(Short Story)
তোমাদের আমি টুংরির গল্প বলেছি কি? সেই কোন যুগে আমার ঠাকুরদা একটু একটু করে বানিয়েছিলেন বাড়িটা। বাবার জন্ম সেই বাড়িতেই। আমার ছোটবেলাও কাটে ওখানেই। কত ঘটনার স্মৃতি আছে টুংরির সেই বাড়িতে! জীবনের প্রথম বারোটি বছরের স্মৃতি যেন আর সব স্মৃতিকে ম্লান করে ছাপিয়ে ওঠে। তার অনেক গল্প জমা হয়ে আছে। পরে যখন লীলা মজুমদারের লেখা পড়েছি, বোগিদাদা ও ঝগড়ুর গল্প, বা গুপির গুপ্তখাতা; মনে হয়েছে যেন আমাকে নিয়েই লেখা। আমি, টুংরির বাড়ি, পিপনি, গুড্ডন, রাজু, বুলকু… সবাইকে খুঁজে পাই ওঁর লেখায়। (Short Story)
টুংরির বাড়ির পেছনদিকে উঠোন ছাড়িয়ে ফলের বাগান, তারপর পুকুর, আর তারপরেই মাহাতদের ফাঁকা মাঠ। মাঠ পেরিয়ে রেললাইন, আর তার পরেই দুম্বিসাইয়ের জঙ্গল। অধুনা ঝাড়খন্ড আর উড়িষ্যার সীমানা বরাবর যে সারান্ডার জঙ্গল, সেখান থেকে বুনো হাতির দল প্রায়ই পথ ভুলে আমাদের জনবসতিতে এসে পড়ত। হাট, গ্রাম, চাষ জমি, মানুষের বসতি এড়িয়ে বুনো হাতির দল যাতে স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করতে পারে, তার জন্য সেফ করিডর ছিল ওই রেললাইনের ওপারের জঙ্গলটা। (Short Story)
দোতলার ছাদ থেকে রোজ ভোরবেলা দেখতাম জঙ্গলের গাছের পেছন থেকে সূয্যি মামা উঁকি দিয়ে জেগে উঠছেন। রেললাইনের ওপর তুলোর মতন কুয়াশার আস্তরণটা ধীরে ধীরে হালকা হয়ে মিলিয়ে যায়। বাবা সূর্য্য প্রণাম শিখিয়েছিলেন, “ওং জবা কুসুম সঙ্কাশন!” পেছনে বাগানের কোনার দিকে বড় নারকোল গাছটায় অনেকগুলো বাবুই পাখির বাসা। সকাল হতে না হতেই তাদের যেন তাড়ার শেষ নেই। একে ওকে ডাকাডাকি, একবার ফুড়ুৎ করে উড়ে কোথাও যাচ্ছে, আবার ফিরে এসে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে। খিড়কির গেটের কাছে বুড়ো তুঁতগাছটায় ভোরের লাল আলো এসে পড়তেই শুঁয়োপোকাগুলো গুটি গুটি পাতার আড়ালে গিয়ে ঢোকে। রাজুর মা কয়লার উনুনে আঁচ দেয়, হাওয়ায় তার গন্ধ ভেসে আসে। নিচ থেকে বাবার গলায় গান ভেসে আসে, “আগুনের পরশ মনি ছোঁয়াও প্রাণে…” (Short Story)

