। রাজনৈতিক দলগুলি নিজের নিজের অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ হাইকমান্ডের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে, কেউ বা মমির ভিতর হিন্দুত্ব খোঁজে। অন্যদিকে পোকামাকড় সমগোত্রীয় বাঙালি শুধু সুযোগ খুঁজতেই ব্যস্ত থাকে।  

এই জাতীয় লেখাগুলি কেন লেখেন, এই প্রশ্নের উত্তরে নবারুণের কৈফিয়ৎ ছিল, ‘আমি একটু আমোদগেঁড়ে আছি। হাজার দুঃখ, হাজার কষ্টের মধ্যেও মানুষকে যেভাবে আনন্দের সন্ধান করতে দেখেছি, কিন্তু এই যে এত লোক আনন্দ করছে, আমি হয়ত তাদের মত করে আনন্দ করতে পারি না। ….’ এখান থেকেই উপন্যাসটির সৃষ্টি। 

নবারুণ নিজেই এক জায়গায় লিখেছেন ‘ডেভেলপমেন্ট তত্ত্বে আমি ঠিক বিশ্বাস করি না।’ তাহলে তাঁর উপন্যাস কি হালফিলের যে সামাজিক উন্নয়ন তার বিরুদ্ধে? যে সমাজের, যে মানুষের অধিকারের কথা মহাশ্বেতা দেবী বলে গেছেন তাঁর উপন্যাসও কি ঘুরিয়ে সেই আধিকারের কথাই বলে না? এই জন্যেই হয়ত ‘কাঙাল মালসাট’ উপন্যাসে তিনি লেখেন, ‘তুমি যদি জাত ক্যাওড়া না হতে তোমাকে আমি ফ্যাতুড়ু করতুম?’   

মনস্তত্ত্ব বলে মানুষ তার হতাশা থেকে খিস্তি দেয়। নবারুণও তাঁর উপন্যাসে শহুরে মানুষের হতাশা ও খিস্তিকে তুলে আনেন, তুলে আনেন মানুষের ভিতরে বিপ্লবী সত্তাকেও। আসলে নবারুণের মতে একটা যুগের পরিবর্তনে আরেকটি যুগ আসে, এই পরিবর্তন সবসময় খুব একটা সহজভাবে হয় না। কখনও সব কিছু ভেঙে দেয়, এই ভেঙে দেওয়াটাকেই অনেকে বিপ্লব বলেন। সারা জীবন লেখার মাধ্যমে নিজের সাথে ও সমাজের সাথে এই বিপ্লবকেই করতে চেয়েছে, করাতে চেয়েছেন। তিনি সারা জীবন বিশ্বাস করে এসেছেন, লেখকদের দায়টা অনেক বেশি, ঘুমন্ত পাঠকদের জাগানোর দায়িত্ব লেখকদের। তাঁর মা মহাশ্বেতা দেবী ও বাবা বিজন ভট্টাচার্যের মতো এই কাজ করতে গিয়ে অনেক রকম সমস্যা ও সমালোচনাতে পড়তে হয়েছে নবারুণকে। কিন্তু নবারুণ অটল থেকেছেন তাঁর নিজের জায়গাতেই। সেই জন্যেই যতদিন বাংলা উপন্যাস থাকবে, ততদিন তিনি বেঁচে থাকবেন বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে।

 

 

তথ্যঋণ- ১)উপন্যাস সমগ্র নবারুণ ভট্টাচার্য, দেজ পাবলিকেশন
২) banglalive.com (সাহিত্য আর বিপ্লব- নবারুণ ভট্টাচার্য)
৩) নবারুণের ব্যক্তিগত কথাবার্তা
৪) ইন্টারনেট
৫) কিছু পত্রপত্রিকা

ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Facebook, Wikimedia Commons, PrimeVideo

লেখালেখির সূত্রপাত ছোটবেলায়। বর্তমানে শিক্ষকতার পাশাপাশি নিয়মিত কবিতা ও গল্প লেখেন তথ্যকেন্দ্র, গৃহশোভা, নবকল্লোল দৈনিক স্টেটসম্যান, সুখবর, সাতসকাল, দেশ, আনন্দবাজার রবিবাসরীয়, এই সময়-সহ আরো বহু বাণিজ্যিক পত্রিকায়। এই পর্যন্ত ইংরেজিতে লিখিত কবিতা ও গল্প ভারত-সহ বহু দেশে প্রকাশিত। নিবন্ধ ও ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভ, মহানগর, দ্য ওয়াল-সহ বহু অনলাইন ম্যাগাজিনে। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সাত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com