রাজস্থান থেকে ফেরার পর মেঘনার উদ্যোগে গোটা রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ জেনে গেল পিকু শখের গোয়েন্দা। ফলে যেটা হল পিকুর বন্ধুরা ওকে টিকটিকি বলে আওয়াজ দিতে শুরু করল। আর এতে পিকু মেঘনার ওপর প্রচণ্ড রেগে গেল। মেঘনার বক্তব্য ও মোটেই সবাইকে বলেনি। কিন্তু পিকুর কথা “তুই নিজেই তো জানিস না কখন, কাকে, কোন প্রসঙ্গে বা কেন আমার গোয়েন্দাগিরির কথা বলেছিস।”
যাইহোক, পরপর কয়েকদিন বটুদার ক্যান্টিনে রোল, মাখন টোস্ট আর অমলেট খাইয়ে মেঘনা পিকুকে শান্ত করল।
সেমিস্টারের পরীক্ষা হয়ে গেছে, তাই কলেজে ক্লাসের চাপ কম। কিন্তু পিকুরা মোটামুটি রোজই কলেজে আসে। পড়ার চাপও নেই তাই ইদানীং কলেজের পরে সিনেমা বা নাটক দ্যাখা লেগেই আছে।
গত সপ্তাহে ঋতজা কলকাতায় এসেছিল। ওরই উদ্যোগে পিকুরা সবাই মিলে মধুসূদন মঞ্চে বালুরঘাটের একটা নাচের দলের ‘গান্ধারীর আবেদন’ আর ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ দেখতে গেছিলো। বেশ ভালো! উপস্থাপনাটা একদম অন্যরকম। ‘গান্ধারীর আবেদন’ বা ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ সাধারণত সবাই আবৃত্তিই করে, নাচে উপস্থাপনা খুব একটা দেখা যায় না। এরা যেটা করেছে, নাচটা শান্তিনিকেতনের টিপিক্যাল “লতায় পাতায়” স্টাইলে মানে ভরতনাট্যম আর মণিপুরী স্টাইলের ব্লেন্ড মোডে না করে পিওর ভরতনাট্যমের আঙ্গিকে করেছে। তাতে পুরো উপস্থাপনাটাই খুব কালারফুল আর এক্সপ্রেসিভ হয়েছে। ছেলেমেয়েগুলো যেমন নেচেছে তেমনই আবৃত্তি আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। দারুণ হয়েছে।
কবিতা দুটো পিকুর আগে পড়া হলেও আগে কখনও এইভাবে ভেবে দ্যাখেনি।
অন্যরা কী বলবে পিকু বলতে পারবে না, কিন্তু পিকুর দারুণ লেগেছে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি। সেটাই মেঘনার সাথে আলোচনা করছিল।
পিকুর মতে এখানে নারীর দুটো ভিন্নরূপ। একদিকে গান্ধারী সমাজ সংসারের ভয়ে সন্তানকে ত্যাগ করতেও প্রস্তুত। তার জন্যে ধৃতরাষ্ট্রকে এও বলছে—
“মাতা আমি নহি? গর্ভভার জর্জরিতা
জাগ্রহ হৃৎপিণ্ডতলে বহি নাই তারে?
স্নেহবিগলিত চিত্ত শুভ্র দুগ্ধধারে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে নাই দুই স্তন বাহি
তার সেই অকলঙ্ক শিশুমুখ চাহি?
… তবু কহি, মহারাজ,
সেই পুত্র দুর্যোধনে ত্যাগ করো আজ।
…
কুরুকুল পিতৃপিতামহ
স্বর্গ হতে এ প্রার্থনা নরনাথ!
ত্যাগ করো, ত্যাগ করো তারে—
…
অধর্মের মধুমাখা বিষফল তুলি
আনন্দে নাচিছে পুত্র; স্নেহমোহে ভুলি
সে ফল দিয়ো না তারে ভোগ করিবারে,
কেড়ে লও, ফেলে দাও, কাঁদাও তাহারে।”
অন্যদিকে কুন্তী কিছুটা পাণ্ডবদের স্বার্থরক্ষার্থে আর কিছুটা মাতৃস্নেহে এতদিন পরে কর্ণকে নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্রের সম্মান দিতে দ্বিধাবোধ করছে না। তাই কর্ণের কাছে গিয়ে বলছে:
“তোমারে বসাব মোর সর্বপুত্র-আগে
জ্যেষ্ঠ পুত্র তুমি।”
সাথে বলছে,
“পুত্র! ভিক্ষা আছে—
বিফল না ফিরি যেন।
…
এসেছি তোমারে নিতে।”

অথচ এই কুন্তী কিন্তু কখনোই সর্বসমক্ষে স্বীকার করেনি কর্ণ তারই গর্ভজাত সন্তান। তাই নিজেই কর্ণকে বলেছে:
“আজো মনে পড়ে
অস্ত্রপরীক্ষার দিন হস্তিনানগরে
তুমি ধীরে প্রবেশিলে তরুণকুমার
রঙ্গস্থলে, নক্ষত্রখচিত পূর্বাশার
প্রান্তদেশে নবোদিত অরুণের মতো।
যবনিকা-অন্তরালে নারী ছিল যত
তার মধ্যে বাক্যহীনা কে সে অভাগিনী
অতৃপ্ত স্নেহক্ষুধার সহস্র নাগিনী
জাগায়ে জর্জর বক্ষে— কাহার নয়ন
তোমার সর্বাঙ্গে দিল আশিস্-চুম্বন।”
আজ যখন কর্ণের মতো বীর কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধে নেমেছে কুন্তী তখন নিজের পাঁচ সন্তানের প্রাণ ও সম্মান রক্ষার্থে কর্ণকে সম্মান, রাজত্বের লোভ দেখিয়ে পাণ্ডবদের দিকে আনার চেষ্টা করছে।
প্রশ্ন একটাই থেকে যায়, কে ঠিক? গান্ধারী না কুন্তী! মানে ধর্ম না মাতৃস্নেহ?