ওই রেল লাইন দিয়ে দিনে একটা মোটে প্যাসেঞ্জার ট্রেন যেত তখন। বাকি সারাদিন ধরে মাঝে মাঝেই শোনা যেত টং লিং টং লিং শেকলের আওয়াজ তুলে একটার পর একটা মাল গাড়ি চলেছে। কাছেই নোয়ামুন্ডির মাইনস থেকে সোজা টাটানগর। বসে বসে গুনতাম, কোন ট্রেনে কটা বগি। শেষ কামরায় কখনও কখনও কালো কোট, সাদা প্যান্ট পরা গার্ড সাহেবকে দেখা যেত। জন্মদিনে পাওয়া বায়নাকুলারটা নিয়ে উৎসুক হয়ে দেখতাম। দেখতাম, আর ভাবতাম, আজ বুঝি পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে ট্রেন থেকে ঝুপ করে লাফ দিয়ে পালিয়ে আসবে ডাকু শার্দুল সিং! পুলিশের গুলি খেয়ে সে তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বা হয়তো দুটো বগির মাঝের শেকলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে জাদুকর কান্হাইয়ালাল। সে বহুরূপী সাজে ম্যাজিক দেখিয়ে ফেরে। (Short Story)
আমাকে শার্দুল সিংয়ের গল্প শোনাত বাহাদুর দাদা। কখনও আমার ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা লাগাতে লাগাতে, কখনও আমাদের অ্যালসেশিয়ন লিওকে বল ছুঁড়ে ছুঁড়ে লোফালুফি করাতে করাতে, অনেক গল্প বলত বাহাদুর দাদা। তার কাছেই তো শুনলাম, শার্দুল সিং আসলে ডাকু নয়, সে হল বাগী। ও সাধারণ মানুষের ওপর মোটেও জুলুম করে না। বড়লোক মহাজনদের থেকে লুঠপাট করে, গরিবদের দিয়ে দেয়। আর কান্হাইয়ালাল? তার আসল চেহারা তো কেউ জানে না! কিন্তু যে কোনও পার্বণে দেখো, সে গাজন উৎসবই হোক, বা কালী পুজো, ঠিক যখন যে সাজটি সাজতে হবে, সেই সাজে ঠিক এসে হাজির হয়ে যাবে। (Short Story)
“নারকোল গাছের ওই পাশটায়, ঠাকুমার ভেঙে পড়া পুরোনো রান্নাঘরের দিকটায় কেউ যায় না; শুধু আমি, আর লিও যাদের পছন্দ করে, একমাত্র তারাই যেতে পারে সেখানে।”
কখনও জন্মাষ্টমীতে কৃষ্ণ হয়ে বাঁশি বাজিয়ে যেমন সবাইকে মাতিয়ে দিতে পারত, তেমনি রামনবমীতে হনুমান সেজে গদা ঘুরিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত। আর নাচে তার জুড়ি নেই– তার সব খেলা দেখানো হয়ে গেলে, হাতে একটা ধুনুচি নিয়ে, নাচতে নাচতে, একেবারে নাচের শেষের দিকে, একটা ধোঁয়ার কুয়াশা বানিয়ে, ঝুপ করে কোথায় হারিয়ে যেত, কেউ খুঁজে পেত না। আমার বন্ধু রাজু, সে বলত ওটা মায়াজাল। (Short Story)
