(Column)
সাতখোলে প্রথম দিন, খালি পায়ে মাটিতে বাবু হয়ে বসে শুরু হল আমাদের Workshop। কেউ কাউকে চিনি না—তাই প্রথমে বন্দিতা বললেন— পাশের জনকে দেখে কী মনে হয়— তা বলতে! এ তো মহা মুশকিল! চিনি না, জানি না- ভেবে ভেবে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে বলতে হবে মানুষটি কেমন এবং তার পরে মানুষটি বলবেন তিনি সত্যি সেরকম কী না। স্বাভাবিকভাবেই সবাই সবার সম্বন্ধে ভাল ভাল কথাই বলতে লাগল। নিজের সম্বন্ধে এমন কিছু ভাল কথা শুনলাম যা চেনাজানা মানুষের থেকে শুনিনি। ভাবতে ভাল লাগল, সত্যি আমি এরকম! (Column)
ভাললাগার পরে এবার খারাপ লাগার পালা। জিজ্ঞেস করা হল— এমন কোনও কথা আছে কী না, যেটা শুনলে আমাদের বারবার খারাপ লাগে! আশ্চর্য! দেখা গেল বেশিরভাগ খারাপ কথাই আমাদের শরীরকে ঘিরে, আর এই কথার সূত্রপাত খুব কাছের মানুষের কাছ থেকে। ছেলেবেলায়! কেউ শুনেছে সে মোটা, কেউ কালো, কেউ খুব রোগা আর কেউ শুধু মেয়ে বলেই ছোটবেলা থেকে শুনতে হয়েছে বিভিন্ন খারাপ কথা। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সারা জীবন তারা প্রমাণ করে এসেছে যে তারা সেটা নয়। এভাবে কত গল্প, কত মানুষের সঙ্গে পরিচিত হলাম। আমাদের দলে ঘটনাচক্রে সবাই ছিল মেয়ে। মূলতঃ উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত, বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থা ভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন মেয়ে যখন তাদের জীবনের গল্প বলতে শুরু করল- মনে হল আমরা কোথাও এগোইনি। দিন দিন যেন মানসিকতায় আরও পিছিয়ে যাচ্ছি। (Column)
কে অন্যের দুঃখ ভাগ করে নিয়ে এক অদ্ভুত Bonding তৈরি হল, নিজেদের মধ্যে। আর তার পরেই হয়ে গেল দুপুরের খাওয়ার সময়। উত্তরাখণ্ডের বিশেষ কালো ডাল, রুটি, মুরগির মাংস— এক কথায় অপূর্ব।
একে অন্যের দুঃখ ভাগ করে নিয়ে এক অদ্ভুত Bonding তৈরি হল, নিজেদের মধ্যে। আর তার পরেই হয়ে গেল দুপুরের খাওয়ার সময়। উত্তরাখণ্ডের বিশেষ কালো ডাল, রুটি, মুরগির মাংস— এক কথায় অপূর্ব। Workshop-এর প্রথম দিন ছিল নিজের পেছনের জীবন মূলতঃ ছেলেবেলার দিনগুলোকে ফিরে দেখা। বন্দিতা বললেন, আমাদের ব্যক্তিত্বের অনেক ধারণাই তৈরি হয় আমাদের ছেলেবেলায়। আমাদের পরিবার, স্কুল, আশপাশের পরিবেশ থেকে আমরা অনেক কিছু নিই বা বাতিল করি। তাই আগামীকালকে গড়তে হলে জানতে হবে ছেলেবেলার কথা। (Column)
Workshop-এর দ্বিতীয় দিন হল বর্তমান সময়ে আমরা কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি তার ওপর। সত্যি দেখা গেল আমাদের ছোটবেলার তৈরি হওয়া ধ্যানধারণার উপর দাঁড়িয়ে আছি আজকের আমি। ছোটবেলায় মনের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে যাওয়া বিশ্বাস আমাদের ভাবায়, কষ্ট দেয়, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে— তবুও আমরা তার থেকে বেরোতে পারি না। সেই বেরোতে চাওয়াগুলোকেই খোঁজা হল দ্বিতীয় দিনে। (Column)

