‘আজ দ্বিতীয় ঘণ্টার পর ছুটি’ নামে মণিভূষণ ভট্টাচার্যের একটি কবিতা আছে। স্কুল শিক্ষক পুলিনবাবু রেশন তুলতে যান, বাকিতে খাওয়া মুদিখানার দোকান এড়িয়ে ঘুরপথে বাড়ি ফেরেন। বাড়িতে এসে চা চাইতে মেয়ের কাছে শোনেন, ঘরে চিনি নেই। এরপর লাউমাচাটার দিকে চোখ পড়তেই ওঁর বড় ছেলের কথা মনে পড়ে, যে
“মাচাটা তৈরী করেছিল সারাদিন খেটে, ও-ই বিচি এনে পুঁতেছিল। লেখাপড়া করেও
কোনো কাজের হোলো না, পুলিনবাবু ভাবেন, সারারাত পোস্টার সেঁটে বাবু এখন
জেলে আছেন”।
পুলিনবাবু কাগজ খোলেন। দেখেন, ‘আজ শিক্ষক দিবস’। বাকি অংশ পুরোটাই উদ্ধৃত করছি:
“রাষ্ট্রপতি বলেছেন: ‘শিক্ষকরা সুমহান জাতিসংগঠক’
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন: ‘যা কিছু শিখেছি সে তো বাল্যকালে শিক্ষকের কাছে’।
শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন: ‘অ্যাঁও ওঁয়াও চ্যাঁও গ্যাঁও কিচ কিচ ভুক ভুক ভুক ভক’।
চতুর্দিক অন্ধকার করে বৃষ্টি নামলো, বৃষ্টি নামে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে—
মাচায় আপোষহীন দুর্দান্ত লাউয়ের ডগা নাচে।“
দিন বদলেছে। মণিভুষণ যখন এই কবিতা লিখেছেন, তখন পুলিনবাবুদের অবস্থা যেমন ছিল, আজ অবশ্যই সে অবস্থা নেই। শিক্ষককূলকে এক শাঁসালো মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে পরিণত করা বিগত বাম সরকারেরই অবদান, নিঃসন্দেহে। তবু শিক্ষকদিবসকে নিয়ে মণিভূষণের এই তীক্ষ্ণ, শাণিত বিদ্রূপ শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়, আজও তা ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে চায়’! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য নিজেও একজন স্কুলশিক্ষক ছিলেন।
শিক্ষকদিবস এক পৌনঃপুনিক, ক্লিশে আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত, একথা বললেই সবকথা বলা হয় না। ছাত্র-শিক্ষকের পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কোনও নির্দিষ্ট দিবস-কেন্দ্রিক হয় না, হতে পারে না। এ তো সামগ্রিক জীবনবোধসঞ্জাত, ক্যালেণ্ডার-শাসিত নয়! একথা বললেও অতিসরলীকরণ হয় যে, আজকাল আর ছেলেমেয়েরা শিক্ষককে শ্রদ্ধা করে না, বা উল্টোদিকে শিক্ষকসমাজ এখন চরম ভোগবাদ-লাঞ্ছিত!
ছাত্ররা যদি তাঁকে বার বা আরও কোনও নিষিদ্ধ শখ-মেটানোর জায়গায় আবিষ্কার করে, তবে ব্যক্তি-স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে তাকে মেনে নেওয়া, এই সময়েও কষ্টকর! একে ‘অকুপেশনাল হ্যাজার্ড’ নাম দিয়ে আমি আরাম পেতে পারি, তবে সেটা জেনেই আমার এই পেশায় আসার কথা!
মূল বিষয়টা বোধহয় একজন শিক্ষকের শিক্ষক ‘হয়ে ওঠা’র প্রশ্ন। এই ‘হয়ে ওঠা’ একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এটা একদিনে হয় না। একটা সময় ছিল, যখন একজন শিক্ষকতা করবেন বলেই শিক্ষক হয়েছেন। অনেকে লোভনীয় চাকরি ছেড়ে মাস্টারি করেছেন। সময় বদলেছে, এখন রেলের বা ব্যাঙ্কের চাকরি হল না, এস.এস.সিতে ‘লেগে গেল’—এভাবেই অনেকে শিক্ষকতায় এসেছেন। এই দু’ভাবে আসার মধ্যে ভূমিকাগত একটা পার্থক্য থাকবেই। সে জন্যই শিক্ষক ‘হয়ে ওঠা’ একটা অনুশীলন। পোডিয়ামের ওপর আছেন, তিনি সব জানেন বা উল্টোদিকে বসে থাকা বাকিদের থেকে বেশি ‘ক্ষমতা’ ধরেন, এই ভ্রান্ত গরিমাবোধ সেই ‘হয়ে ওঠা’র পথে অন্তরায়। ভরসার কথা, এই দূরত্ব ঘুচিয়ে দেওয়ার একটা সচেতন প্রয়াস এই সময়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। অনেক সময় সেই প্রয়াস মাত্রা ছাড়িয়ে যায় যদিও। আমি এমন শিক্ষক দেখেছি, যিনি ছাত্রদের সঙ্গে ট্যুইস্ট নাচ করাকে জনসংযোগের হাতিয়ার মনে করেন, এবং নাচেনও! ট্যুইস্ট নাচের বদলে ভরতনাট্যম নাচলে সেটা বেশি সহনীয় হত সে কথা বলছি না, বলতে চাইছি, ছাত্রদের কাছাকাছি যাওয়ার এই শর্টকাট পদ্ধতির মধ্যে সহজতার চেয়ে বিপদ বেশি।
[the_ad id=”270084″]
এক শিক্ষাবিদের বক্তব্য শুনেছিলাম, যিনি বলেছিলেন, একজন শিক্ষকের কাজ হল, সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ছাত্রের মধ্যে ভালোবাসা জাগিয়ে তোলা। ‘পড়ানো’ বা ‘বোঝানো’ অনেক দূরের কথা! ব্যক্তিগতভাবে কথাটা একশ দশ শতাংশ মানি!
