Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

উপন্যাস: আকাশপ্রদীপ: পর্ব ৯

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

অক্টোবর ১৯, ২০২২

Sikh Taxi Driver
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

প্রবাসের পটভূমিকায় লিখিত বলে উপন্যাসে ইংরিজি সংলাপ ও শব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে। 

আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] []

১৯

বেল বাজাবার পর বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল গুর্মুখকে৷ দ্বিতীয়বার বাজাবে কিনা যখন ভাবছে, তখন সেই মুহূর্তে দরজা খুলে দিল সীমন্তিনী৷ ‘প্রণাম ভাবিজি’ বলে সবিনয়ে অভিবাদন জানাল গুর্মুখ৷ তারপর ওর ঝোলা থেকে বের করল দুটো বোতল৷ এবার ওদের জন্য আমতেল, আর টকমিষ্টি তেঁতুলের আচার এনেছে সে৷ বেল বাজার পর সিসিটিভি-র মনিটরে দেখে ধীরেসুস্থে এসে দরজা খুলে দিয়েছিল সীমন্তিনী৷ ওর পরনে এখনও হাউসকোট৷ নাইটির উপর কোনওক্রমে হাউসকোটটা জড়িয়ে নিয়েছে৷ এই পোশাকে দরজা খোলা এখানে দস্তুর নয়৷ কিন্তু শনিবার সাত সকালে এসে বেল দেওয়াও তো দস্তুরের মধ্যে পড়ে না৷ সদ্য ঘুম থেকে ওঠা সীমন্তিনীকে দেখে একটু বোধহয় অপ্রস্তুত হল গুর্মুখ৷ একটু কিন্তু কিন্তু করে প্রচুর অ্যাপোলজাইস করল৷ সারাদিন ট্যাক্সি নিয়ে ঘুরবে, সময় হবে না, তাই একফাঁকে আচারগুলো দিতে এসেছে৷ 

সীমন্তিনী ভিতরে ভিতরে একটু বিরক্ত বোধ করে সকালের ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায়৷ রাতে ওর ওষুধ খেয়ে শুতে হয়, অনিদ্রার জন্য৷ সকালের দিকে আঠার মতো চোখটা লেগে আসে৷ আগে একটা সময় ছিল, যখন রণো ছোট ছিল, ইচ্ছে না করলেও সাতসকালে উঠে ওকে তৈরি করতে হত, লাঞ্চবক্সে খাবার গোছাতে হত, বাইরে বেরিয়ে একটু হেঁটে রণোকে স্কুলবাসে তুলে আবার ফিরে আসত সীমন্তিনী৷ এই একই রুটিন অরুণলেখারও ছিল, যখন তাঁর ছেলেমেয়ে ছোট ছিল৷ রণো বড় হয়ে কলেজ যাবার পর থেকে এক হিসেবে বেঁচেছে সীমন্তিনী৷ রণোর প্রিন্সটনে যাবার পর বছরখানেক খুব ফাঁকা লাগত, যেন কিছুই করার নেই৷ এখন এই দশবছর ধরে নতুন রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে৷ অরুণাভর জন্য কোনওদিনই কিছু করতে হয় না৷ সকালে উঠেই ফিটনেস ফ্যানাটিক অরুণাভ জিম আর যোগাসন করার পর ব্রেকফাস্ট সেরে সারাদিনের জন্য বেরিয়ে পড়ে হাসপাতালে৷ সোম থেকে শুক্র এটাই রুটিন৷ শনি-রবিবার অরুণাভও অবশ্য একটু বেলা করে ওঠে ইদানীং৷ 

আজ নটার সময় বেল বাজিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে গুর্মুখ৷ অরুণাভদের লিভিংরুমটা উপরতলার শোবার ঘরের ভিতরদিকে লাগোয়া প্যাসেজের রেলিং দিয়ে ঘেরা৷ ওরা বলে গ্যালারি৷ গ্যালারি থেকে যেমন ভিতরের স্টেডিয়ামে খেলোয়াড়দের দেখা যায়, তেমনই ওদের বাড়ির উপরের তলার অর্ধচন্দ্রাকার গ্যালারি, যার ওপাশ দিয়ে চারটে বেডরুম৷ আর তিনটে বাথরুম৷ গ্যালারি থেকে রেলিং ধরে ঝুঁকে অরুণাভ দেখল, গুর্মুখ এসে লিভিং রুমের বিশাল হলের একপাশের সোফায় সঙ্কুচিত হয়ে বসে রয়েছে এবং সীমন্তিনী চা করে আনছে৷ গুর্মুখ এ বাড়িতে অপরিচিত নয়৷ বরং হুটহাট করে অসময়ে চলে আসাটা ওর অভ্যাস৷ দু’একমাস অন্তর অন্তরই গুর্মুখ চলে আসে ওর অফুরন্ত আচার, পাঁপড়, পাপড়ি চাটের জোগান নিয়ে৷ এত আচার যে ওরা খেয়ে শেষ করতে পারে না৷ বলেও কোনও লাভ হয় না৷ এসব জিনিস ডাক্তারবাবুর পরিবারকে দেওয়া ওর কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ৷ গুর্মুখ আচারগুলো কিনে আনে, নাকি ওদের কোনও আত্মীয়ের গ্রসারি স্টোর থেকে পায়, অরুণাভ সঠিক জানে না৷ ঠিক যেমন সঠিক জানে না ও এইচআইভি পজিটিভ শুনলে সীমন্তিনীর কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে? সীমন্তিনী চিরকালই খুব আনপ্রেডিক্টেবল্‌৷ এখন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জিনিসটা আরও বাড়ছে৷ হুইমস্‌ ব্যাপারটা মাঝে মাঝে মারাত্মক আকার নেয়৷ এখন যেমন ও খুব ভদ্রতা করে গুর্মুখকে চা দিচ্ছে৷ কুকি সাজাচ্ছে প্লেটে৷ ওর রোগের বিষয় জানালে এরকম ব্যবহার করত কিনা অরুণাভ পুরোপুরি নিশ্চিত নয়৷

Jaliyanwalabagh
জালিয়ানওয়ালাবাগের ম্যাসাকারের তীব্র নিন্দা করে রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল ট্রিবিউনে।