মেঘনা বলল “গান্ধারী! কেননা গান্ধারী সত্যকেই আঁকড়ে ধরেছিল। তাই দুর্যোধনকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা বোধ করেনি।
অন্যদিকে কুন্তী? সে তো পরম স্বার্থপরতা দেখিয়েছে। আজ যদিও বা মনে হয় কুন্তী মাতৃস্নেহের বশে এসব কথা বলছে, কিন্তু ভেবে দ্যাখ তো একজন নারী হয়েও কত সহজে দ্রৌপদীকে পাঁচ পুরুষের ভোগের বস্তু হতে বাধ্য করেছে।
আমার তো মনে হয় কুন্তী এগুলো নিজের জীবনের চরম অপমানের আক্রোশ থেকে করেছিল। ভেবে দ্যাখ, কিশোরী অবস্থায়, যখন মাতৃত্ব কাকে বলে বোঝে না তখন প্রথম মা হয়, জন্ম দেয় কর্ণের, সূর্যের ঔরসে। জেনেশুনেও পাণ্ডুর মত একজন নপুংসককে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। তারপর সেই পাণ্ডুর পুত্র-সন্তানের ইচ্ছা পূরণ করতে তিন ছেলে যুধিষ্ঠির, ভীম আর অর্জুনকে নিজের গর্ভে ধারণ করে যাদের বায়োলজিক্যাল ফাদার কিন্তু ধর্ম, বায়ু আর ইন্দ্র! এও তো একধরনের অবিচার বা অত্যাচার। ওয়াজন’ট দ্যাট এ পারভারটেড সোসাইটি? নিশ্চয়ই এতগুলো পরপুরুষের সন্তানের জন্ম দেওয়ার কোনও ইচ্ছা ছিল না কুন্তীর!
আসলে এই হচ্ছে আমাদের সমাজ। এখনও তুই এই জিনিস খুঁজে পাবি! আগে যা ছিল, এখনও তাই আছে, ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। তা নাহলে জয়সলমিরের ওই মিস্টার শর্মা সন্তানের জন্ম দিতে পারেনি বলে নিজের বউকে অমনিভাবে খুন করে!
আবার একই ফ্রেমে গান্ধারীকে বসা, বুঝতে পারবি তাকেও কত অন্যায় অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। একশটা সন্তানের জন্ম দেওয়া! হরিবল! জাস্ট ভেবে দ্যাখ, শি ওয়াজ ইউজড অ্যাজ এ চাইল্ড প্রোডিউসিং মেশিন! হোয়াইল শি ওয়াজ সো সিমপ্যাথেটিক টু হার সেম ব্লাডি হাজবেন্ড ফর বিইং ব্লাইন্ড! এ্যাকচুয়ালি সেক্স ওয়াজ দ্য প্রাইমারি ইস্যু নট দ্য ফাদারহুড!” মেঘনা খুব ইমোশনাল হয়ে পড়ল। পিকু সবটাই চুপ ক’রে শুনল।
ভেবে দ্যাখ, কিশোরী অবস্থায়, যখন মাতৃত্ব কাকে বলে বোঝে না তখন প্রথম মা হয়, জন্ম দেয় কর্ণের, সূর্যের ঔরসে। জেনেশুনেও পাণ্ডুর মত একজন নপুংসককে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। তারপর সেই পাণ্ডুর পুত্র-সন্তানের ইচ্ছা পূরণ করতে তিন ছেলে যুধিষ্ঠির, ভীম আর অর্জুনকে নিজের গর্ভে ধারণ করে যাদের বায়োলজিক্যাল ফাদার কিন্তু ধর্ম, বায়ু আর ইন্দ্র! এও তো একধরনের অবিচার বা অত্যাচার। ওয়াজন’ট দ্যাট এ পারভারটেড সোসাইটি?
“আসলে মহাভারত যারা লিখেছিলেন তারা সমাজকে কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন সেটা আমার কাছে একটা বড় বিস্ময়!” পিকু খুব বিস্ময়ের সাথে বলল।
***
পরদিন সকালে আটটায় কৌশিকের ফোন!
“ভাগ্নে! তুমি কি ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে একবার হাতিবাগান স্টার থিয়েটারের সামনে আসতে পারবে! একটা জরুরি দরকার আছে। আমি ওয়েট করব!” উত্তরের অপেক্ষা না করে কৌশিক ফোনটা কেটে দিল। পিকু বুঝতেই পারল ব্যাপারটা সিরিয়াস।

তাড়াতাড়ি স্নান খাওয়া করে বেরিয়ে পড়ল পিকু। স্টার থিয়েটার পৌঁছাতে সওয়া দশটা বেজে গেল। পৌঁছে দ্যাখে কৌশিক একলা দাঁড়িয়ে আছে। পিকু পৌঁছতেই কৌশিক বলল “তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি। চল এবার যাওয়া যাক।”
উল্টোফুটেই হরি ঘোষ স্ট্রিট। হরি ঘোষ স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে কৌশিক পিকুকে কেসটা বলল। “আজ সকালে বাড়ির লোকজন দ্যাখে বাড়ির মালকিন মানে মা, আর কিছুদিন ধরে এই বাড়িতেই থাকত একজন লোক, দুজনেই মায়ের ঘরে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। যেভাবে দুজনে শুয়ে আছে সেটাই অস্বাভাবিক। তুমি চল নিজের চোখেই দেখবে।” বড়তলা থানার ওসি মণ্ডলবাবু দাঁড়িয়েই ছিলেন। ওরা একসঙ্গে গেল।