নারকোল গাছের ওই পাশটায়, ঠাকুমার ভেঙে পড়া পুরোনো রান্নাঘরের দিকটায় কেউ যায় না; শুধু আমি, আর লিও যাদের পছন্দ করে, একমাত্র তারাই যেতে পারে সেখানে। ওইখানে ভাঙা ইট সাজিয়ে সাজিয়ে আমি আর রাজু আমাদের গোপন দুর্গ বানিয়ে রেখেছি। আমাদের অনেক অ্যাডভেঞ্চার হয় সেখানে। কখনও আমি হক আই, রাজু ম্যাগুয়া; কখনও আমি বীর হাম্বির মল্লদেব, রাজু হয় সুলতান দাউদ খান। আমরা ঠিক করে রেখেছি, শার্দুল সিং এলে, ওই দুর্গেই তাকে লুকিয়ে রাখব, কান্হাইয়ালালকে বলব ওর বহুরূপী ম্যাজিক দিয়ে আমাদের দুর্গটাকে জাদুর কুয়াশায় ঢেকে রাখবে। (Short Story)
গরমকালে তখন আমাদের মর্নিং স্কুল চলছে। একদিন আমি বাড়ি ফিরে এসে চান করে চিলেকোঠার ঘরে মেকানো নিয়ে খেলছি, হঠাৎ এক মেঠাইয়ালার ডাক শুনতে পেলাম –
“শোন পা আ আ আ আ –
প্ড়ি সন্দে এ এ এ এ –
শ্নারকেল নাড়ু উ উ উ –
উচ্চন্দ্রপুলি ই ই ই ই …” (Short Story)
“আমি বাবার বুকের ওপর বসে, কোনওদিন আমার ঘুড়ির নতুন মাঞ্জার ফর্মুলাটা বোঝাতাম, বা কোনওদিন বাপ্পাদিত্যর গল্প শোনাতাম।”
আগে কখনও খেয়াল করিনি। অবশ্য অন্য সময় তো দুপুরবেলা বাড়ি থাকি না। সেদিনই শুনলাম প্রথম। এবং তার পর থেকে প্রায় রোজই শুনি সে যায়। ওই ভর দুপ্পুর বেলা কেউ ওকে ডাকে না, কেউ মেঠাই কেনে না। আমার স্থির বিশ্বাস, বড়রা কেউ দেখতে পেত না লোকটাকে, কেউ শুনতেও পেত না তার ডাক। শুধু আমি শুনতে পেতাম, যদিও ঠিক করে দেখতে পাইনি কখনও। বাইরে তখন ভূতে ঢিল ছোঁড়া খটখটে রোদ্দুর। কে আর থাকবে বাইরে তার কাছ থেকে মেঠাই কেনার জন্য? সবাই জানালায় খসখস টাঙিয়ে তাতে জলের ছিটে দিয়ে দুয়ারে খিল এঁটে দিয়েছে। (Short Story)
বাবা সকালে কাছারির কাজ সেরে ফিরে এসে, একতলার অপিস ঘরে খানিকক্ষণ ইজি চেয়ারে বসে ডাবের জল খেতে খেতে রেডিওতে খবর শুনতেন। আমি বাবার বুকের ওপর বসে, কোনওদিন আমার ঘুড়ির নতুন মাঞ্জার ফর্মুলাটা বোঝাতাম, বা কোনওদিন বাপ্পাদিত্যর গল্প শোনাতাম। তারপর বাবা চান করতে গেলে, আমি সোজা চলে আসতাম চিলেকোঠার ঘরে। ওখানেই আমার যত খেলনা, গল্পের বই, ঘুড়ি, লাট্টু, অরন্যদেবের মুখোশ– সে আমার নিজস্ব অন্য এক জগৎ। (Short Story)
মা তখন রান্না ঘরে ব্যস্ত। রাজুর মা বাসন মাজা, ঘর মোছা শেষ করে চলে যায় ভাত চড়াতে। রাজুটারও কোনও দেখা নেই। নির্ঘাত বনে বাদাড়ে লিচু পেড়ে বেড়াচ্ছে! এক্ষুনি হয়তো রাজুর মা তাকেও ঠ্যাঙানি দিয়ে পাঠাবে পুকুরপাড়ে চান করতে। আমার আবার এই দুপুরবেলায় বাইরে বেরুনো মানা। ছোটনাগপুরের গরমে নাকি লু বয়, বেরোলে শরীর খারাপ হবে। শরীর খারাপ হবে না কচুপোড়া! বড়জোর আমার নাক দিয়ে একটু রক্ত পড়বে। সে আর এমন কী! ওসব বায়নাক্কা আসলে বড়দের কারসাজি। একটু সুযোগ পেয়েছো, কি ধরে পড়তে বসিয়ে দাও! (Short Story)