গুর্মুখের খুব ভালো লাগে ভাবিকে৷ এত বড় ডাক্তারের বউ, আমেরিকায় এত বড় বাড়ি, তবু কোনও গুমোর নেই৷ ডাক্তার সাবও মাটির মানুষ৷ বড় দুঃখের সময় ডাক্তার সাবের সঙ্গে আলাপ গুর্মুখের৷ তখন সদ্য জানতে পেরেছে ও এইচআইভি পজিটিভ৷ কোত্থেকে এই রোগটা ধরল, জানত না গুর্মুখ৷ ম্যাস জেনারেল হাসপাতালের চত্বরে একটা কাঠের বেঞ্চে বসেছিল ও৷ চোখ দিয়ে জল পড়ছিল ঝরঝর করে৷ ডাক্তার সাব গাড়ি পার্ক করে নেমে ওখান দিয়ে যাচ্ছিলেন৷ ঠিক দেবদূতের মতো সামনে দাঁড়ালেন গুর্মুখের৷ খোঁজখবর নিলেন৷ পাঁচ মিনিটের কথায় বুঝে গেলেন ওর মনের ভিতরটা৷ ডাক্তারসাব খুব বড়ো মনের মানুষ৷ অন্য কেউ হলে কথাই বলত না হয়তো গুর্মুখের সঙ্গে৷ উনি ওঁর চেনা অন্য ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে সমস্ত জিনিসটা বুঝে গুর্মুখের কী করা উচিত, কেমন জীবন কাটানো উচিত, সবটা সহজ করে বুঝিয়ে দিলেন৷ গুর্মুখ খুব কৃতজ্ঞবোধ করে ডাক্তারবাবুর প্রতি৷ ডাক্তারবাবুর বাড়িতে অনেকবার এসেছে গুর্মুখ৷ ডাক্তারবাবুর মা-ও এখন এই বাড়িতে থাকেন৷ গুর্মুখ মাতাজি বলে প্রণাম করে আসে সুযোগ পেলেই৷ আর ভাবিজি যে কত কথা জিজ্ঞাসা করেন গুর্মুখকে৷ আজকেও চা খেতে খেতে কথা বলছেন ভাবিজি, অন্যান্যবারের মতোই৷ হিন্দিতেই হচ্ছে কথোপকথন৷ সীমন্তিনীর অবশ্য ইংরেজিতেই সুবিধা হয় বেশি৷ গুর্মুখ উত্তর দেয় হিন্দিতে৷ 
– আপনার বাড়ি তো লাহোরে ছিল তাই না?
– জি ভাবিজি৷ লাহোর থেকে আমার দাদাজি চলে এসেছিলেন ইন্ডিয়ায়৷ আপনি গেছেন লাহোরে? 
সীমন্তিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷
– নাঃ! লাহোর যাওয়া হয়নি কখনও৷ কিন্তু ওখানে আমার দাদুর এক ভাই সেটল্‌ করেছিলেন৷
– ওখানে কি করতেন আপনার দাদাজি?
সীমন্তিনী হাসে৷ বলে,
– আমার সেই দাদুকে কখনও দেখিনি আমি৷ উনি লাহোর ট্রিবিউনের এডিটর ছিলেন৷ কালীনাথ রায়৷
– বাপ-জ্যাঠার মুখে নাম শুনেছি পেপারটার৷ বহুৎ বড়িয়া পেপার৷ তবে ওটা যে আপনার দাদুর, তা জানতাম না৷
একটু ভেবে গুর্মুখ বলে৷ 
– না না! কালীনাথ ওটার মালিক ছিলেন না৷ উনি শুধু পত্রিকাটা চালাতেন৷ আর গান্ধীর সঙ্গে ঘুরতেন৷ খুব দেশপ্রেমিক ছিলেন শুনেছি৷
– আমার কেমন মনে হচ্ছে শুনেছি এই নামটা৷ জালিয়ানওয়ালাবাগের গাইড ছিল তো আমার বাবা৷ খবরের কাগজে অনেক বেরিয়েছিল তো ঘটনাটা৷ বাবাকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারব৷

গুর্মুখ এ বাড়িতে অপরিচিত নয়৷ বরং হুটহাট করে অসময়ে চলে আসাটা ওর অভ্যাস৷ দু’একমাস অন্তর অন্তরই গুর্মুখ চলে আসে ওর অফুরন্ত আচার, পাঁপড়, পাপড়ি চাটের জোগান নিয়ে৷ এত আচার যে ওরা খেয়ে শেষ করতে পারে না৷ বলেও কোনও লাভ হয় না৷ এসব জিনিস ডাক্তারবাবুর পরিবারকে দেওয়া ওর কৃতজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ৷ গুর্মুখ আচারগুলো কিনে আনে, নাকি ওদের কোনও আত্মীয়ের গ্রসারি স্টোর থেকে পায়, অরুণাভ সঠিক জানে না৷ 