উত্তর কলকাতার টিপিক্যাল বনেদি বাড়ি। বাড়ির দরজার পাশে পাথরের ফলকে ‘মিত্র’ লেখা।
ঢুকেই একটা বড় ঘর, সেই ঘর দিয়ে গেলেই সামনে পড়বে উঠোন আর উল্টোদিকে ঠাকুরদালান। উঠোনের চারপাশে দালান বা বারান্দাও বলা যেতে পারে। দালান ধরে সারি সারি ঘর। দোতলাতেও সেই একই রকম চারপাশ, ঘোরানো রেলিং দেওয়া বারান্দা, তারও চারপাশে ঘর। ঠাকুরদালানের ঠিক উল্টোদিকের দোতলার ঘরে এই বাড়ির মালকিন বা অভিভাবিকা মৃন্ময়ী দেবী থাকতেন। মৃন্ময়ী দেবীর দুই ছেলে, অতনু আর সুতনু। অতনুর বয়স বছর পঞ্চাশেক হবে আর সুতনুর বছর পঁয়তাল্লিশ! দুজনেই বিবাহিত। অতনুর একটি ছেলে টুবান আর সুতনুর মেয়ে মিতু। এছাড়া কার্তিক, বাড়ির চব্বিশ ঘণ্টার কাজের লোক। কার্তিক এই বাড়িতে গত চল্লিশ বছর ধরে আছে।
মণ্ডলবাবু বলাতে অতনু কৌশিক আর পিকুর সঙ্গে বাড়ির সকলের আলাপ করিয়ে দিলেন।
মৃন্ময়ী দেবীর ঘরে ঢুকে পিকু দ্যাখে বিশাল পালঙ্কের মাথার দিকে হেলান দিয়ে মৃন্ময়ী দেবী শুয়ে আছেন আর কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে সেই লোকটি, যার নাম ভোলা। ভোলার হাতে একটা সিরিঞ্জ আর বিছানার পাশের টেবিলে একটা লেবেল ছাড়া ইনজেকশনের ওষুধের শিশি। এর থেকেই মৃত্যুর কারণটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
মৃন্ময়ী দেবীর বয়স বছর সত্তর হবে। অল্প বয়সে অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন বোঝাই যাচ্ছে। চেহারার মধ্যে একটা বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে। একটা সাদা থান পরা, মানে বিধবা। আর ভোলার বয়স পঞ্চাশ বাহান্নর কাছাকাছি। একটা সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা।
দুজনের মুখেই একটা প্রশান্তির ছাপ। কোনও যন্ত্রণা নেই।
দালান ধরে সারি সারি ঘর। দোতলাতেও সেই একই রকম চারপাশ, ঘোরানো রেলিং দেওয়া বারান্দা, তারও চারপাশে ঘর। ঠাকুরদালানের ঠিক উল্টোদিকের দোতলার ঘরে এই বাড়ির মালকিন বা অভিভাবিকা মৃন্ময়ী দেবী থাকতেন। মৃন্ময়ী দেবীর দুই ছেলে, অতনু আর সুতনু। অতনুর বয়স বছর পঞ্চাশেক হবে আর সুতনুর বছর পঁয়তাল্লিশ! দুজনেই বিবাহিত।
মৃন্ময়ী দেবীর ঘরে সুন্দর কাঠের কাজ করা সব ফার্নিচার। বসার জায়গার গোল টেবিলটার ওপরে একটা দারুণ সুন্দর মার্বেল বসানো। কৌশিক বলল ইটালিয়ান মার্বেল। জমিদারের মত দেখতে একজনের বড় একটা অয়েল পেইন্টিং ঠিক মাথার দিকের দেওয়ালে টাঙানো। অতনু জানালেন ওটা মৃন্ময়ী দেবীর বাবা রায়বাহাদুর শশধর মিত্রের ছবি। এই বাড়িটি ওঁরই আর সেই সূত্রেই একমাত্র সন্তান হিসেবে মৃন্ময়ী দেবী পেয়েছিলেন।
ঘরে অনেক বই দেখে পিকু প্রশ্ন করে “ওঁর বোধহয় পড়াশোনা করার খুব শখ ছিলো?” অতনু জানায় সে তো ছিলই, মৃন্ময়ী দেবী সেই সময়কার বাংলায় এম এ পাশ ছিলেন। মৃন্ময়ী দেবীর বইয়ের সংগ্রহ দেখে পিকু এটা বুঝলো যে উনি বেশ আধুনিক মনের মানুষ ছিলেন। কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত, তুলসীদাসের রামচরিত মানস, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ যেমন আছে, তেমনই সৈয়েদ মুজতবা আলী, সমরেশ বসু, বুদ্ধদেব বসু বা মানিক বন্দোপাধ্যায়, প্রেমেন মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, লীলা মজুমদারও আছেন। আবার তারই সঙ্গে শক্তি, সুনীল, পূর্ণেন্দু পত্রীর পাশাপাশি সত্যজিৎ রায়ও আছেন। এমনকি শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামী, বাণী বসু বা মল্লিকা সেনগুপ্তের মত লেখক লেখিকারাও আছেন।
পিকু অতনুকে অনুরোধ করল যদি বাকি ঘরগুলোও একবার দেখা যায়।
মৃন্ময়ী দেবীর ঘরের উঁচু চৌকাঠ পার হতে না হতেই মেঘনার ফোন। “তুই কলেজে আসিসনি? তোর কি শরীর খারাপ?” ইত্যাদি পাঁচ ছটা প্রশ্ন। মেঘনা থামার পর পিকু বুঝিয়ে বলল ও কোথায় এবং কেন। ব্যাস “আমিও আসছি বলে মেঘনা ফোনটা কেটে দিল!”

