(১)
একটা মথ এসে বসেছে দেওয়ালে। পতপত শব্দ হচ্ছে পাখার। মথ, নাকি প্রজাপতি? কী যেন তফাৎ দুটোর মধ্যে? বিকাশ ভাবে। তারপর লাঠির খোঁচা মেরে উড়িয়ে দেয়। মথটা আলমারির পাশের দেওয়াল থেকে সরে গিয়ে জানালার পর্দার উপরে বসে। মথই হবে। প্রজাপতি নয়। সন্ধে কাটিয়ে রাতের বেলায় এসেছে। দিনের আলোয় নয়। পাখা ভাঁজ করে নয়, খুলে বসেছে। নাহ, প্রজাপতি নয়। অবশ্য প্রজাপতি এলেও বিকাশ উড়িয়েই দিত। আলমারির পেছন থেকে মুণ্ডু বের করে টিকটিকিটা অনেকক্ষণ ধরে মথটার দিকে তাকিয়েছিল। বিকাশ না দেখলে এতক্ষণে…
বিকাশ গত রাতেও এই কাণ্ড করে মথটাকে বাঁচিয়েছে। ভাগ্যিস চোখে পড়ল, তাই রক্ষে। যদি খেয়াল না করতো, ও কি মথটাকে বাঁচাতে পারত? কিন্তু মথটা কি এতটাই বোকা? নাকি অন্ধ? ও কি বুঝতে পারে না যে বিপদ ওঁত পেতে আছে? নাকি বুঝেও …
হয়তো শিবানীও বোঝেনি। নাকি বুঝেছিল? বিকাশ তো কম চেষ্টা করেনি মেয়েটাকে রাহুলের হাত থেকে বাঁচাবার! কিন্তু শিবানী রাহুলকে ভালবেসে ফেলেছে। রাহুল বাসেনি। রাহুল সেভাবে ভালবাসেও না। কাউকেই না। কবিসুলভ চেহারার আড়ালে ও শিকারী। শিকার ধরে। শিকারগুলো কি বুঝেও চুপ করে বসে থাকে? যেমন সুনয়না, কিম্বা সায়ন্তিকা। তবে শিবানী এদের মধ্যে আলাদা একদম। কবিতা খারাপ লেখে না। ভাষাজ্ঞান আছে। বানান ভুল নেই। রাহুলের পত্রিকা ‘বিস্তার’-এ প্রতি সংখ্যায় লেখে। প্রতি সংখ্যা মানে বছরে তিনটে। এর বেশি সংখ্যা বের করবেই বা কীভাবে রাহুল? হ্যাঁ, বাবার ওষুধের দোকান আছে ঠিকই। কিন্তু বাবা ছেলেকে খুব ভালো চেনেন। কাজেই ব্যবসার রাশ পুরোটাই এখনও নিজের হাতে রেখেছেন। দোকানে বসলেও ছেলের মন পড়ে থাকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিম্বা নন্দন চত্বরে। কে জানে কোত্থেকে শিবানীকে গেঁথেছে রাহুল। হয়তো শিবানীও যে কোনও শর্তে রাজি। বিকাশ বুঝিয়েছে। বিকাশ শিবানীকে বুঝিয়েছে অনেক। শিয়ালদহ স্টেশনে ট্রেনে উঠে নিজের স্টেশন বিরাটি ছাড়িয়ে মধ্যমগ্রাম অবধি যেতে যেতে বুঝিয়েছে।
আরও পড়ুন: বাংলালাইভের বিশেষ ক্রোড়পত্র: সুরের সুরধুনী
–এদিকে বলছ যে বাড়িতে বর এসব পছন্দ করে না, তাহলে এখানে আসো কেন? …
শিবানীর কপালের বড় লাল টিপটা একটু নেচে উঠল ভ্রুয়ের ওঠানামায়। মুখ টিপে হাসল…
– না বিকাশদা, লিখতে বারণ করে না লোকটা।
– তবে?
– এই অনুষ্ঠানে আসা নিয়েই সমস্যা…
– এসো না। কেন আসো? কী এমন অনুষ্ঠান হয়?
