“নমস্কার। আমি সরমা। লক্ষ্য করছি বিগত কয়েকমাস ধরে আপনি মহাকাব্যের অবহেলিত নারী চরিত্র নিয়ে পড়াশোনা করছেন। মনে হল আপনাকে এ বিষয়ে কিছু সাহায্য করতে পারি। অনুমতি দিলে বিষদে কথা বলব আপনার সঙ্গে।” হোয়াটসআপ ভয়েস মেসেজে এই বার্তা পেয়ে অবাক হল তিথি। সে আবার শুনল রেকর্ডটা। অবাঙালি কোনও এক নারীর কণ্ঠস্বর। কথাগুলো বাঙলায় বললেও বোঝা যাচ্ছে তা সংস্কৃত ধাঁচের। অনেকটা গুগল ট্রান্সলেশনে যেমন হয় তেমন উচ্চারণ। যে নাম্বার থেকে এই মেসেজ এসেছে তার দিকে তাকাল সে। উহুঁ। কোনও নাম্বার দেখাচ্ছে না। তিথি আবারও শুনতে গিয়ে দেখল তা আর শোনা যাচ্ছে না। ফাইল কোরাপ্টেড। অদ্ভুত তো! নিজের মনেই বলে তিথি ফিরে গেল নিজের কাজে। (Short story)
বিভীষণের স্ত্রী। সরমা। খুবই কম উল্লেখ করা হয়েছে এই নারীর। তাই দেখে তিথির জেদ চেপেছে। তাকে জানতেই হবে এই নারীকে নিয়ে।
ক-দিন ধরেই সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটে অবধি সে একটি বিশেষ লাইব্রেরিতে বসে আদি মহাকাব্যর নায়িকাদের পাশাপাশি যে চরিত্রগুলোতে সেভাবে আলোকপাত হয়নি, অথচ গুরুত্বপূর্ণ, এমন নারীদের নিয়ে কাজে মগ্ন। এর আগে অন্যান্য জায়গা থেকে এ বিষয়ে নানা তথ্য সংগ্রহ করে লিখলেও একটি চরিত্র নিয়ে বেশ বিভ্রান্ত। বিভীষণের স্ত্রী। সরমা। খুবই কম উল্লেখ করা হয়েছে এই নারীর। তাই দেখে তিথির জেদ চেপেছে। তাকে জানতেই হবে এই নারীকে নিয়ে।
-ম্যাডাম আপনি সরমা-কে নিয়ে কোনও বই বা লেখা পাওয়া যাবে কী না খোঁজ নিতে বলেছিলেন। আমাদের লাইব্রেরিতে বিভিন্ন মানুষের লেখা রামায়ণ ও তার আলোচনা নিয়ে গ্রন্থ রয়েছে। বাঙলা ছাড়াও তেলেগু, তামিল, সংস্কৃততে লেখা। কিন্তু শুধুমাত্র সরমাকে নিয়ে তেমন কোনও গ্রন্থ নেই। লাইব্রেরিয়ান ছেলেটি বলে চলে গেল।
তিথি ছেলেটির চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে নিজের মোবাইলটা হাতে নিল। তখনই আবার একটা ভয়েস মেসেজ এল।

“রামায়ণে সেভাবে আমার উল্লেখ নেই। বাল্মিকী বা বাঙালির আইকন যিনি ঘরে ঘরে রাম গাঁথা ঢুকিয়ে দিলেন, সেখানেও আমি অল্প কিছুক্ষণের জন্য উপস্থিত।”
-হ্যাঁ ওই যখন আপনি সীতাকে জানালেন রাম মারা যাননি। ওটা যাদু বলে রাবণ দেখিয়েছেন। তিথি যেন একটা ঘোরের মধ্যে থেকে বলে উঠল।
-ঠিক। তবে বিষয়টা কিন্তু এমন ছিল না। মানে আমি শুধু এই একটি কাজের জন্য মহাকাব্যে থাকলেও আসলে সীতা লঙ্কায় আসার পর থেকে ফিরে যাওয়া পর্যন্তই আমি ভীষণভাবে ছিলাম। কিন্তু সে কথা কেউ একবারও জানতে চাইলেন না।
-আমি জানতে চাই। আপনি বলুন।
-বেশ তবে আমি অশোকবন থেকেই শুরু করছি। যেখানে সীতা ছিলেন। এখান থেকেই তো আমার পরিচয় পৃথিবীর লোক জেনেছেন।
-আচ্ছা। তাই হোক। কিন্তু আমি আপনার বক্তব্য নথিভূক্ত করব কী ভাবে?