সীমন্তিনী একটু হাসে৷ জালিয়ানওয়ালাবাগের ম্যাসাকারের তীব্র নিন্দা করে রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল ট্রিবিউনে৷ ‘প্রেয়ার অ্যাট দ্যা জামা মসজিদ’ নামে সেই রিপোর্টের জন্য দু’বছরের জন্য জেলে যেতে হয়েছিল কালীনাথকে৷ এক হাজার টাকা ফাইনও হয়েছিল৷ লাহোরে বাঙালি অ্যাডভোকেট সুধীর মুখার্জি লড়েছিলেন বিখ্যাত সেই কেস৷ লোকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে চাঁদা দিয়ে চালিয়েছিল মামলার খরচ৷ কালীনাথ রায়ের মুক্তির জন্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করেছিলেন।
– আপনার দাদু কি লাহোরেই থেকে গেছিলেন পার্টিশনের পরে?
গুর্মুখের কথায় চমক ভাঙে সীমন্তিনীর৷ না, ওঁকে পার্টিশন দেখতে হয়নি৷ ১৯৪৫-এর ডিসেম্বরে মৃত্যুপথযাত্রী কালীনাথ ফিরেছিলেন কলকাতায়, মাত্র কয়েকদিনের জন্য৷ যে কলকাতায় তাঁর যৌবন কেটেছে, যেখানে তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র ছিলেন, সেই শহরেই তাঁর জীবন শেষ হয় মাত্র সাতষট্টি বছর বয়সে৷ সীমন্তিনী এই গল্প শুনেছে ছোটবেলায়৷ পারিবারিক সূত্রে৷ কালীনাথ রায় এবং তাঁর স্বনামধন্য পুত্র সমরেন্দ্রনাথ রায়কে পরবর্তী প্রজন্মের বাঙালি আর মনে রাখেনি৷
– বহুৎ আফশোস কি বাত৷ দেশের স্বাধীনতার জন্য এত কিছু করলেন যাঁরা, তাঁদের তো সম্মান দেওয়া উচিত৷ দেখুন না, আমার দাদুও তো সেটল্‌ হলেন জালিয়ানওয়ালাবাগের পাশে।
বিশাল এক দাঙ্গায় ওর পরিবারের কয়েকজনের কচুকাটা লাশ এসে নেমেছিল ট্রেন থেকে৷ গুর্মুখের দাদাজির বড়ো দুই ছেলের দেহ শনাক্ত করা যায়নি মৃতদেহ ভর্তি ট্রেন থেকে৷ ওর বাপ-জ্যাঠারা দেশভাগের পরে শরণার্থী হিসেবে এসে পাশের গ্রামে যখন আসে, তখন তারা আট-দশ বছরের বালক৷
– তবু ভাবীজি, দেখুন সময় সব ভুলিয়ে দেয়৷ সন্তানশোক পেয়েও আমার দাদাজি তো পাথর হয়ে যাননি৷ মাঝবয়সে আবার নতুন করে শুরু করলেন৷ জমি-জিরেত কিনলেন একটু একটু করে৷ বাপ-জ্যাঠা জালিয়ানওয়ালাবাগের গাইডের কাজ পেল৷ আর আমাকে দেখুন৷ নিজের আত্মীয়রা মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে দিল আমাকে৷ পালাতে হল৷ ঘর ছাড়তে হল৷ এখন দশ বছর হল ঘরে ফিরতে পারি না৷ নসিব যে কাকে, কোথায় এনে ফেলে!
গুর্মুখ কপালে একটা হাত ঠেকিয়ে বলে৷ যেন কপালেই ওর ভাগ্য নির্দিষ্ট হয়ে গেছে৷
– কী করবেন গুর্মুখ! এখানেই থেকে যাবেন? বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না আপনার?
না জিজ্ঞেস করে পারে না সীমন্তিনী৷ 
– জানি না ভাবিজি! এখন আর ভাবি না৷ ভেবে কী হবে বলুন? আপনাদের মতো লোক ভাবার সময় পায়৷ আর আমি? নিজের অবস্থা দেখে নিজেরই হাসি পায় আমার৷ দেশভাগ না হলে তো লাহোরেই থাকতে পারতাম আমি৷ অন্য একটা ইন্ডিয়ায় জন্ম হত আমার৷ হিন্দুস্থান- পাকিস্তান হয়েই সব গন্ডগোল শুরু হল৷ জমি ভাগ হয়ে গেল, মহল্লা ভাগ হয়ে গেল৷ জালিয়ানওয়ালাবাগের গ্রামেও তো থাকতে পারতাম৷ আজ এখানে এদেশে একা দিন গুজরান করতে হত না৷ শরীরটাও খারাপ হয়ে যেত না৷ মাঝে মাঝে ভাবি এখানেই যদি মারা যাই, তবে দেশে কি ছেলেটা কাঁদবে আমার জন্য? ও তো সেভাবে চেনেই না আমাকে!

গুর্মুখ চলে যাবার পরও মনের মধ্যে ওর কথাগুলোই নাড়াচাড়া করছে সীমন্তিনীর৷ সত্যিই মানুষের জীবন বড় বিচিত্র৷ পরিযায়ী পাখিদের যেমন বাসা বদল হয় ঋতুচক্রের সঙ্গে সঙ্গে৷ শীতের সময় যেমন ওরা উড়ান দেয় একটু উষ্ণতার জন্য, মানুষও তো তেমনি৷ জীবনভোর এক অজানা উষ্ণতার সন্ধানে যাত্রা, যেখানে সে বাসা বাঁধবে৷ খেলাঘর গড়বে কোথাও অন্য কোনও ভৌগোলিক অবস্থানে, অচেনা কোনও সম্পর্কের অনুসন্ধান  করে বেড়াবে নরনারী৷ খুঁজে পাবেও৷ সেখানে তারা সবাই শরণার্থী৷

Taxi
নসিব যে কাকে, কোথায় এনে ফেলে!

২০

আলো এখন সম্পূর্ণ নিরামিষাশী৷ প্রথমে মাছ-মাংস ছেড়েছিলেন৷ কয়েক মাস হল ডিম, পেঁয়াজ, রসুনও তিনি বাদ দিয়ে দিয়েছেন৷ জীবনের আকাঙ্ক্ষাগুলো আস্তে আস্তে কমিয়ে আনাই ভালো৷ সাতাত্তর পেরিয়ে আটাত্তরে পড়বেন তিনি এই অগাস্টে৷ এই নতুন আবাসে আসার আগে পারমিতা বলে মেয়েটি ওঁর নাম, ব্লাড গ্রুপ, নিকট আত্মীয়ের নাম, ডেট অব বার্থ, পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস সব জেনে নিয়েছে৷ চমৎকার মেয়ে পারমিতা৷ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সব খুঁটিনাটির দিকে ওর নজর৷ এই শহরে যেসব বৃদ্ধাবাস আছে, এটা ঠিক সেরকম নয়৷ এখানে সত্যিই বাড়ি বাড়ি একটা ব্যাপার আছে৷ হিডকোর তৈরি করা এই বৃদ্ধাবাসটি একটি ছোটখাটো হাউসিং কমপ্লেক্স প্রায়৷ টেন্থ ফ্লোর অর্থাৎ এগারো তলায় আলোর অ্যাপার্টমেন্ট৷ উপরের দুটো ফ্লোরে প্রশস্ত লবি৷ সোফা, সেন্টার টেবিল, সুদৃশ্য স্ট্যান্ডল্যাম্প৷ লবি থেকে চারদিকে চারটে অ্যাপার্টমেন্ট৷ চারজনের জন্য৷ অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেই আয়তাকার লিভিং রুম৷ একদিকে দু’টি বেতের গদিওয়ালা বিশাল সিঙ্গল চেয়ার আর গোল কাচের টেবিল৷ অন্যদিকে আর একটু বড় গোল কাঠের টেবিল, যাকে পড়ার টেবিল হিসেবেও ব্যবহার করা যায়, আবার খাবার টেবিলও৷ টেবিলের দু’পাশে দুটি চেয়ার৷ এই ঘরটায় বসে আলো পড়েন, লেখেন, কম্পিউটারে টাইপ করেন৷ ৷ ভোরবেলা কাচের বড় জানলা দিয়ে পুবের রোদ এসে মুখে পড়ে৷ আলোর বেশ লাগে৷ ভিতরের ঘরটায় দুটো আলাদা আলাদা সিঙ্গল খাট৷ কেউ কেউ একটা খাটের ঘরও নেয়৷ আলো দুটো খাটই নিয়েছেন৷ তাঁর কাছে আসার মতো কেউই নেই৷ তবুও৷ 