পিকুরা এক এক করে সব ঘর ঘুরে দেখল। বোঝাই যায় কয়েক পুরুষের বনেদি পরিবার এবং সচ্ছলও বটে।
শেষে ভোলার ঘরে এসে পিকুর মনটা কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। ছোট্ট ঘর, অসম্ভব পরিষ্কার। একটি তক্তপোষ, তাতে কোনও বিছানার বালাই নেই। শুধু একটা বালিশ, তার পাশে একটা গীতা রাখা। ঘরে সুন্দর ধূপের গন্ধ ম ম করছে। একটি মাত্র জানালা, কিন্তু ঘরটাতে ঢুকেই মনটা ভালো হয়ে যায়। কী যেন একটা আছে ঘরটাতে।
সব দ্যাখা হলে ওরা সবাই নীচের ঘরে এসে বসল। ততক্ষণে মেঘনাও পৌঁছে গেছে। পিকু অতনুদের জিজ্ঞাসা করল “আপনারা যদি একটু আপনাদের পারিবারিক ইতিহাস, আপনাদের চোখে মৃন্ময়ী দেবী কেমন ছিলেন আর ভোলাবাবু সম্পর্কে একটু বিশদে বলেন। এছাড়া যদি আপনাদের আলাদা করে কিছু বলার থাকে আপনারা প্লিজ নির্দ্বিধায় বলবেন।”
অতনু বলতে আরম্ভ করল…
“আমাদের মা একজন প্রখর বুদ্ধিমতী, শিক্ষিতা আর ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহিলা ছিলেন। আমাদের স্বর্গীয় বাবা শ্রীযুক্ত হেমন্ত দত্ত ডিব্রুগড়ে কাজ করতেন, তাই আমরা দুই ভাই মা’র তত্ত্বাবধানে কলকাতাতে এই বাড়িতে থেকেই বড় হয়েছি। বাবা বছরে দুই থেকে তিনবার বাড়ি আসতেন। আমার মায়ের দাদু দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার রায়চক অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। পরবর্তীকালে সেই জমিদারী আর সেই সংলগ্ন যাবতীয় সম্পত্তির অধিকারী হন আমার দাদু রায়বাহাদুর শশধর মিত্র। আমাদের এই বাড়ি তাঁরই করা।”
“আপনাদের রায়চকের জমিদারী কি এখনও আছে?” পিকু প্রশ্ন করে।
“সেই অর্থে এখন ঠিক আর জমিদারী নেই, তবে অনেকটা জমি নেওটিয়াদের গঙ্গাকুটির প্রজেক্টে বিক্রি করে দিলেও কিছু জমি আছে যাতে চাষবাস হয়। রায়চক বাসস্ট্যান্ডে মিত্রদের বাগানবাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করলে যে কেউ দেখিয়ে দেবে।” একটু জল খেয়ে অতনু আবার শুরু করল।
“রায়চকের জমিজমার দেখাশোনা মা নিজেই করতেন। তবে বর্তমানে মজুমদারবাবু মানে জিতেন মজুমদার ও তাঁর ছেলে সলিলই সব দেখাশোনা করে। আমরা ছোট থেকেই দেখে আসছি মা প্রতিমাসে একবার অন্তত রায়চকে যেতেন। তবে ইদানীং, মানে বছর তিনেক হল মা’র রায়চক যাওয়ার ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যায়। তারপর থেকে মা মাসে দুবার করে রায়চক যেতেন আর অন্তত দু-তিন দিন থেকে আসতেন। গত মাস ছয়েক হল মা খুব একটা আর রায়চক যেতেন না। বলতেন শরীরটা আর দিচ্ছে না রে! এবার থেকে আস্তে আস্তে তোরা দুই ভাই জমিজমা দেখাশোনার দায়িত্ব ভাগ করে নে।” অতনু বলল।
আমাদের স্বর্গীয় বাবা শ্রীযুক্ত হেমন্ত দত্ত ডিব্রুগড়ে কাজ করতেন, তাই আমরা দুই ভাই মা’র তত্ত্বাবধানে কলকাতাতে এই বাড়িতে থেকেই বড় হয়েছি। বাবা বছরে দুই থেকে তিনবার বাড়ি আসতেন। আমার মায়ের দাদু দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার রায়চক অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। পরবর্তীকালে সেই জমিদারী আর সেই সংলগ্ন যাবতীয় সম্পত্তির অধিকারী হন আমার দাদু রায়বাহাদুর শশধর মিত্র।
“আপনাদের ওখানে বাড়ি আছে?” পিকু জিজ্ঞাসা করল।
“হ্যাঁ আছে তো। আমরাও মাঝেমধ্যে গিয়ে থাকি। মজুমদার মশাই ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন আর জমি বাড়ির দেখভালও করেন। আগে ওঁর বাবা গোপাল দাদু দেখাশোনা করতেন। উনি এখনও বেঁচে আছেন। আমার দাদুর সময়কার লোক।” অতনু উত্তর দিল।
“জায়গাটা এক্সাক্টলি কোনখানে?” পিকু জানতে চাইল।
“গঙ্গাকুটির ছাড়িয়ে একটু গেলেই আব্দালপুর, নোয়াখালি বলে একটা জায়গা আছে! সেখানে। একদম গঙ্গার পারে।” অতনু জানালো।
“আর ভোলাবাবু?” পিকু জিজ্ঞাসা করল।
“ভোলাদার সম্বন্ধে খুব একটা বিশেষ কিছু জানা নেই। মাসখানেক আগে মা বলেছিল ওঁর এক দূর সম্পর্কের বোনের ছেলে। একটু মানসিক ভারসাম্যহীন। সেই বোন মারা যাওয়াতে ভোলাদার কেউ নেই তাই মা ওকে এখানে এনে রাখতে চায়। আমাদের কারুরই কোনও অসুবিধা না থাকায় ভোলাদা মাস ছয়েক হ’ল আমাদের এখানেই আছে। মানসিক ভারসাম্যহীন কখনও মনে হয়নি, তবে ভীষণ অমায়িক মানুষ ছিলেন আর অত্যন্ত কম কথা বলতেন। যেটুকু কথা বলতেন তা শুধুই মার সঙ্গে। তবে হ্যাঁ, সকালবেলা নটা নাগাদ পায়জামা পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে যেতেন, ফিরতেন সন্ধ্যাবেলা। কোথায় যেতেন জানা নেই।
কি যে হল! এখনও পুরো ব্যাপারটা আমাদের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। কেন যে ওরা এমন করল! দেখুন আমাদের পারিবারিক এত সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও আমাদের পরিবারে কোনও বিরোধ নেই। ছোটবেলা থেকেই মা আমাদের শিখিয়েছিলেন যা থাকবে তা সমান দুভাগে ভাগ করে উপভোগ করতে।” অতনু থামল।
“ভোলাবাবুর বাড়ি কোথায় ছিল, মানে এখানে আসার আগে উনি কোথায় থাকতেন? এসব কিছু বলতে পারবেন?” পিকু জিজ্ঞাসা করল।
“না! তা তো বলতে পারব না! আসলে মা’র ঘনিষ্ঠ তাই আমরা আর কখনও কিছু জানার চেষ্টা করিনি।” অতনু বলল।
“আচ্ছা ভোলাবাবুর কোনও মোবাইল আছে?” পিকু প্রশ্ন করল।
“নাহ, ভোলাদার কোনও মোবাইল ফোন ছিল না। কদিন আগে দুদিনের জন্যে কোথাও গেছিল, পরশু রাত্রে ফিরে আসে।” অতনু বলল।

কৌশিক জিজ্ঞাসা করল “আপনাদের আর কারুর কিছু বলার আছে!” কেউ আর কিছু না বলাতে পিকুরা বেরিয়ে পড়ল, শুধু পিকু মণ্ডলবাবুর কাছে চেয়ে ভোলাবাবুর ঘর থেকে পাওয়া গীতাটা নিয়ে নিল। মণ্ডলবাবু একবার থানায় এসে চা খেতে রিকোয়েস্ট করলেও ওরা কাটিয়ে দিল।
কৌশিক রাস্তার মোড়ে এসে জিজ্ঞাসা করল “বলো কোথায় খাওয়া যায়? ‘ভজহরি’ না ‘কষে কষা’?”