মুহূর্তের মধ্যেই তিথি তার সামনে এক নারী অবয়ব অনুভব করল। সে চারদিক তাকিয়ে মোবাইলের রেকর্ডার অন করল।
সেই মূর্তি বলতে শুরু করল – লঙ্কেশ্বর রাবণের ছোট ভাই বিভীষণের স্ত্রী আমি। আমার জন্ম বা বড় হওয়া নিয়ে বেশি কথা খরচ করেননি বাল্মিকী বা কৃত্তিবাস। কিন্তু আপনার জ্ঞাতার্থে জানাই আমি গন্ধর্বকন্যা। বাবা শৈলূষ, জাতে ব্রাহ্মণ, মা আদিবাসী কন্যা।
-মায়ের নাম?
লঙ্কেশ্বর রাবণের ছোট ভাই বিভীষণের স্ত্রী আমি। আমার জন্ম বা বড় হওয়া নিয়ে বেশি কথা খরচ করেননি বাল্মিকী বা কৃত্তিবাস। কিন্তু আপনার জ্ঞাতার্থে জানাই আমি গন্ধর্বকন্যা।
একটু যেন থমকে গেল সরমা। কী যেন একটা ভেবে উত্তর দিলেন- একে নারী, তার উপর আদিবাসী। তার নামে কী-ই বা আসে যায়! হয়তো একটা নাম ছিল, কিন্তু গান্ধার রাজ তাঁকে বিয়ে করার পর সে নাম মুছে গেল চিরতরে। কেউ আর কষ্ট করে তাঁকে নাম দিয়ে সম্বোধন করলেন না। রাণি, মা হয়েই থেকে গেলেন। তাছাড়া তাঁকে কেন্দ্র করে তো মহাকাব্য লেখা হয়নি, তাই তিনি উপেক্ষিতাই রইলেন। পৃথিবীর অগণিত নামহীন মায়েদের মতোই আমার মা-ও আমার জন্য আদর্শ মা ছিলেন। স্ত্রী হিসাবেও স্বামীর প্রতি কর্তব্যে অবিচল তিনি। তবে গন্ধর্ব রাজাদের অনেক স্ত্রী থাকেন। কাজেই বুঝতেই পারছেন আমার সঙ্গে তাঁর ভাগ্যের খুব একটা পার্থক্য ছিল না।
-আগেকার দিনে রাজারা এত বিয়ে করতেন কেন বলুন তো?