– কী যে বলো বিকাশদা! আজ কী ভালো অনুষ্ঠান হল। কত কিছু শেখা যায়…
শিবানী আরও কিছু বলছিল কলকল করে। কিন্তু বিকাশ অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। ট্রেনটা একটা ব্রিজ পেরিয়ে যাচ্ছিল তখনই। ট্রেনের চাকায়, রেললাইনে জড়িয়ে যাচ্ছিল ফাঁকা বাতাস। ঝমঝম শব্দ হচ্ছিল। ট্রেন ব্রিজে উঠলেই বিকাশ অন্যমনস্ক হয়ে যায়। বাতাস। ফাঁকা বাতাস। অথচ শব্দটা বদলে যায়। ঝমঝম শব্দ। একটা অযথা হুল্লোড়। একহাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের কথাও শোনা যায়না তখন। ধাতব আওয়াজ বেড়ে ওঠে শুধুই ফাঁকা বাতাস ঢুকে যায় বলে।
অনেকক্ষণ চুপ করে বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়েছিল বিকাশ। বেশি লোক ছিল না কামরায়। শিবানীর কানের পোড়ামাটির ঝোলা দুল দুটো খুব দুলে উঠছিল ওর কথার তালে তালে।
– যাই বলো…
একটা শ্বাস টেনেছিল বিকাশ…
– লিখতে হলে না হয় ঘরে বসেই লেখ…
বিকাশের কথার মাঝেই হিহি করে হেসে উঠেছিল শিবানী।
– সব সময় ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে নাকি? কী যে বলো বিকাশদা… এখানে এলে মনটা ভালো হয়ে যায়…
(২)
রাহুল বিকাশের কলেজবেলার বন্ধু। বরাবরই রাহুল হুল্লোড় করতে, মজা করতে ভালবাসে। দেখতে যে খুব সুন্দর, এমন নয়। কিন্তু একটা এক্স-ফ্যাক্টর আছে। মেয়েরা প্রেমে পড়ে যায় সহজেই। সঞ্চিতাও পড়েছিল। বিয়েও হয়েছিল। প্রথমে রেজিস্ট্রি। বিকাশ সাক্ষী ছিল। পরে সোশ্যাল ম্যারেজ। রাহুল সেলসে চাকরি পাওয়ার পরে। কিন্তু বিয়ের দু’বছর পূর্ণ হবার আগেই সঞ্চিতা বাপের বাড়ি গিয়ে থাকা শুরু করে। বনিবনা হচ্ছিল না। রাহুলের অনুরোধে বিকাশ এক দু’বার চেষ্টা করেছে মধ্যস্থতা করতে। ফল হয়নি। সম্পর্কটা টেকেনি। অফিসিয়াল ডিভোর্স হয়েছে কিনা বিকাশ জানে না। অবশ্য কোনওদিন জানতে চায়নি। তাছাড়া রাহুল একটু দূরে সরে গিয়েছিল তখন। লোকমুখে শুনেছে চাকরি ছেড়ে বাবার সঙ্গে ওষুধের দোকানে বসছে রোজ। সুমতি হয়েছে। অথচ দোকানে বসা দু’চোখের বিষ ছিল রাহুলের কাছে।

বিকাশও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল নিজের জীবন নিয়ে। বাবার হঠাৎ মৃত্যু, মায়ের অসুস্থতা তাকে বদলে দিয়েছিল রাতারাতি। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া খুব জরুরি মনে হয়েছিল তার। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন পড়া ছেড়ে চাকরির পরীক্ষায় বসতে শুরু করেছিল বিকাশ। পেয়েও গিয়েছিল একটা চাকরি। কিন্তু মায়ের নার্ভের অসুখটা খুব বাড়তে লাগল। মা একেবারে শয্যা নিলেন। বাড়িটা অসুখ-অসুখ গন্ধে ভরে গেল। বিকাশ মাকে অযত্নে রাখে না। সাধ্যমতো করে। দেখাশোনা করবার লোক আছে। তবে বিকাশের বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না মাঝে মাঝে। মনে হয় পালিয়ে চলে যায় কোথাও। অফিসের সহকর্মীরা দল বেঁধে বেড়াতে যায়। বিকাশ যেতে পারে না কোথাও এক রাতের জন্যেও। কীভাবে এরকম একজন রুগিকে বাড়িতে ফেলে দূরে কোথাও যাবে? কোনও বন্ধু আবার উপদেশ দেয় বিয়ে করবার জন্য। বিকাশ হিসেব করে দেখেছে। উপার্জনের একটা বড় অংশ বেরিয়ে যায় মায়ের ওষুধ, নিয়মিত ডাক্তারের চেক-আপ, ফিজিওথেরাপি, নার্সিং ইত্যাদি খরচে। বিয়ে করলে এতসব সামলাতে পারবে কিনা সন্দেহ!