পিকু আর মেঘনা দুজনেই ভজহরিতেই সাত দিল।
রাস্তার উল্টো ফুটেই স্টার থিয়েটারের নীচে ভজহরি।
আমপোড়া সরবৎ দিয়ে শুরু, পরে ভাত, লুচি, মটন কষা, ছোলার ডাল শেষে আমসত্ত্ব আর খেজুরের চাটনি আর শেষে দরবেশ। সেট মেনু হলেও পরিমাণটা একটু কমই ছিল।
খাওয়া শেষে হাঁটতে হাঁটতে হাতিবাগান মোড়ে এসে কৌশিক পিকুকে পরে ফোন করবে বলে চলে যেতেই মেঘনা পিকুকে খপাৎ করে ধরল। বেচারা পিকু কী আর করে, সবটাই বলল। তবে মেঘনাও প্রমিস করল কাউকে কিছু বলবে না।
সেদিন আর কলেজে না ফিরে পিকুরা মেঘনার বাড়ি গেল। মেঘনার মা, ঠাম্মা আর বৌদি পিকুকে বেশ পছন্দ করে। ঠাম্মা তো পিকু গেলেই পাশে বসে গল্প জুড়ে দেয়। আজ অবশ্য বৌদিও বাড়িতে। সবাই মিলে অনেক গল্প হল। একটু সন্ধে হতেই মুড়ি চানাচুর মাখা, গরম বেগুনি আর চা খাওয়ালো বৌদি। কিছুক্ষণ তাতাইয়ের সাথে গল্প করে পিকু বেড়িয়ে পড়ল।
সামহাউ পিকুর মনটা হরি ঘোষ স্ট্রিটে মিত্র বাড়ির দোতলায় ভোলাবাবুর ঘরে পড়ে আছে। কী স্নিগ্ধ একটা ব্যাপার ঘরটাতে! পিকু কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
কিন্তু কী এমন ঘটল মৃন্ময়ী দেবী আর ভোলাবাবুর মধ্যে যে দুজনকে আত্মহত্যা করতে হল! কীইবা ওদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল যে দুজনে এতটা ঘনিষ্ঠ অবস্থায় বসে ছিল! পিকুর সবকিছু কেমন গুলিয়ে যেতে লাগল। বড্ড স্ট্রেসড ফিস করছে পিকু। ঠিক করল আজ আর মিত্রবাড়ি নিয়ে কিছু ভাববে না। আজ ক্লাবে যাবে। বহুদিন পাড়ার ক্লাবে যাওয়া হয় না। ক্লাবে এসে দ্যাখে ঋতমরা ক্যারামে পার্টনার খুঁজছে। পিকু দাঁড়িয়ে পড়ল। তিনটে গেম খেলে একটু আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরল। মনটা এখন অনেকটাই হাল্কা বোধ হচ্ছে।
সকাল সাড়ে ছ়টায় মেঘনা ম্যাডামের ফোন। ফিসফিস করে বললো “হ্যালো! কিছু বার করতে পারলি?”
“এখন ঘুমাচ্ছি! পরে কথা বলবো।” পিকু ফোনটা রেখে দিলো। আবার ফোন করলো মেঘনা “বলনা প্লিজ! আমার ঘুম হচ্ছে না!”
“আমি কিচ্ছু ভাবিনি, কাল বাড়ি ফিরে ক্যারাম খেলেছি। তুই একটু ভেবে রাখ আমি কলেজে তোর কাছ থেকে জেনে নেবো। এখন রাখি?” পিকু আবার নিশ্চিন্তে ঘুমোতে লাগলো।
বড্ড স্ট্রেসড ফিস করছে পিকু। ঠিক করল আজ আর মিত্রবাড়ি নিয়ে কিছু ভাববে না। আজ ক্লাবে যাবে। বহুদিন পাড়ার ক্লাবে যাওয়া হয় না। ক্লাবে এসে দ্যাখে ঋতমরা ক্যারামে পার্টনার খুঁজছে। পিকু দাঁড়িয়ে পড়ল। তিনটে গেম খেলে একটু আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরল। মনটা এখন অনেকটাই হাল্কা বোধ হচ্ছে।
সকালে উঠে প্রথমেই মেঘনাকে ফোন করল পিকু, ম্যাডামের মুড বোঝার জন্যে। “কী রে কিছু বেরলো?”