-শুধু কি রাজা? মুনি ঋষিরাও তাই করতেন। সোজা উপায়ে না হলে ছল করে নারীর সম্মান লুঠ করতে তাঁরা দ্বিধা করতেন না। কিন্তু আমি এখন এসব কেচ্ছা-কাহিনি নিয়ে আলোচনা করতে এতদূর আসিনি। আপনার যদি আমাকে নিয়ে সত্যি উৎসাহ থেকে থাকে তবেই আমি বসছি। নইলে…
-না, না। আপনি বসুন। আমি শুনছি। তিথি তাড়াতাড়ি বলে উঠল।
-আমার জন্ম মানস সরোবরের ধারে। আমি যখন একেবারে ছোটো, একবার হ্রদের ধারে খেলায় মগ্ন ছিলাম, তখন বর্ষা কাল, ক-দিন ধরে টানা বৃষ্টিতে সরোবরের জল ফুলে ফেঁপে ডাঙায় উঠে আসছিল। সেই দেখে আমি ভয়ে কাঁদতে লাগলে মা আমাকে সেখান থেকে সরিয়ে ঘরে নিয়ে গিয়ে হ্রদকে অনুরোধ করল- “সরঃ মা বদ্ধতঃ” অর্থাৎ “হে জল মাতা আপনি আর ডাঙায় আসবেন না। আমার মেয়ে ভয় পাচ্ছে আপনাকে দেখে।” মায়ের অনুরোধে জল ডাঙা থেকে সরে গেল। আর তাই দেখে মা আমার নাম রাখলেন সরমা।
আরও পড়ুন: কালিদাসের মেঘপিওন থেকে আজকের ডাকপিওন
-তার মানে সরমার অর্থ হল হ্রদ। তিথি বলল। তবে যে অভিধানে সরমা মানে ইন্দ্রের মেয়ে কুকুরকে বলা হয়েছে।
-না, সরমার অর্থ হ্রদ হলেও এর প্রকৃত মানে আলোর শক্তি। সম্ভবত ভোরবেলায় আমার জন্ম। ভোরের আলোয় যে শক্তি উৎপন্ন হয় সেই সময় আমি জন্মেছিলাম। তাই বাবাও আমার এই নাম মেনে নিয়েছিলেন।
তারপর যা বলছিলাম, গান্ধার দেশের রাজা শৈলূষের প্রাসাদে আমার কৈশোর কাটে। সকলে বলতেন, আমার মায়াময় চোখ, লাবণ্যেভরা দেহ যেন ফুলের মতো। কারোর দুঃখ কষ্ট দেখলে আমার মন খারাপ হয়ে যেত। ভাবতাম কীভাবে তাদের দুঃখ দূর করব। আমার গুরুদেব বলতেন, সত্য নিজেকেই খুঁজে বের করতে হয়, তাই তার খোঁজ করতে গেলে ক্রমশ একা হয়ে যেতে হবে। আমার খুব ভালো লাগত এই অন্বেষণ। শাস্ত্র পুঁথি পাঠ এসবেই মগ্ন থাকতাম। ভাবতাম, একদিন এমন কিছু করব যা মানুষের দুঃখ দূর করবে। কিন্তু আমি ভাবলেই যে তা হবে সেটা হয় না।
একদিন জানা গেল মায়ের আদেশে লঙ্কেশ্বর রাবণ তাঁর ভাই বিভীষণের জন্য পাত্রীর সন্ধানে বেরিয়েছেন। তাঁর ও কুম্ভকর্ণের বিয়ে হয়ে গেলেও বিভীষণ তখনও অবিবাহিত।
একদিন জানা গেল মায়ের আদেশে লঙ্কেশ্বর রাবণ তাঁর ভাই বিভীষণের জন্য পাত্রীর সন্ধানে বেরিয়েছেন। তাঁর ও কুম্ভকর্ণের বিয়ে হয়ে গেলেও বিভীষণ তখনও অবিবাহিত। তিনি গান্ধার দেশে উপস্থিত হলেন। রাজা শৈলূষের সঙ্গে তাঁর ভাল সম্পর্ক। আমাকে দেখেই তাঁর পছন্দ হয়ে গেল।
তিনি বাবাকে বললেন- এরকম শাস্ত্রজ্ঞ, ধর্মমনস্ক, দয়ালু কন্যাই তো দরকার বিভীষণের জন্য।
লঙ্কার অধিপতি বিশ্রবা মুনির পুত্র বিশ্ব খ্যাত রাবণ স্বয়ং তাঁর ভাইয়ের জন্য আমাকে পছন্দ করছেন, বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন গান্ধাররাজ। মহাসমারোহে বিভীষণ আর আমার বিয়ে হয়ে গেল। আমি চলে এলাম লঙ্কায়। আমার স্বামী সত্যিই খুব সৎ। ভাল মনের মানুষ। আমাকে কখনও অযত্ন করা তো দূরের কথা, শাস্ত্র নিয়েও আমার সঙ্গে নিবিড় আলোচনা করতেন। নারীসঙ্গ লাভের থেকে ধর্ম বিষয়ক বিষয়েই তাঁর অধিক আগ্রহ ছিল। তাই আমিও নিশ্চিন্ত ছিলাম তাঁকে নিয়ে। যথাসময়ে আমাদের সন্তান জন্মাল। তিন কন্যা- ত্রিজাতা, অনলতে আর সানন্দা, দুই পুত্র- তরণী আর নীল। আমরা তাদের নিয়ে সুখেই ছিলাম। মন্দোদরী, করকোটি, বজ্রজ্বালার সঙ্গেও আমার সম্পর্ক খুবই মধুর ছিল।