এখানে আস্তে আস্তে তাঁর মন বসে গেছে৷ এখানে মর্নিং ওয়াকের জায়গা আছে৷ কিন্তু তাঁর আজকাল আর হাঁটতে ইচ্ছে করে না৷ সকালে ইন্টারকমে কিচেন থেকে ফ্লাস্কভর্তি চা আনিয়ে নেন আলো৷ আর দুটো বিস্কুট৷ একটা খবরের কাগজ দিয়ে যায় তাঁর দরজায়৷ আলো জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ৷ সারাদিন ধরেই তাঁর জীবনের হারিয়ে যাওয়া মৃত মানুষদের কথা মনে পড়ে তাঁর৷ গত সপ্তাহে শান্তিনিকেতনে গিয়ে পুরনো ছবির অ্যালবামগুলো সব নিয়ে এসেছেন৷ আজ সারাদিন বসে বসে অ্যালবামগুলোই দেখবেন ঠিক করেছেন৷ এখন আর তাঁর কোনও কাজে বাধা দেবার, এমনকী মতামত দেবারও কেউ নেই৷ রঙিন যতদিন ছিল, ততদিন ও কিছু কিছু বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করত, খুব পীড়াপীড়ি করলে৷ রঙিন কখনোই উচ্চকিত ছিল না, বরং প্রায় নিরুচ্চারে তাঁর পাশে থেকেছে সারাজীবন৷ 

রঙিনের সম্পর্কে পাস্ট টেন্সে ভাবতে আজও কেমন যেন আশ্চর্য লাগে৷ রঙিন যেন আজও তাঁর জীবনে রয়েছে কোথাও, নিষ্কম্প অবিচল ছায়ার মতো৷ অথচ ও চলে গেছে প্রায় দু’বছর হতে চলল৷ ও চলে যাবার পরই সুখদিয়াতে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন আলো৷ দিদির ছেলে আর বউ সেই সময়টায় কলকাতায় ছিল৷ ওরা দুজনেই সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে কাজের সূত্রে এই প্রজেক্টের কথা জানত৷ খুব অল্পই দেখেছেন দীপ্ত আর ওর স্ত্রী সন্ধ্যাকে৷ ওরা কর্মসূত্রে কলকাতায় ছিল বলে, বার দুয়েক এসেছে শান্তিনিকেতনে৷ গেস্ট হাউসে উঠে, প্রতিবারই দেখা করতে এসেছে আলোর সঙ্গে৷ তখনই হৃদ্যতা, জানাশোনা হয়েছে ওদের সঙ্গে৷ নয়তো আলোর দিদি কমলিকা বিয়ের পর থেকেই বাইরে বাইরে৷ দীপ্তকে ছোটবেলায় কয়েকবার দেখলেও তাকে অত ভালো করে কোনওদিন খেয়াল করেননি আলো৷ মাত্র বছর তিনেক হলো দীপ্ত আর সন্ধ্যার মধ্যে দিয়ে আত্মীয়তা ব্যাপারটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন আলো৷ কথায় কথায় বলেছিলেন কলকাতায় একটা ছোট্ট আস্তানা করার কথা ভাবছেন উনি৷ একটু অবাক হয়েছিল ওরা৷
– শান্তিনিকেতনে এত বছরের বাস তুলে দেবে মাসি?
সন্ধ্যা জানতে চেয়েছিল৷