“আমার কেমন যেন মনে হয়েছিল, লোকটা নিশ্চই রাজা হরিশচন্দ্র। সেযুগের অনেকের মতো, এও চির অমর। এইরকম ভাল লোকেরা যুগ যুগ ধরে নিঃস্বার্থভাবে ঘুরে ঘুরে মানুষের উপকার করে বেড়ায়।”
খুব রাগ হত। ওই মেঠাইওয়ালা লোকটা এমন সময় আসে, কেউ কোত্থাও নেই যে ডেকে দেখাব। আর আমি মেকানোর টুকরো গুলো সরিয়ে রেখে, মেঝেতে চতুর্দিকে ছত্রাকার কমিকসগুলো ডিঙিয়ে, যতক্ষণে দৌড়ে ছাতে বা কোনও জানালার কাছে এসে পৌঁছোতাম, ততক্ষণে দেখতাম লোকটা যুগল ত্রিপাঠীদের বাড়ি ছড়িয়ে, তেমাথার মোড় ঘুরে মিলিয়ে গেল। (Short Story)
আমি বিকেলবেলা মায়ের কাছে বায়না করতাম। বলতুম, “মা, পাপড়ি সন্দেশ কেনো না কেন? আমি খাব একদিন।”
মা বলতেন, “পাপড়ি সন্দেশ আবার কি? অমন কোনও খাবার হয় না। আজ নাহয় বাবাকে বলব যোগেন ময়রার দোকান থেকে জলভরা কড়াপাক নিয়ে আসবে।”
আমি বলতাম, “না, আমি পাপড়ি সন্দেশ খাব। ওর কাছ থেকে কেউ কেনে না।”
মা বলতেন, “কার কাছ থেকে?”
কিন্তু সেই মেঠাইওয়ালা যে কে, তা তো জানি না; তাই একদিন ভেবে চিন্তে বললাম, “হরিশচন্দ্র।” (Short Story)
আরও পড়ুন: অর্থ কোনও খুঁজে নাহি পাই রে
আমার কেমন যেন মনে হয়েছিল, লোকটা নিশ্চই রাজা হরিশচন্দ্র। সেযুগের অনেকের মতো, এও চির অমর। এইরকম ভাল লোকেরা যুগ যুগ ধরে নিঃস্বার্থভাবে ঘুরে ঘুরে মানুষের উপকার করে বেড়ায়। তা না হলে এই রোদে গরমে কেউ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়? নিশ্চয় দীন দুঃখী মানুষের খোঁজ খবর নিতে থাকে, এই গরমেও মাঠে ঘাটে যারা কাজ করে তাদের গাছের ছায়ায় বসিয়ে দুদণ্ড গল্প করে। তবে এখন তো আর রাজত্ব টাজত্ব নেই, তাই গরীব হয়ে গিয়ে পাপড়ি সন্দেশ বিক্রি করেই রোজগার করতে হয়। হুঁ হুঁ বাবা, গরীব হয়েছে তো কী হয়েছে, রাজপ্রাসাদের আসল স্বাদ এই সব মিষ্টিতে। সে কি পাবে তুমি যোগেন ময়রার দোকানে? (Short Story)