“না তো! মাথার মধ্যে সব গোল গোল ঘুরছে, কিছুই বুঝতে পারছি না!” মেঘনা একটু কাঁদো কাঁদো স্বরে জানাল।
“ঠিক আছে, একসঙ্গে কলেজ যাব। তারাতলায় থাকিস।” পিকু বলল।
আজ আর কিছুই এগোল না। পিকু আর মেঘনা একবার সি জির সঙ্গে ডিপার্টমেন্টেই দ্যাখা করে এল। স্যার বলছিলেন কাল স্যারের বাড়ি যেতে, পিকু বলল “স্যার এই সপ্তাহে বাড়িতে একটু কাজ আছে, নেক্সট উইকে যাব।”
কাল মামাদের আসার কথা, তাই মেঘনাকে বলে দিল কাল রাত্রে ফোন করবে।
রাত্রে কৌশিক পিকুকে ফোন করে জানাল পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী এটা সুইসাইড। মৃত্যুর সময় মৃন্ময়ী দেবীর সকাল চারটে তিরিশ নাগাদ আর ভোলাবাবুর তার মিনিট দশেক পরে। পিকু ঠিক এরকমই এক্সপেক্ট করেছিল।
রাত্রে পিকু ভোলাবাবুর গীতাটা ভালো করে উল্টেপাল্টে দেখল। বইটা খুলতেই প্রথম পাতায় সুন্দর হাতের লেখায় বড় করে লেখা–
সূতো বা সূতপুত্রো বা যে বা কো বা ভবাম্যহম।
দৈবায়ত্তং কুলে জন্ম মদায়িত্তং তু পৌরুষম॥
আর এর ঠিক তলায় একটু জায়গা ছেড়ে লেখা –
উপাসিতাস্তে রাধেয় ব্রাহ্মণা বেদপারগাঃ।
তত্ৎবার্থং পরিপৃষ্টাশ্চ নিয়তেনানসূয়যা ॥
ৎবমেব কর্ণ জানাসি বেদবাদান্সনাতনান্ ।
ৎবমেব ধর্মশাস্ত্রেষু সূক্ষ্মেষু পরিনিষ্ঠিতঃ ॥
এছাড়া দুএকটা কাগজের টুকরোতে লেখা কিছু কথা, আর কিছুই নেই।
তাতে লেখা–
সত্য হোক, স্বপ্ন হোক, এসো স্নেহময়ী
তোমার দক্ষিণ হস্ত ললাটে চিবুকে
রাখো ক্ষণকাল।
আবার আরেক পাতায় পেনসিলে লেখা–
প্রশাধি রাজ্যং কৌন্তেয় কুন্তীঞ্চ প্রতিনন্দয়॥
পুরো বইটা নেড়েচেড়ে দেখে পিকুর কিছুই বোধগম্য হ’ল না।

এদিকে আজ সারাটা দিন মেঘনার খুবই খারাপ কাটল। এই প্রথমবার মেঘনা রিয়েলাইজ করল ওর সঙ্গে পিকুর সম্পর্কটা কতটা গভীর। নইলে আজ কেন বারে বারে পিকুর কথা মনে হচ্ছে! কেনই বা মনে হচ্ছে পিকু আজ বাড়িতে মামাদের সঙ্গে সময় না কাটিয়ে ওর সাথে কোথাও যেতে পারত। এইসব ভাবতে ভাবতে মেঘনা এটাও বুঝতে পারল যে ও যা ভাবছে সব রাবিশ, মোস্ট ইরেশনাল চিন্তা ভাবনা। আসলে ও পিকুর ব্যাপারে খুব পসেসিভ হয়ে উঠছে। ওদের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক আছে ঠিকই কিন্তু ও আর পিকু তো দুজনে আলাদা দুটো সত্তা। দে সুড বি অনেস্ট টু ইচ আদার, কিন্তু তার অর্থ এ তো হতে পারে না যে ওরা একে অন্যের মেন্টাল ইনডিভিজুয়ালিটিকে সম্মান করবে না!
রাত্রে পিকুই মেঘনাকে ফোন করে বলল “বুঝলি, কিছু একটা মনে হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। ভাবছি কাল সকালে মিত্র বাড়িতে একবার যাব।
যদি যাই, বলে দেব কখন যাব, তুই তৈরি থাকিস, একসঙ্গে যাব।”
সেইমত পিকু কৌশিককেও জানিয়ে দিল, কাল দুপুরে আড়াইটে নাগাদ মিত্র বাড়িতে যাবে। বাড়ির সবাই যেন উপস্থিত থাকে আর মণ্ডল সাহেবও যেন আসেন।
রবিবার বলে দুপুরে খেয়েদেয়েই বেরোল পিকু আর মেঘনা। ওরা দুজনে ঠিক সওয়া দুটোতে স্টারের সামনে পৌঁছে গেল। মিনিটখানেকের মধ্যে কৌশিকও চলে এল। পিকুরা মিত্র বাড়িতে পৌঁছানোর মধ্যে মণ্ডলবাবুও হাজির।
নীচের ঘরেই বসল ওরা সকলে। পিকু রিকোয়েস্ট করল যদি এই আলোচনায় মিত্র ফ্যামিলির তরফে শুধু অতনু আর সুতনু থাকে! সেইমত বাড়ির বাকিরা দরজা টেনে দিয়ে চলে গেল। পিকু বলল “আমাদের আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, আরও দুজন ভদ্রলোকের আসার কথা আছে। ওঁরা এলেই আমরা আলোচনা শুরু করব। যদিও সবার মনে কৌতূহল বাকি দুজন কারা জানার জন্যে, তবুও কেউ কোনও প্রশ্ন করল না। সবাই চুপ করে বসে রইল। কিছুক্ষণ পরে অতনুর স্ত্রী এসে জানালো “জিতেনবাবু আর সলিল এসেছেন! এই ঘরে নিয়ে আসব কি?”
পিকু বলল “প্লিজ, একটু এই ঘরে নিয়ে আসুন!”
একটু পরে ঘরে ঢুকল খাটো ধুতি আর ফতুয়া পরা এক অশীতিপর বৃদ্ধ, বোঝাই যাচ্ছে সিনিয়র মজুমদার আর প্যান্ট শার্ট পরা বছর পঞ্চাশের আর একজন প্রৌঢ়, বোঝাই যাচ্ছে সলিল। অতনু সবার সঙ্গে সিনিয়র আর জুনিয়ার মজুমদারের আলাপ করিয়ে দিল। পিকু জানালো ও ওঁদের আগেই মিট করেছে। এটা শুনে মেঘনা তো অবাক। জিজ্ঞাসা করল “তুই কবে গেছিলিস রায়চক?”
“এখন চুপ করে বস! পরে বলছি…” পিকু বলল।

পিকু শুরু করল!
“এটা বলা জরুরি যে মৃন্ময়ী দেবী এবং ভোলাবাবুর মৃত্যু একটি হত্যা এবং আত্মহত্যার যুগলবন্দি হলেও তার সঙ্গে এই ঘরে উপস্থিত কেউ যুক্ত নন। হ্যাঁ! তবে পুরো ঘটনাটা বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে এমন কিছু অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ উঠে আসবে যেগুলো কোনওটাই অতনুবাবু বা সুতনুবাবু কারোরই শুনতে ভালো লাগবে না। আর সেই কারণেই আমি বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের এখানে থাকতে মানা করেছি।
প্রথমেই বলি সেদিন এই বাড়িতে এসে মৃন্ময়ী দেবী এবং ভোলাবাবুর মৃতদেহ দেখে আমার কখনোই মনে হয়নি ওটা কোনও ইচ্ছাবিরুদ্ধ কাজ। ওঁদের মুখের মধ্যে একটা প্রশান্তির ভাব দেখে আমার মনে হয়েছে এটা ওঁরা পরস্পর জেনে বুঝে নিজেদের সম্মতিতে করেছেন। তাহলে হত্যা বলছি কেন? আসলে ভোলাবাবু প্রথমে ইঞ্জেকশনটা মৃন্ময়ী দেবীকে দেন আর তারপরে নিজেকে। তাই মৃন্ময়ী দেবীকে ভোলাবাবুই হত্যা করেছেন। এরপর আপনাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, ভোলাবাবু এই বাড়িতে আসার পর থেকেই মৃন্ময়ী দেবী রায়চক যাওয়া বন্ধ করে দেন। তার থেকেই আমার মনে হয় ভোলাবাবুর সঙ্গে রায়চকের কোথাও একটা যোগ থাকলেও থাকতে পারে।”
এর মাঝে কার্তিক এসে চা দিয়ে যায়।
পিকু আবার বলতে শুরু করে!