শিবানী এদের মধ্যে আলাদা একদম। কবিতা খারাপ লেখে না। ভাষাজ্ঞান আছে। বানান ভুল নেই। রাহুলের পত্রিকা ‘বিস্তার’-এ প্রতি সংখ্যায় লেখে। প্রতি সংখ্যা মানে বছরে তিনটে। এর বেশি সংখ্যা বের করবেই বা কীভাবে রাহুল? হ্যাঁ, বাবার ওষুধের দোকান আছে ঠিকই। কিন্তু বাবা ছেলেকে খুব ভালো চেনেন। কাজেই ব্যবসার রাশ পুরোটাই এখনও নিজের হাতে রেখেছেন। দোকানে বসলেও ছেলের মন পড়ে থাকে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে কিম্বা নন্দন চত্বরে। কে জানে কোত্থেকে শিবানীকে গেঁথেছে রাহুল।
বিকাশ বিয়ের কথা ভাবে না। তাছাড়া মেয়েদের সঙ্গে যেচে আলাপ করতে কোনওদিনই পারে না সে। এক দু’জনকে ভালো লাগলেও বন্ধুত্বের সীমারেখা ছাড়িয়ে প্রেমের দিকে কখনই এগোতে পারেনি সে। অফিস ছুটির পরে সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না বিকাশের। ইতস্তত ঘুরে বেড়ায় এদিক ওদিক। সিনেমা কিম্বা নাটক দেখে একা একাই। রাত ঘনিয়ে এলে বাড়ি ফিরে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এরকমভাবেই ঘুরতে ঘুরতে একদিন নন্দন চত্বরে বহুকাল পরে দেখা হয়ে গিয়েছিল রাহুলের সঙ্গে। রাহুলের পত্রিকার অনুষ্ঠান ছিল সেদিন। রাহুল হইহই করে জীবনানন্দ সভাঘরে ডেকে নিয়েছিল বিকাশকে। বিকাশ যে এককালে লেখালেখি করত, সেটা ভোলেনি রাহুল। যদিও সেদিন বিকাশ নিজের কবিতা কিছু পাঠ করেনি। স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করেছিল ‘অবনী, বাড়ি আছ’। অনেকদিন পরে এরকম একটা পরিবেশে এসে মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল।
(৩)
বিকাশ নিজের পাড়ায়, বিরাটিতে স্কুলবেলা থেকেই বের করত একটা পত্রিকা– ‘দেবীনগর’। প্রথম প্রথম ছিল আর্টপেপারের উপরে হাতে লেখা। পাড়ার ক্লাবে টাঙানো হত পুজোর সময়। পরে ছাপানো বই। বছরে একটা। তখন হাতে পয়সা কোথায় যে এর বেশি করবে? তাও আত্মীয়-বন্ধু, পাড়া প্রতিবেশীদের থেকে চাঁদা তুলে পুজোর সময় বেরত। প্রচ্ছদের জন্য হলদেটে তুলোট কাগজের উপরে মেরুন রঙ দিয়ে জোরালো তুলির টানে দেবীর ত্রিনয়ন এঁকে দিয়েছিল প্রতিবেশী আর্ট কলেজের ছাত্র শুভ। কলেজে পড়াকালীন রাহুলও এক দু’বার লিখেছিল দেবীনগরে। তখন সঞ্চিতার সঙ্গে প্রেম চলছিল। স্বাভাবিকভাবেই প্রেমের কবিতা লিখেছিল রাহুল। অথচ, বিকাশ কখনই প্রেমের কবিতা সেভাবে লিখতে পারে না। কেমন একটা বিষাদের সুর নেমে আসে ওর সব কবিতায়। ‘দেবীনগর’ পত্রিকার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন আড়ম্বর করে কিম্বা হল ভাড়া করে, বিকাশ কোনওকালেই করেনি। মহালয়া আর ষষ্ঠীর মাঝে যেদিন রবিবার পড়ত, বিকাশ পত্রিকা প্রকাশের অনুষ্ঠান করত বাড়ির ছাতে, হাতে গোনা কিছু মানুষজনকে নিয়ে। অবশ্য ‘বিস্তার’ ছোট ছোট অনুষ্ঠান প্রায়ই করে। বিকাশ যায় রাহুলের অনুরোধে। সত্যিই কি অনুরোধে, নাকি সন্ধেবেলায় নিজের বাড়িতে অসুখ-অসুখ গন্ধের মধ্যে ফিরবার বদলে অন্য কোথাও, অন্য কোনো হুল্লোড়ে নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে যায় সে?