আর তৃতীয় মানে শেষ দিনে ছিল এই অতীত আর বর্তমানের সুখ-দুঃখ, কষ্ট পাওয়া, ভাললাগা খারাপ লাগার ওপর দাঁড়িয়ে নিজে কীভাবে নিজের ভবিষ্যত বানাতে পারি- তা নিয়ে আলোচনা হল। একটা নতুন কাজ দিলেন বন্দিতা। খাতার একপাশে লিখতে জীবনের বড়-বড় পাওয়া মানে Acheivement-গুলো আর অন্যদিকে জীবনের ছোট ছোট পাওয়া মানে প্রতিদিনের নানা আনন্দের মুহূর্তগুলো। দেখা গেল প্রতিদিন জীবনে ছোটখাটো কত আনন্দের উপকরণ থাকে। আমরা তার দিকে তাকিয়েও দেখি না। ছুটি, বড় বড় পাওয়ার পিছনে। আর তাতেই বাড়ে চিন্তা— কবে পাব, কী করে পাব! প্রতিদিনের বাঁচাকে সুন্দর করতে শিখলাম যখন, দেখলাম আরে কত ছোট ছোট জিনিস আমাদের আনন্দ দেয়! সেগুলো করি না কেন? খালি দৌড়ে চলি আগামীর পিছনে, বর্তমানকে ভাল না বেসে। (Column)
দিনের শেষটা হল খুব সুন্দরভাবে। আমরা সবাই নিজেরা, কীভাবে সামনের দিনগুলো কাটাব, খারাপ লাগাগুলোকে বাদ দিয়ে নিজের শর্তে বাঁচব তার একটা ফর্দ লিখলাম। নিজের ফর্দ পড়ার আগে ঠিক যেভাবে শুরু হয়েছিল সেভাবেই শেষ হল। আমরা এক-একজন উঠে নিজেদের কেমন জীবন চাই আর কীভাবে তা গড়ব বললাম—তারপর বাকিরাও আমাদের তিনদিনের জানার ভিত্তিতে একে একে বলতে শুরু করল তারা কী মনে করে, আমার কী করা উচিত— কী কী দিক আমার সত্যি ভাল, যার ওপর ভিত্তি করে আমি গড়তে পারি এক সুন্দর জীবন। (Column)
“দিনের শেষটা হল খুব সুন্দরভাবে। আমরা সবাই নিজেরা, কীভাবে সামনের দিনগুলো কাটাব, খারাপ লাগাগুলোকে বাদ দিয়ে নিজের শর্তে বাঁচব তার একটা ফর্দ লিখলাম। নিজের ফর্দ পড়ার আগে ঠিক যেভাবে শুরু হয়েছিল সেভাবেই শেষ হল।”
শেষে সবারই চোখে জল— হাসি-কান্নায় মিশে গেলাম আমরা। নিজেদের খারাপ লাগা, খারাপ অভিজ্ঞতা– যা যা আমরা ভুলতে চাই, বাদ দিতে চাই, এক চিরকুটে লিখে ফায়ার প্লেসের আগুনে তা পুড়িয়ে দিলাম। এ যেন সেই ‘অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’। এখনও সেই মুহূর্তের কথা ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। আজও প্রায়, পাঁচবছর পর ভাবি সত্যি সেদিন আগুনের উত্তাপে মনের অনেক জ্বালা-যন্ত্রণা ধোঁয়ায় উড়ে গিয়েছিল। আজ আর তা নেই। জীবনটাও যেভাবে চেয়েছিলাম তার অনেকটাই যাপন করতে পেরেছি। ছোট ছোট আনন্দের স্মৃতিতে ভরসা করে বড় বড় দুঃখগুলো ভুলতে পারি। (Column)
শরতের ওই তিন-চারদিন, কলকাতায় যখন উৎসবের ভিড়— মা দুর্গা যখন কৈলাশ থেকে বাপের বাড়ি চলে এসেছেন— আমি তাঁর বাড়ির এক ছোট্ট আস্তানায় মেতে উঠেছি জীবনের উৎসবে। কত মেয়ের দুঃখ-কষ্টের গল্প শুনলে নিজের দুঃখ কম হয়ে যায়। নানা মেয়ের নানা জীবনের গল্পগুলো এখনও মনে আছে পরিষ্কার। (Column)

গুরগাঁওয়ের এক ঝকঝকে মেয়ে, নিজের বেকারি চালায়, কথা বলে চোস্ত ইংরেজিতে। কথা শুনলেই বোঝা যায় জীবনে- যা যা আনন্দের উপকরণ পেলে আমরা ভাবি জীবন দারুণ চলবে তার কাছে সবই আছে। তবে কীসের দুঃখ! তার অনেকটা দুঃখ তার মেয়ে হওয়ার, বারংবার নিজেকে প্রমাণ দেওয়ার যে সে ছেলেদের মতো পারে। গুরগাঁওয়ে এক বিশাল বাংলো বাড়িতে, খুবই স্বচ্ছল পরিবারে তার জন্ম। বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। কিন্তু মেয়ে। তাই তার পরের বছরই