(Shibram Chakraborty)
“চাকর পরিলো ধুতি
গিলে করা পাঞ্জাবি
তাহারে কহিনু ডাকি
আজ “তুই কোথায় যাবি”?
কোঁচাটি লইয়া হাতে
হাসি হাসি বদনে
কহিল “যাইব আমি রবীন্দ্রসদনে”।”
এমন রসিকতা, তাও আবার ২৫শে বৈশাখে খোদ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে! না, ঠিক আস্পর্ধা বলা চলে না। আসলে মানুষটিই যে রসসাগরে পাওয়া সেই অরূপ রতন! মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের মেসবাড়িতে ছিল যাঁর আবাস, প্রায়ই তাঁর দেখা মিলত কলেজস্ট্রিটের ফুটপাথে। ঈশ্বর-পৃথিবী-ভালবাসা আর ভালবাসা-পৃথিবী-ঈশ্বর-এর সেই মানুষটিই ‘শিব্রাম’, শিবরাম চক্রবর্তী। রসিকতা তাঁর মজ্জাগত তবে ভিতরে ছিল চরম দারিদ্র্য! অভাবে ঠিকমতো খেতে পেতেন না প্রতিদিন, কিন্ত কখনো সেই অভাব প্রকাশ করেননি। (Shibram Chakraborty)
ভারতের উত্তর সীমান্তের বেশ কিছু অংশ দখলে তৎপর চিন। ম্যাকমোহন লাইন অতিক্রম করে চিনের সেনা প্রবেশ করেছে, শিবরাম কিন্ত নির্বিকার তাঁর লেখায়! লিখলেন, “রবীন্দ্রনাথ তো লিখেই গিয়েছেন, “একদিন চিনে নেবে তারে।” ” এই রসিকতা শিবরামের মজ্জাগত। বাঙালি পাঠককে তিনি মজিয়ে রেখেছেন রসবোধে। মস্কো বনাম পণ্ডিচেরী, হর্ষবর্ধন–গোবর্ধন, ইশ্বর পৃথিবী ভালবাসা-র কথা জানেন নারাজ এমন পাঠক বিশেষ করে বাঙালি পাঠক পাওয়া অতি দুর্লভ! (Shibram Chakraborty)
ফিরে যেতে হবে আরেকটু পিছনে। বিশ শতকের শুরুর দিকে, ১৯০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর, মালদার চাঁচলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শিবরাম। বাবা শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী ছিলেন সংসার-ত্যাগী সন্ন্যাসী। মা শিবরানী দেবী। মনে পড়ে যেতে পারে সেই অবিস্মরণীয় কটি লাইনের কথা, ঈশ্বর থেকে পৃথিবীতে আসা, তারপর ভালোবাসাকে জানা এবং তার ভিতরেই ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়া! নিজের জীবনের কথাই কি বলতে চেয়েছিলেন শিবরাম! (Shibram Chakraborty)
নিজে সাংসারিক বন্ধনে আবদ্ধ হননি, কিন্ত দূর থেকে দেখেছেন সেই বন্ধনকে, উপভোগও করেছেন বিলক্ষণ! নচেৎ তাঁর বিভিন্ন গল্পে এত বোন, ভগ্নিপতি আসে কীভাবে আর পাতানো বোন, ভাগ্নে, ভাগ্নিদের বিভিন্ন অছিলায় সংসারে বেঁধে ফেলার ছুতোই বা করতেন কেন! ভুলে গেলে চলবে না, কিশোরবেলায় নিজের প্রেমিকাকে হারিয়ে সারাজীবন এই মানুষটি কিন্ত অকৃতদারই থেকে গিয়েছিলেন! (Shibram Chakraborty)
কেউ কেউ তাঁকে চুটকি লেখক বলে হেয় করেছিলেন। নির্বিকার শিবরাম সেই চুটকির চটকেও রসিকতা করতে ছাড়েননি, “বিশ্বামিত্র তিনটি ছত্রে রচিলা গায়ত্রী/ চুটকি বলিয়া পেল নাকো ঋষি ফলারের পত্রী।” রাবড়ি খেতে ভালোবাসতেন খুব কিন্ত পকেট যে গড়ের মাঠ! অগত্যা কিনে আনতেন গুঁড়ো দুধ আর তাই-ই খেতেন অল্প অল্প করে। এখান থেকেই জন্ম হল সেই বিখ্যাত ‘রাবড়িচূর্ণ’-র, শিবরামের অতি প্রিয় মিষ্টি! (Shibram Chakraborty)