মাঝরাতে ঘুমের মধ্যে সে শুনতে পায় মথটার ডানা ছটফটানির শব্দ খুব বেড়ে গেছে। তাহলে কি টিকটিকিটা শিকার ধরতে পেরেছে? বিকাশ মশারি সরিয়ে খাট থেকে নেমে আলো জ্বালে। হ্যাঁ, ওর অনুমান অভ্রান্ত। টিকটিকিটা মথটার আধখানা শরীর গিলে ফেলেছে। মথটা ছটফট করছে। হয়তো খুব কষ্ট হচ্ছে প্রাণিটার। মরণযন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু এখন আর বিকাশ কিছু করতে পারবে না। তাছাড়া করবেই বা কেন? কেন খামকা লাঠি হাতে মথটাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছিল সে? নিজেরি হঠাৎ খুব হাসি পায় তার। এ তো বাস্তুতন্ত্রের নিয়ম। তার বিপরীতে কেউ কীভাবে যাবে?

সেদিন ট্রেনের কামরাটা ফাঁকা ফাঁকা। ধারেপাশে কেউ বসেনি। শিবানী সরাসরি তাকায় বিকাশের চোখের দিকে। কিন্তু বিকাশের চশমার মোটা কাচের ভেতর দিয়ে দেখতে পায় না তার চোখের মণি।
– হিংসে করো? হিংসে করো তুমি রাহুলদাকে?
– হিংসে? কেন?
বিকাশ হাসবার চেষ্টা করে…
– তাহলে কেন আমাকে বারবার বলো… অনুষ্ঠানে না আসতে, ঘরে বসে লিখতে?
– লেখা খুব একান্তের জিনিস শিবানী। অনুষ্ঠানের হুল্লোড় চেঁচামেচিতে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লে লেখার মান নেমে যায়… এটা আমার মনে হয়… আমি নিজেও এখন থেকে এই সব অনুষ্ঠানে কম আসব ভাবছি।
– বেশ। সেটাই ভালো। তাহলে আর নিজের স্টেশন পার করে করে তোমায় এতদূর আসতেও হবে না আমায় পাহারা দিতে দিতে। তাছাড়া তোমাকে আমার সঙ্গে সবসময় দেখলে লোকে কী ভাববে বলো তো?
– লোকের ভাবনায় তোমার কি সত্যিই কিছু যায় আসে শিবানী?
বিকাশ কেটে কেটে বলে…
– মানে? কী বলতে চাও তুমি?
– আমি কী বলব? সবাই বলছে। গত সপ্তাহে টাকিতে গিয়েছিলে তুমি? রাহুলের সঙ্গে? গেস্টহাউসের বারান্দায় চুল খুলে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে প্রোফাইল-পিক করেছ ফেসবুকে। এদিকে রাহুলও নিজের প্রোপিক বদলেছে সেদিন। সে দাঁড়িয়ে আছে ইছামতীর পারে। দুয়ে দুয়ে চার করতে কি খুব বেশি বুদ্ধি লাগে?