কিন্তু সত্যযুগের এইসব লোকগুলো আবার ভীষণ লাজুক, বড়দের সামনে একদম আসতে চায় না। তাই শুধু আমি দেখতে পাই। রাজু হতভাগাটা যদি একটু আগে চানটা সেরে আসে, তো ওকেও একদিন দেখিয়ে দিই। তাকে তো কোনওদিনই দরকারের সময় পাওয়া যায় না। এই যেমন সেদিন, ঠিক মনে হল দেখলাম ট্রেনের দুটো বগীর মাঝে ঝুলতে ঝুলতে কে যেন যাচ্ছে। মনে হল মাথায় পাগড়ি। ওই কি শার্দুল সিং? সেদিনই হতচ্ছাড়া রাজুর দেখা নেই – কী, না, সে নাকি তখন লাট্টুর লেত্তি পাকাচ্ছিল। (Short Story)

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু পাল্টে যায়। এক সময়ে চাইবাসা ছেড়ে চলে এলাম আমরা। তারপর অনেকদিন কেটে গেছে– বহু বছর। বাবার চাকরি সূত্রে এদিক ওদিক বদলি হন। বছরে, দু’বছরে, কখনও সখনও চাইবাসা আসার সুযোগ হয় ছুটিতে। বিত্তহারা বিধবার মতন ধীরে ধীরে ম্লান হতে থাকে টুংরির বাড়ির সৌষ্ঠব। তবু যখনই আসি, তখনই মনে হয়, টুংরির বাড়ি যেন সাদা থান পরে ঠাকুমার মতন আদর করে বসিয়ে আমড়ার টক আর পোস্ত ভাত খাওয়াতে খাওয়াতে রূপকথার গল্প বলে। (Short Story)
সেইরকমই একবার, আমি তখন কলেজে, সবাই মিলে গরমের ছুটিতে চাইবাসা এলাম। আমরা, বড় পিসি, খোকন দাদা, আরও অনেকে একসঙ্গে এসে উঠলাম। সকাল বিকেল পাড়ার অসিতদা, রাঠোরজী, মানটুকাকা, ইত্যাদি নানান লোকের সঙ্গে দেখা করে আর গল্প করে কেটে যায়। কিন্তু দুপুর হলেই পাড়ার লোকেরা যে যার ঘরে ঢুকে খিল এঁটে দেয়। এমনই একদিন দুপুরে আমরা সবাই বাবার একতলার অপিস ঘরে বসে গজল্লা করছি। এমন সময়, বাইরে শুনতে পেলাম, “শোন পা আ আ আ আ, প্ড়ি সন্দে এ এ এ এ…” (Short Story)
আমি কোনওরকমে তার বার্ণিশের বুরুশ, টারপেন্টাইন তেলের শিশি, ইত্যাদি টপকে টপকে পেরোতে পেরোতে বললাম, “আরে, হরিশচন্দ্র কো।”
শুনেই বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। এই তো সুযোগ। এতদিন পর! খানিকক্ষণ প্রায় দিশেহারা হয়ে বসে রইলাম। তারপর একটু সম্বিত ফিরে পেতেই, দুদ্দাড় করে ছুটে পশ্চিমের ঢাকা বারান্দায় এলাম তাকে ডাকব বলে। কিন্তু বারান্দায় তখন বৈঠকখানা ঘরের দেওয়ালে টাঙানো হরিণের শিংটা মেঝেতে নামিয়ে, রাজু তাতে বার্ণিশ করছে। সেই সমস্ত সরঞ্জাম টপকে দৌড়ে বেরোবার উপায় নেই। উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে রাজুকে বললাম, “আরে, বুলাও বুলাও।” (Short Story)
রাজু মুখের বিড়িটা বাগানে ছুঁড়ে ফেলে অবাক হয়ে বলল, “কিসকো?”