Santiniketan
শান্তিনিকেতনে যাবার সম্ভাবনায় খুব উত্তেজিত ছিলেন তিনি…

শান্তিনিকেতনের সঙ্গে সত্যি সত্যিই প্রায় ষাট বছরের যোগাযোগ৷ সেই ছাত্রজীবন থেকে যখন বাবা প্রথমে দিদি, তারপর তাঁকে কলেজে পড়ার জন্য এখানে ভর্তি করে দেন৷ এখন মনে হয় দমদমে ছোটবেলায় থেকে, দমদম মতিঝিল স্কুলে পড়ে, তাঁদের দু’বোনের পক্ষে খুব স্বাভাবিক ছিল কলকাতার কোনও কলেজে পড়া৷ তাঁদের মতিঝিল, দেবীনিবাস থেকে অনেকেই তখন বেথুনে এমনকী আরও দক্ষিণে লেডি ব্রেবোর্নেও পড়তে যেত৷ তাঁর কলেজ যাবার সাত-আট বছর পর ছোটকু ওখান থেকেই প্রেসিডেন্সিতে পড়তে যেত৷ তাঁদের বোনেদের ক্ষেত্রে বাবার কেমন যেন ধারণা ছিল, ললিতকলা, চারুকলায় পারদর্শী হতে গেলে রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই শ্রেয়৷ মেয়েদের যে কলাবিদ্যায় স্বাভাবিক দক্ষতা থাকে, মস্তিষ্ক বনাম হৃদয়, এই দাঁড়িপাল্লায় হৃদয়াবেগের পাল্লাই যে মেয়েদের ক্ষেত্রে ভারী, এরকম একটা সরলীকৃত লিঙ্গ বিভাজনের পক্ষপাতী ছিলেন বাবা। অনেক পরে আলো বুঝেছেন এগুলি সমাজের মানসিকতায় যে পুরুষালী এবং মেয়েলি বলে যে স্থূল স্টিরিওটাইপিং থাকে, তারই নামান্তর৷ তবে তখন বাবাকে বোঝাবার মতো মানসিকতা বা সাহস তাঁদের কারোরই ছিল না৷ তাঁর নিজের কথা মনে আছে, দিদির তিন বছর পর শান্তিনিকেতনে যাবার সম্ভাবনায় খুব উত্তেজিত ছিলেন তিনি৷ শান্তিনিকেতনে দিদির বন্ধুদের সঙ্গে আগেই আলাপ হয়ে গিয়েছিল৷ অরুণদি তখন দাদার বউ হয়ে তাদের বাড়িতে আসবে, সে জন্য আরও বাড়তি উত্তেজনা৷ প্রায় ষাট বছর ধরে শান্তিনিকেতনের মাটিতে শিকড় জন্মে গেছে তাঁর, সেকথা যেমন সত্যি, তেমনই রঙিন চলে যাবার পর তাঁর পুরনো জীবনের আকর্ষণ যে ফিকে হয়ে এসেছে, সেকথাও তো অস্বীকার করতে পারেন না আলো৷ সন্ধ্যার প্রশ্নের উত্তরে অবশ্য এসব কোনও কথাই বলেননি। অজুহাত দিয়েছিলেন শরীরের৷
– আসলে ইদানীং শরীরটা খুব ভালো যায় না৷ জান তো, আমাদের এদিকে ডাক্তার আর হাসপাতালের খুব অভাব৷ শান্তিনিকেতন গত ত্রিশ-চল্লিশ বছরে অনেকভাবে পাল্টে গেছে৷ কিন্তু মেডিক্যাল সিনটা একইরকম রয়ে গেছে৷ এসবের জন্য ভাবছি৷ কলকাতায় তো আজকাল অনেকগুলো ভালো সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল হয়েছে শুনি৷
সন্ধ্যার হঠাৎ যেন কিছু একটা মনে পড়ে গিয়েছিল৷
– আচ্ছা মাসি, তুমি সুখদিয়ায় ট্রাই করবে?
সুখদিয়ার তখন নামও শোনেনি আলো৷ সন্ধ্যার কাছেই শুনেছিলেন- এমন একটা প্রজেক্ট চালু হয়েছে যেটা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের হোম অ্যাওয়ে ফ্রম হোমের কাজ করবে৷ চাইলেই হাতের কাছে সার্ভিসের লোক, যারা ঘর পরিষ্কার রাখবে, কাপড়জামা ধোবার পর শুকিয়ে ইস্ত্রি করে দিয়ে যাবে৷ ওই আবাসনেই আছে ডাক্তার, ২৪ ঘণ্টা অক্সিজেন, মেডিকেল ইমার্জেন্সির সুবিধা৷ তাছাড়া আবাসনে গাড়ি পার্ক করার ব্যবস্থা রয়েছে৷ পুজো, বড়দিন পালনের জন্য স্থায়ী মণ্ডপ৷ উল্টোদিকে বিরাট ঘাসের লন, প্রাতঃ ও সান্ধ্যভ্রমণের জন্য৷ টেলিভিশন, সব ঘরে এয়ার কন্ডিশনিং– সব মিলিয়ে এলাহি ব্যবস্থা৷ অথচ প্রাইভেসি রক্ষার জন্য প্রত্যেকের আলাদা অ্যাপার্টমেন্ট৷ সব শুনে বেশ অবাকই হয়েছিলেন আলো৷ এমন ব্যবস্থাই তো এতদিন চাইছিলেন তিনি৷ 

অর্থমূল্য সাধারণ বৃদ্ধাবাসের থেকে বেশ একটু বেশিই৷ এককালীন এবং মাসিক মিলিয়ে৷ তা হোক৷ সারাজীবন খুব সাদামাটাভাবে থেকেছেন তিনি৷ কোনও বিশেষ শখ-আহ্লাদ পূরণ করেননি৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে আঁকা শিখিয়েছেন সারাজীবন৷ যা মাইনে পেতেন, তা একার জন্য যথেষ্ট৷ তাছাড়া তাঁর জমা অর্থও ছিল কিছু৷ পূর্বপল্লিতে বাড়ি কিনতে তাঁর নিজের একটুও খরচ হয়নি৷ বাবার মৃত্যুর পরে কিছু টাকার আলাদা করে নমিনি ছিলেন তিনি৷ মৃত্যুর কয়েকমাস আগে একদিন বাবা সব কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়ে বলেছিলেন,
– মেয়েদের সুশিক্ষিত করে সৎপাত্রে সম্প্রদান করাটা বাবার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে৷ হাসির ক্ষেত্রে সে কর্তব্য আমি সম্পন্ন করেছি৷ তোমার ক্ষেত্রে পারিনি৷ তুমি জানো মাঝে আমার উপর কি ঝড় চলে গেছে৷ তারপর তোমার বিয়ে নিয়ে চিন্তা করার মানসিকতা আমার ছিল না৷ তবু যদি কখনও সংসার কর, এই ভেবে আলাদা করে এই টাকা রেখেছিলাম৷ আমি চলে যাবার পর এ টাকা তোমার থাকবে৷ যেভাবে ইচ্ছা হয় খরচ কোরো৷ শান্তিনিকেতনে থাকছ যখন পাকাপাকিভাবে, তখন একটা বাসস্থানের চিন্তাও করতে পার৷
আলো বাবার সেই চিন্তার মর্যাদা দিয়েছিলেন৷ ‘৭৯ সালে তাঁর আটত্রিশ বছর বয়সে পূর্বপল্লির বাড়িটা পরিচিত একজনের কাছ থেকে কিনে নিলেন তিনি৷ দোতলা ছোট বাড়ি লাগোয়া আউটহাউস, এক চিলতে জমিতে ইচ্ছেমতো ফুলগাছ, এককোণে একটা ইঁদারা৷ বাড়িটার রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে একটু ভগ্নদশা ছিল৷ আপাদমস্তক সারিয়েছিলেন আলো৷ কিছু কিছু অংশে রিমডেলিং করেছিলেন৷ নিজের রুচিমতো আসবাব আর ছবি দিয়ে সাজিয়েছিলেন বাড়ি৷ একটা মার্বেল ফলকে গেটের মুখে লেখা ‘পিতৃস্মৃতি’৷ পিতৃঋণ শোধ করা হয়নি সেভাবে, কিন্তু স্বীকার করা গেছিল৷ 