“পরে ভোলাবাবুর ঘর থেকে পাওয়া গীতাটা আমি ভালো করে দেখতে থাকি। সেখান থেকে আমি দুটো জিনিস উদ্ধার করি।
এক– বইটির প্রথম পাতায় বড় বড় করে লেখা:
সূতো বা সূতপুত্রো বা যে বা কো বা ভবাম্যহম।
দৈবায়ত্তং কুলে জন্ম মদায়িত্তং তু পৌরুষম।
মানে–
আমি সূত অথবা সূতপুত্র, যাই হই না কেন,
আমার জন্ম দৈবের অধীনে হ’লেও কর্ম আমার পৌরুষের॥
অর্থাৎ আমার জাত যাই হোক না কেন, অথবা আমার জন্ম দৈবের কারণে হ’লেও আজ আমি যা, তা আমার নিজের পৌরুষ দিয়েই অর্জিত।
ঠিক এর তলায় একটু জায়গা ছেড়ে লেখা–
উপাসিতাস্তে রাধেয় ব্রাহ্মণা বেদপারগাঃ।
তত্ৎবার্থং পরিপৃষ্টাশ্চ নিয়তেনানসূয়যা ॥
ৎবমেব কর্ণ জানাসি বেদবাদান্সনাতনান্ ।
ৎবমেব ধর্মশাস্ত্রেষু সূক্ষ্মেষু পরিনিষ্ঠিতঃ ॥
প্রশাধি রাজ্যং কৌন্তেয় কুন্তীঞ্চ প্রতিনন্দয়!
এখানে শ্রীকৃষ্ণ বলছে–
“হে রাধেয়, তুমি তো মহান শাস্ত্রজ্ঞানী, তুমি ব্রাহ্মণত্ব সম্পর্কে সব জানো।
তুমি রাজা হও, নিজের রাজ্যপাট সামলাও আর তৃপ্ত কর জননী কুন্তীর পুত্রস্নেহাতুর হৃদয়খানি।”
মোদ্দাকথা, অনেক হয়েছে ভাই, সুখে থাকো, যুদ্ধটুদ্ধ করতে এস না।
এরপর আপনাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, ভোলাবাবু এই বাড়িতে আসার পর থেকেই মৃন্ময়ী দেবী রায়চক যাওয়া বন্ধ করে দেন। তার থেকেই আমার মনে হয় ভোলাবাবুর সঙ্গে রায়চকের কোথাও একটা যোগ থাকলেও থাকতে পারে।
এতটা শুনে মেঘনা খুব অবাক হয়ে বলে উঠল “পিকু! তুই সংস্কৃতও জানিস?”
“না! আমারও একজন সিধু জ্যাঠা আছে! আমার ছোটপিসির শ্বশুরমশাই। উনিই মানে বলে দিয়েছেন।” পিকু জানাল।
পিকু বলতে থাকে-
“এইসব পড়ে মৃন্ময়ী দেবী আর ভোলাবাবুর সম্পর্ক সম্বন্ধে আমার মনে সন্দেহ জাগে। ভোলাবাবুর বইটি যদিও গীতা কিন্তু পরতে পরতে শুধু কর্ণের কথা লিখে রেখেছেন।
বুঝতেই পারছিলাম ভোলাবাবুর সম্পর্কে বিশদে জানাটা ভীষণ দরকার। কিন্তু এটা বুঝতে পারছিলাম না, ভোলাবাবুর খবর কার থেকে পাব। হঠাৎ মনে হল রায়চকে গিয়ে জিতেনবাবুর সঙ্গে কথা বললে হয়তো মৃন্ময়ীদেবীর ব্যাপারে আর একটু কিছু জানা যেতে পারে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। পৌঁছে গেলাম রায়চক।
বুঝতে পারি রায়চকে গেলে এর অনেকটাই হয়তো উদ্ধার করা যাবে।
আপনাদের কথামত কাল রায়চক গিয়ে মজুমদারবাবুদের খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধা হয় না।
মজুমদারদাদু আর মজুমদারবাবু দুজনের সঙ্গেই কথা হয়।
দাদু! আমি কিছু ভুল বললে শুধরে দেবেন।” পিকু বলে। বৃদ্ধ মজুমদার হাত নেড়ে সম্মতি জানায়।
পিকু বলতে থাকে, “ভোলাবাবুর বই-এর চিরকুটে লেখা শ্লোক আর প্রথম থেকেই আমার মনে যে সন্দেহটা ছিল সেটাই সত্যি বেরোয়! অর্থাৎ ভোলাবাবু মৃন্ময়ী দেবীর সন্তান!” চারিদিক নিস্তব্ধতায় ভরে গেল। শুধু অতনু বলে উঠল “সত্যি?”
মজুমদার দাদু বললেন “হ্যাঁ!”