– বাব্বা! এত কিছু জানো যখন…
– না শিবানী। আমি কিছুই জানি না। জানতে চাইও না।
– তুমি রাহুলদাকে তো কিছু বলো না…
– ওকে বলে লাভ নেই…
বিকাশ সিট ছেড়ে ট্রেনের দরজার দিকে যায়…
– ওর ব্যাপারটা… একী! নামবে না? মধ্যমগ্রাম ঢুকছে তো… শিবানী ট্রেনের জানালার দিকে সরে বসে। রাতের অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকে। এক ঝলক মুখ ফিরিয়ে বলে-
– আমি হৃদয়পুরে যাব আজ… তুমি এখানেই নেমে যাও। নাহলে ফিরতি ট্রেন পাবে না।
আরও পড়ুন: ধ্রুব মুখোপাধ্যায়ের গল্প: উটকো ঝামেলা
হৃদয়পুরে শিবানীর বাপের বাড়ি। বিকাশের হঠাৎ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা কবিতার লাইন মনে পড়ে… ‘তখনো ছিল অন্ধকার, তখনো ছিল বেলা/ হৃদয়পুরে জটিলতার চলিতেছিল খেলা’। সত্যি, শিবানীর ব্যাপারটা জটিল হয়ে উঠছে। মধ্যমগ্রামে নামল না আজ। হয়তো বরের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। পরকীয়া চালাবে, আর সংসারে আঁচ লাগবে না, এটা অসম্ভব। মধ্যপথে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। কোনও এক মেরুতে তো যেতেই হবে। তাই শিবানী আজ হৃদয়পুরে ফিরবে। কিন্তু সত্যিই কি ব্যাপারটা হৃদয়ের খেলা? শিকার-শিকারি সমীকরণ নয়? যাই হোক, বিকাশ আর মাথা ঘামাবে না এসব ব্যাপারে। তাছাড়া শিবানীকেই বা কতটুকু চেনে সে? পত্রিকার সবকটা মিটিং কিম্বা অনুষ্ঠানের শেষে শিয়ালদহ থেকে একই ট্রেনে ফিরবার ব্যাপারটা স্বতঃসিদ্ধের মত হয়ে গিয়েছে। বিকাশ যদি ক’দিন না যায়, তাহলেই কেটে যাবে এই ছন্দটা। বিকাশ এতকিছু বোঝাবেই বা কেন? কচি খুকি তো আর নয়। চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি হবে শিবানীর বয়স। বাচ্চাকাচ্চা নেই বলে আরও কম দেখায়। ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বাড়ি ফেরে সে।
(৪)
বেশ কিছুদিন কোনও অনুষ্ঠানে যায়নি বিকাশ। যেতে পারেনি। মায়ের অসুস্থতা বেড়ে চলছিল ক্রমশ। বিকাশ অফিসের শেষে তাড়াতাড়ি ফিরে আসছিল ঘরে এবং অসুখ-অসুখ গন্ধের মধ্যে অস্থির বোধ করছিল। দীর্ঘ দশ বছর রোগভোগের পর এক কাক-ডাকা ভোরে মা চলে গেলেন। হয়তো মুক্তি পেলেন। এক মুহূর্তের জন্য বিকাশের মনে হল যে সেও এখন ওই অসুখ-অসুখ গন্ধটার থেকে মুক্তি পাবে। পরক্ষণেই নিজের উপরে রেগে উঠল সে। শোকে ডুবে যাওয়ার কথা ছিল তার। মুক্তির কথা ভাবা খুব অপ্রাসঙ্গিক এরকম সময়ে। মায়ের কাজ মিটে গেল ভালোভাবে। খবর পেয়ে রাহুল এসেছিল। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব অনেকেই খোঁজ নিয়েছিল, এসেছিল কেউ কেউ। কিন্তু শিবানী কোনও খোঁজ নেয়নি। ফোনও করেনি।
বিকাশের হঠাৎ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা কবিতার লাইন মনে পড়ে… ‘তখনো ছিল অন্ধকার, তখনো ছিল বেলা/ হৃদয়পুরে জটিলতার চলিতেছিল খেলা’। সত্যি, শিবানীর ব্যাপারটা জটিল হয়ে উঠছে। …কিন্তু সত্যিই কি ব্যাপারটা হৃদয়ের খেলা? শিকার-শিকারি সমীকরণ নয়?