এখানে মর্নিং ওয়াকের জায়গা আছে৷ কিন্তু তাঁর আজকাল আর হাঁটতে ইচ্ছে করে না৷ সকালে ইন্টারকমে কিচেন থেকে ফ্লাস্কভর্তি চা আনিয়ে নেন আলো৷ আর দুটো বিস্কুট৷ একটা খবরের কাগজ দিয়ে যায় তাঁর দরজায়৷ আলো জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ৷ সারাদিন ধরেই তাঁর জীবনের হারিয়ে যাওয়া মৃত মানুষদের কথা মনে পড়ে তাঁর৷ গত সপ্তাহে শান্তিনিকেতনে গিয়ে পুরনো ছবির অ্যালবামগুলো সব নিয়ে এসেছেন৷ আজ সারাদিন বসে বসে অ্যালবামগুলোই দেখবেন ঠিক করেছেন৷ 

টোটন ইন্টারকমে জিজ্ঞেস করল,
– ব্রেকফাস্ট কি ডাইনিং হলে গিয়ে খাবেন, না ঘরে পৌঁছে দেব?
খুব চটপটে চালাকচতুর ছোকরা টোটন৷ এই বিল্ডিংয়ের যতজন আবাসিক সদস্য, তাঁদের সকলের দেখভালের দায়িত্ব ওর৷ কে কী খাবেন, কার কিসে অ্যালার্জি, ইত্যাদি পুরো জিনিসটাই একটা চার্ট করে সামনের দেওয়ালে ঝোলে টোটনের৷ সেইমতো সপ্তাহের প্রতিদিনের তিনবেলার মেনু ঠিক হয়৷ মাসের গোড়ায় খাওয়া-দাওয়া এবং অন্যান্য সব সুবিধে অসুবিধে বুঝতে একটা করে গম্ভীর মিটিং হয়৷ আলো লক্ষ করে দেখেছেন– তাতে বেশিরভাগ আবাসিকেরই অজস্র বক্তব্য থাকে৷ সবচেয়ে বেশি কথার চাষ হয় কবে কোন মাছটা হওয়া বাঞ্ছনীয়, সে নিয়ে৷ মাছের পিস ভালো হচ্ছে না, মাংসটা তেল চুপচুপে, এসব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলে৷ আলো এইসব সময়ে চুপ করে থাকেন৷ তাঁর কোনও বক্তব্য নেই৷ তিনি নিরামিশাষী হবার পাশাপাশি স্বল্পাহারেও অভ্যস্ত হয়েছেন৷ জীবনে কোনওদিনই পার্থিব জিনিসের জন্য তাঁর উদগ্র আকাঙ্ক্ষা বা প্রবল চাহিদা ছিল না৷ এখন ডায়োজিনিসের মতো ‘হোয়াট আর দ্য থিংস্‌ উই ক্যান ডু উইদাউট’-এর দর্শনে বিশ্বাসী তিনি৷ আজ ব্রেকফাস্ট খেতে ডাইনিং এরিয়ায় যেতে ইচ্ছে করল না৷ এখানে ফ্লোর প্রতি আলাদা আলাদা ডাইনিং হল৷ তাছাড়াও কতগুলো ছোট ছোট ডাইনিং এরিয়া আছে যেখানে চা বা প্রাতঃরাশ খাওয়া যায়৷ অতিথি আপ্যায়ণও করা যায়৷ আজ ব্রেকফাস্ট দিয়েছে কারিপাতা আর বাদাম দিয়ে নোনতা সুজি, উপমা৷ এছাড়া একটা করে মিষ্টি থাকে৷ আলোর ডায়াবেটিস আছে জেনে নিয়েছে বলে মিষ্টিটা সাধারণত পাঠায় না৷ আজ একটা ছোট্ট বাটিতে একটু পায়েস আছে৷ নিশ্চয়ই আবাসিকদের কারোর জন্মদিন৷ স্পেশাল কোনও দিন হলেই পায়েস রান্না করায় টোটন৷ ছোকরার এসব দিকেও খেয়াল আছে৷ 

অনেকদিন টানা বৃষ্টির পর আজ ভারী সুন্দর রোদ উঠেছে৷ ঘরের জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখতেও অবশ্য খুব ভালো লাগে আলোর৷ বহুদিন আগে শান্তিনিকেতনে যেমন ঘন কালো মেঘ করে পূর্বপল্লির মাঠের ওপারে সাঁওতালদের গ্রাম থেকে বৃষ্টি আসত, সেই স্মৃতি মনে পড়ে তাঁর৷ ছাত্রী অবস্থায় তো বটেই, পরে যখন শিক্ষক হিসেবে পাঠভবনে যোগ দিয়েছেন, তখনও প্রায়ই বৃষ্টির দিনে দল বেঁধে ভিজতে বার হতেন তাঁরা বন্ধুরা মিলে৷ কোপাইয়ের পাড় দিয়ে সাইকেল নিয়ে সোনাঝুরি খোয়াই অবধি চলত বৃষ্টিতে সেলিব্রেট করার হুল্লোড়৷ সেই শান্তিনিকেতন চোখের সামনে দিয়ে কেমন বদলে গেল৷ বেশ কিছুকাল ধরেই নিজের যৌবনের শান্তিনিকেতনকে আর মেলাতে পারছিলেন না এখনকার সঙ্গে৷ এখন দশ-পনেরো বছর ধরেই শুরু হয়েছে শান্তিনিকেতনে বাড়ি কেনার রেওয়াজ৷ কলকাতার একটু উচ্চবর্গের ভদ্রলোকেদের হঠাৎ ভীষণ পছন্দের জায়গা হয়েছে শান্তিনিকেতন৷ চড়চড় করে দাম বেড়েছে জমির, বাড়ির৷ অনেক বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি, যারা বড় মাপের প্রমোটার তারা হৈ হৈ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাজারে৷ তৈরি হয়েছে উচ্চবিত্তের পকেটসই দামি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স, যা কলকাতার বড়লোকদের সপ্তাহান্তিক মদ্যপানের জায়গা৷ বাইরে থেকে জনস্রোত আসার ফলেই কি জায়গাটা এমন বদলে গেল? আলো মাঝে মাঝে ভাবার চেষ্টা করেন৷ তিনিও তো আউটসাইডার হিসেবেই গেছিলেন ওখানে পড়তে৷ থাকতে থাকতে জায়গাটাকে ভিতর থেকে ভালোবেসে ফেললেন৷ রবীন্দ্রনাথ যে আদর্শে আশ্রমের জীবনকে গড়ে তুলেছিলেন, সেই আদর্শ থেকে কখনও বিচ্যুত হননি সেই আমলের বাসিন্দারা৷ অথচ আলো তো কত পরে গেছেন শান্তিনিকেতনে৷ তখন রথী ঠাকুরও পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেছেন দেরাদুনে৷ সুধীরঞ্জন দাসের জমানা তখন৷

shanti-niketan-tribal-painting
নিজের যৌবনের শান্তিনিকেতনকে আর মেলাতে পারেন না এখনকার সঙ্গে।