আসে ভাই। পিঠোপিঠি ভাইবোন। মেয়েটি ভাইয়ের চেয়ে লেখাপড়ায় ভাল। বারো ক্লাসের পর বিদেশ যাওয়ার একটা স্কলারশিপও পেল। আর সে সময়ই হল বাবার হার্ট অ্যাটাক। ব্যবসায় ঘাটতি। ঠিক করা হল ভাই বা বোন যে কোনও একজন বিদেশ যেতে পারবে। ভাইকে যেহেতু বাবার ব্যবসা দেখতে হবে তাই মেয়েটি বাড়ির লোকের কথা শুনে নিজেই সেই স্বপ্ন ছেড়ে দিল। মেয়েটির বাবার একটি ব্যবসা ছিল Amusement Park-এর। মেয়েটির বয়ানে ব্যবসাটি ছোট। বাবা তাকে বলেন ভাই না আসা পর্যন্ত সেটি সামলাতে। (Column)
আপাতভাবে ঘাটতিতে চলা ব্যবসাও মেয়েটি দাঁড় করিয়ে দেয়। কিন্তু ভাই আসার পর মেয়েটিকে ব্যবসা ছেড়ে দিতে হয়— তাকে কেক, বিস্কুট বানানোর স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। কারণ বিষয়টি নারীসুলভ।
আপাতভাবে ঘাটতিতে চলা ব্যবসাও মেয়েটি দাঁড় করিয়ে দেয়। কিন্তু ভাই আসার পর মেয়েটিকে ব্যবসা ছেড়ে দিতে হয়— তাকে কেক, বিস্কুট বানানোর স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। কারণ বিষয়টি নারীসুলভ। তারপর মোটা টাকা পণ দিয়ে বিয়ে হয়ে যায় মেয়েটির। বিয়ের পর মেয়েটি শ্বশুরবাড়িতে তার চালচলন, সাজপোশাক নিয়ে বাধা পেতে থাকে। একদিন তো শ্বশুর বলেই বসেন— “শোনো, তোমাকে জিনস টি-শার্ট একদমই মানায় না। কারণ তোমার বুক পেছন সবই ছোট।” এই কথা শুনে মেয়েটি আর একদিনও শ্বশুরবাড়িতে থাকতে রাজি হয়নি। কিন্তু বাবা-মা’কে ছেড়ে বরের, বাইরে থাকার সামর্থ নেই। (Column)
মেয়েটি ভাবে পণের টাকা চেয়ে নিজেই ব্যবসা শুরু করবে! শ্বশুরের কাছে সে টাকা চাইতে শ্বশুর বলেন বিয়েতেই সেই কয়েক কোটি টাকা নাকি শেষ হয়ে গেছে। মেয়েটির বাবা বলেন এত খরচ করে বিয়ে দিয়ে ফেরত আসাটা খুবই লজ্জার ব্যাপার। মেয়েটি থেমে থাকেনি। বাড়ি থেকে শুরু করেছে কেকের ব্যবসা। স্বপ্ন একদিন ব্যবসা করেই নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কিন্তু মনের মধ্যে তার ক্লান্তি আর হতাশা। সে জানে, সে একা। আশেপাশে তার কেউ নেই যার কাঁধে মাথা রেখে মেয়েটি কাঁদতে পারে। সেদিন মেয়েটির কথা শুনে আমরা সবাই চেয়েছিলাম মেয়েটি নতুনভাবে বাঁচুক, খুঁজে পাক ভালবাসার মানুষ, সফল হোক নিজের মনের মতো ব্যবসায়। (Column)

আর একটি মেয়ের সমস্যা মাতৃত্বের। কিন্তু বেশির ভাগ সময় সে চিন্তায় থাকে তার কেরিয়ার নিয়ে। বাড়িতে বলে এসেছে এই Workshop তাকে কেরিয়ারে সাহায্য করবে। মেয়েটি লেখাপড়ায় ভাল ছিল, এমবিএ, কিন্তু সেই অনুপাতে এক মোটামুটি চাকরি করে। সারাক্ষণই কাজের কথা বলার মাঝে সে বলে ফেলল সে মা হতে চায় না। সে মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির চাপ আছে তার ওপর! এইটুকু শ্বশুরবাড়ির সমালোচনা করেই সে মরমে মরে যায়। তার বয়ানে তার শ্বশুর-শাশুড়ি, বড় জা খুব ভাল। বড় জা-কে ডাক্তার বলে দিয়েছে তার সন্তান হবে না। মেয়েটির পরিবার দত্তক নেওয়ার পরিপন্থী। তাই তারা চায় মেয়েটি পরিবারকে একটি সন্তান দিক— যাকে তার জা নিজের সন্তানের মতো মানুষ করবে। মেয়েটি যে সেটা চায় না, সে কথা বলতেও সে লজ্জিত, দ্বিধাগ্রস্ত। (Column)