লঙ্কার অধিপতি বিশ্রবা মুনির পুত্র বিশ্ব খ্যাত রাবণ স্বয়ং তাঁর ভাইয়ের জন্য আমাকে পছন্দ করছেন, বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন গান্ধাররাজ।
তাছাড়া আমাদের নিজস্ব গ্রন্থাগার ছিল। এই পরিবারের সকলেই জ্ঞানী পুরুষ ছিলেন। সেখানে নানা ধরণের পুঁথি থাকায় আমিও কাজের ফাঁকে সেখানে গিয়ে অধ্যায়ণ করতে পারতাম। যেটা বুঝতে পারতাম না বিভীষণ রাতে আমাকে বুঝিয়ে দিতেন।
-তাহলে এক অর্থে ধরা যায়, আপনাদের বেশ সুখী পরিবার ছিল।
-ছিল। যতক্ষণ না লঙ্কেশ্বর বোনের উপর অত্যাচারের বদলা নেওয়ার জন্য সীতাকে তুলে নিয়ে এলেন। তখন থেকেই সব বদলে যেতে লাগল। আমরা প্রত্যেকেই তাঁর এই কাজ মেনে নিতে পারিনি। কিন্তু এটাও ঠিক নিজের বোনের এই অবস্থা দেখে কে আর শান্ত থাকতে পারে!
-ঠিকই। সূর্পনখার উপর যা হয়েছিল…
-হ্যাঁ। এই ঘটনার পর থেকেই রাবণের সঙ্গে বিভীষণের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছিল। এই সময় বোন ও দাদার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের সমর্থন করাই বীর পুরুষের ধর্ম হলেও, আমি বুঝতে পারছিলাম তিনি রাবণের এই কাজকে সমর্থন করছেন না, আবার এটাও ঠিক তিনি এই সুযোগে রামকে সঙ্গী করে রাবণকে সিংহাসনচ্যূত করতে চাইছেন।
-কী করে বুঝলেন?
-তিনি আমার স্বামী। এতদিন তাঁর সঙ্গে কাটিয়েছি। আমি জানতাম তিনি সিংহাসনে বসতে চান, কিন্তু শৌর্য, বীর্য, বীরত্ব, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বা বুদ্ধি কোনওটাতেই তিনি রাবণকে পরাজিত করতে পারবেন না। তার উপর ভীতু। ফলে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় ছিল না তাঁর।
-তার পর?
-তারপর সীতার স্থান হল অশোক বনে। আমাদের সেনানীরা তাকে পাহারায় রাখত। কিন্তু মন্দোদরী তাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। অন্য দিকে মহারাজ আমাকে খুব বিশ্বাস ও ভরসা করতেন। ভাবতেন সীতার মন আমিই ভাল রাখতে পারব। মন্দোদরীও চাইতেন আমি সীতাকে চোখে চোখে রাখি, যাতে রাবণ কোনওভাবে তার অনিষ্ট করতে না পারেন। সীতাও তখন এমন একজনকে চাইছিল, যে তাকে ওই অপরিচিত পরিবেশে ভাল রাখবে। ফলে সবমিলিয়ে আমার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।

-হ্যাঁ, কৃত্তিবাস এই নিয়ে একটা অধ্যায় লিখেছেন। যেখানে সীতা আপনাকে বোন, বন্ধু বলে অভিহিত করে বলছেন, ‘আমি যদি রমা হই, তুমি হে সরমা। সার্থক তোমার নামে যে দেখি সুষমা। ধন্য তব পিতা মাতা, বুঝিনু এখন। রাখিলা সরমা নাম আমারি কারণ।”
-হ্যাঁ, ওই যখন রামকে না পেয়ে রাবণ ক্রুদ্ধ হয়ে সীতাকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন, তখন মন্দোদরী তাঁকে নারী হত্যা পাপ বলে আটকালেন, আর আমাকে সীতার সঙ্গে সর্বক্ষণ থাকতে আদেশ দিলেন।
-কিন্তু সত্যি কি রাবণ তাঁকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন?