আমি কোনওরকমে তার বার্ণিশের বুরুশ, টারপেন্টাইন তেলের শিশি, ইত্যাদি টপকে টপকে পেরোতে পেরোতে বললাম, “আরে, হরিশচন্দ্র কো।” (Short Story)
রাজু তেমনি হাঁ করে তাকিয়ে রইল। আমি বাগানে নেমে দৌড়ে রাস্তায় এসে দেখলাম, ঝোলা পিঠে লোকটা ত্রিপাঠীদের তেমাথার কাছে। আজ আবার লক্ষ্য করলাম, সঙ্গে একটা ছোকরা মতন সাগরেদও রয়েছে। আমি যতক্ষণে পৌঁছলাম, ততক্ষণে দুজনেই তেমাথার বাঁক ঘুরে হারিয়ে গেল। (Short Story)
“লোকটা একমনে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে, কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থেমে গেল। এবাড়ি থেকে তো কেউ ডাকেনি কখনও! তাই বোধহয় প্রথমে বুঝতে পারেনি কে ডাকছে।”
পরদিন আমি সকাল থেকে তক্কে তক্কে রইলাম। রাজুটার ভরসায় কিস্যু হবে না। আজ ক্যাঁক করে ধরব হরিশচন্দ্রকে। বাবার পুরোনো অপিস ঘরের জানালাগুলোয় খসখস টাঙিয়ে তাতে পিচকিরি দিয়ে জলের ছিটে দিয়ে রাজু চান করতে চলে গেছে। আমি, খোকনদাদা ও আরও অনেকে বসে আড্ডা হচ্ছে। বাবা ইজি চেয়ারে, ভালপিসি তক্তপোষে, চন্দনদাদা আরাম কেদারাটাতে… এমন সময়ে বাইরে শুনি, “শোন পা আ আ আ আ…”, আর তক্ষুনি আমি দৌড় লাগাই বাইরে। ছুটে পশ্চিমের ঢাকা বারান্দা পেরিয়ে, এক লাফে নিচে নেমে আতা গাছটার পাশ দিয়ে দৌড়ে এসে ডাকলাম, “এই শোন, এদিকে এসো।” (Short Story)
লোকটা একমনে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে, কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থেমে গেল। এবাড়ি থেকে তো কেউ ডাকেনি কখনও! তাই বোধহয় প্রথমে বুঝতে পারেনি কে ডাকছে। একবার আমাদের উল্টোদিকে কেশুভাইদের বাড়ির দিকে তাকাচ্ছে, একবার আমাদের দিকে। সঙ্গের ছোকরা সাগরেদও হতভম্ভ মুখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আমি তখনও ডেকে চলেছি, “ও হরিশচন্দ্র, এই যে এইখানে, এদিকে তাকাও।” (Short Story)
তারপর লোকটা আমাকে দেখতে পেয়ে, একটু হেসে, ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। দেখলাম বেশ তাগড়া মতন একটা লোক, পরনে লম্বা পাঞ্জাবীর মতন একটা জামা, আর খাটো ধুতি। গাল ভরতি দাড়ি, আর ডান হাতে একটা লোহার বালা। আমি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে মাকে ডেকে বললাম, “এসো দেখবে এসো, এই সেই হরিশচন্দ্র, আর তার পাপড়ি সন্দেশ।” (Short Story)
তার সঙ্গে বাবা মায়ের কথা বার্তা হল কিছুক্ষণ। লোকটা ঢাকা বারান্দার ওপর নিজের পোঁটলা নামিয়ে, হাতের লোহার বালাটা খুলে রেখে, সাগরেদকে সঙ্গে নিয়ে গেল কুয়োতলায়। সেখানে গিয়ে আগে হাত পা ধুয়ে, মুখে চোখে জল দিয়ে এল দু’জনে। তারপর এসে শালপাতার ঠোঙায় এক এক করে বের করে দিল, সন্দেশ, চন্দ্রপুলি, শোনপাপড়ি। কয়েকটা আপাতত টেস্ট করা হল, আর বেশ কিছু কেনা হল। কিন্তু সব এখনই খেয়ে ফেললে তো চলবে না! ওদিকে এখন রাজুর মা পাঁঠার মাংস বানাচ্ছে, দুপুরের খাবার। পরে বিকেলে চায়ের সঙ্গে আবার খাওয়া হবে মেঠাই। (Short Story)
আমি বোকার মতন হাঁ করে চেয়ে থেকে বললাম, “পার্বতীচরণ?”
লোকটা বলল, “এজ্ঞে।”
মা হাসেন, বলেন, “যাক, অন্তত পাপড়ি সন্দেশের রহস্যটা আজ পরিষ্কার হল।”
কিন্তু এখন দুটি টেস্ট করেই বোঝা গেলো কী সুন্দর খেতে! সকলে বলাবলি করতে লাগল, বাংলার বাইরের বাঙালি মিষ্টি একটু অন্যরকম স্বাদ হয়, সে বরং ভালই লাগে, যেন ছানার ভাগ একটু বেশি, মনে হয় খুব টাটকা – বড়দের যত রাজ্যের পাকা পাকা কথা আরকি! কিন্তু যে যাই বলুক, আমি তো জানি, এ হল খোদ রাজপ্রাসাদের মিষ্টি! ভাল তো হতেই হবে। (Short Story)
এমন সময়ে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “তুই জানলি কি করে, ওর নাম হরিশচন্দ্র?”