শুধু একবারই বলল সে নিজের সময়ে নিজের সস্তান চায়। সেই সময়টাই তাকে দেওয়া হচ্ছে না। তাই মেয়েটি প্রাণপণে এমন এক চূড়ান্ত সফল কেরিয়ার চায় যেখানে সে বলতে পারে কাজের চাপে সন্তান নিতে সে প্রস্তুত নয়। মেয়েটি নিজেও জানে না এক আপাত ভালবাসার জালে সে বন্দী। Workshop-এর দ্বিতীয় দিন দিল্লি থেকে মেয়েটির স্বামী হাজির। তিনি দেখতে চান বৌয়ের কেরিয়ারে কীভাবে সাহায্য করছে এই Workshop। বন্দিতা শেষে বিনয়ের সঙ্গে বললেন Workshop চলাকালীন তিনি তা দেখতে পারবেন না। বদলে তিনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। ভদ্রলোক অবশ্য তার বদলে Laptop খুলে কাজকেই বেছে নিয়েছিলেন তাঁর দু’দিনের ছুটিতে। (Column)
“এত নতুন মানুষ, নতুন জীবন, নতুন গল্প আমাকে শিখিয়েছিল নতুনভাবে বাঁচতে। মনে সাহস পেয়েছিলাম— আমি চাইলে ঠিক পারব নিজের জীবনকে সুন্দর করতে। সেদিন যে জীবন নির্মানের কথা ভেবেছিলাম আজ হয়তো তার পঞ্চাশ ভাগ যাপন করি। কিন্তু স্বপ্ন দেখি বাকি পঞ্চাশও একদিন আমি করে ফেলব।”
তৃতীয় যে মেয়েটি সে ইঞ্জিনিয়ার। প্রাইমারি স্কুল মাস্টার বাবার প্রবল উৎসাহে রাজস্থানের এক অজ পাড়া গাঁ থেকে গুরগাঁও এসে সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে। দুনিয়াকে দেখার ধরণ বদলে গেছে তার। বিয়ে করতে চায় না সে। কিন্তু বাবা নাছোড়বান্দা। ‘‘পড়িয়েছি— এই অনেক! কিন্তু চাকরি করবে কেন? বিয়ে হবে না। লোকে কী বলবে!’’ এই লোকে কী বলবে নিয়ে বাবা এতটাই ভাবেন যে তাঁর শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটিও জেদি। একা একা প্রথম চাকরি পেয়ে মুম্বইয়ে যায় সে। (Column)
প্রথম দিন গিয়ে দেখে যে বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিল সে- তারা চুক্তি ভেঙে অন্য লোককে সে ফ্ল্যাট দিয়ে দিয়েছে। বৃষ্টির রাতে বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খুব কেঁদেছিল সে। বাবাকে ফোন করেছিল। বাবা বলেছিলেন, ‘চাকরি করার সিদ্ধান্ত তোমার। তাই তার ঝক্কি-ঝামেলা তোমাকেই সামলাতে হবে। নিজে বুঝে নাও।’ বাবার সামনে মা নীরব শ্রোতা মাত্র। সেদিন বাবা-মা কেউ তার হাত ধরেনি। এতটা রাস্তা সে একা হেঁটেছে। বাবা থাকেননি। কিন্তু গ্রামে গেলে বাবা তার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় হাঁটেন! পাছে লোকে বলে— সঙ্গে কোনও ছেলে নেই। একা রাস্তায় বেরিয়েছে। মেয়ের সাহস দেখো! (Column)
গ্রামের ছোট্ট চৌহদ্দিতে বাবা সবাইকে এটাই বোঝাতে চান, মেয়ের আজ বাদে কালই বিয়ে হবে। ততদিন পুরুষমানুষ হিসেবে তিনিই আছেন তার পাশে! কিন্তু গ্রামের সীমা ছাড়িয়ে মেয়েটি দেশের সীমাও একা পেরিয়ে এসেছে! পায়নি বাবার হাত। দূর থেকে ভালবাসাও পাঠাননি তিনি। আপাত স্মার্ট, ঝকঝকে মেয়েটি ছেলেমানুষের মতো কাঁদছিল! (Column)
আমি ভাবছিলাম— কত জীবন দেখলাম! দেখলাম এক অন্য ভারতবর্ষ যা আমার চেনা জীবন থেকে আলাদা।