-না। তাঁকে হত্যা করার বা বলপূর্বক নিজের অঙ্কশায়িনী করার ইচ্ছে থাকলে মহারাজ তা অনেক আগেই করতে পারতেন। বরং এক্ষেত্রে কোথায় যেন তাঁর চোখে স্নেহই দেখেছিলাম।
-কিন্তু কৃত্তিবাস লিখছেন রাবণ শুধু তাঁকে হত্যা করতেই উদ্যত হননি, রামের কাটা মুণ্ডও তাকে দেখিয়ে রাম মৃত প্রতিপন্ন করে সীতাকে বিয়ে করার জন্য জোর করেছিলেন। এবং আপনিই তাঁকে জানিয়েছিলেন এ রাবণের যাদু।
-ঠিক। তবে বিয়ে করবেন এই ভাবনা থেকে নয়। সীতা দিন-রাত রাম রাম করে কাঁদতেন, আমরা যে এতগুলো মানুষ তাঁকে যত্ন আত্তি করছি, সুবিধা-অসুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখছি, সারাক্ষণ তাঁর সব আবদার মেনে নিচ্ছি, সেদিকে তাঁর এতটুকুও মন ছিল না। পরাক্রমশালী রাবণ, তিনি শাস্ত্র ও সংগীতবিশারদ, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় বুৎপত্তি সম্পন্ন, সারা বিশ্ব তাঁকে সম্মান করেন, আর তাঁকেই যদি কেউ ক্রমাগত শাপ দেন, রামের গুণ গেয়ে তাঁকে অপমান করেন, তবে কতদিন আর তা সহ্য করা যায়! আপনাদের বাল্মিকী বা কৃত্তিবাসও কিন্তু এত বড় মিথ্যা লিখতে পারেননি যে রাবণ সীতার চরিত্র হরণ করেছিলেন, বা চেষ্টা করেছিলেন। তবে এটা ঠিক তিনি বিদ্যুৎজিহ্বাকে বলেছিলেন কিছু একটা দেখিয়ে সীতাকে শান্ত রাখতে, একই সঙ্গে ভয়ও দেখাতে। সীতা তাই দেখে কাঁদতে শুরু করলে আমি তখন তাকে সত্যিটা জানিয়ে দিই।
তিথি বলল- “রাবণ কহিল মিথ্যা, না করে সংগ্রাম। সর্বদা কুশলে তব আছেন শ্রীরাম।” এমনই কথা পড়লাম আমরা, তাই তো সরমা।
আরও পড়ুন: মন্থরা ও সীতা–এক কাল্পনিক সংলাপ
-হ্যাঁ। ভয়াবহ যুদ্ধ শেষ হলে লঙ্কাকে প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে সীতা ফিরে গেল স্বামীর কাছে। পুষ্পক রথে করে তাঁকে নিজ হাতে সাজিয়ে আমি পৌঁছে দিলাম অযোধ্যায়। ফিরে এসে আমি কী পেলাম?
-আপনি মন্দোদরীর সঙ্গে বিভীষণের বিয়ের জন্য আক্ষেপ করছেন?