পুরনো অ্যালবাম খুলে বসেছেন আলো৷ ছবির টানে বহুদিনের বহু গল্প ভেসে আসছে বিস্মরণের পলেস্তারা সরিয়ে৷ মনের মধ্যে গল্প দানা বাঁধছে টের পেয়ে ল্যাপটপ টেনে নেন তিনি৷ আলোলিকা রিটায়ার করেছেন বছর পনেরো হয়ে গেল৷ যতদিন চাকরিতে ছিলেন, ততদিন কম্পিউটার ব্যবহার করতে হত না তাঁর৷ তখন পোস্ট অফিসের যুগ৷ শান্তিনিকেতনের পোস্ট অফিসটি ছিল জমজমাট৷ যে কোনও সুসংবাদের মতো তখন দুঃসংবাদও যেত টেলিগ্রাম বা ট্রাঙ্ককল মারফৎ৷ ছোটকুর মৃত্যুসংবাদও আলো টেলিগ্রাম মারফৎ জানিয়েছিলেন তাঁর দাদাকে৷ বাবার মৃত্যুর খবর জানাতে ট্রাঙ্ককল বুক করতে হয়েছিল৷ মা অবশ্য শেষজীবনটা দিদির কাছে কাটিয়েছিলেন৷ মা’র মৃত্যুর খবর দিদি কীভাবে জানিয়েছিল দাদাকে, জানেন না আলোলিকা৷ তার আগেই দাদাদের সঙ্গে সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল৷ ইদানীং কয়েকবছর হল আলো ই-মেল করতে অভ্যস্ত হয়েছেন৷ বছর আটেক আগে রঙিন তাঁকে একটা ল্যাপটপ কিনে দিয়েছিল৷ খুব আশ্চর্য হয়েছিলেন আলো৷ রঙিন কোনওদিন কিছু কিনে এনেছে বলে মনে পড়ে না তাঁর, শুধু বই ছাড়া৷ তাদের সম্পর্কের মধ্যে আদানপ্রদান ব্যাপারটা বাহ্যিকভাবে ছিল না বললেই চলে৷ আর্ট বিষয়ক কোনও বই, বা স্মৃতিকথা, এমনকি বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার বইও কিনে আনত রঙিন৷ সেবার কলকাতা থেকে ফেরার পথে একটা আস্ত ল্যাপটপ নিয়ে এসেছিল ও৷
– হঠাৎ এটা?
একটু ভ্রূকুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করেছিলেন আলো৷
– এমনিই৷ মনে হলো তোমাকে ই-মেল করাটা শেখাতে হবে৷ আজকাল ইন্টারনেট চালু হয়ে কত সুবিধা হয়ে গেছে বলো তো!
– বুড়ো বয়সে এখন এইসব শিখে কি লাভ আমার? কাকেই বা ই-মেল করব?
– ধরে নাও আমাকে৷ আগেকার দিনে হত না, চিঠি লিখে মন খুলত সবাই৷ আমাকে না হয় ই-মেলেই লিখবে৷ আমিও লিখব তোমাকে৷ আমি কখনও তোমাকে সেভাবে চিঠি লিখিনি আলোদি, এত কিছু হল প্রেমপত্রটাই বা বাকি থাকবে কেন বলো?
রঙিন ঠোঁট চেপে হেসেছিল৷ তখন ছাপ্পান্ন কি সাতান্ন বছর রঙিনের৷ জীবনের শেষ দশ বছরই তো একটু ঘনিষ্ঠভাবে, একটু কাছাকাছি থাকতে পেরেছিলেন তাঁরা৷ 

শান্তিনিকেতনে তখন ইন্টারনেটের তেমন স্পিড ছিল না৷ আস্তে আস্তে আলো শিখেছিলেন ই-মেল করতে৷ ফেসবুক ধরলেন তারও কয়েকবছর পর৷ ক্রমে কম্পিউটারের ভারচুয়াল জগৎটা আলোকে গ্রাস করে ফেলল৷ রঙিন চলে যাবার পর সইয়ে নিতে সময় লেগেছিল৷ তখন ছেদ পড়েছিল ফেসবুক আর ই-মেলের জগৎ থেকে৷ সুখদিয়ায় আসার পর এই ক’মাসে আবার নতুন করে ভারচুয়াল জগতের সঙ্গে বন্ধুত্ব হচ্ছে তাঁর৷ নিজে চেষ্টা করে করে আলো অভ্যস্ত হয়েছেন কম্পিউটারে বাংলা লিখতে৷ একটি ব্লগ লেখা শুরু করেছেন তিনি৷ ছ-সাতটা কিস্তি লেখার পর বেশ জনপ্রিয় হয়েছে ব্লগটা৷ ফেসবুকের বন্ধুরা ব্লগটা পড়ে খুব খুশি৷ সুখদিয়ায় ইন্টারনেট স্পিড বেশ ভাল৷ প্রতিদিনই সকালটা ফেসবুক পোস্টের জবাব দেওয়া আর ব্লগ লেখায় বেশ কিছুটা সময় কাটে তাঁর৷ ব্লগ লেখাটা নতুন চালু করেছেন৷ প্রথম প্রথম একটু আড়ষ্ট লাগছিল৷ চিরকাল তো ছবি এঁকেছেন আর আঁকা শিখিয়েছেন৷ কলম ধরে লেখেননি কখনও, কম্পিউটারে বাংলা টাইপ করে ব্লগ লেখা তো দূরস্থান৷ তাও আবার নিজের কথা৷ নিজের কথা লেখা মানে তো নিজের মনের একটা টুকরো খুলে নিয়ে সম্পূর্ণ নিরাবরণ করে অন্যের কাছে পেশ করা৷ কেনই বা পঁচাত্তর পেরিয়ে নিজেকে মেলে ধরে অন্যদের কাছে দেখাবেন তিনি? ‘এই যে দ্যাখো, দেখে নাও আমাকে ৷ আমার ভালো-মন্দ, আলো-ছায়া সবটুকু লিখে রাখছি আমার অজানা পাঠকদের জন্য৷’ প্রথমে আলোর নিজের লেখা নিয়ে অনেক সঙ্কোচ ছিল৷ ঠিক প্রথম শরীরী আত্মসমর্পণে যেমন সঙ্কোচ থাকে৷ নিজের কথা লেখার জন্য রঙিনও প্রচুর উৎসাহ যুগিয়েছে একসময়৷