বিকাশ ভেবেছিল আবার নন্দন চত্বরে ঘোরাঘুরি শুরু করবে কিম্বা অফিসের বন্ধুদের দলের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাবে। সন্ধেবেলায় বাড়িতে থাকলে আবার সেই অসুখ-অসুখ গন্ধটা চেপে বসে। মুক্তি পায়নি সে। একদিন সকালে লক্ষ করল মায়ের ঘরে খাটের নীচ থেকে বেরিয়ে এল একটা মোটা হুলো বেড়াল। বিকাশ তাড়িয়ে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু রান্নাঘর থেকে ঠিকে রান্নার লোক বসুমতী বলে উঠল,
– ওকে তাড়িও না মামা! দিদা এঁটোকাঁটা দিত। ডাকত ‘বটেশ্বর’ বলে।
বিকাশের ভ্রুদুটো কুঁচকে উঠল। হয়তো এই বেড়ালটাই দায়ী। অসুখ-অসুখ গন্ধ নয়। নির্ঘাত ঘরে কোথাও বর্জ্যত্যাগ করেছে বেড়ালটা। সেইজন্য একটা বাজে গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়িতে। সন্ধেবেলায় দরজা-জানালা বন্ধ থাকে বলে গন্ধটা বেড়ে যায়। রবিবার নিজে ফিনাইল দিয়ে বাড়িঘর পরিষ্কার করল সে। নাহ, বেড়ালটা ঘর নোংরা করেনি কোথাও। তবুও সন্ধেটা কিছুতেই তাড়াতাড়ি ফিরতে ভালো লাগত না তার। এর মধ্যে একদিন শুরু হল লকডাউন।

লকডাউনে অফিস বন্ধ থাকায় বাড়ি বসে বেশ কিছুদিন অস্থির লাগতে থাকার পরে বিকাশ ভাবল যে ‘দেবীনগর’ আবার বের করলে কেমন হয়! যেমন ভাবা তেমনি কাজ। যারা লিখতেন আগে, সবাইকে ফোন করে লেখা চাইতে শুরু করল সে। কেউ কেউ দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিল। কেউ কেউ আবার দিয়েও দিল। পত্রিকার নামে আলাদা ইমেল আইডি তৈরি করে ফেলল সে। অনলাইনে সস্তায় একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার কিনে মেতে উঠল বিকাশ। আপাতত ‘দেবীনগর’ বছরে একটা সংখ্যা প্রকাশ করবে সে। বিশাল কিছু পরিচিতির প্রয়োজন নেই তার। পত্রিকার লেখা, বিষয়বস্তু, পাতা, প্রচ্ছদ সব দিক দিয়ে মান ভালো রাখবার চেষ্টা করবে। ‘দেবীনগর’-এর ভাবনাটা মাথায় চাগাড় দেওয়ার পর থেকেই অদ্ভুতভাবে সে লক্ষ করল, যে আজকাল আর অতখানি খারাপ লাগছে না বাড়িতে। সন্ধেবেলায় জানালা-দরজা বন্ধ থাকলেও বিশ্রি দমচাপা অসুখ-অসুখ গন্ধটা আর ততটা পায় না। বটেশ্বর এসে বসে থাকে মাঝে মাঝে। খাওয়ার লোভে আসে। আলমারির পেছন থেকে কিম্বা দেয়ালের অন্য জায়গায় টিকটিকি বিশেষ দেখতে পাচ্ছে না বিকাশ আজকাল। বেড়ালের ভয়ে টিকটিকি আসছে না? হতেই পারে।
(৫)
অফিস খুলে গেলেও ট্রেন চালু হল না। বিকাশ পুলকারে অফিসে যাতায়াত করে। মাঝে একবার রাহুল ফোন করেছিল। একদিন যেতে বলেছিল। ‘বিস্তার’ নিয়মিত বের করতে পারছে না সে। সমস্যাটা অর্থনৈতিক নয়। বিকাশ গিয়েছিল। একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল সে। খুব ভিড় দোকানে। অতিমারীতে ওষুধের দোকান ভালো চলবে, ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠবে, এর মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই। যেটা আশ্চর্য, সেটা হল রাহুল মন দিয়ে দোকান সামলাচ্ছে। বাবা হঠাৎ চলে গেছেন কোভিডে। রাহুলের উপরে এখন সব দায়িত্ব। ভিড় একটু কমলে কাছে গেল সে। রাহুল লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল দোকান থেকে…
– আরে আয় আয়…
বিকাশ লক্ষ করল ক্যাশ-কাউন্টারে একজন পৃথুলা মহিলা বসে আছেন। মুখ মাস্কে ঢাকা। হঠাৎ বিকাশকে দেখে তিনি হাসতে শুরু করলেন। মুখ ঢাকা হলেও কুঁচকে ওঠা চোখ দেখে বিকাশ বুঝতে পারল যে হাসছেন। তারপর মাস্ক একটু সরিয়ে তিনি বলে উঠলেন…
– কী রে বিকাশ, চিনতে পারছিস না!…
বিকাশ বিস্মিত হতেও ভুলে গেল সঞ্চিতাকে দেখে। সত্যিই সে প্রথমে চিনতে পারেনি। বিস্ময় গোপন করার চেষ্টা না করেই সে বলে উঠল…
– আরে, তুই… ভালো আছিস তো?