পিকু বলতে থাকল।
“মৃন্ময়ী দেবীর যখন বছর সতেরো বয়স তখন পরিবারেরই কোনও এক লোভী বয়স্ক পুরুষের নজরে পড়ে গর্ভবতী হয়ে পড়েন। ঘটনাটা বুঝতে একটু দেরি হয়ে যাওয়াতে রায়বাহাদুর শশধর মিত্র মেয়েকে রায়চকে মজুমদারদাদুর তত্ত্বাবধানে রেখে আসেন। সঠিক সময়ে মৃন্ময়ী দেবী পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। রায়চকে মিত্রবাবুদের গ্রামে ছিল নিঃসন্তান চাষি দম্পতি মদন আর রাধা। তাদের এই বাচ্চাটিকে মানুষ করার দায়িত্ব দিতে তারা খুশি মনে মেনে নেয়। এর জন্যে মদনরা মোটা মাসোহারাও পেতে থাকে।
এদিকে মৃন্ময়ী দেবীর পড়াশোনার শেষে ঠিকঠাকভাবে বিয়ে-থা হয়ে যায়। অতনুবাবু এবং সুতনুবাবুর জন্ম হয়। মৃন্ময়ী দেবীও সুখে সংসারের কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। অন্যদিকে ভোলাও বড় হতে থাকে, স্কুলে যেতে শুরু করে।
শশধর মিত্র একটা কাজ করেছিলেন, মৃন্ময়ী দেবীর রায়চক যাওয়া একদম বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
সবকিছুই প্ল্যানমাফিক চলছিল। সব বদলে গেল শশধর মিত্রের মৃত্যুর পর। প্রথম প্রথম সবটা মজুমদারদাদু দেখাশোনা করলেও ওঁর বয়েস হওয়াতে সমস্যা তৈরি হয়। ওঁর ছেলে অনভিজ্ঞ ছিলেন, তাই মৃন্ময়ী দেবীকে মাঝেমধ্যেই রায়চক যেতে হত। যদিও ভোলাকে তিনি অনেকবারই দেখেছিলেন, কিন্তু জানতেন না ওই তাঁর হতভাগ্য সন্তান। শশধর মিত্রের মৃত্যুর পর যা কিছু বুদ্ধি-পরামর্শ মৃন্ময়ী দেবী মজুমদারদাদুর সঙ্গেই করতেন। বছর তিনেক আগে রায়চকে গিয়ে একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে মৃন্ময়ী দেবী মজুমদারদাদুর কাছে একটা উইল করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সাথে এও বলেন যে, ওঁর ইচ্ছা উনি নিজের প্রথম সন্তানের জন্যেও কিছু রেখে যান, যদিও উনি জানেন না সেই হতভাগ্য ছেলে কোথায় কী অবস্থায় আছে।
মনের ভার হালকা করতে পরদিন সকালে মজুমদারদাদু মৃন্ময়ী দেবীকে ভোলাবাবুর সম্পর্কে সবকিছু খুলে বলেন। এসব শুনে মৃন্ময়ী দেবী অস্থির অস্থির বোধ করতে থাকেন, ভোলাবাবুর সঙ্গে দেখা করেন আর ওঁকে রাজিও করান যাতে ভোলাবাবু কলকাতায় এসে মৃন্ময়ী দেবীর সাথেই থাকেন। উইলে ভোলাবাবুর নাম রাখা নিয়ে মৃন্ময়ী দেবীর সঙ্গে ভোলাবাবুর মতান্তরও হয়। ভোলাবাবুর বক্তব্য ছিল এতবছর যখন মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে চাষার ঘরেই জীবন কাটিয়েছেন তখন এই বয়েসে এসে সম্পত্তি পেলে চূড়ান্ত অপমানিত বোধ করবেন। বাকি জীবনটা উনি এখানেই থাকতে চান আর মাতৃস্নেহ উপভোগ করতে চান। এইসব কথা ভোলাবাবু মারা যাওয়ার দিন দুয়েক আগে মজুমদারদাদুকে বলে এসেছিলেন যাতে উনি মৃন্ময়ী দেবীকে একটু বুঝিয়ে বলেন।
এই হচ্ছে সম্পূর্ণ ঘটনা। তবে কৃষ্ণের কর্ণ সম্পর্কে উদ্ধৃতি, কর্ণ কুন্তী সংবাদের তিনটি লাইন আর মৃত্যুর পর দুজনের পশ্চার আর মুখে পরম শান্তির ছাপ দেখে আমার মনে হয়েছে , মৃন্ময়ী দেবীও যেমন আর সন্তানহারা হতে চাননি ঠিক তেমনই ভোলাবাবুও মা’কে হারাতে চাননি! তাই এই পরিণতি বেছে নিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, চাষির ঘরে বড় হয়ে উঠলেও জিতেন মজুমদারের তত্ত্বাবধানে ভোলা উচ্চশিক্ষিত হয়েছিলেন। বাংলা নিয়ে পড়াশুনো করে এম এ পাশ ক’রে পিএইচডি সম্পূর্ণ করে বেশ কিছু বছর যাবৎ রায়দিঘি কলেজে অধ্যাপনা করছিলেন।”
সব শুনে অতনু শুধু বলল “ভাই অসীম বুদ্ধি তোমার, আর এই রহস্য উদঘাটন করে তুমি আমাদের মনের ভার যে কতটা লাঘব করলে তা বলার নয়!”
কেউ আর কোনও শব্দ করল না, শুধু মণ্ডলবাবু পিকুর দিকে বড় বড় চোখ করে চেয়ে থেকে বলে উঠলেন “কী যেন বেশ নাম সাহেবটার! শার্লকসস্ হোমসস্।”
বেরোনোর আগে পিকু অতনুকে বলল “আমি কখনও কোনও পারিশ্রমিক চাই না, কিন্তু আজ চাইব।” অতনু বলে উঠলেন “নিশ্চয়ই! বল না!”
পিকু উত্তর দিল “আমরা কয়েকজন বন্ধু আপনাদের রায়চকের বাড়িতে একটা উইকএন্ডে গিয়ে থাকতে চাই।”
“অবশ্যই! মজুমদার কাকা! দেখো ওদের যেন কোনও অসুবিধা না হয়।” অতনু সম্মতি জানালো।
অলঙ্করণ: পারমিতা দাশগুপ্ত
পড়াশোনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিয়ো ফিজিক্স বিভাগে। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তথ্য প্রযুক্তিকে। প্রায় এগারো বছর নানা বহুজাতিক সংস্থার সাথে যুক্ত থাকার পর উনিশশো সাতানব্বইতে তৈরি করেন নিজের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। বর্তমানেও যুক্ত রয়েছেন সেই সংস্থার পরিচালনার দায়িত্বে। কাজের জগতের ব্যস্ততার ফাঁকে ভালবাসেন গান-বাজনা শুনতে এবং নানা বিষয়ে পড়াশোনা করতে। সুযোগ পেলেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়েন আর সেই অভিজ্ঞতা ধরে রাখেন ক্যামেরায়।
2 Responses
ডিটেকটিভ গল্প হিসাবে খুব কাঁচা লেখা। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তে নাকি মিনিট ধরে মৃত্যুর সময় লেখা। ওনারা কি মরার আগে একটা করে চালু ঘড়ি গিলেছিলেন
খুব ভাল লাগল ।