পাশাপাশি আরেকটা কথাও অনুভব করি। আমাদের সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তিমানুষের ভূমিকা অপরিসীম। একজন শিক্ষক ব্যক্তি হিসেবে ছাত্রদের কাছে অনুকরণীয় হবেন, এ চাহিদা কিন্তু এই ব্যবস্থার ভেতরেই রয়ে গেছে এখনও। তিনি এমন কিছু করবেন না, যা আঙুল তুলে দেখানো যায়! সে প্রত্যাশা কিন্তু বাতাসে ছড়িয়ে আছে, থাকে!
বিচারের দণ্ডমুণ্ডের কর্তার হার্লে ডেভিডসন চড়ার শখ-আহ্লাদ থাকতে আছে কী নেই, সে তর্ক ওঠা যেমন স্বাভাবিক, তেমনই স্বাভাবিক শিক্ষকের জীবনচর্যা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা। নীতিকথামালার চরিত্র হয়ে তিনি থাকবেন না ঠিকই, কিন্তু ছাত্ররা যদি তাঁকে বারে বা আরও কোনও নিষিদ্ধ শখ-মেটানোর জায়গায় আবিষ্কার করে, তবে ব্যক্তি-স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে তাকে মেনে নেওয়া, এই সময়েও কষ্টকর! একে ‘অকুপেশনাল হ্যাজার্ড’ নাম দিয়ে আমি আরাম পেতে পারি, তবে সেটা জেনেই আমার এই পেশায় আসার কথা!
[the_ad id=”270088″]
অর্থাৎ, জীবনচর্যা ও পঠিতব্য বিষয় সম্পর্কে ভালোবাসা জাগিয়ে তোলা—এই দুইয়ের মিলনেই হতে পারে সে অনুশীলন, ‘হয়ে ওঠা’র অনুশীলন। স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে ছেলেমেয়েরা যখন বৃহত্তর আঙিনায় পা দেয়, তারা বোঝে, স্কুলের মাস্টারমশায়, দিদিমণিদের থেকে তার জানার পরিধি বেড়েছে অনেকটাই, কিন্তু তাতে কি সেদিনের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি তার অশ্রদ্ধা জাগে! মোটেই না! তারা বোঝে, একজন মাস্টারমশায় বা দিদিমণি কতটা কোয়ান্টাম তত্ত্ব বা শেক্সপীয়র পড়েছেন, সেটা বিচার্য নয়, তাদের বেড়ে ওঠার দিনগুলিতে সেই মাস্টারমশায় বা দিদিমণি ক’বার তার কাঁধে হাত রেখেছেন, মনে রাখার বিষয় সেটাই। এই সহানুভূতি ও ভালোবাসার স্পর্শই বয়সন্ধির ছেলেমেয়েদের জায়মান হৃদয়বেত্তায় স্থায়ী জায়গা করে নেয়! সম্পুর্ণ হয় ‘হয়ে ওঠা’র বৃত্তটি।
পাশাপাশি একজন শিক্ষক কী চান তাঁর ছাত্রের কাছে? ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হলে শিক্ষকের তৃপ্তি হয়, অহংকার হয়, সবই ঠিক। আবার ততটা প্রতিষ্ঠিত নন, এমন ছাত্রছাত্রীরা অনেকটা অতীত উজিয়ে যখন পায়ে হাত দেয়, তখনও একজন শিক্ষকের বুকে অনুরণন হয়। তবে একজন শিক্ষক বা শিক্ষিকা যখন দেখেন ‘কোটিতে গুটিক’ হলেও তাঁর কোনও ছাত্র বা ছাত্রীর মধ্যে সেই শক্তপোক্ত মাচাটি তৈরি হয়ে গেছে যেখানে ‘আপোষহীন দুর্দান্ত লাউয়ের ডগা নাচে’, তখন সেই শিক্ষক বা শিক্ষিকা ভেতর থেকে অনুভব করেন-‘ এ জনমে ঘটালে মোর জন্ম জনমান্তর!’
সার্থক হয় প্রতিটি শিক্ষক দিবস।
পেশায় স্কুলশিক্ষক। বিষয় বাংলা সাহিত্য। বর্তমানে হালিশহরের বাসিন্দা। সাহিত্যের প্রতি একনিষ্ঠ দীর্ঘদিন ধরেই। ইতিমধ্যেই দুটি ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। একটির নাম তৃতীয় প্রহর। অপরটি পূর্বাপর।
One Response
সুন্দর লেখা