‘৮৯ সালে তাঁর আটত্রিশ বছর বয়সে পূর্বপল্লির বাড়িটা পরিচিত একজনের কাছ থেকে কিনে নিলেন তিনি৷ দোতলা ছোট বাড়ি লাগোয়া আউটহাউস, এক চিলতে জমিতে ইচ্ছেমতো ফুলগাছ, এককোণে একটা ইঁদারা৷ বাড়িটার রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে একটু ভগ্নদশা ছিল৷ আপাদমস্তক সারিয়েছিলেন আলো৷ কিছু কিছু অংশে রিমডেলিং করেছিলেন৷ নিজের রুচিমতো আসবাব আর ছবি দিয়ে সাজিয়েছিলেন বাড়ি৷ একটা মার্বেল ফলকে গেটের মুখে লেখা ‘পিতৃস্মৃতি’৷

– ব্যাপারটাকে অন্যভাবে ভাবো আলোদি৷ দ্যাখো আমরা তো প্রত্যেকেই এই পৃথিবীতে জন্মাই, বড় হই, ক্রমশ বুড়ো, তারপর একদিন ফুরিয়ে যাই৷ মহামানব তো সকলে হয় না৷ এই যে আমরা নিতান্ত সাধারণ, এলেবেলে মানুষরা, তারা ধরো ঠিক এক একটা গাছের মতো৷ কারোর লতানো জীবন, পরজীবী, কেউ আগাছা, পৃথিবীর উপকারে না লাগা জঞ্জাল, কেউ পর্ণমোচী, শীতের দিনে পাতা ঝরে যায়, বসন্তে আবার নতুন করে বেঁচে ওঠার জন্য নতুন পাতায় সাজায় নিজেকে, কোনও গাছ সুদূর ধূ ধূ মরুভূমির ক্যাকটাসের মতো, সহস্র প্রতিকূলতা অতিক্রম করেও তেড়েফুঁড়ে মাথা তোলে৷ ভিতরে কত জোর! কোনও গাছ নয়নতারা বা সন্ধ্যামণির মতো, নিয়মিত পরিচর্যা ছাড়াই গৃহস্থের উঠোনে, ছাদের কার্নিশে উঁকি দেয়, নর্দমার পাশে, আস্তাকুঁড়ের জমা জলে কলমি লতা, কচুপাতা ফনফন করে বাড়ে, পাখির মুখে করে আনা বীজ ছড়িয়ে যায় দেশ থেকে দেশান্তরে, গরমের ফুটিফাটা মাটি থেকেই ঠাঁই হয় শুভ্র বরফের দেশে৷ আর বৃক্ষরা তো থাকেই, মহীরুহ হয়ে ওঠার জন্য, চারদিকে ডালপালা মেলে বাড়তি জায়গার দখল নেওয়ার জন্য, অন্যকে তপ্তদিনের দাবদাহে ছায়ার প্রলেপ দেবার জন্য, কিংবা ধূসর রাত্রিতে আকাশের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া হাতে মহাকাশ ছুঁতে চাওয়ার জন্য৷ বৃক্ষজন্ম সকলের ভাগ্যে থাকে না আলোদি৷ বটানিকাল গার্ডেনে সেই যে বটগাছটা, যার আসল গুঁড়িটা আর খুঁজে পাওয়াই যায় না, কেননা ঝুরি নেমে নেমে আসল গাছটা কখন মহাবৃক্ষের আকার নিয়েছে, কিংবা ধরো অনেকশো বছরের পুরনো সেই দীর্ঘকায় রেডউড গাছ, যারা উঠে যায় আকাশের উচ্চতা ছুঁতে, তেমন বৃক্ষজন্ম সকলে পায় না, যাতে তার নিজের কথা নিজের মুখে আর বলতে হয় না, অন্য সবাই তার কথা জানে, তার কথা বলে৷ তুমি কোন গাছ, আলোদি? তোমার কথা কেউ জানবে না, মনে রাখবে না, তুমি একদিন কালের গর্ভে এক ক্ষণিক বুদ্বুদের মতো টুপ করে নেই হয়ে যাবে, সেই চরম মুহূর্তের জন্যই কি তুমি বেঁচে আছ? একবার তুমুলভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে না আলোদি? শেষ হয়ে যাবার আগে একবার মনে হয় না প্রবলভাবে জ্বলে উঠি? মাটির এই পৃথিবীর সব রস আকণ্ঠ পান করি? ছবি আঁকার মতো, লেখাও তেমন জ্বলে ওঠার প্রক্রিয়া, সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে আমাদের এই বেঁচে থাকাকে সেলিব্রেট করার মাধ্যম৷ এইভাবে যদি ভাবো আলোদি, দেখবে লিখতে আর বাধো বাধো ঠেকছে না, সঙ্কুচিত লাগছে না৷

এইভাবে বোঝাত রঙিন৷ খুব অন্যরকম একটা মনের মানুষ ছিল, চারপাশে দেখা আর পাঁচজনের থেকে আলাদা৷ রঙিন চলে যাবার পর আলো ভাবতে শুরু করেন আকাশপাতাল৷ পাগল পাগল লাগত, যেসব কথা তিনি বলতে চান, সেসব কথা শোনার লোক ছিল না আর৷ রঙিনের সঙ্গে মনে মনে কথা বলতেন তিনি৷ সেই দারুন দুঃখের দিনেই ব্লগ লিখতে শুরু করেন আলো৷  (চলবে)

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২৬ অক্টোবর ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Pinterest, Alamy, Indiatales
Author Aparajita Dasgupta

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

Picture of অপরাজিতা দাশগুপ্ত

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।
Picture of অপরাজিতা দাশগুপ্ত

অপরাজিতা দাশগুপ্ত

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস