(Saraswati Puja) দু’টো ভয় দেখানো হতো। এক, ঠান্ডা লেগে জ্বর আসবে। দুই, কিছুতেই ভালো পড়াশোনা হবে না— পরীক্ষায় গোল্লা।
সরস্বতী পুজোর প্রসাদী কুলের আগে কুল খেয়ে ফেলাটা অপরাধ এবং সেই অপরাধ করলে এই দু’টো সর্বনাশা পরিণতি অনিবার্য। বাড়ির বড়রা, পাশের বাড়ির বড়রা তো ভয় দেখাতেনই। তাছাড়া, বড়দের কাছে ও কথা বার বার শুনে শুনে আমরা, পাড়ার ছোটরাও একে অন্যকে সাবধান করে দিতাম এই বলে যে, “সরস্বতী পুজোর আগে কুল খাওয়া চলবে না”। মরশুমের প্রথম কুল মা সরস্বতী আগে মুখে দেবেন। তার পরেই আমাদের সবার কুল খাওয়ার পারমিশান। আমার কাছে তাই সরস্বতী পুজোর প্রসাদ এবং কুল সমার্থক। (Saraswati Puja)

দক্ষিণ শহরতলির যে উদ্বাস্তু কলোনিতে আমার শৈশব-কৈশোরের পুরোটা ও তারুণ্যের কিছুটা যাপন, সেখানে আমাদের আশপাশের বেশ কয়েকটা বাড়িতে গত শতকের সত্তর ও আশির দশক তো বটেই, নব্বইয়ের দশকের গোড়াতেও ছিল কুলগাছ। সে জন্য ভয় যতই দেখানো হোক, সেই ভয় পেতে পেতেই সরস্বতী পুজোর আগেই টুকটাক কুল খেয়ে নেওয়া এবং দুরু দুরু বুকে খারাপ পরিণামের জন্য অপেক্ষা করার এই গোটা ব্যাপারটাই ছিল অন্য স্বাদের। (Saraswati Puja)

তবে সরস্বতী পুজোর প্রসাদ আর সরস্বতী পুজো উপলক্ষে বা সেদিনের দুপুরে খাওয়া-দাওয়া, এই দু’টো সব সময়ে এক নয়। বরং, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আলাদা। মানে, যেটা আমি তারিয়ে খাচ্ছি, সেটাকে মনে করছি পুজোর ভোগ প্রসাদ বলে, অথচ সেই ভোগ আদৌ দেওয়া হয়নি মা সরস্বতীকে।
এই কিছুদিন আগেও সরস্বতী পুজো মানে ছিল ভোরে ঘুম থেকে ওঠার এক উদযাপন। বাড়ির পুজো যেহেতু সকালেই হবে, তাই খুব সকাল সকাল স্নান করে তরতাজা হয়ে অঞ্জলি দিতে বসা এবং সেটা অবশ্যই খালি পেটে। পুজোর পর প্রসাদ দিয়েই প্রাতরাশ। কুল এবং অন্যান্য ফল তো থাকবেই, সেই সঙ্গে খই, মুড়কি, কদমা, চিনির মঠ, নানাবিধ তক্তি, সন্দেশ আর কখনও-সখনও অমৃতি। (Saraswati Puja)

বাড়িতে আমার ঠাকুরদা ৩৬৫ দিনের মধ্যে অন্তত ৩৬০ দিন লাঞ্চ করে নিতেন দুপুর ১২টার আগে। তবে সরস্বতী পুজোর দিন সাড়ে ১১টা থেকেই তিনি তাগাদা দিতেন। লাঞ্চের মেনুটাও তাঁর ঠিক করে দেওয়া। খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, বাঁধাকপির ঘণ্ট এবং টমেটোর চাটনি। এগুলোর একটাও কিন্তু সরস্বতী ঠাকুরকে দেওয়া হয়নি। পুজো উপলক্ষে খাওয়া-দাওয়া। এখন যেমন মরশুমি আনাজপাতি ও ফলের ব্যাপারটাই ঘেঁটে গিয়েছে, আমাদের শৈশব-কৈশোরে তো আর সেটা ছিল না। তাই, বাঁধাকপির ঘণ্ট তখন সরস্বতী পুজো ছাড়া অন্য কোনও পুজোর ভোগ প্রসাদ কিংবা পুজো উপলক্ষে খাওয়ার উপায় ছিল না। একই কথা প্রযোজ্য টমেটোর চাটনির ক্ষেত্রে। আবার, সরস্বতী পুজোর বেগুন ভাজাটা বেশ অন্যরকম। শীতের বেগুন মানে স্বাদে মিষ্টি, দানা তাতে নামমাত্র। (Saraswati Puja)

ক্লাস টু থেকে টেন যে স্কুলে পড়েছি, সেখানে সরস্বতী পুজোর দিন দুপুরে ছিল পাত পেড়ে খিচুড়ি খাওয়ার আয়োজন। ছিল কেন, এখনও আছে। এখনকার ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী ও অবসর নেওয়া স্যার-দিদিমণিদের সপরিবার নেমন্তন্ন থাকে ওই দিন। মেনুতে খিচুড়ি, বেগুনি, বাঁধাকপির ঘণ্ট, টমেটোর চাটনি, বোঁদে। ওই সব খাবারও কিন্তু মা সরস্বতীর প্রসাদ নয়। প্রসাদে ওই কুল-সহ হরেক কিসিমের ফল, মিষ্টি, খই, মুড়কি, তক্তি এ সব।
কোনও এক রহস্যজনক কারণে একবার স্কুলের সরস্বতী পুজোর দিন খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন ছিল না— কেবলই ফল প্রসাদের ব্যবস্থা ছিল। সে বার পুজোর দিন কয়েক পর একদিন টিফিন টাইমে স্কুল ছুটি দিয়ে সবাইকে একটা করে খয়েরি রংয়ের ঠোঙা ধরানো হলো। তাতে চারটে রাধাবল্লভি বা ডালপুরি, শুকনো আলুর দম আর এক রকম মিষ্টি। (Saraswati Puja)

তার পরের বছরই মহাসমারোহে ফিরল পাত পেড়ে খাওয়া। মেনুও স্পেশাল। গাজর-বিন্স-কড়াইশুঁটি দিয়ে ভেজিটেবল ফ্রায়েড রাইস, নতুন আলুর কষা কষা আলুর দম, বেগুনি, টমেটোর চাটনি আর রসগোল্লা। জমিয়ে খেলাম সবাই। তবে খেতে খেতেই প্রবল এবং সর্বসম্মত দাবি উঠল যে, খিচুড়ি ফেরানো হোক। সেইমতো তার পরের বছরই ফিরল খিচুড়ি। এবং সেটাই থেকে গেল।
সহজ এবং সরল সত্যিটা হলো, সরস্বতী পুজোর দুপুরে জিভটা খিচুড়ি-খিচুড়িই করে। স্টেপল হিসেবে খিচুড়ির উপস্থিত থাকার সেই মেনুতে কিন্তু লাবড়া থাকবে না লক্ষ্মীপুজোর মতো। কারণ, লাবড়ার যেটা অপরিহার্য, সেই ডাঁটা শাক শীতকালে খুব এটা বেশি ও তেমন ভালো মানের দেখা যায় না। সরস্বতী পুজোর খিচুড়ির সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করবে কড়াইশুঁটি ও আলু দিয়ে রাঁধা বাঁধাকপি কিংবা নতুন আলু দিয়ে রাঁধা আলুর দম। তবে আমার কাছে বেগুন ভাজা নয়, ব্যাপারটা জম্পেশ হবে মেনুতে বেগুনি থাকলে। (Saraswati Puja)
আরও পড়ুন: সাবেকি পুজোর ভোগ প্রসাদ
তবে সরস্বতী পুজোর দুপুরে খিচুড়ির চিরাচরিত অভ্যাসটায় বড়সড় ধাক্কা লেগেছিল ১৯৯৫ সালে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সে বার ছিল সরস্বতী পুজো। তখন কলেজ জীবন। প্রেসিডেন্সি-তে ফার্স্ট ইয়ার। কলেজে ভর্তি হওয়া মাস পাঁচেকের মধ্যে এক সহপাঠিনীর প্রেমে পড়া। প্রেমিকার বাড়িতে সরস্বতী পুজোর দুপুরে নেমন্তন্ন। উত্তর কলকাতার একটি বনেদি বাড়ির কন্যা সে। তাদের বাড়ির কাছাকাছি, শোভাবাজার তল্লাটে সরস্বতী পুজোর একটি মণ্ডপে দু’জনে মিলে অঞ্জলি দিয়ে হাতে হাত ধরে সেই বাড়িতে ফেরা। দুপুরে খেতে বসার আগে ইভান পাভলভের সেই তত্ত্বের মতো মস্তিষ্ক থেকে জিভ খিচুড়ির সঙ্কেত পাঠাল। (Saraswati Puja)