যদিও সঞ্চিতাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে খুবই ভালো আছে। অতীতের ধারালো কাটা কাটা লম্বাটে সুন্দর মুখটা মেদের ভারে একদম গোল। সুখী মানুষের শরীর থেকে একরকম মসৃণ আভা বের হয়। সঞ্চিতাকেও সেরকম দেখাচ্ছে। রাহুল নিচুস্বরে বলল…
– ফিরে এসেছে… বাবা চলে যাওয়ার পরে…
বিকাশ বুঝতে পারল না কেন হঠাৎ সঞ্চিতার কুঁচকে ওঠা চোখ দেখে ওর বটেশ্বরের কথা মনে পড়ল।

রাহুল ইনিয়েবিনিয়ে যেটা বলল, যে ‘বিস্তার’এ পুরোপুরি সময় সে এখন দিতে পারবে না। কিন্তু যদি বিকাশ ওর হয়ে পত্রিকার হাল ধরে, তাহলে পত্রিকা ছাপানো, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ইত্যাদি সব খরচ রাহুল দেবে। রাহুলকে বেশ অন্যরকম দেখাচ্ছে আজ। সেই শিকারি পুরুষ উধাও। সেই কবিসুলভ ভঙ্গিমাও নেই। বাস্তব কেজো পৃথিবীর দৈনন্দিন যাপনের সঙ্গে তাল মেলাতে চাওয়া ব্যস্তসমস্ত এক মানুষ, যার সঙ্গে লেখালেখি, কবিতা এসবের কোনও সম্পর্ক আছে বলে মনে হচ্ছে না। রাহুল চাইছে বিস্তারের প্রধান সম্পাদক হবে বিকাশ। রাহুল উপদেষ্টা হিসেবে থাকবে। বিকাশের অদ্ভুত লাগল। সে যখন ভাবছে ‘দেবীনগর’ নতুন করে বের করবে, তখনি এরকম একটা প্রস্তাব! যদি ‘দেবীনগর’-এর ভাবনাটা না থাকত, তাহলে বিকাশ সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ বলে দিত। কেন সে জানে না, নির্দ্বিধায় হ্যাঁ বলতে পারছে না আজ। কোথায় যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। তবুও বাইরে প্রকাশ করল না সে। …
– পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হোক, ট্রেন চলুক, দেখছি…
এসব বলে বিকাশ চুপ করে গেল। ভেবেছিল রাহুলকে শিবানীর কথা একবার জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু দু’হাত দূরেই সঞ্চিতা বসে আছে। জানা হল না শিবানী কেমন আছে।
অনলাইনে সস্তায় একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার কিনে মেতে উঠল বিকাশ। আপাতত ‘দেবীনগর’ বছরে একটা সংখ্যা প্রকাশ করবে সে। বিশাল কিছু পরিচিতির প্রয়োজন নেই তার। পত্রিকার লেখা, বিষয়বস্তু, পাতা, প্রচ্ছদ সব দিক দিয়ে মান ভালো রাখবার চেষ্টা করবে। ‘দেবীনগর’-এর ভাবনাটা মাথায় চাগাড় দেওয়ার পর থেকেই অদ্ভুতভাবে সে লক্ষ করল, যে আজকাল আর অতখানি খারাপ লাগছে না বাড়িতে।
ফেরবার পথে মনটা খচখচ করতে লাগল। মাঝে একবার ফোন করেছিল শিবানীকে। ‘মওজুদ নেহি হ্যায়’ বলে রেকর্ডেড বার্তা বেজে উঠল। এই নাম্বারটা এখন বাতিল। হয়তো নাম্বার বদলেছে। এমনকী ফেসবুক অ্যাকাউন্টটাও উধাও। মেয়েটা কি কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায় না? তাই হবে। হয়তো ভালই আছে। তাছাড়া কতটুকু আর দেখেছে বিকাশ মেয়েটাকে? সাকুল্যে সাত কি আটবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। কলকল করে কথা বলত। ট্রেনে একইসঙ্গে ফিরত অনুষ্ঠান শেষ হবার পরে। রাত হয়ে গিয়েছিল বলে দুদিন বিকাশ সঙ্গে মধ্যমগ্রাম অবধি গিয়েছিল। স্টেশন থেকে রিক্সায় তুলে দিয়ে আবার অন্য ট্রেন ধরে ফিরেছিল বিরাটিতে। মেয়েটা খারাপ লিখত না। যদি যোগাযোগ হত একবার, দেবীনগরের জন্য লেখা চাইত বিকাশ। এছাড়া তো আর কোনও প্রয়োজন নেই। রাহুলের কাছে ফোন নাম্বার চাইবে? কিন্তু শিবানী সম্ভবত কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায় না, তাছাড়া রাহুলও বদলে গেছে। শিবানীও হয়তো বরের কাছে ফিরে গেছে মধ্যমগ্রামে।