শেষ গল্প চেতন আর বন্দিতার জীবনের। দু’জনেরই বিদেশি ডিগ্রি। বন্দিতা পেশায় মনস্তত্ববিদ আর চেতন এমবিএ। আমেরিকায় কাটছিল দিব্বি জীবন। ছেলেমেয়ে হওয়ার পর দু’জনেরই মনে হয় দেশে ফিরতে হবে। তাই গুড়গাঁওতে আবার নতুন জীবন শুরু করেন তাঁরা। সে সময় চেতন এক Educational Institution-এর সঙ্গে জড়িত, যারা IAS, IPS এর মতো নানা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য ট্রেনিং দেন। কোম্পানিটি ছিল দুবাইয়ের। ভারতে তার CEO ছিলেন চেতন। বিহারে এক প্রশ্নপত্র ফাঁস কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। সংস্থার মাথা হিসেবে চেতনকে গুরগাঁও থেকে নিয়ে এসে সোজা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বোকারো জেলে। পরদিন থেকে ছিল ছটপুজো, শনি, রবির লম্বা ছুটি। বেশ কয়েকদিন অপরাধীদের সঙ্গে জেলে কাটাতে হয় চেতনকে। (Column)
জীবনের সেই কঠিন সময়ে চেতন এক বই লিখে ফেলেন তাঁর জেলের স্মৃতি নিয়ে। নাম Bokaro Bad Boys। বইটি Penguin থেকে প্রকাশের পরই হয়ে যায় Best Seller।
কদিন পরে প্রতিষ্ঠান থেকে আইনি উপায়ে ছাড়িয়ে আনা হয় চেতনকে। অন্য চাকরিতে join করেন চেতন। কিন্তু কাজ থেকে মন সরে যায়। কিছুটা অবসাদ গ্রাস করে। জীবনের সেই কঠিন সময়ে চেতন এক বই লিখে ফেলেন তাঁর জেলের স্মৃতি নিয়ে। নাম Bokaro Bad Boys। বইটি Penguin থেকে প্রকাশের পরই হয়ে যায় Best Seller। সে সময় চেতন বন্দিতা ঠিক করেন আর শহরে থাকবেন না। প্রকৃতির মধ্যে ছেলেমেয়েকে বড় করবেন। (Column)
প্রথমে উত্তরাখণ্ডের এই ছোট্ট গ্রামে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন তাঁরা। উত্তরাখণ্ড, বিশেষ করে সাতখোলের আশেপাশে আছে অনেক ডেয়ারি। অনেক ছোট ছোট কোম্পানি সেখানে চিজ বানায়। চিজের মান ভাল হলেও ব্যবসা না জানার জন্য তারা সেই চিজকে ঠিক মতো বেচতে পারে না। চেতন সেরকম সব ছোট প্রতিষ্ঠানের পেশাদারভাবে হাল ধরলেন। (Column)
আরও পড়ুন: হাততালি দিতেই ইতালি: তৃতীয় পর্ব
সেই সঙ্গে ইচ্ছে হল— কী করে লিখতে হয় তা শেখানোর। নিজে লেখক না হয়েও যদি Best Seller লেখক হওয়া যায় তাহলে ইচ্ছে থাকলে অনেক কিছুই করা যায়। আর চেতন বন্দিতার সেই ইচ্ছেপূরণের নামই হল The Himalayan Writing Retreat, যেখানে শুধু লেখকেরই জন্ম হয় না, জন্ম হয় নতুন মানুষের। নিজেদের জীবন যেমন নতুনভাবে গড়ে তুলেছেন বন্দিতা আর চেতন— ঠিক সেভাবেই তাঁরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অন্য মানুষদের দিকে। (Column)
এত নতুন মানুষ, নতুন জীবন, নতুন গল্প আমাকে শিখিয়েছিল নতুনভাবে বাঁচতে। মনে সাহস পেয়েছিলাম— আমি চাইলে ঠিক পারব নিজের জীবনকে সুন্দর করতে। সেদিন যে জীবন নির্মানের কথা ভেবেছিলাম আজ হয়তো তার পঞ্চাশ ভাগ যাপন করি। কিন্তু স্বপ্ন দেখি বাকি পঞ্চাশও একদিন আমি করে ফেলব। (Column)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অলংকরণ- লেখিকা
ছাত্রী ইতিহাসের আর চাকরি গণমাধ্যমে। তাতে কী! নেশা কিন্তু আঁকা এবং লেখা। বিশেষত নকশা। নোটবুক ভর্তি তার প্রতিটি ছবিই গল্প বলে চলে। গুছিয়ে বসে বা দফতরের মিটিংয়ের ফাঁকে - রং কাগজ এবং কলম সবসময় মজুত।