কিন্তু এ কী! পাতে পড়ল ঘিয়ে ভাজা নিষ্কলুষ, একটা লাল স্পট-ও না-থাকা ধবধবে সাদা লুচি! খিচুড়ি নয়, ওটাই স্টেপল। তার সঙ্গে সোনামুগের ডাল। খুব ঘন মানে জমাট বাঁধা নয়, আবার পাতলা ট্যালটেলেও নয়— মাঝামাঝি একটা কিছু। মুগ ডালের প্রতিটি দানা অক্ষত, অথচ সুসিদ্ধ। স্বাদে মিষ্টি মিষ্টি, অল্প ঝাল। কিছু একটা ভাজা ছিল। বেগুন ভাজা কি? মনে পড়ছে না। তবে আলু-ফুলকপির তরকারি এবং ছানার অপূর্ব ডালনা যে খেয়েছিলাম, সেটা মনে আছে। সবটা তৈরি করেছিলেন কাকিমা, মানে আমার সহপাঠিনীর মা। (Saraswati Puja)
সেই বনেদি বাড়িতে সরস্বতী পুজোর দিন লাঞ্চের সূত্রে খোঁজখবর নিয়ে পরে জেনেছিলাম, লুচির সঙ্গে ছোলার ডাল যতই জনপ্রিয় হোক, সেটা আসলে সাবঅল্টার্ন ব্যাপার-স্যাপার। উচ্চবর্গীয় ও খানদানি রুচির প্রকাশ লুচির সঙ্গে সোনামুগ ডালে— সোনামুগ এখন আর মেলে না, তা হলে নিদেনপক্ষে ভালো জাতের মুগডালে। এই জ্ঞান অর্জন কিন্তু বিদ্যার দেবীর আরাধনার দিন দুপুরে প্রেমিকার বাড়িতে লাঞ্চের সূত্রেই।
অনেক দিন পর্যন্ত ধারণা ছিল, সরস্বতী পুজোর প্রসাদে কিংবা পুজোর দিন দুপুরে স্টেপল বা মুখ্য খাবার হিসেবে লুচি মূলত পশ্চিমবঙ্গীয়দের আর খিচুড়ি প্রধানত পূর্ববঙ্গীয়দের খাদ্য-সংস্কৃতির পরিচায়ক। এই ধারণাটাই ভেঙে চুর চুর হয়ে গেল দক্ষিণ শহরতলির বিজয়গড়ে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া লাগোয়া ভটচায বাড়িতে দশকের পর দশক ধরে চলে আসা সরস্বতী পুজোর ভোগের কথা জেনে। যে বাড়ি ওই তল্লাটে মন্দির বাড়ি নামেও খ্যাত। বাংলাদেশের ফরিদপুরের ননীগোপাল ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গে এসে তাঁর বাড়িতেই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ওখান থেকেই মন্দির বাড়ি| তিনি ছিলেন মস্ত পণ্ডিত। (Saraswati Puja)