বিপ্লবী আমল। জোড়াসাঁকো থানা এলাকার গোয়েন্দা-পুলিশের কাছে পাকা খবর, মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে এক অদ্ভুত মেস আছে! সেই মেসের এক বোর্ডারের নামে প্রতিমাসে আসে মানি অর্ডার! টাকার পরিমাণও নেহাত কম না, কখনো ২০০ কখনো বা ৩০০ কিন্ত কোনোবারেই যুবকটি টাকা নেন না! খবর নিয়ে জানা যায়, এই যুবকটিই হচ্ছেন আমাদের ‘শিব্রাম’। কিন্ত ওই বাজারে টাকা ছাড়া কি চলে? তদন্তকারীরা খানা-তল্লাশির পর জানতে পারেন, শিবরাম হতদরিদ্র। দু-তিনমাস বাকি আছে মেসভাড়া। পুলিশের সন্দেহ তাও যায় না! ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপে এমন মেকি গরিবের আনাগোনাও বেড়েছিল তৎকালীন সময়ে। পঞ্চানন ঘোষাল, পুলিশের বড়কর্তা। অনেক চেষ্টা করেও কোনো বিপ্লবীকে বার করতে পারলেন না! (Shibram Chakraborty)
ভিডিও: বাংলা কথাসাহিত্যের হীরে-‘মানিক’ – জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য
শিবরামের লেখা সুন্দর, এমনটা শিবরামকে জানালে উত্তর ছিল স্পষ্ট, “ঠিক বলেছেন। আমি সুন্দর লিখি। কিন্তু ‘সুন্দরী’ লিখি না। সেই জন্য ভুগতে হয় অর্থকষ্টে।’’ বন্ধু হিসেবে প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন শিবরামের খুব কাছের। মজা করে প্রায়ই বলতেন, “প্রেমেনের মতো মিত্র হয় না।” প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই পুতুল ও প্রতিমা উৎসর্গ করেন শিবরামকে।
অভাবে কখনো স্বভাব নষ্ট হয়নি তাঁর। একবার প্রচণ্ড আর্থিক টানাটানি। কাবুলিওয়ালার কাছ থেকে টাকা ধার করবেন কিনা ভাবছেন শিবরাম কিন্তু সংবাদ কোনোভাবে চলে গেল বিভূতিভূষণের কাছে! অর্থাৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সব শুনে বললেন, কোনো কাবুলির থেকে টাকা ধারের প্রয়োজন নেই, তিনিই টাকা ধার দেবেন। তখনও দুজনের পরিচয় ততটা হয়ে ওঠেনি। পঞ্চাশ টাকা ধার নিয়েছিলেন শিবরাম কিন্তু সেই টাকা আর শোধ করে ওঠা হয়নি। কখনো দেখা-সাক্ষাৎ হলে শিবরাম যদিও বা টাকার প্রসঙ্গ তোলার চেষ্টা করতেন, বিভূতিভূষণ কিন্তু কৌশলে এড়িয়ে যেতেন সেই প্রসঙ্গ! আসলের বদলে কিছুটা সুদই উসুল হত তাদের আলাপ-পরিচয়ে, অর্থাৎ মুড়ি-তেলেভাজা খাওয়াতেন শিবরাম, বিভূতিভূষণকে!
বিভূতিভূষণের মৃত্যুর পর একদিন রিপন কলেজে তাঁর জন্মদিন পালন বিষয়ে শিবরামকে সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব দেয় কলেজ ছাত্ররা। শিবরাম জানতে পারেন প্ল্যানচেটে স্বয়ং বিভূতিবাবুও নাকি উপস্থিত থাকবেন ওই অনুষ্ঠানে! শেষপর্যন্ত আর যাননি শিবরাম। কে বলতে পারে, বিভূতিভূষণের বিদেহী আত্মা যদি সেই পঞ্চাশ টাকার প্রসঙ্গ তুলে সভাপতিকে লজ্জায় ফেলে দেয়, তবে!
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।