(৬)
– ফিরেই তো গিয়েছিলাম।
কালো মুখোশটা টানে শিবানী। স্থির হয়ে দাঁড়ায় ট্রেনের দরজার দিকে মুখ করে। অনেকদিন পরে ট্রেন চালু হয়েছে। ফাঁকা ফাঁকা কামরা। অনেক জায়গা রয়েছে বসবার। শিবানী বসে না। দরজার খোলা বাতাসের সামনে দাঁড়িয়ে মুখোশটা নামিয়ে শ্বাস টানে। বিকাশ ফিরছিল অফিস থেকে। অর্ধেক মুখ মুখোশ ঢাকা হলেও চোখদুটো দেখেই শিয়ালদহ স্টেশনে শিবানীকে চিনতে পেরেছিল। শিবানীর সিঁথি সাদা। কপালে লালের বদলে আজ কালো টিপ। কানে বড় ঝোলা দুলের বদলে অশ্রুর মতো দেখতে ছোট মুক্তোর দানা।
– ফিরেই গিয়েছিলাম বিকাশদা। নতুন করে সব বোঝাপড়া করে আবার শুরু করেছিলাম… তুমি বুঝিয়েছিলে… কিন্তু এই সময়টা… এই অতিমারী… নিয়ে গেল লোকটাকে…
শিবানী একটুও কলকল করে কথা বলছে না আজ। থেমে থেমে নিচু গলায় বলছে শব্দগুলো। বিকাশ ঠিক বুঝতে পারছে না এরকম পরিস্থিতিতে কী বলা উচিত। পত্রিকার জন্য লেখা চাইবার কথা এখন বলা যায় না। এমনকী ফোন নাম্বারটাও চাইতে পারছে না সে।
– তারপর বলো, তোমার খবর কী?
শিবানী বাইরের সন্ধে নামা আকাশের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে প্রশ্ন করে। বিকাশ উত্তর দেবার আগেই ট্রেনটা ব্রিজ পেরোতে থাকে। বাতাসের শব্দ, চাকার ঝমঝম শব্দের অদ্ভুত হুল্লোড়ের মাঝে ওরা দুজনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। শিবানী নির্দিষ্ট কোনও উত্তরের প্রত্যাশী নয়, বুঝতে পারে বিকাশ। তবে আজকের পরে শিবানীর সঙ্গে আবার দেখা হবে হয়তো। এই লাইনের ট্রেনেই তো বিকাশ রোজ ফিরবে অফিস থেকে। শিবানীও ফিরবে। বরের অফিসে চাকরিটা পেয়েছে সে। আবার কখনো দেখা হয়ে যাবে।
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Saatchiart, Pixels, Wikimedia commons
জন্ম জুলাই, ১৯৭১, কলকাতায়। ২০০৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূবিদ্যায় পিএইচডি। গল্প, কবিতা লেখালেখি ছাড়াও ইংরেজি এবং জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদের কাজ বিশেষ পছন্দের। ২০১৬ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই ‘অরণ্যমেঘবন্ধুর দল’ বিশেষ সমাদৃত হয়েছে।
8 Responses
এক পাহাড়ি নদীর মত তরতরিয়ে এগিয়ে গেছে লেখাটি – জীবনের ভাঙা-গড়ার গল্প শোনাতে শোনাতে।
মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ!
প্রাঞ্জল ও স্বতস্ফূর্ত লেখনী। বাস্তব জীবনের প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলিকে যেন এক নিপুণ চিত্রকরের মত আঁকা হয়েছে এই ছোটগল্পে। মধ্যবিত্ত জীবনের অনেক চেনা জানা বাঁক ও ঘাত প্রতিঘাত জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই লেখায়। নন্দিনীকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
Thanks Arindam 🙏🍀
আমাদেরই কথা। চারপাশে যা দেখি শুনি। ভালো লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ 🙏🍀
দারুন, সহজ স্বাভাবিক গতিতে লেখনী লেখিকার ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, পাঠকের জীবনের কোনো অভিজ্ঞতাকে কোনো এক বাঁকে মিলিয়ে দিয়েছে | আরও লেখার আশায় রইলাম |
মতামতের জন্য ধন্যবাদ!