ননীগোপালবাবু লক্ষ্য করলেন, পাড়া বা আশপাশের কিছু বাড়িতে দেবী সরস্বতীকে ফল-মিষ্টি প্রসাদের বাইরে দেওয়া হয় খিচুড়ি ভোগ। সেই ভোগ আসে তাঁর বাড়িতেও| তা ছাড়া, বাড়ির ছোটরা স্কুলে গেলে সেখানেও খিচুড়ি ভোগ। বিচক্ষণ ননীগোপালবাবু ঠিক করলেন, অন্তত নিজের বাড়িতে এই একঘেয়েমি কাটানো একান্তই জরুরি। তাঁর হুকুম হলো, বাড়িতে মা সরস্বতীর কোনও অন্নভোগ হবে না। তা হলে কী দেওয়া হবে? লুচি, ছোলার ডাল, বাঁধাকপির ঘণ্ট, আলু-ফুলকপির ডালনা এবং পায়েস। তবে পায়েসটা সিমাইয়ের। ওই যে, অন্নভোগ যে চলবে না। পুজো হয়ে যাওয়ার পর সকালের জলখাবারে বাড়ির সবাই এবং বাড়িতে আসা অতিথিরা পাবেন মা সরস্বতীর এই ভোগ। সেই প্রথা বিজগড়ের মন্দির বাড়িতে আজও চলে আসছে। (Saraswati Puja)
একটা পুরুষ ইলিশ, অন্যটা নারী। নতুন একটা কুলোয় রাখা হয় দু’জনকে। মেয়ে ইলিশের মাথায় সিঁদুর-হলুদ পরানো হয়। তারপর দু’টো ইলিশের মাথায় ধান দূর্বা দিয়ে, উলু দিয়ে, শঙ্খ বাজিয়ে বিয়ে দেওয়া হয় তাদের। এই প্রথার নাম হলো, ইলিশের বিয়ে।
তবে ওই ভটচায বাড়িতে মা সরস্বতীকে অন্নভোগ না-দেওয়ার পিছনে সম্ভবত আরও একটা কারণ ছিল ইলিশ মাছ।
কেউ কেউ মনে করেন, সরস্বতী পুজোর দিন বিদ্যার দেবীকে ইলিশ মাছ রান্না করে ভোগ হিসেবে দেওয়া হয়। এটা সম্ভবত ঠিক নয় একেবারেই। পুরাণ অনুযায়ী, সরস্বতী নিরামিষ খান। সে ক্ষেত্রে তাঁর ভোগে ইলিশ মাছ দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু এটাও ঠিক যে, সরস্বতী পুজোর দিন বহু বাড়িতে ইলিশ মাছ রান্না হয়। এটা আসলে একটা প্রথা। যার সঙ্গে সরস্বতী পুজোর কোনও যোগ সম্ভবত নেই। কোনও পরিবারে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন, কোনও পরিবারে দুর্গাপুজোর দশমী আবার কোনও কোনও পরিবারে লক্ষ্মীপুজোয় ইলিশ মাছ খাওয়ার পর বেশ কয়েক মাসের একটা বিরতি দেওয়া হয়। (Saraswati Puja)

ফের ইলিশ খাওয়া হয় কোনও কোনও বাড়িতে পয়লা মাঘ, আবার কোনও কোনও পরিবারে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে— অর্থাৎ সরস্বতী পুজোর দিন। ভটচায বাড়িতে সরস্বতী পুজোর দিন প্রথমে জোড়া ইলিশ কাটাকুটি না-করে আস্ত কিনে নিয়ে আসা হয় বাজার থেকে। একটা পুরুষ ইলিশ, অন্যটা নারী। নতুন একটা কুলোয় রাখা হয় দু’জনকে। মেয়ে ইলিশের মাথায় সিঁদুর-হলুদ পরানো হয়। তারপর দু’টো ইলিশের মাথায় ধান দূর্বা দিয়ে, উলু দিয়ে, শঙ্খ বাজিয়ে বিয়ে দেওয়া হয় তাদের।
এই প্রথার নাম হলো, ইলিশের বিয়ে। তারপর বাজারে নিয়ে গিয়ে দু’টো ইলিশ কেটেকুটে আনা হয়। তবে ওই ভটচায বাড়িতে বিয়ে দেওয়া জোড়া ইলিশ রান্নারও আছে নির্দিষ্ট রেসিপি। তার বাইরে যাওয়া চলবে না। সরষের তেলে কাঁচালঙ্কা ও কালো জিরের ফোড়ন পড়বে, নুন-হলুদ পড়বে এবং ফুটন্ত ঝোলে নুন-হলুদ মাখানো মাছটা পড়বে। দুপুরে ইলিশের সেই ঝোল-ই বাড়ির সবাই খাবেন সাদা ভাত দিয়ে মেখে। (Saraswati Puja)
ধর্মনিষ্ঠ ননীগোপাল ভট্টাচার্য খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে শুধু খুঁতখুঁতে নয়, কতটা দূরদর্শী ছিলেন, তাঁর বাড়ির সরস্বতী পুজোর সকাল থেকে দুপুরের এই মেনু-ই তার প্রমাণ।
সরস্বতী পুজো আসলে শুধু বাঙালির ভ্যালেন্টাইন ডে নয়, রসনাতৃপ্তিরও দিন। (Saraswati Puja)
ছবি: Mohamushkil, WikimediaCommons, millenniumpost, Kolkatar Chobiwala, Facebook
খাওয়ার জন্য বাঁচেন। চোখ বেঁধে খেতে দিলেও রুই ও কাতলা মাছের পার্থক্য নিরূপণ করতে পারেন অনায়াসে। আর চোখ খোলা থাকলে? মুখে না-তুলে রান্না করা খাবারের রং দেখেই বুঝতে পারেন, নুন বেশি বয়েছে নাকি কম।