-না। অভিযোগ জানাচ্ছি। আমার স্বামী যেদিন নিজের দাদাকে ছেড়ে রামের কাছে ধর্মের নামে, সত্যের নামে আশ্রয় নিলেন, গোপনে রাজপুরীর সমস্ত খবর তাঁকে পাচার করলেন, সেদিনই তাঁর প্রতি আমার সম্মান ভালোবাসা শ্রদ্ধা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। জানেন যেদিন রাজদরবারে তিনি লঙ্কেশ্বরকে রামের সঙ্গে সন্ধি করে সীতাকে ফেরত দিতে বললেন, সেদিন আমরা কেউ যুদ্ধ চাইনি। আমি, মন্দোদরী, এমনকি মা কেকষীও চাননি সীতার কারণে একটা যুদ্ধ হোক। আমাদের বিশাল সাম্রাজ্য। প্রজারা অনুগত। রাষ্ট্রে সু-শাসন রয়েছে, কোনও কিছুর অভাব নেই। রাজার ব্যক্তিগতভাবে নারীদের প্রতি আকর্ষণ থাকলেও তা কখনও দরবারে বিবাদ তৈরি করেনি। কিন্তু বিভীষণ চাইছিলেন যেন-তেন প্রকারে সিংহাসন দখল করতে। রাবণকে সরাবার জন্য তিনি তাই কুবেরের সঙ্গেও মন্ত্রণা করেছিলেন। সেদিন হঠাৎ করেই লঙ্কেশ্বর উত্তেজিত হয়ে তাকে পদাঘাত করলে তিনি সেটাকেই অজুহাত হিসাবে নিয়ে নিলেন।
মন্দোদরীর প্রতি তাঁর মোহ, লোভ ছিল। এটাও জানতাম মন্দোদরী তাঁকে কখনোই স্বীকার করবেন না। রামের নির্দেশে বা আদেশে বিয়েটা হল ঠিকই, কিন্তু তিনি বিভীষণকে ঘৃণাই করতেন।
আমি যখন এই নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করলাম তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি। আমি অনেকবার তাঁকে বুঝিয়েছিলাম রাম আমাদের শত্রু। এই সময় তাঁর সঙ্গে হাত মেলানো মানে দেশের সঙ্গে অন্যায় করা। তিনি মানলেন না। তবু আমি ভেবেছিলাম যার যার ধর্ম নিজের কাছে। তিনি চলে গেলেন রামের শিবিরে। আমার খারাপ লেগেছিল। কিন্তু তিনি যে এভাবে পরিবারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে তা ভাবতেও পারিনি। মন্দিরে পুজোয় বসা মেঘনাথকে যেভাবে লক্ষ্মণ খুন করল তা তিনি না বলে দিলে হত না। আবার তরণী, আমার ছোটো পুত্র যাকে লঙ্কেশ্বর কিছুতেই যুদ্ধে যেতে দিচ্ছিল না, সে জোর করে নিজের মাতৃভূমির সম্মান রক্ষা করতে গেল, রাম তাকে হত্যা করল। সন্তানের পিতা হয়ে বিভীষণ সেখানে দাঁড়িয়ে তা দেখলেন কী করে! তখনও তার মনে একবারও নিজের পুত্রের জন্য মায়া হল না?
-তাহলে আপনি বলছেন, মন্দোদরীকে বিভীষণ বিয়ে করায় আপনার দুঃখ হয়নি? এগুলোতেই বেশি আঘাত পেয়েছিলেন?

-একেবারে হয়নি বললে মিথ্যে বলা হবে। মন্দোদরীর প্রতি তাঁর মোহ, লোভ ছিল। এটাও জানতাম মন্দোদরী তাঁকে কখনোই স্বীকার করবেন না। রামের নির্দেশে বা আদেশে বিয়েটা হল ঠিকই, কিন্তু তিনি বিভীষণকে ঘৃণাই করতেন। তাঁর সঙ্গে তিনি এক কক্ষে থাকতেনও না।
-কেন? তিনি যখন থাকলেন না বিভীষণের সঙ্গে আপনার থাকায় বাধা কি ছিল?
-না, সেভাবে বাধা ছিল না। আবার ছিলও। আমি তখন প্রধান রাণি নই, রাজার সঙ্গে থাকব কোন অধিকারে! তাছাড়া বিভীষণ তখন আমার কাছে একজন দেশদ্রোহী, নিজের সুখের জন্য দেশকে বেচে দিয়েছেন, অন্যের স্ত্রীকে জোর করে বিয়ে করেছেন। এমন পুরুষটির জন্য আমার ঘৃণার পাশাপাশি করুণাই হয়।
-করুণা কেন?