আমি কী বলব ভেবে পাই না, এমন সময় লোকটাই কেমন যেন একটু থতমত খেয়ে, পান খাওয়া দাঁতে একগাল হেসে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “না গো ছোড়দাবাবু, আমি হরিশচন্দ্র হব কেনে, আমি পার্বতীচরণ।” (Short Story)

আমি বোকার মতন হাঁ করে চেয়ে থেকে বললাম, “পার্বতীচরণ?”
লোকটা বলল, “এজ্ঞে।”
মা হাসেন, বলেন, “যাক, অন্তত পাপড়ি সন্দেশের রহস্যটা আজ পরিষ্কার হল।”
নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা লাগছিল। তাই আমি আর কিছু বললাম না। খালি নিজের অপ্রস্তুত ভাবটা কাটাবার জন্য, লোকটার সঙ্গের ছোকরাটাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আর তোমার নাম?”
সে একগাল হেসে বলল, “বাঁকে বিহারী, দাদাবাবু।” (Short Story)
আমাদের কেনা কাটা চুকে গেছে, সবাই বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। লোকটা নিজের জিনিসপত্র সব গুটিয়ে পাটিয়ে চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হল। তারপর বাবাকে, মাকে, “আসি তাহলে?” বলে, আমার দিকে তাকিয়ে মাথাটা টুক করে একটু নেড়ে উঠে পড়ল। ওঠার সময়ে তার বোতাম ছেঁড়া জামার কলারের কাছটা একটু ফাঁক হয়ে সরে যাওয়াতে আমি দেখলাম, লোকটার গলায় একটা বাঘ নখের তাবিজ আর কাঁধের কাছে একটা বহু পুরনো কিন্তু গভীর এক ক্ষতচিহ্ন। (Short Story)
মিষ্টি খেয়ে তেষ্টা পেয়েছিল। রাজু কখন জানি কুয়োতলা থেকে কুঁজো ভরে জল নিয়ে এসেছে। সকলকে গ্লাসে ভরে ভরে দিচ্ছে। আমিও জল নিয়ে খাচ্ছি। হঠাৎ মাথাটা বাঁই করে ঘুরে গেলো। বাঘ নখ! তাহলে কি? আবার এক লাফে বারান্দা থেকে নেমে আমি দৌড়ে বাগান পেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। মাথার মধ্যে তখন ঘূর্ণিঝড়ের মতন হাজার চিন্তা ঘুরছে। পার্বতীচরণ– মা দুর্গার পায়ের কাছে কে থাকে? তাহলে কি, এতদিন ধরে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে… আর বাঁকে বিহারী? সে তো… (Short Story)
আমি ভাবলাম চিৎকার করে ডাকি, “শার্দুল সিং! কান্হাইয়ালাল!” কিন্তু ডাকা আর হল না। ততক্ষণে ওরা দু’জনে যুগল ত্রিপাঠীদের বাড়ি ছাড়িয়ে তেমাথার মোড়ের কাছে। অত দূর থেকেও স্পষ্ট দেখলাম, দুজনে বাঁক নিতে নিতে ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে একটু হেসে, হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। (Short Story)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাকোত্তর করার পর শিবু এখন ডালাসে এক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। জীবনের নানান উপাখ্যানের ওপর কল্পনার জাল বুনে বন্ধুদের শোনাতে ভালোবাসে। লেখা দেখে মনে হয়, বয়েস কয়েকবার ওঠানামা করে এখন হয়েছে তেরো!