-এতগুলো প্রাণ যার কারণে গেল, যার তঞ্চকতায় পুরবাসী লজ্জায় মাথা নত করল, তাঁর স্ত্রী হিসাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরণ-ই ভাল ছিল।
-আপনি এখন কোথা থেকে আসছেন?
-আমি যুগ যুগ ধরে ঘুরে বেরাচ্ছি এক রূপ থেকে আরেক রূপ নিয়ে। ঘর শত্রু বিভীষণকে এখনও কেউ ভুলতে পারেনি দেখে আমার তাঁর প্রতি এখন কষ্ট হয়। আর অনুভব করি কেবল ক্রেতাকালেই নয়, বিভীষণের জন্ম এই কলিকালেও হয়েছে, হচ্ছে। এক বিভীষণ মরা মাত্র রক্ত বীজের মতো আরেকজন জন্মে যাচ্ছে। এদের থেকে মুক্তি নেই। আর এরা নিশ্চিহ্ন না হওয়া অব্দি আমারও মুক্তি নেই।
-তাহলে উপায়?
-আপনি আমাদের মতো নির্যাতিতা, উপেক্ষিতা নারীদের নিয়ে লিখছেন, আমি জানি কাজটা কঠিন। তবু একবার যদি কাব্যগুলোকে নতুন করে লেখা যায়, যেখানে যুদ্ধ নয়, কেবল ভালোবাসা শান্তির কথাই থাকবে, অবিশ্বাস, ধর্মের নামে এত হত্যা হবে না…
তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই এক পুরুষ কণ্ঠ বলে উঠল- ম্যাডাম লাইব্রেরি বন্ধ করতে হবে। আপনি বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আগেও একবার এসে দেখলাম, একই ভাবে বসে।
দিতি অবাক দৃষ্টিতে চারদিক তাকাল। কেউ কোত্থাও নেই। গল্পটা সম্পূর্ণ না করেই চলে গেল সে! সরমা, অন্বেষণকারী! কোন সত্য সে উদ্ঘাটন করতে চাইছে কালের গহ্বর খুঁড়ে, এর উত্তর কোথায় খুঁজবে সে!
অলংকরণ- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
বিতস্তা ঘোষাল গল্পকার, কবি,প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। আধুনিক ইতিহাসে এম এ, লাইব্রেরি সায়েন্সে বিলিস। কলেজে সাময়িক অধ্যাপনা। প্রকাশনা সংস্থা ভাষা সংসদের কর্ণধার। ও অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকা’-র সম্পাদক।
'বাংলা আকাডেমি' ,'সারস্বত সম্মান' 'বিবেকানন্দ যুব সম্মান', ‘একান্তর কথাসাহিত্যিক পুরস্কার,'কেতকী' কবি সম্মান, ‘চলন্তিকা’, দুই বাংলা সেরা কবি সম্মান, 'বিজয়া সর্বজয়া' 'মদন মোহন তর্কালঙ্কার সম্মান', 'বই বন্ধু সেরা লেখক ২০২৪ ' সহ একাধিক পুরস্কার ও সম্মান প্রাপ্ত।
বিতস্তার প্রকাশিত বই ৩৪টি। তাঁর কবিতা ও গল্প হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও ইংরেজি,ইতালি, গ্রীক ও স্প্যানিশে অনুবাদ হয়েছে। সম্প্রতি ওড়িয়া ভাষায় প্রকাশিত তার গল্প সংকলন রূপকথার রাজকন্যারা।
দেশ বিদেশে কবিতা ও গল্প পড়ার ডাক পেয়েছেন একাধিকবার।বাংলা সবকটি জনপ্রিয় পত্রিকা ও সংবাদপত্রে তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত।
নিজের কাজের গণ্ডীর বাইরে অফিস ও পরিবারেই স্বচ্ছন্দ বিতস্তা কাজের ফাঁকে অবসর সময় কাটান নানান সামাজিক কাজে।
ভালোবাসা ছাড়া বাকি সব কাজ গুরুত্বপূর্ণহীন। তার নিজের কথায় ভালোবাসা ছাড়া কেউ কী বাঁচে?